শুক্রবার, ১ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

কবি হাসান হাফিজুর রহমান

হাসানুল কায়সার

কবি হাসান হাফিজুর রহমান

হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-১৯৮৩) সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সমালোচক। ১৯৩২ সালের ১৪ জুন জামালপুর শহরে মাতুলালয়ে তার জন্ম। পৈতৃক নিবাস জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার কুলকান্দি গ্রামে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫১ সালে বিএ এবং ১৯৫৫ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তার পেশাগত জীবন খুবই বৈচিত্র্যময়। ১৯৫২ সালে সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। পরে সওগাত (১৯৫৩), ইত্তেহাদ (১৯৫৫-১৯৫৭), পাকিস্তান (১৯৬৫) এবং স্বাধীনতার পর দৈনিক বাংলা পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি দৈনিক বাংলার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি নির্বাচিত হন। এর মাঝে ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত দুইবার তিনি জগন্নাথ কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি মস্কোস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস কাউন্সিলর নিযুক্ত হন এবং সোভিয়েত লেখক সংঘের আমন্ত্রণে আলমা আতায় অনুষ্ঠিত আফ্রো-এশীয় লেখক সংঘের সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্ব্বরে দেশে প্রত্যাবর্তন করে তিনি সরকারের সংস্থাপন শাখায় যোগদান করেন এবং ১৯৭৮ সালে তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্প’-এর পরিচালক নিযুক্ত হন।

হাসান হাফিজুর রহমানের সাহিত্যচর্চার শুরু ছাত্রজীবন থেকেই। ১৯৪৬ সালে স্কুলে পড়া অবস্থায় তার প্রথম রচনা একটি ছোট গল্প ‘অশ্রুভেজা পথ চলতে’ সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরে ১৯৪৯ সালে সোনার বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার প্রথম কবিতা। একই বছর তিনি ‘ঢাকা প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ’-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং এ বছরই তার বিখ্যাত কবিতা ‘অমর একুশে’ রচিত হয়। ১৯৫৩ সালে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ভাষা আন্দোলনের ওপর প্রথম সংকলন গ্রন্থ একুশে ফেব্রুয়ারি।

সাহিত্যচর্চা এবং পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি হাফিজুর রহমান বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। ১৯৫৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ডাকসুর মাসিক ম্যাগাজিন ঝঢ়বপঃত্ধ সম্পাদনা করেন। এ বছর তিনি  ড্রামা সার্কেলের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং মননশীল প্রবন্ধ ‘কবিতার বিষয়বস্তু’ ও ‘আধুনিক কবিতার লক্ষণ’ রচনা করেন। ১৯৫২ সালে তিনি কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন এবং পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি সাহিত্যপত্র  ‘সমকাল’ (১৯৫৭) সম্পাদনায় সিকান্দার আবু জাফরের সহযোগী ছিলেন। ১৯৬৪ সালে তিনি সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি নির্বাচিত হন। পাকিস্তানি শাসকচক্র কর্তৃক বাংলা বর্ণমালা ও বানান সংস্কার এবং পাকিস্তানের আদর্শ পরিপন্থী বলে রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধের ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে তিনি অংশগ্রহণ করেন।

হাসান হাফিজুর রহমান ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন একজন কমিউনিস্ট। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি তার আজীবন অনুরাগ ছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তিনি পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রিত পত্রিকায় সাংবাদিকতা করলেও গণচেতনা ও গণদাবির প্রতি সর্বদা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তার সাহিত্যকর্মে জনজীবনের প্রত্যাশা, যন্ত্রণা, প্রতিবাদ এবং মানুষের সংগ্রামী চেতনার প্রকাশ ঘটেছে। সমাজ ও জীবনের অঙ্গীকারে তার সাহিত্য হয়ে উঠেছে বাস্তবমুখী। বিভাগোত্তর পূর্ব বাংলায় আধুনিক কাব্যান্দোলনের যে উন্মেষ ঘটে, তার অন্যতম স্থপতি ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। তার সম্পাদনায় ১৬ খণ্ডে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র (১৯৮২-৮৩) প্রকাশিত হয়। এটি তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তার মৌলিক গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে : বিমুখ প্রান্তর (১৯৬৩), আধুনিক কবি ও কবিতা (১৯৬৫), সীমান্ত শিবিরে (১৯৬৭), আর্ত শব্দাবলী (১৯৬৮), আরো দুটি মৃত্যু (১৯৭০), মূল্যবোধের জন্যে (১৯৭০), যখন উদ্যত সঙ্গীণ (১৯৭২), সাহিত্য প্রসঙ্গ (১৯৭৩), দক্ষিণের জানালা (১৯৭৪), প্রতিবিম্ব্ব (১৯৭৬), বজে  চেরা আঁধার আমার (১৯৭৬), শোকার্ত তরবারী (১৯৮২), আমার ভেতরের বাঘ (১৯৮৩) ইত্যাদি। এছাড়া তিনি যৌথভাবে সম্পাদনা করেন উত্তরবঙ্গের মেয়েলি গীত (১৯৬২) এবং এককভাবে বাংলায় অনুবাদ করেন হোমারের ওডিসি (১৯৮৭)। সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ হাসান হাফিজুর রহমান বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭১), একুশে পদক (মরণোত্তর, ১৯৮৪) লাভ করেন। ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল মস্কো সেন্ট্রাল ক্লিনিক্যাল হাসপাতালে তার জীবনাবসান ঘটে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর