শুক্রবার, ১১ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

মাইকেল মধুসূদনের ভের্সাই বসবাস

রবিশঙ্কর মৈত্রী

মাইকেল মধুসূদনের ভের্সাই বসবাস

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

২০০৮ সালে প্যারিসে একুশের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল সাংস্কৃতিক সংগঠন কথা। সেবার ফেব্রুয়ারির শেষ দিনে হাজির হয়েছিলাম প্যারিসে। কবি নির্মলেন্দু গুণ এবং কবিকন্যা কবি মৃত্তিকা গুণ আমার আগেই প্যারিসে পৌঁছেছিলেন। সেই আমার প্রথম ফ্রান্স সফর। সে বছর মার্চের প্রথম সপ্তাহে কবি মোহাম্মদ জাকারিয়া রিপন, কবি নূর হাসনাত পলাশ এবং কবি লিটন হায়দারের সঙ্গে গিয়েছিলাম শাতু দ্য ভের্সাই ভ্রমণে। উদ্দেশ্য, মাইকেল মধুসূদনের ভাড়া বাড়ি দর্শন। কিন্তু সে-বার হয়নি। সেদিন খুব ঠাণ্ডা বইছিল, সঙ্গে বৃষ্টি। মধুসূদনের দেড়শো বছর আগের ঠিকানা খুঁজে বের করার উপযুক্ত আবহাওয়া কোনোটাই ছিল না। রাজা চতুর্দশ লুইয়ের প্রাসাদ বাগান দেখেই প্যারিসে ফিরেছিলাম। প্রায় আট বছর পর আজ আবার প্যারিস থেকে যাচ্ছি ভের্সাইয়ের পথে। আজ মাইকেল মধুসূদন দত্তের ভাড়া বাড়িটা খুঁজে বের করতেই হবে। প্যারিসের ব্যস্ত এলাকা বাস্তি। বাস্তি থেকে আমি আর কিশোর বিশ্বাস মেট্রো পাঁচ ধরে পৌঁছলাম প্যারিস ওস্তারলিজ (Paris Asuterlitz)। সিয়েন নদীতীরে বড় একটা স্টেশন ওস্তারলিজ। এখান থেকেই উঠে পড়লাম আর ই আর ট্রেন সি ফাইভে। এই ট্রেনই যাবে প্রাচীন রাজধানী শাতু দ্য ভের্সাই। নামতে হবে এই ট্রেনের শেষ গন্তব্য স্টেশন ভের্সাই রিভ গোশে শাতু দ্য ভের্সাই (Versailles Rive Gauche, Chateau de Versailles)। প্যারিসে চৌদ্দটি মেট্রো লাইন এবং পাঁচটি আর ই আর ট্রেন লাইন— এ বি সি ডি ই। আমরা যাচ্ছি আর ই আর সি ফাইভে। প্যারিস থেকে আর ই আর সি ট্রেনের দক্ষিণ মুখে পাঁচটি ডিরেকশন আছে। আর ই আর সি ফাইভে ভের্সেই রিভ গোশ ডিরেকশনে উঠলেই শাতু দ্যু ভের্সাইয়ের কাছে পৌঁছনো যায়।

প্যারিস অস্তারলিজের পরের স্টেশনই সামি-শেল নতর-দেম (ঝঃ.(St. Michel Notre Dame). সেলফোনে যোগাযোগ মতো এখান থেকেই আমাদের কামরার দোতলায় উঠে পড়ল কাব্য কামরুল, আশরাফউদ্দিন চয়ন আর ফাতেমা মলি। প্যারিসের তলদেশ দিয়ে পাতাল পথ কাঁপিয়ে আর ই আর ট্রেন ছুটে চলেছে শাতু দ্যু ভের্সাইয়ের দিকে। বেশ কয়েকটা স্টেশন পেরুনোর পর আমাদের ট্রেন আলোর মুখ দেখল। ট্রেনের দোতলা থেকে সিয়েন নদীকে দুচোখ ভরে দেখতে পেলাম। আচমকা কপোতাক্ষ নদের কথা মনে হলো। ‘সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে, সতত তোমারি কথা ভাবি এ বিরলে।’ মনে মনে ভাবছি— মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) কেন এসেছিলেন এই ফরাসি দেশে? ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি মধুসূদন দত্তের জন্ম কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামে। পিতা রাজনারায়ণ দত্ত, মাতা জাহ্নবী। কলকাতায় হিন্দু কলেজে পড়ার সময়ই কেন মনে হলো কবি হতে হলে তাকে বিলেতে যেতে হবে, ইংরেজ হতে হবে। জমিদার নন্দন কবি হতে চান; তার সময়ের উজ্জ্বলতম কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯)। মধুসূদন বোধহয় তাকে খুব উঁচুদরের কবি মনে করেননি। বাংলা এবং সংস্কৃতের পাশাপাশি ফারসি, ইংরেজি ভাষাটাও স্কুল বয়সে রপ্ত করে ফেলেছিলেন বলে হয়তো মধুর রুচি এবং স্বপ্ন প্রথমেই অনেক উঁচুতে বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। ১৮৪৩ সালে উনিশ বছর বয়সেই বিলেত যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে খ্রিস্টান হয়ে গেলেন তিনি, মধুসূদন দত্ত নামের আগে যুক্ত হলো মাইকেল। ধর্মান্তরিত হওয়ার ফলে পিতার রোষানলে পড়ে ত্যাজ্যপুত্র হলেন। ১৮৪৪ সালে হিন্দু কলেজ থেকে তাকে চলে যেতে হলো বিশপস কলেজে। তিন বছর তিনি বিশপস কলেজেই পড়লেন। ইংরেজি ছাড়াও গ্রিক আর লাতিন ভাষাও শিখে নিলেন।

১৮৪৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে জাহাজে যাত্রা করলেন মাদ্রাজের উদ্দেশে; বলা যায় অজানার পথে। মাদ্রাজের অরফান মেইল আসাইলামের স্কুলে চাকরিও পেলেন সামান্য বেতনে। ১৮৪৮ সালের ৩১ জুলাই বিয়ে করলেন রেবেকা ম্যাকটাভিশকে। রেবেকা, শ্বেতাঙ্গিনী। তার মাতা-পিতার পরিচয়ও সঠিকভাবে নির্ণয় করা কঠিন। রেবেকার প্রকৃত পিতা হয়তোবা রবার্ট টমসন। রেবেকা মাদ্রাজের ফিমেল আসাইলামে আশ্রিত ছিলেন। মাদ্রাজেই কবির আত্মপ্রকাশ ঘটে। মাদ্রাজ থেকেই কবি শিখে নেন হিব্রু, ফরাসি, ইতালিয়ান, তামিল ও তেলেগু ভাষা। এখান থেকেই তার প্রথম কাব্য ঞযব The Captive Ladie  প্রকাশিত হয়; কবি এই বই প্রকাশ করতে গিয়ে ধারদেনাতেও পড়ে যান। কলকাতায় বন্ধু গৌরদাস বসাককে কবি দেনামুক্ত হওয়ার জন্য সাহায্য চেয়ে চিঠিও লেখেন। জমিদারপুত্রের কষ্টও হচ্ছিল সামান্য বেতনের জীবনযাপনে। এখানে তিনি বিয়ের এক বছর পরই তেরো বছরের কিশোরী অ্যামেলিয়া হেনরিয়েটা সফাইয়ার প্রেমে পড়ে যান। এদিকে ১৮৫৫ সাল অবধি মাইকেলের ঔরসে রেবেকার গর্ভজাত সন্তানের সংখ্যা দাঁড়ায় চারে।

১৮৫৮ সালের ২৮ জানুয়ারি স্ত্রী-সন্তানদের ফেলে রেখে কবি ফিরে আসেন কলকাতায়। পরে হেনরিয়েটাও মাদ্রাজ ছেড়ে চলে আসেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাছে। তবে তাদের বিয়ের কোনো প্রমাণাদি পাওয়া যায় না। হেনরিয়েটাও চারটি সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন। দুটি সন্তান জন্মেছিল কলকাতায় এবং দুটি সন্তান জন্মেছিল ফ্রান্সের ভের্সাইয়ে। ভের্সাইয়ে একটি কন্যা সন্তান জন্মের পরই মারা যায়। ১৮৫৮ থেকে ১৮৬২ সময়কালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত কবি এবং নাট্যকার-খ্যাতির শীর্ষে। শর্মিষ্ঠা, পদ্মাবতী, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, ব্রজাঙ্গনা কাব্য, কৃষ্ণকুমারী নাটক, মেঘনাদবধ, বীরাঙ্গনার দাপটে তখন বাংলাসাহিত্যের আকাশ প্রকম্পিত। বাংলাভাষায় নাটক, অমিত্রাক্ষর ছন্দের জন্ম, নেটিভ ইংরেজদের চেয়েও সপ্রতিভ ভাষায় ইংরেজি কাব্য রচনা— এসবই হয়েছে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কলম থেকে। কলকাতায় মধুকবি চাকরি করে ভালোই চলছিলেন। কবিযশ পাওয়ার আশায় ইংরেজি ভাষায়ই লিখতে হবে— এমন ধারণা থেকেও তিনি মুক্ত হয়েছিলেন বলেই মনে হয়। কিন্তু এমনকী হলো কবির মনে? ১৮৬২ সালের ৯ জুন কবি কলকাতা থেকে লন্ডনের উদ্দেশে জাহাজে উঠে পড়েছিলেন কেন? শুধুই কি ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য?

—রবিদা, মেদোঁ ভেফিউয়োরি। আর তিন স্টেশন পরেই আমরা নামব। কিশোরদার কথা শুনে দেড় শতাধিক বছরের অতীত থেকে ফিরে এলাম আজকের দিনে। ট্রেনের স্বচ্ছ জানালার ওপারে আজও মেঘলা আকাশ। ভীষণ নীরব স্টেশন মেদোঁ ভেফিউয়োরি। ত্রিশ সেকেন্ড পরেই ট্রেন আবার ছুটতে শুরু করল একশো বিশ কিমি গতিতে।

আমার মন আবারও ছুটে গেল মাইকেলের কাছে। ১৮৬২ সালের ১৯ জুলাই মধুকবি লন্ডনে পৌঁছান। তখনো সুয়েজ খাল কাটা শেষ হয়নি বলে কবিকে পথে কয়েকবার জাহাজ পাল্টাতে হয়েছিল। কবি লন্ডনের গ্রেজ ইনে ব্যারিস্টারি পড়া শুরু করেছিলেন। পরে হেনরিয়েটাও দুই সন্তানকে নিয়ে চলে আসেন লন্ডনে। কবির পক্ষে লন্ডনের জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে অর্থাভাবে। কম টাকায় সংসার চালিয়ে লেখাপড়াও চালিয়ে যেতে পারবেন বলে তিনি সপরিবারে লন্ডন থেকে প্যারিস হয়ে চলেন আসেন ভের্সাই শহরে ১৮৬৩ সালের ১৭ জুনে। কীভাবে এসেছিলেন? ইংলিশ চ্যানেল জাহাজে পার হয়ে তারপর কি ট্রেনে এসেছিলেন প্যারিসে? প্যারিস থেকে ঊনত্রিশ কিলোমিটার দূরে ভের্সাই এসেছিলেন কীভাবে? ১৮৬৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বরের আগে শাতু দ্যু ভের্সাই টু প্যারিস ট্রেন চালুই হয়নি।

দানবের মতো শক্তিমান, কিন্তু রেস্তোরাঁর মতো সুন্দর আর ই আর সি ট্রেন। ট্রেন থেমে গেল শেষ স্টেশন ভের্সাই রিভ গোশ শাতু দ্যু ভের্সাইয়ে। স্টেশন থেকে বেরিয়েই দেখছি চকচকে শহর। প্রশস্ত রাস্তা। প্রাচীন দালানে দারুণ ক্যাফে বার। আমাদের হাতে মাইকেল মধুসূদন দত্তের দুটো ঠিকানা। তথ্য পেয়েছি এই শহরে তিনি দুই ঠিকানায় বসবাস করেছেন। প্রথম ঠিকানা ১২ রু দ্য শনতিয়ে, দ্বিতীয় ঠিকানা ৫ রু দ্য মোপাসাঁ। স্টেশন থেকে বেরিয়ে জিপিএসে সেট করে ১২ রু দ্য শনতিয়ে যে বাড়িটা দেখছি এই বাড়িতে মাইকেলের নামফলক লাগানো নেই; বাড়িটি তিনতলা বিশিষ্টও নয়। ৫ রু দ্য মোপাসাঁর হদিস জিপিএস দিতে পারছে না। কী আর করা; অনুমানেই চললাম শাতু দ্য ভের্সাই, রাজবাড়িতে।

রাজার বাড়ির সামনেটা বিশাল গড়ের মাঠ। ঝকঝকে সুন্দর। ১৬৭১ সাল অবধি এটা রাজবাড়িই ছিল। তারপর লুই ফিলিপ ১৮৩৭ সালে এই বাড়িটিকে মিউজিয়ামে পরিণত করেন। রাজবাড়িতে টিকিট কেটে ঢোকার কোনো ইচ্ছে হলো না। জেনেছি মধুকবি রাজবাড়ির পেছনে বিশাল বাগানে জলাশয়ের ধারে বসে হাঁসদের খাবার দিতেন। রাজপ্রাসাদের পেছনে কিছুক্ষণ বাগানের পথে পথে আর হ্রদের ধারে হাঁটাহাঁটি করে আবার আমরা মাইকেলের ভাড়া বাড়ি খুঁজতে থাকি। সদাশয় একজন বলেন, রু দ্য মোপাসাঁ নামে কোনো রাস্তা ভের্সাইয়ে নেই। ওটা হবে রু দ্য মোরপা (Rue de Maurepas). সঙ্গে সঙ্গে আমরা পাঁচজনে সজোরে হেঁটে অনেক ঘুরে ঘুরে খুঁজে পাই ৫ রু দ্য মোরপা। বিশাল বড় বাড়ি। এখনো বেশ চকচকে। রাজবাড়ি থেকে খুব বেশি দূরেও নয় এই বাড়ি। বাড়িটা এখনো নতুনের মতো। কিন্তু তিনশো কি চারশো বছর আগে তৈরি। ভের্সাইতে এটা ছিল কবির দ্বিতীয় ভাড়া বাড়ি। এই বাড়িতে মধুকবি অল্প কদিন ছিলেন।

১৮৬২ সালে কবি ব্যারিস্টারি পড়তে এলেন লন্ডনে। টাকার অভাবে লন্ডন বাস হলো না বলে সস্তায় থাকার জন্য ভের্সাই এলেন। এখানে এসেও চরম অনটনে পড়লেন। মধুসূদন কলকাতা থেকে আসার আগে বন্ধুদের ঠিক করে এসেছিলেন— তার জমিদারি থেকে যেন নিয়মিত টাকা পান লন্ডনে। কিন্তু বন্ধুরা কথা রাখেননি। পাওনা টাকা কেউই দিচ্ছিলেন না। শেষে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে ভের্সাই থেকে বারবার চিঠি লিখে মধুসূদন অনুরোধ করেছিলেন। পাওয়ার অব অ্যাটর্নিও পাঠিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর সদয় হয়ে তার সম্পত্তির বিপরীতে কত কায়দা-কানুন করে কয়েকবার টাকা পাঠিয়েছিলেন কবির কাছে। মধুকবি ভের্সাইয়ে বারবার দেনায় ডুবে গিয়ে বিদ্যাসাগরের পাঠানো টাকায় মুক্তও হয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর বেশ কবারে মোট ছয় হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন ভের্সাইয়ের ভাড়া বাড়ির ঠিকানায়। কবি একবার ভের্সাইয়ের চার্চ থেকে পঁচিশ ফ্রাঁ ধারও করেছিলেন। পঁচিশ ফ্রাঁতে কোনো রকমে চারজনের সংসার চলার কথা। কিন্তু মাইকেল মধুসূদন দত্ত কি সেভাবে চলতে পারেন? বিদ্যাসাগর দয়ারও সাগর। মধুকবি তার কাছ থেকে দয়া চাননি; সহযোগিতাই চেয়েছিলেন। দিগম্বর মিত্র, মহাদেব চট্টোপাধ্যায়দের কাছ থেকে পাওনা টাকা এবং তার সম্পত্তি বন্ধক রেখে প্রাপ্য টাকা পাঠাতে অনুরোধ করেছিলেন। বিদ্যাসাগরও যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত কবি কিছুটা সচ্ছলও হয়েছিলেন এবং ব্যারিস্টারি পড়া শেষ করার জন্য ১৮৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভের্সাই ত্যাগ করে লন্ডনে ফিরে গিয়েছিলেন। লন্ডনে গিয়েও মধুসূদন বিদ্যাসাগরের কাছে টাকা চেয়ে বহুবার চিঠি লিখেছিলেন; বিদ্যাসাগর আরও কয়েকবার লন্ডনে টাকা পাঠিয়েছিলেন। বন্ধুকে তিনি বিমুখ করেননি।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮৬৬ সালের ডিসেম্বরে ব্যারিস্টারি পাস করে স্ত্রী আর দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে ফিরে এসেছিলেন ভের্সাইয়ে। ভাড়া করেছিলেন ৫ রু দ্য মোরপার একটি ফ্ল্যাট। এই বাড়িটি রাজবাড়ির কাছেই, উত্তর দিকে। খুব সম্ভব মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই বাড়িতে বাস করেছিলেন দশ কি বারো দিন। দুই সন্তানসহ পাঁচ মাসের গর্ভবতী হেনরিয়েটাকে স্বজনহীন নির্জন ভের্সাই শহরে রেখে কবি একাই চলে যান ফ্রান্সের মার্সেই বন্দরে। মার্সেই থেকে কবি কলকাতার উদ্দেশে জাহাজে ওঠেন ১৮৬৭ সালের ১৯ জানুয়ারি। ভের্সাই শহরে হেনরিয়েটার জীবন কেমন কেটেছিল সহজেই অনুমান করা যায়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলকাতায় গিয়ে আবার বেহিসেবি চলনে পড়ে ঋণী হয়ে পড়েন। ব্যারিস্টারি করতে গিয়ে সাহেবি ভাব ধরে রাখার জন্য দুহাতে খরচ করেছেন, আর ভের্সাইয়ে হেনরিয়েটা সন্তানদের নিয়ে চরম কষ্টে কাটিয়েছেন। ১৮৬৯ সালের মার্চ মাসে হেনরিয়েটাকে কিছু বাড়তি টাকা পাঠিয়েছিলেন মধুসূদন। হেনরিয়েটার তখন তিন সন্তান। তিনি কম দামে টিকিট কেটে জাহাজে উঠে পড়েছিলেন কলকাতার উদ্দেশে। ভের্সাই শহরের রু দ্য মোরপা খুব নির্জন। এখনো নির্জন। মাইকেল মধুসূদন যখন এখানে ছিলেন তখন এই শহরের লোকসংখ্যা ছিল মাত্র চল্লিশ হাজার। দেড়শো বছর পর ঊনত্রিশ বর্গকিমি আয়তনের এই শহরে এখন লোকসংখ্যা প্রায় নব্বই হাজার। রু দ্য মোরপা থেকেই আমরা একজন ফরাসি বৃদ্ধাকে মধুকবির প্রথম ভাড়া বাড়ির একটি ছবি দেখাই। তিনি বলেন, এটা তো রু দ্যু শনতি নয়, এটা হু দ্য জেতাজেনেয়্যু। ভদ্রমহিলার নির্দেশমতো এবার আমরা আবার হাঁটতে থাকি সেই স্টেশনের দিকে, যেখান থেকে ভের্সাই শহরে ঢুকেছিলাম। রেলস্টেশনকে ফরাসি ভাষায় বলা হয় গা। অভ্রান্ত হওয়ার জন্য গারের ভিতরে ঢুকে গিয়ে আবার বের হই। বের হয়েই আ দোয়াত। অর্থাৎ ভের্সাই রিভ গোশে শাতু দ্য ভের্সাই স্টেশন থেকে বেরিয়ে ডান দিকে হাঁটতে থাকি। একটু হেঁটেই পেয়ে যাই এভিনিউ দ্যু প্যারিস। এভিনিউ দ্য পারিস পার না হয়ে আবার ডান দিকে একটু হেঁটেই পেয়ে যাই রোড জেতাজেনেয়্যু। এই রোডে ঢুকে একটু এগিয়েই পেয়ে যাই একটি পেট্রল পাম্প। পাম্পের পাশের বিল্ডিংটাই ১২ রু দ্য এতা জেনেরু। ফরাসি উচ্চারণে হু দ্য জেতাজেনেউ (12 Rue des Etats Generaux)। এই রোডের আরেক প্রান্তের নাম রু দ্য শনতি (Rue de Chantiers)। হয়তো মধুকবি যখন ছিলেন তখন পুরো রোডটার নামই ছিল রু দ্য শনতি। এবার নিশ্চিত হতে পারি এটাই মধুকবির ভাড়া বাড়ি। তিনতলা বাড়ি। পঁচিশ কি ছাব্বিশটি ফ্ল্যাট। আজও এই বাড়ি পরিত্যক্ত নয়, জীবন্ত। বাড়ির নিচের একটি এন্টিক দোকান। বই ছাড়াও নানা দুষ্প্রাপ্য জিনিস পাওয়া যায়। ১৮৬৩ সালের জুনে এই বাড়িই কবি ভাড়া করেছিলেন।

ডক্টর রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত, ভারতীয় দূতাবাস এবং ভের্সাই মেরির উদ্যোগে এই বাড়িতে একটি স্মৃতিফলক লাগানো হয় ১৯৬৭ সালের ৩ জুলাই তারিখে। কবি যে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলেন সেই ফ্ল্যাটের জানালার নিচেই ফলকটি লাগানো আছে। ১৮৬৩ থেকে ১৮৬৫। দু বছরের কিছু বেশি সময় কবি এখানে সপরিবারে বাস করেছেন। এখান থেকেই তিনি চতুর্দশপদী কবিতা বা সনেট লিখেছেন ইতালিয়ান কবি পেত্রার্কের অনুকরণে। একশোটি সনেট নিয়েই ১৮৬৬ সালে বেরিয়েছিল চতুর্দশপদী কবিতাবলি। ফরাসি কবিতা অনুসরণ করে বেশ কটি নীতি কবিতাও লিখেছিলেন মধুকবি। কিন্তু ইউরোপে তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকীর্তি বলতে চতুর্দশপদী কবিতাবলি।

হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;

তা সবে, (অবোধ আমি) অবহেলা করি,

পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ

পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।

কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি!

অনিদ্রায়, অনাহারে সঁপি কায়, মনঃ,

মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি;

কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন!

স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে

ওরে বাছা মাতৃ-কোষে রতনের রাজি,

যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!

পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে

মাতৃভাষা-রূপ খনি, পূর্ণ মণিজালে

 

ভের্সাই থেকে লেখা এই কবিতা থেকেই বোঝা যায় কবি কতটা কষ্টে ছিলেন পরবাসে। কিন্তু কষ্টের অনেকখানি ছিল তার নিজেরই জন্য। তিনি ভের্সাইয়ের এই বাড়িতে প্রায়ই ফরাসি অতিথিদের আপ্যায়ন করতেন। আগ্রহীদের বাড়িতে এনে সংস্কৃত শেখাতেন। ভের্সাইয়ের শিল্পসাহিত্যের অনুষ্ঠানে একজন অভিজাত কবি হিসেবেই হাজির হতেন। হিসেব করে চলার অভ্যাস তার কোনো দিনই ছিল না। মাইকেল মধুসূদন দত্ত যত বেহিসেবিই হন না কেন তিনি পরদেশে কারও দেনা শোধ না করে দেশে ফিরে যাননি। ভের্সাই শহরের দোকানদার এবং কোনো ব্যক্তির কাছেই তিনি ঋণী ছিলেন না।

 

টুরিস্টদের উদ্দেশ্যে

কোনো বাঙালি সাহিত্যপ্রেমী যদি আসেন প্যারিসে তবে মধুকবির স্মৃতি অনুভব করতে ভের্সাই বেড়াতে আসতে ভুলবেন না। অবশ্যই আসবেন। মধুকবির ভাড়া বাড়িটা দেখার পর শাতু দ্য ভের্সাই অর্থাৎ ভের্সাইয়ের রাজবাড়ি এবং বাগান দেখতে পারবেন সারা দিন ধরে। বেড়াতে এসে যারা একটু সাশ্রয়ী হতে চান তাদের উদ্দেশ্যে সবিনয়ে বলি, প্যারিসের সুপার শপ দিয়া লিদল কিংবা কারিফু থেকে স্যান্ডউইচ জল ফল খুব অল্প দামে কিনে ব্যাগে পুরে নিয়ে সারা দিনের জন্য ঘুরতে বের হন কোনো সমস্যা নেই। দশ ইউরোর খাবার সারা দিনে চার-পাঁচজনেও শেষ করতে পারবেন না। কিন্তু রেস্তোরাঁয় বসে লাঞ্চ ডিনার করতে চাইলে মাথা পিছু দশ-বারো ইউরোতেও কুলোবে না।

সর্বশেষ খবর