শুক্রবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

আমার প্রথম প্রেম

শেখ আতাউর রহমান

আমার প্রথম প্রেম

স্যার, এই লেখাটির নাম দিয়েছি ‘আমার প্রথম প্রেম’। আপনি বেঁচে থাকলে হয়তো চমকে উঠতেন, নয়তোবা আপনার দু’ঠোঁটের ফাঁকে ভেসে উঠত এক চিলতে হাসি (যে হাসি আপনার ছবিতে অহরহ প্রত্যক্ষ করি)। ভাবতেন মানুষটা বলে কি? হ্যাঁ স্যার, আমি ভুল করিনি, বুকে হাত রেখে বলি, আপনিই আমার প্রথম প্রেম- আমার প্রথম স্বপ্নের পুরুষ। কেন? বলি সে কথা। তবে গুছিয়ে কি বলতে পারব? আপনার মতো প্রতিভা আমার কোথায়? আবেগগুলো যে একসঙ্গে মাথার মধ্যে জট পাকিয়ে যাচ্ছে, সব একসঙ্গে একটা অবরুদ্ধ অগ্নিগিরির মতো উছলে পড়ছে।

স্যার, এই প্রেমের শুরু ১৯৬৩ সালে, তখন ময়মনসিংহ শহরে আনন্দমোহন কলেজে অনার্স পড়ি। কানে এলো একটা সুন্দর বই এসেছে বাজারে। ছুটে যাই আমার সেই অতি পরিচিত বইয়ের দোকানে, করতলে হীরকের মতো ঝলকে ওঠে ‘কালের পুতুল’। বিস্ময়ে আনন্দে ছলকে উঠে দুচোখ। একটি সামান্য বই দেখতে এত সুন্দর হতে পারে? স্যার, বাংলাদেশে একটা প্রবাদ আছে, ‘আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী’। ‘কালের পুতুল’- হ্যাঁ, সে আমার প্রথম প্রেম/যামিনী রায়ের আঁকা কমলারঙ প্রচ্ছদ, পেছনের মলাটেও তার বিস্তৃতি-ছটি পুতুল ছন্দোবদ্ধ তালে এগিয়ে চলেছে। প্রথম দৃষ্টিতেই এ ছবি আমার হৃদয় হরণ করে নেয়। তারপর ঘরে এসে যখন পাতা উল্টাই, একের পর এক লেখাগুলো পড়ি, আমি মুহুর্মুহু রোমাঞ্চিত হই। ভাবি বাংলা ভাষায় এত সুন্দর করে লেখা সম্ভব? সেই প্রথম আপনি আমাকে চিনিয়ে দিলেন জীবনানন্দ দাশকে, চিনিয়ে দিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে, অজিত দত্তকে, সমর সেনকে- এমনকি নজরুলকেও। আপনার কনফিডেন্স আজো আমাকে ক্ষণে ক্ষণে বিস্মিত করে। মনে পড়ে সে বইয়ে জীবনানন্দ দাশকে আপনিই প্রথম ‘নির্জন’ কবি বলে চিহ্নিত করেছিলেন এবং বলেছিলেন এর পরে আর কেউ যখন এ কবিকে ‘নির্জন’ বলবে তখন তাকে ইনভারটেড কোটেশন ব্যবহার করতে হবে। আর একথা কেমন করে ভুলি যে নজরুলকে আপনি মাত্র একটি বাক্যে মূল্যায়ন করেছিলেন : অপরিসীম আবেগ একই সঙ্গে নজরুলের কবিতার প্রধান গুণ ও প্রধান দোষ। নজরুল সম্পর্কে আপনার এ ঐতিহাসিক মূল্যায়ন আজো আমার মনে গাঁথা হয়ে আছে। এরপর সেই বিখ্যাত আলোচনাটি চোখে পড়ে ‘লেখার ইস্কুল’। আপনিই তো আমাকে শেখালেন কেমন করে লিখতে হয়, কেমন করে লেখা শুরু করতে হয়। বললেন, লিখে দু’দিন ফেলে রাখ। তারপর আবার তার কাটছাঁট কর। তারপর বন্ধুদের পড়তে দাও এবং সেই বন্ধুকে যে সাহিত্যের একজন উৎসাহী পাঠক। কিন্তু খবরদার, ওই বন্ধুকে পড়তে দেবে না যে কিনা নিজে লেখে। কেননা যে বন্ধু লেখে সে মনে করে বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাটি সেই-ই লিখছে। অতএব তোমার সঠিক মূল্যায়ন হবে না, সেতো তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী। তুমি ভালো লিখলে তার মুখ চুপসে যাবে, তোমাকে ঈর্ষা করবে। স্যার, শিক্ষকের মতো আপনি সেদিন তরুণ লিখিয়েদের যে পরামর্শ দিয়েছিলেন আমি আজো তা সঠিক বলে মানি।

এরপর পড়ি ‘রবীন্দ্রনাথ : কথাসাহিত্য’। বাংলাদেশে বোধকরি আপনিই সেই অনন্য পুরুষ যিনি বিনা দ্বিধায় বলতে পারেন ‘চোখের বালি’ আমার ভালো লাগেনি। তারপর ‘কবি রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে কি অসীম সাহসের সঙ্গে আপনি উচ্চারণ করেছেন নুড যে, রবীন্দ্রনাথ ‘অকারণ’ শব্দটি যত্রতত্র অকারণে ব্যবহার করেছেন। আবার ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ গানটিতে যে কোনো অন্ত্যমিল নেই তা সবার আগে আপনার চোখেই ধরা পড়েছে।

ময়মনসিংহ ইউসিস লাইব্রেরিতে ‘আটলান্টিক’ ম্যাগাজিনটা নিয়মিত আসত, আমি তার নির্বোধ পাঠক ছিলাম। সেখানে প্রথম অ্যালেন গিন্সবার্গের কবিতা পড়ি, সেই বিখ্যাত ‘হাওল’ কবিতাটি- ‘আই হ্যাভ সিন মেনি মাইন্ডস্ ডেস্ট্রয়েড বাই দ্য ডায়নামিক সিভিলাইজেশন, আমেরিকা, গো ব্যাক, ফাক্ ইওরসেল্ফ উইথ ইওর অ্যাটোমবোম্ব।’ তখন থেকেই এ পঙক্তিগুলো আমার মনে গেঁথে আছে। আমার কেবলই জানতে ইচ্ছা করত এ বীট কবিরা কেমন জীবনযাপন করে। অ্যালেন গিন্সবার্গ, লরেন্স ফার্লিংহেট্টি, জ্যাক কেরুয়াক- এঁরা? আমার এ কৌত‚হল প্রথম আপনিই মেটালেন, সোজা কথা বীট কবিদের সঙ্গে আমার মেলবন্ধন ঘটিয়ে দিলেন আপনি। গ্রিনিজ ভিলেজে আপনার মাতাল-ভ্রমণের কথা পড়েছি। বলেছেন, যে বই আপনি সারা পৃথিবীর কোথাও খুঁজে পাননি, দেখলেন গ্রিনিজ ভিলেজে তা ফুটপাতে স্ত‚প হয়ে আছে, বিকোচ্ছে মাত্র এক ডলারে, আপনি দুরুদুরু বক্ষে সেই অমূল্য ধন তুলে নিয়েছেন হাতে, তারপর বইয়ের পাহাড় বস্তাবন্দী করে ঘরে তুলে এনেছেন, এ এক অপার্থিব আনন্দ!

তারপর আপনার সেই চমকপ্রদ অভিজ্ঞতার কথা জেনেছি- আমেরিকার এক নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের চলতি ক্লাস দেখার অভিজ্ঞতা। পড়ানো হচ্ছে ‘হ্যামলেট’। আপনাকে চমৎকৃত করল যে দৃশ্য তাহলো টিচার ক্লাসে ঢুকে প্রথমেই এক ছাত্রের কাছ থেকে সিগারেট চেয়ে নিয়ে টানতে শুরু করলেন, তারপর বললেন ছাত্র-ছাত্রীকে হ্যামলেট সম্পর্কে যে যতটুকু জান বল। বলল সবই। পরিশেষে টিচার একটি কনক্লুশন টানলেন। ব্যস, ক্লাস শেষ। ছাত্রের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে টিচারের ক্লাস নেওয়া সেদিন আপনাকে বড়ই আনন্দ দিয়েছিল। ‘তিথিডোর’ উপন্যাসটি আমি একটু বিলম্বে পড়ি। তখন আমার বয়স ২১ কি ২২। সেই পাঁচ বোনের ছোট বোন স্মাতি উপন্যাসের নায়িকা, তাৎক্ষণিক আমি তার প্রেমে পড়ে যাই। ঢাকার পুরানা পল্টন আমার কাছে রাজকন্যার দেশ হয়ে ওঠে। স্যার, এটা কি আপনার আত্মজৈবনিক রচনা? স্মাতিই কি রানু? অর্থাৎ প্রতিভা বসু? আপনি যতই না না করুন স্যার একথা বিশ্বাস করে আমি যারপরনাই আনন্দ পাই।

‘মেঘদূত’ এর অনুবাদ- বোঁদলেয়ারের অনুবাদ করার অধিকার এ-দেশে তো শুধু একজনেরই আছে, তিনি আপনি/আপনি বলেছেন, ‘কবিতার অনুবাদ মূলানুগত নতুন সৃষ্টি’ শেকসপিয়রের অনুবাদ করার অধিকার যেমন বরিস পাস্তেরনাকের আছে, তেমনি একমাত্র আপনিই পারেন বরিস পাস্তেরনাককে বাংলায় ভাষান্তর করতে, নতুন করে সৃষ্টি করতে, যা পাঠ করে আমরা অপার আনন্দ লাভ করি। আমি ‘ডক্টর ঝিভাগো’র কথা বলছি। এবার আপনার সেই কবিতার কথা- ‘একখানি হাত’। রোমান্টিকতার এত বড় দৃষ্টান্ত আর কি হতে পারে বলুন। ওই সময়ে কতদিন আমি অচেনা কোনো যুবতীর হাতের দিকে নির্বোধের মতো চেয়ে থেকেছি! সে এক বিব্রতকর অবস্থা! স্যার, আপনি এখন ঘুমিয়ে আছেন। প্রগাঢ় ঘুম এখন আপনার দুচোখে। এ ঘুম ভাঙবে না আর। তবে কি আমি আপনাকে বিরক্ত করছি, কষ্ট দিচ্ছি? ঘুমিয়ে থাকুন স্যার চিরদিন আমার হৃদয়ের মণিকোঠায়, সহস্র বাঙালির অন্তরে। কেননা আপনি যে বাঙালিকে ‘আরবান’ করতে চেয়েছিলেন, বিশ্বের সঙ্গে বাঙালির মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছিলেন, খুলে দিয়েছিলেন বসন্তবাতাসের দখিনা দুয়ার।

এবারে শেষ কথা। এ অধমের পেশা পড়ানো। এ প্রসঙ্গে আরেকজন শিক্ষকের কথা না বলে পারছি না। তার নাম মোহাম্মদ নজিবর রহমান (১৮৭৮-১৯২৩)। আপনি চিনবেন না স্যার। তিনি ‘আনোয়ারা’ উপন্যাসের লেখক। এদেশে একসময় খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল বইটি। কারণ অসূর্যস্পর্শা মুসলিম নারীর এই প্রথম দ্রোহী আÍপ্রকাশ। পর্দার অন্তরালে থেকেও আপন বুদ্ধিমত্তায় সে নিরপরাধ স্বামী নুরুল ইসলামকে কারাগার থেকে মুক্ত করে আনে। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৪ সালে। লেখক নজিবর রহমান ছিলেন রাজশাহী সরকারি মাদ্রাসার শিক্ষক, বাড়ি পাবনার শাহজাদপুরে। কিন্তু উপন্যাসটি লেখার পর (১৯১১) লেখক কোনোক্রমেই বইটি প্রকাশ করতে পারছিলেন না অর্থাভাবে। শেষ পর্যন্ত মাদ্রাসার ছাত্ররা চাঁদা তুলে স্থানীয়ভাবে বইটি প্রকাশ করে। এরপর ঢাকার ‘ওসমানি বুক ডিপো’ দ্বিতীয় প্রকাশ করে বইটি (১৯১৪)। ওসমানী বুক ডিপোর মালিক যদ্দুর মনে পড়ছে ভদ্রলোকের নাম ওসমান গনি। তিনি এক স্মৃতিকথায় এই ‘আনোয়ারা’ উপন্যাসটির অভ‚তপূর্ব জনপ্রিয়তার এক মনোজ্ঞ ভাষণ দিয়েছিলেন। সে সময় পূর্ব বাংলার প্রতিটি হাটে নৌকা করে বস্তাভর্তি ‘আনোয়ারা’ উপন্যাসটি পাঠানো হতো এবং গ্রামেগঞ্জে যেকোনো বিয়েতে একপালা ‘আনোয়ারা’ উপহার হিসেবে জমা পড়ত। আজো বাংলাদেশের যেকোনো বইয়ের দোকানে উপন্যাসটি দেখতে পাবেন আপনি। এই অধমের এক মহান শিক্ষাগুরু অধ্যাপক আব্দুল হাই ১৯৫৬ সালে লিখেছেন যে, ১৯৪৯ সালে এ বইটির ত্রয়োবিংশতি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে এবং ‘এ যাবৎ ‘আনোয়ারা’র দেড় লক্ষাধিক কপি নিঃশেষিত হয়েছে।’ যাই হোক এই লেখক পরে ‘গরীবের মেয়ে’ (১৯২৩) নামে আরেকটি উপন্যাস লেখেন। বইটি ‘আনোয়ারার মতো অতটা জনপ্রিয় হয়নি। 

স্যার, নজিবুর রহমান সে যুগে এন্ট্রাস পর্যন্ত পড়েছিলেন। অতি সাধারণ একজন মানুষ, কিন্তু কি অসাধারণ লেখক! এই বই আমাকে এক সময় খুব অবাক করেছিল, কি দারুণ অবজারভেশন তাই না স্যার? আমিও লক্ষ্য করেছি আমার যে ছাত্র বা ছাত্রী পড়াশোনায় মনোযোগী অর্থাৎ বই পড়ে, নিত্য নতুন বই পড়ার চমৎকার অভ্যাস গড়ে তুলেছে দেখি দিন দিন সে কেমন সুন্দর হয়ে উঠছে, পরিশীলিত হয়ে উঠছে তার ব্যবহার-কথাবার্তা। জ্ঞান, আনন্দ আর সৌন্দর্য তো তিন ভাই এবং খুব পাশাপাশি তাদের বাস। আপনিতো জানেন ‘ওল্ডটেস্টামেন্ট’ এ আছে- ফেস্ ইজ দ্য ইনডেক্স অব এ ম্যান’। বইপড়া যে কত বড় মহৌষধ এ কথাতো আপনার কাছ থেকেই প্রথম জেনেছি। অবশ্য আরও পরে টিএস এলিয়টের কাছ থেকেও জেনেছি- ‘ট্রেডিশন ক্যান নট বি ইনহেরিটেড। ইফ্ ইউ ওয়ান্ট ইট ইউ স্যুড অবটেন ইট বাই গ্রেট লেবার।’ অতএব পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই। বইহীন জীবন আনন্দহীন মরুর মতো। এদেশে তরুণ প্রজম্মকে প্রথম বই পড়া শেখালেন তো আপনি।

পরিশেষে বলি, আমি আপনার রেজারেকশন চাই। এই ঘুমকাতুরে বাঙালির দেশে আপনি কি আবার ফিরে আসবেন? আসুন। বলুন কে করবে আমাদের এই অসংখ্য অসুখের চিকিৎসা? বড় সাধ ছিল আপনাকে একবার ছুঁয়ে দেখার। আপনি নেই, আপনার সৃষ্টি আছে, বই আছে। সেই বই যখন ছুঁই আপনার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পাই। আর শুনতে পাই আপনার উদাত্ত কণ্ঠস্বর- আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকবো। বিদায় স্যার, বিদায়। আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর