শুক্রবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই

রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই

রোকনুজ্জামান খান [জন্ম : ৯ এপ্রিল ১৯২৫-মৃত্যু ৩ ডিসেম্বর ১৯৯৯]

রোকনুজ্জামান দাদাভাই (১৯২৫-১৯৯৯) সাংবাদিক, শিশুসংগঠক। তার জন্ম ১৯২৫ সালের ৯ এপ্রিল, রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামে, নানার বাড়িতে। তার নানা রওশন আলী চৌধুরী আবার ছিলেন ‘কোহিনূর’ পত্রিকার সম্পাদক। তার বাবার নাম মৌলভী মোখাইরউদ্দীন খান, মায়ের নাম রাহেলা খাতুন। তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে পাংশায়, নানাবাড়িতে। শৈশবকালে সাহিত্যচর্চা ও সাংবাদিকতায় আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ‘দাদাভাই’ ছদ্মনামে তিনি কবিতা লিখতেন। তিনি ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের কন্যা নূরজাহান বেগমকে বিয়ে করেন। নূরজাহান সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

তার কর্মজীবন শুরু হয় কলকাতায়। ১৯৪৬ সালে ১৬ আগস্ট, কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে গেল। এই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যেই, ‘ইত্তেহাদ’ নামে একটি পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে। পত্রিকাটির শিশুপাতা ‘মিতালী মজলিস’ সম্পাদনার দায়িত্ব ছিল তার। পড়াশোনা শেষে সাংবাদিকতাকে রোকনুজ্জামান খান পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি কাজ করেন ইত্তেহাদ (১৯৪৭), শিশু সওগাত (১৯৪৯) ও দৈনিক মিল্লাত (১৯৫১) পত্রিকায়। তিনি ইত্তেহাদের ‘মিতালী মজলিস’ এবং মিল্লাতের ‘কিশোর দুনিয়া’র শিশুপাতা সম্পাদনা করতেন। ১৯৫৫ সালে তিনি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় যোগদান করে ‘দাদাভাই’ ছদ্মনামে শিশুদের পাতা ‘কচি-কাঁচার আসর’ সম্পাদনা শুরু করেন এবং আমৃত্যুর এ পত্রিকায় জড়িত ছিলেন। আর এ থেকেই তিনি ‘দাদাভাই’ নামে দেশব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠেন।

রোকনুজ্জামান নিজে অনেক কবিতা ও ছড়া লিখেছেন এবং শিশুদের লেখা সংশোধন ও সম্পাদনা করে পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন। শিশুদের চিত্তবৃত্তির উন্মেষ ও প্রতিভার বিকাশে তিনি নিরলস প্রয়াস চালিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন আগামী দিনের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শিশু-কিশোরদের সৃজনশীল বিকাশের বিকল্প নেই। আর সেজন্যই ‘কচি-কাঁচার আসর’ আসরের কার্যক্রম দেশব্যাপী বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। তার সম্পাদিত আমার প্রথম লেখা (১৯৫৭) গ্রন্থে বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক ও লেখকদের সেসব লেখা স্থান পেয়েছে, যেগুলি কচি-কাঁচার পাতায় প্রথম মুদ্রিত হয়। তার প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থ হচ্ছে হাট্টিমাটিম (১৯৬২), খোকন খোকন ডাক পাড়ি, আজব হলেও গুজব নয় প্রভৃতি। তার সম্পাদিত ঝিকিমিকি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিশুসংকলন। এসব রচনার মাধ্যমে তিনি কোমলমতি শিশুদের মনে নীতিজ্ঞান, দেশপ্রেম ও চারিত্রিক গুণাবলি জাগ্রত করার চেষ্টা করেন। তিনি কচি ও কাঁচা (১৯৬৫) নামে একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই ছিলেন স্বপ্ন গড়ার কারিগর। হয়তো এর আগেই কথাটি তার জন্য প্রাপ্য ছিল। আজকের দেশজুড়ে যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বরেণ্য অথবা সম্মানের সাথে কাজ করে যাচ্ছে তাদের পেশায় বিশেষভাবে সাহিত্য ক্ষেত্রে এর একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কোনো না কোনোভাবে সান্নিধ্য পেয়েছেন এই গুণী মানুষটির।

রোকনুজ্জামানের অপর একটি বড় অবদান ‘কচি-কাঁচার মেলা’ (১৯৫৬) নামে একটি শিশুসংগঠন প্রতিষ্ঠা। তার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এর শাখা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকার সেগুনবাগিচায় এর মূল কেন্দ্র অবস্থিত। এখানে শিশুদের গান, আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এছাড়াও তাদের পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার জন্য ‘কাকলী পাঠাগার’ স্থাপিত হয়। লক্ষ্য একই দেহে ও মনে শিশুদের সত্ ও আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। তিনি বাঙালি সংস্কৃতি লালন করতেন বলে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা কচি-কাঁচার মেলার অফিস ভাংচুর করে এবং বইপত্র পুড়িয়ে দিয়েছিল। মৌলিক ছড়ার বই দুটি ‘হাটটিমা টিম’ অন্যটি ‘খোকন খোকন ডাক পাড়ি’। সম্পাদনা গ্রন্থ বেশ কয়েকটি— ‘আমার প্রথম লেখা’, ‘ঝিকিমিকি’, ‘কবি আহসান হাবীব স্মারকগ্রন্থ’, ‘ছোটদের আবৃত্তি’, ‘মাসিক কচি ও কাঁচা’, ‘বার্ষিক কচি ও কাঁচা’, এবং কেন্দ্রীয় কচি কাঁচার মেলার বিভিন্ন পুস্তিকা। এছাড়া তিনি অনেক ছড়া-কবিতা লিখেছেন। লিখেছেন বড়দের গল্পও। তিনি সৃজনশীল ও সাংগঠনিক কর্মের পুরস্কারস্বরূপ বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৮), শিশু একাডেমি পুরস্কার (১৯৯৪), একুশে পদক (১৯৯৮), স্বাধীনতা পদক (১৯৯৯), জসিমউদ্দীন স্বর্ণপদক এবং রোটারি ইন্টারন্যাশনাল ও রোটারি ফাউন্ডেশন ট্রাস্টির পল হ্যারিস ফেলো সম্মানে ভূষিত হন। ১৯৯৯ সালের ৩ ডিসেম্ব্বর, মারা যান সবার প্রিয় দাদাভাই। তাকে পরদিন বিকালে মেলা ভবনের দক্ষিণ পূর্ব কোণে সমাহিত করা হয়।

-সাহিত্য ডেস্ক

সর্বশেষ খবর