শুক্রবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

নারীর ক্ষমতায়নে সুলতানার স্বপ্নের অতিক্রমণ

নাছিমা বেগম এনডিসি

নারীর ক্ষমতায়নে সুলতানার স্বপ্নের অতিক্রমণ

প্রতিকৃতি : কাইয়ুম চৌধুরী

নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া আজ থেকে ১১০ বছর আগে ১৯০৫ সালে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামক কল্পকাহিনীটি ‘Sultana’s Dream’ নামে ইংরেজিতে লিখেছিলেন। তিনি তার সময় থেকে অনেক দূরে দেখতে পেতেন বলেই কল্পনার রথে চড়ে এত সুন্দর করে অন্তঃপুরের নারীদের রাজ্যক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার স্বপ্ন বুনতে পেরেছিলেন। কাহিনীটিতে পুরুষরা অন্তঃপুরে ছিলেন বলেই নারীরা বাইরে নিরাপদে কাজ করতে পারতেন। বেগম রোকেয়ার নারীস্থানে দুটি মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল যেখানে মেয়েরাই শুধু পড়াশোনা করত। তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিভিন্ন গবেষণা করে মানুষের জন্য প্রকৃতির ভাণ্ডারে সঞ্চিত অফুরন্ত সম্পদকে কাজে লাগিয়েছিলেন। এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের মধ্যে নতুন নতুন আবিষ্কারের বিষয়ে সুস্থ প্রতিযোগিতাও ছিল। যেমন একটি প্রতিষ্ঠানের মহিলা প্রিন্সিপাল এক অভিনব বেলুন আবিষ্কার করেন। যার সাহায্যে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে রাখতে পারতেন বিধায় আকাশে মেঘ জমে অন্ধকার হতো না। বুদ্ধিমতী এই লেডি প্রিন্সিপাল এ বেলুনের সাহায্যে প্রাকৃতিক ঝড়-বৃষ্টিও নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন, কৃষিকাজে সেচ দিতে পারতেন। এর ফলে অপর বিদ্যাপীঠের প্রিন্সিপালের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব জাগে। তিনিও এমন অসাধারণ কিছু উদ্ভাবন করতে চাইলেন যাতে ওই প্রতিষ্ঠানকে পরাজিত করা যায়। তারা অক্লান্ত চেষ্টায় অল্পকালের মধ্যেই অসাধারণ একটি যন্ত্র আবিষ্কার  করলেন, যার মাধ্যমে সূর্যোত্তাপ সংগ্রহ করে রাখা যেত। তারা এর সাহায্যে প্রচুর পরিমাণে সূর্যের উত্তাপ সংগ্রহ করে রাখার পাশাপাশি এ সূর্যতাপ ইচ্ছামতো যেখানে সেখানে বিতরণ করতে পারতেন। এ সৌরশক্তির মাধ্যমে তারা বিনা রক্তপাতে যুদ্ধে জয়সহ প্রতিবেশী রাজ্যের আক্রমণ থেকেও নিজেদের রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তারা নির্বিঘ্নে রান্নাবান্নার কাজও সারতেন।

আজকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রায় তিন দশক যাবৎ নারী নেতৃত্ব রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং মন্ত্রিপরিষদের সদস্যসহ ৭০ জন নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন। এছাড়া সিটি করপোরেশনের মেয়র থেকে শুরু করে জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ সর্বত্রই নারী জনপ্রতিনিধির নেতৃত্ব বিরাজমান। বর্তমানে নারীরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখায়ই শিক্ষালাভের পাশাপাশি বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং পেশায় নিয়োজিত  থেকে সাফল্য অর্জন করছেন। একদিকে যেমন বিচার বিভাগে সুপ্রিমকোর্টের অ্যাপিলেট বিভাগে নারী বিচারপতি কর্মরত রয়েছেন, তেমনি নির্বাহী বিভাগে সরকারের সচিব, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের উপাচার্যসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর, বিভিন্ন সংস্থাপ্রধান, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ পেশাসহ সব ধরনের চাকরিতে নারী আজ অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০০ সালে প্রথম সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীতে নারী কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছেন। সেই থেকে নারী সামরিক কর্মকর্তারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শন করছেন। এমনকি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও তিন বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ে নারী সদস্য নিয়োজিত থেকে বিদেশের মাটিতে গৌরবোজ্জ্বল অবদান রাখছেন। বর্তমানে রাজনীতিতে এবং বিভিন্ন পেশায় নারীর প্রবেশের ফলে রাষ্ট্র পরিচালনা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়ার ভাবনার অতিক্রমণ ঘটেছে।

বেগম রোকেয়া উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখতেন বলেই তার চেষ্টা ছিল মেয়েদের সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া। তার লেখনীতে তিনি অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে মেয়েদের মাথা উঁচু করে চলার জন্য স্বপ্ন দেখাতে চেয়েছেন। তিনি মেয়েদের অলঙ্কারগুলোকে দাসত্বের শৃঙ্খল মনে করতেন। তিনি এ প্রসঙ্গে তার প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘মতিচূর’ (প্রথম খণ্ড)-এর বোরকা গল্পে লিখেছেন, ‘এখন ভ্রাতাদের সমীপে নিবেদন এই- তাহারা যে টাকার শ্রাদ্ধ করিয়া কন্যাকে জড় স্বর্ণ-মুক্তার অলঙ্কারে সজ্জিত করেন, ঐ টাকা দ্বারা তাহাদিগকে জ্ঞান-ভূষণে অলঙ্কৃতা করিতে চেষ্টা করিবেন। একখানা জ্ঞানগর্ভ পুস্তক পাঠে যে অনির্বচনীয় সুখ লাভ হয়, দশখানা অলংকার পরিলে তাহার শতাংশের একাংশ সুখও পাওয়া যায় না। অতএব শরীর শোভন অলংকার ছাড়িয়া জ্ঞান-ভূষণ লাভের জন্য ললনাদের আগ্রহ বৃদ্ধি হওয়া বাঞ্ছনীয়।’

তিনি এই গল্পে অলঙ্কারের টাকা দ্বারা মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন এবং দৃপ্তকণ্ঠে বলেছেন, ‘পর্দা শিক্ষার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়নি’। ‘শিক্ষার অভাবে আমরা স্বাধীনতা লাভের অনুপযুক্ত হইয়াছি। অযোগ্য হইয়াছি বলিয়া স্বাধীনতা হারাইয়াছি।’ শিক্ষয়িত্রীর অভাব পূরণ এবং স্বতন্ত্র স্কুল কলেজ স্থাপিত হলে যথাবিধি পর্দা রক্ষা করেও উচ্চশিক্ষা লাভ হতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। বেগম রোকেয়া তার ‘বোরকা’ গল্পেই দেখাতে চেয়েছেন পুরুষরাও মেয়েদের শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে শুরু করেছেন। ‘অদূরদর্শী পুরুষেরা ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষার জন্য এতদিন আমাদিগকে শিক্ষা হইতে বঞ্চিত রাখিতেন। এখন দূরদর্শী ভ্রাতাগণ বুঝিতে পারিয়াছেন যে, ইহাতে তাহাদের ক্ষতি ও অবনতি হইতেছে। তাই তাহারা জাগিয়া উঠিতে ও উঠাইতে ব্যস্ত হইয়াছেন।’

বেগম রোকেয়া নারী শিক্ষার প্রসার এবং সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণসহ বাল্যবিবাহ বন্ধের যে স্বপ্ন দেখেছেন তা তিনি ‘সুলতানার স্বপ্ন’ গল্পে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘মহারাণী বাল্যকাল হইতেই বিজ্ঞান চর্চ্চা করিতে ভালবাসিতেন। সাধারণ রাজকন্যাদের ন্যায় তিনি বৃথা সময় যাপন করিতেন না। একদিন তাহার খেয়াল হইল যে, তাহার রাজ্যের সমুদয় স্ত্রীলোকই সুশিক্ষা প্রাপ্ত হউক। মহারাণীর খেয়াল, সে খেয়াল তত্ক্ষণাৎ কার্য্যে পরিণত হইল। অচিরে গভর্নমেন্ট পক্ষ হইতে অসংখ্য বালিকা স্কুল স্থাপিত হইল। এমনকি পল্লীগ্রামেও উচ্চশিক্ষার অমিয়-স্রোত প্রবাহিত হইল। শিক্ষার বিমল জ্যোতিতে কুসংস্কাররূপ অন্ধকার তিরোহিত হইতে লাগিল এবং বাল্যবিবাহ প্রথাও রহিত হইল। একুশ বছর বয়ঃক্রমের পূর্বে কোন কন্যার বিবাহ হইতে পারিবে না-এই আইন হইল।’

বাংলাদেশে নারী শিক্ষার প্রসারে বিপ্লব ঘটেছে। প্রাথমিক শিক্ষায় ৫০.৭ ভাগ ও মাধ্যমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে ৫৩.৬ ভাগ নারী দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত। চিকিৎসা, প্রকৌশল, আইন, সাংবাদিকতা প্রভৃতি পেশায় নারীর অংশগ্রহণ ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেলেও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এখনো নারীদের শিক্ষার হারে বড় রকমের পার্থক্য রয়ে গেছে। আর এর অন্যতম কারণ বাল্যবিবাহ বলে প্রতীয়মান হয়। এক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ বন্ধ এবং নারীর কর্মসংস্থানের সহায়ক পরিবেশ তৈরিসহ কর্মস্থানের সুযোগ আরও বৃদ্ধি করতে পারলে অচিরেই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষ সমতা লাভ করবে। 

এখানে উল্লেখ করা যায় যে, আজ থেকে শত বছর আগে বেগম রোকেয়া যদি ২১ বছর বয়সের আগে কোনো কন্যার বিয়ে যাতে না হয় সে জন্য আইন প্রণয়নের স্বপ্ন দেখতে পারেন, তবে আজকের বাংলাদেশে আমরা নিশ্চয়ই বাল্যবিবাহ আইন যুগোপযোগীকরণের মাধ্যমে বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে সমর্থ হব। এ জন্য প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা। গ্রামগঞ্জ, শহর, বন্দরে এর কুফল প্রচার করে বাল্যবিয়ে বন্ধের বিষয়ে ব্যাপক জনমত তৈরিসহ সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে সবাইকে উদ্বুদ্ধকরণে ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা ইতিমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষ করে এ বিষয়ে স্কুল এবং কলেজের মেয়েদের কিশোর-কিশোরী ক্লাবে সম্পৃক্ত করে বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে অ্যাডভোকেট হিসেবে কাজ করার জন্য তৈরি করা হচ্ছে যাতে তারা নিজেরাই ১৮ বছরের আগে বিয়ে করবে না বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়।

বেগম রোকেয়া নারী জাতির জাগরণ ঘটানোর জন্য তার ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ গল্পে বিশ্বব্যাপী নারীদের অধঃপতনের কারণ কী তা অনুসন্ধান করতে চেয়েছেন, পাশাপাশি এর হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় খুঁজেছেন। তিনি দেখেছেন— ‘সম্ভবতঃ সুযোগের অভাব ইহার প্রধান কারণ। স্ত্রীজাতি সুবিধা না পাইয়া সংসারের সব প্রকার কার্য্য হইতে অবসর লইয়াছে এবং ইহাদিগকে অক্ষম ও অকর্ম্মন্য দেখিয়া পুরুষজাতি ইহাদের সাহায্য করিতে আরম্ভ করিল। ক্রমে পুরুষ পক্ষ হইতে যতই বেশী সাহায্য পাওয়া যাইতে লাগিল, স্ত্রী-পক্ষ ততই অধিকতর অকর্ম্মন্য হইতে লাগিল।’ অতঃপর তিনি নারীদের জাগানোর জন্য উল্লেখ করেছেন ‘অতএব জাগ, জাগ গো ভগিনি!’

বেগম রোকেয়া নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের স্বপ্ন পূরণের প্রত্যয় ব্যক্ত করে এ গল্পেই উল্লেখ করেছেন, ‘পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব। যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয়, তবে তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে আমরা লেডীকেরাণী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডীম্যাজিস্ট্রেট, লেডীব্যারিষ্টার, লেডীজজ সবই হইব। পঞ্চাশ বছর পরে লেডী Viceroy হইয়া এ দেশে সমস্ত নারীকে ‘রাণী’ করিয়া ফেলিব! উপার্জন করিব না কেন? আমাদের কি হাত নাই, না পা নাই, না বুদ্ধি নাই? কি নাই? যে পরিশ্রম আমরা ‘স্বামী’র গৃহকার্য্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসায় করিতে পারিব না?’ তিনি উক্ত গল্পে আরও উল্লেখ করেছেন, ‘আমরা যদি রাজকীয় কার্য্যক্ষেত্রে প্রবেশ করিতে না পারি, তবে কৃষিক্ষেত্রে প্রবেশ করিব।’ তিনি ভারতে কন্যার জন্য পাত্রের অভাব হয়েছে বলে কন্যাদায়ে কেঁদে মরার পরিবর্তে অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিত করিয়া কার্য্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্নবস্ত্র উপার্জন করুক।’ তবে কার্যক্ষেত্রে পুরুষের পরিশ্রমের মূল্য বেশি এবং নারীর কাজ সস্তায় বিক্রি হয় সেটিও তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।

আমরা সবাই জানি নারীর ক্ষমতায়নের মূল ভিশন হলো এমন একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে নারী ও পুরুষ সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বত্র সমসুযোগ ও সমঅধিকার লাভ করবে। ১৯৭২ সালে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই নারীর সমঅধিকার ও ক্ষমতায়নের সূচনা করে গেছেন। আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮ এর আলোকে মৌলিক অধিকারসমূহ ভোগের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের জেন্ডার বৈষম্য থাকবে না। নারী-পুরুষ সমানতালে কাজ করবে এবং যাবতীয় কর্মকাণ্ডে পুরুষের পাশাপাশি সমভাবে অংশ নেবে। সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দফতর ও সংস্থায় নারী কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গার্মেন্টশিল্প দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করেছে। তৈরি পোশাকশিল্পের বিকাশে অন্যতম নিয়ামক শক্তির ভূমিকায় রয়েছেন আমাদের নারীরা। এ শিল্পের মোট শ্রমিকের ৮০ শতাংশই নারী, যারা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।

মহিলাবিষয়ক অধিদফতর এবং জাতীয় মহিলা সংস্থার আওতায় কর্মজীবী মহিলাদের জন্য আটটি আবাসিক হোস্টেল ও ৪৪টি ডে-কেয়ার পরিচালিত হচ্ছে এবং প্রতি জেলায় কর্মজীবী নারীদের জন্য আবাসিক হোস্টেল নির্মাণের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এনজিও সেক্টরে নারীদের বিশাল অবদান রয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নারীদের নেতৃত্বে বিভিন্ন এনজিওর মধ্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি, ব্লাস্ট এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান, ব্যবসা সম্পর্কিত তথ্য সহায়তা, উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণ সহায়তা, ঋণ প্রাপ্তিতে সহায়তা এবং স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে নেটওয়ার্ক ও অংশীদারিত্ব উন্নয়নে কাজ করছে। ফলে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন মহিলা সমিতির উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বাজারজাতকরণের সুবিধা সৃষ্টির ক্ষেত্রে ঢাকাস্থ রাপা প্লাজায়  জয়িতা নামক বিপণন কেন্দ্র চালু হয়েছে। এ কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে জয়িতা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে গড়ে উঠা বিভিন্ন নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য, সেবা বিপণন ও বাজারজাতকরণ পর্যায়ক্রমে দেশব্যাপী নারীবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তোলা এবং বিদেশে বাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে। ক্রিকেট, ফুটবল থেকে শুরু করে নানা খেলাধুলায় সরকারের উৎসাহ ও প্রণোদনা নিয়ে নারীরা অংশগ্রহণ করছে এবং কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে। এক কথায় তৃণমূল থেকে হিমালয়ের শিখর পর্যন্ত জয় করেছে বাংলার নারী। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক সব অঙ্গনেই রাষ্ট্র, সরকার এবং সমাজের কাছ থেকে সুযোগ পাওয়া মাত্রই নারীরা এগিয়ে এসেছে এবং এগিয়ে যাবে।

বাংলাদেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী, সেহেতু এ বিপুল জনসংখ্যাকে উন্নয়নের বাইরে রেখে কখনোই দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। উন্নয়নকে স্থায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘নারীর ক্ষমতায়ন : টেকসই উন্নয়ন’ এটিই এখন বাস্তবতা। আর এ লক্ষ্যে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সম্প্রতি জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত টেকসই উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে পঞ্চম লক্ষ্যমাত্রাটি জেন্ডার সমতা অর্জন এবং সব নারী ও বালিকাদের ক্ষমতায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। তবে নারীর ক্ষমতায়নে নারীর আগ্রহ এবং একান্ত চেষ্টা যেমন প্রয়োজন তেমনি পুরুষের সহযোগিতা প্রয়োজন; যেমনটি বেগম রোকেয়ার ক্ষেত্রে ঘটেছে। তার পরিবারে তার লেখা-পড়ার বিষয়ে বাবার কাছ থেকে সাড়া না পেলেও পেয়েছিলেন তার ভাইয়ের কাছে, পেয়েছিলেন স্বামীর কাছে। নারী-পুরুষের সম্মিলিত চেষ্টা এবং প্রয়াসেই নারীর ক্ষমতায়ন।

বেগম রোকেয়া আজ থেকে শত বছর আগে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা আজ বাস্তবতা। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বর্তমান বাংলাদেশে তার অতিক্রমণ ঘটছে। বেগম রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্নের মতো বাংলাদেশের পুরুষরা অন্তঃপুরে না থাকলেও গত ২৫ বছর ধরে নারীদের দ্বারাই বাংলাদেশের শাসনকার্য পরিচালিত হচ্ছে।  প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তের জন্য বাংলাদেশ আজ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে স্থান পেয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪২টি দেশের মধ্যে ১০ম এবং সার্কভুক্ত সব দেশের মধ্যে শীর্ষে। বেগম রোকেয়া আজ থেকে শত বছর আগে তার নারীস্থানে শাসনকার্য পরিচালনায় জ্ঞান-বিজ্ঞানে উর্ত্কষতা অর্জন ও প্রসারণে যে দৃঢ়চেতা নারীশাসকের স্বপ্ন দেখেছিলেন তা বাস্তবে প্রমাণিত হয়েছে।

সর্বশেষ খবর