শুক্রবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিশ্বভ্রাতৃত্বের বন্ধনে গোথেনবার্গ বইমেলা

মনিরুল হক

বিশ্বভ্রাতৃত্বের বন্ধনে গোথেনবার্গ বইমেলা

সুইডেনের অন্যতম পুরনো শহর গোথেনবার্গ। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান প্রাচীন এ শহরে মোটে সাড়ে পাঁচ লাখ লোকের বসবাস। সবুজ তরুপল্লব ঘেরা প্রকৃতির আলিঙ্গনে পুরো শহর যেন ছবির মতো। সেপ্টেম্বরের শেষে প্রকৃতি ফিরে পায় পূর্ণ যৌবন। লোকজন মেতে উঠে নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক আয়োজনে। তাবৎ বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম বইমেলার আয়োজন হয় গোথেনবার্গে। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের পর এর অবস্থান। ১৯৮৫ সাল থেকে শুরু করে প্রতিবছর আয়োজিত হয়ে আসছে এ মেলা। সাধারণত সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে শুরু হয়, চলে চারদিন। সাতটি মহাদেশ থেকে প্রায় ৮০০ গ্রন্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এ মেলায় অংশ নিয়ে থাকে। বইয়ের স্বত্ব কেনাবেচা ছাড়াও সাহিত্যকর্মের ওপর নানা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। খ্যাতিমান লেখক-প্রকাশকের কর্মব্যস্ত উপস্থিতি মেলাকে অন্য এক মাত্রায় পৌঁছে দেয়। চার দিনব্যাপী এ মেলায় আগমন ঘটে লক্ষাধিক বইপ্রেমী দর্শকের। হঠাৎ সুইডিশ আর্ট কাউন্সিলের ফেলোশিপ পেয়ে চমকে উঠি। এতবড় আয়োজনে বাংলাদেশের একমাত্র আমন্ত্রিত প্রকাশক হিসেবে যোগ দেব, দেশের হয়ে কথা বলব, দেশের প্রকাশনাশিল্পকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরব-শিহরিত না হয়ে উপায় কি?

মেলা কর্তৃপক্ষ ভ্রমণ সংক্রান্ত সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে। মেলার মূল অংশে একটি সেলফ বরাদ্দ রেখেছে অনন্যা প্রকাশনীর জন্য, কাজেই প্রস্তুতি নেওয়ার পালা শুরু। ভিসার ঝুট-ঝামেলা ছাড়াও ভাবতে থাকলাম ফেলোশিপ প্রাপ্তির এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে দেশের প্রকাশনাশিল্পকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপস্থাপন করা যায়। গোথেনবার্গ ল্যান্ডভেটার এয়ারপোর্ট টার্মিনালের দরজা পেরিয়ে হোটেল ২৫ মিনিটের পথ। পড়ন্ত বিকালের সোনালি রোদ্দুর রাঙিয়ে দিয়েছে চারদিক। একেবারে ঝকঝকে তকতকে। ধুলাময়লার চিহ্ন পর্যন্ত নেই। নাম পরিচয় দিতেই হোটেলের রিসিপশন থেকে চাবি আর একগাদা কাগজপত্র ধরিয়ে দিল। চলে এলাম রুমে। দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তিতে গা এলিয়ে দিলাম মখমল পাতা নরম বিছানায়। চোখ জড়িয়ে ঘুম আসছে, কিন্তু না; ফ্রেশ হয়ে বের হতে হবে। মেলার মূল আয়োজন গথিয়া টাওয়ার পায়ে হাঁটার পথ। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে ওয়েলকাম ডিনার।

সন্ধ্যা ৭টার কিছু বেশি। গথিয়া টাওয়ারের হলরুম ভর্তি মানুষ। দুনিয়া কাঁপানো লেখক-লেখিকা আর প্রকাশকদের মিলনমেলা। ছোট ছোট দলে বিভক্ত অতিথিরা নানা গল্প-গুজবে মশগুল। হাস্যরসে মুখরিত পুরো হল। সবার হাতে রং-বেরঙের পানীয়। আমিই একমাত্র বাঙ্গাল মুলুক থেকে আগত গোবেচারা প্রকাশক ঘ্রাণ শুকেই যেন মাতাল হয়ে যাচ্ছি। কি আর করা ওয়াইন গ্লাসে পানি ভর্তি করে অন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাটিয়ে দিলাম ডিনারের পুরো অনুষ্ঠান। যাদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হলো তাদের মধ্যে এগনেস হেলার, লিলিয়ান তুরান, হেনরিক বার্গেন, লাইনি টেলর, পলা হকিন্স, রোসা লিকসম প্রমুখ লেখক-প্রকাশকের সঙ্গে। পরিচয় হলো সুইডিশ আর্ট কাউন্সিলের পরিচালক সুমান বার্গস্টরম লারসনের সঙ্গে। সদা হাস্যময়ী করিৎকর্মা এ মহীয়সী নারী সবার সঙ্গে হাই হ্যালো করছেন, অভিনন্দিত করছেন অতিথিদের।

মেলার আনুষ্ঠানিক শুরু ২৪ সেপ্টেম্বর সকাল নয়টা। গথিয়া টাওয়ার সেজেছে বধূর বেশে। হাজারো বইপ্রেমীর উপস্থিতিতে জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে শুরু হলো চারদিনব্যাপী বইমেলা। উদ্বোধনীর পর যে যার মতো ছড়িয়ে পড়ল যার যার কাজে। আমি ছুটলাম অনন্যার সেলফের দিকে। বিশাল আয়োজন, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নানা অনুষ্ঠান। প্রায় এক লাখ বিশ হাজার বর্গফুট জায়গা জুড়ে এ মেলা। বইয়ের কেনাবেচা ছাড়াও মেলা প্রাঙ্গণে প্রকাশকরা ব্যস্ত অন্য প্রকাশকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে। স্বত্ব কেনাবেচা কিংবা অনুবাদ বিষয়ে সম্ভাবনা নিয়েই আলোচনা বেশি। ওখানকার প্রকাশকদের ব্যবসার ধরন ভিন্ন। ছাপার কাজটা বেশিরভাগ সময়ে ওরা নিজেরা করে না। করিয়ে নেয় ছাপাখানা থেকে। আবার ডিস্ট্রিবিউশনের কাজটাও করে অন্যরা। এক একটি বই ওরা এক লাখ দুই লাখ কপি ছাপিয়ে ফেলে হরহামেশা। অনুবাদের কাজটাও ওরা করে সমান তালে। এদেশে নিজেদের বইয়ের বাইরে ওপার বাংলার কিছু লেখালেখির সঙ্গে আমাদের পাঠকদের সামান্য পরিচয় রয়েছে, কিন্তু পশ্চিমা, চৈনিক, জাপানি, রুশ কিংবা আরব্য সাহিত্যের সঙ্গে অধিকতর পরিচিতি থাকলে আমাদের লেখক-পাঠকদের উপকারই হতো। গোথেনবার্গ বইমেলার আসল উদ্দেশ্য কিন্তু তাই। যা হোক নিজের সেলফের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত সুইডিশ কবি ট্রান্সট্রমারের একটি কবিতার বই এ বছরই অনন্যা থেকে অনুবাদসহ প্রকাশিত হয়েছে। বইটি অনেক যতœ করে অনুবাদ করেছেন কবি মোহাম্মদ সামাদ এবং সুইডেন প্রবাসী লেখক আনিসুর রহমান। এছাড়া সম্বল মোটে আট দশটি ইংরেজি সাহিত্য কিংবা অনুবাদের বই সঙ্গে নিয়ে এসেছি। সাহস করে জনাকয়েক প্রকাশকের সঙ্গে কথাবার্তাও বলেছি। আমাদের দেশের প্রকাশনার অবস্থা জানতে চেয়েছেন অনেকে। যৌথ উদ্যোগে কিছু কাজ করা যায় কিনা সে বিষয়েও কথা হয় অনেকের সঙ্গে।

সন্ধ্যা নামতেই শুরু হয় অন্যরকম আয়োজন। একদিকে কবিতা পাঠের আসর, অন্যদিকে হয়তো সেলি গ্রিনের ‘হাফ ব্যাড’ ট্রিলজি নিয়ে চলছে তুমূল আলোচনা-সমালোচনা। শিশু সাহিত্যবিষয়ক একটি সেমিনারে কিছু বলতে হলো আমাকে। হাইথট ডিসকাশন এভাবেই কেটে গেল চার-চারটি দিন। বিউগলের করুণ সুরে মেলার পর্দা নামে এ বছরের জন্য। আবার আসর জমবে এক বছর পর। ফের হয়তো লেখালেখির জগতের রথীমহারথীরা সামনের সেপ্টেম্বরে গোথেনবার্গের বোর্ডিং পাস হাতে নিয়ে অপেক্ষা করবে এয়ারপোর্টের ওয়েটিং লাউঞ্জে। আবার দেখা হবে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে গথিয়া টাওয়ার চত্বরে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় অবস্থা শোচনীয়। ফেরার পালা। ইস্তাম্বুল হয়ে ঢাকা, হাজারটা ঝক্কি, ট্রাফিক জ্যাম। তারপরও আমার প্রিয় ঢাকা।

সুইডেন প্রবাসী লেখক আনিসুর রহমানের গ্রন্থপ্রেম আমাকে মুগ্ধ করেছে। বইমেলা আয়োজক কমিটিতে তার অনেক ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশের সাহিত্য ও প্রকাশনাকে বৈশ্বিক অঙ্গনে তুলে ধরতে তার নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। তার আতিথেয়তার কথাও আমার মনে থাকবে অনেকদিন।

সর্বশেষ খবর