শুক্রবার, ১ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

মায়ের চিঠি

মাসউদ আহমাদ

মায়ের চিঠি

প্রিয় রাতুল,

আমার আদর ও ভালোবাসা নিও। তুমি কেমন আছ বাপ?

একসন্ধ্যায় এখানে যখন আসি, তখন সত্যি বলার মতোন কোনো গল্প ছিল না আমার। তবু কত গল্পই না জমে আছে বুকের তোরণে। রাবেয়া বুবুকে আমি সেসব গল্প প্রায়ই আকুল হয়ে বলি। আবার কখনো বলি না। একদিন বললাম, ছেলেটা আমার একদিনের জন্যেও কি আসবে না, বুবু?

রাবেয়াবু কিছু বলেন না, চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকান। আমি আর কোনো কথা খুঁজে পাই না।

জানো বাবা, আমাদের ঘরের একজন বাসিন্দা— ফাতেমা বেওয়া, একদিন সন্ধ্যায়, কোনো অসুখ করেছিল তা নয়, দিব্যি সুস্থ এবং স্বাভাবিক মানুষ; বিকেলের দিকে বললেন যে তার বুকে ব্যথা করছে। তারপর, দিনের আলো ফুরিয়ে আসে যখন— ঘনায়মান সন্ধ্যার আগে আগে— টুক করে মারা গেলেন।

অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন তিনি। বয়স যে খুব বেশি হয়েছিল, তা নয়। ৬৫ বছর কি খুব বেশি বয়স, খোকা? এখন তো শোনা যায়, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে? বড় কোনো অসুখ যেহেতু ছিল না, ফাতেমা আপার, আমার ব্যক্তিগত ধারণা, সন্তানের শোক ও শূন্যতায় তিনি এত বিষণ্ন থাকতেন— ঠিকমতো খেতেন না, ঘুমোতেন না, খুব দরকারি কথাটুকু ছাড়া কারও সঙ্গে তেমন আলাপও করতেন না। এটা হয়তো দারুণভাবে প্রভাব ফেলেছে।

যে কদিন বেঁচেছিলেন তিনি, খুব কষ্ট পেয়েছেন। মৃত্যুর পরেও, জগতের সব আয়োজন ও লেনদেন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন তিনি— কিন্তু তার কষ্ট কমলো না এতটুকু। বরং বেড়ে গেল কয়েকগুণ।

একটা দিনের কথা খুব মনে পড়ে, সেদিন কোনো বিশেষ দিন ছিল কিনা জানি না, ফাতেমা আপা জেনে থাকবেন হয়তো। ব্যক্তিগত বিশেষ দিন বা বসন্ত দিন তো একান্ত নিজের করেই তোলা থাকে। অমন গোপন রেখাভাস জেনে ওঠা শক্ত। তো, সেদিন তিনি খুব কথা বলছিলেন; রোদন করছিলেন আর কি। রাবেয়াবু তার কাছে গিয়ে বসলেন। তখন ফাতেমা আপা প্রায় ডুকরে কেঁদে উঠলেন— তোমাদের পায়ে ধরি বোন, তোমরা আমার সন্তানকে একবার আইন্যা দাও। সোনামাণিকে আমি বুকে জড়াইয়ে ধরতে চাই, আমার বুকের কাছে রাখতে চাই। আর ভালো লাগে না। আমি মইরা যামু রে বোন। আর বেশি দিন বাঁচুম না। আমার জাদুমণি পোলাডারে একবার দেখতে চাই। রাবেয়াবুর হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলেন— ও বইন, পোলা কি আসবে আমারে দেখতে? আমি কি তার মুখটা একবার দেইখা মরতে পারব না? আল্লাহ গো, একটু দয়া করো! ... তোমরা চুপ করে আছ ক্যান? কেউ কথা কউনা ক্যান?

সকাল থেকেই এমন করে কাঁদছিলেন তিনি। তবে এসব কিছু না, খোকা। এখানে যারা থাকে, সবার মনেই নানারকম কষ্ট থাকে। দুঃখ থাকে। না পাওয়ার জ্বালা থাকে। দহন থাকে। অত কিছুকে ভাবতে নেই, পাত্তা দিতে নেই।

এমন সময় আমার বিছানায় এসে বসলেন রাবেয়া বু। বললেন, বুড়ির ধৈর্যের বাঁধ ভাইঙা পড়ছে রে কুসুম।

আমি প্রশ্নচোখে তাকাই।

রাবেয়াবু এখানে এসেই ফাতেমা আপাকে প্রথম দেখেন। তার কাছে গিয়ে এসে বসতেন। গল্প করতেন। কীভাবে ও কেন এখানে আসলেন তিনি? কত যে কথা। কথা ফুরায় না তার। কে তাকে রেখে গেছে তিনি, জানেন না। খুব আশায় থাকতেন, কেউ এসে তাকে বাড়িতে নিয়ে যাবে। তার কষ্টের অবসান হবে। শেষ জীবনটা নিজের মাটির কাছে থেকে, নিশ্চিন্তে মরতে পারবেন। কিন্তু কোনো দিন কেউ আসেনি। গত প্রায় তিন মাস বিছানায় শুয়ে থাকেন। শরীর খারাপ নয়, কিন্তু শুয়ে থাকেন। ঠিকমতো খেতে পারেন না। শরীরের সব কয়টা হাড় অনায়াসেই গুনে ফেলা যায়। গাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে না। নীরবে তাকিয়ে থাকে। সন্তানের কথা বলতেন কখনো কখনো। তার দুইটা ছেলে। এক সন্তান বিদেশে থাকে। আর একজন দেশে। বড় চাকরি করে। গাড়ি বাড়ি সব আছে।

আমি বোকার মতো বলি, সন্তানের জন্য ফাতেমা আপা এমন করে কাঁদতো?

বুবু বলেন, হুম। গায়ের রক্ত দিয়ে সন্তানকে মানুষ করছে, বুকে আগলে রাখছে। একজন মায়ের যে কষ্ট আর হাহাকার, সেটা মা না হলে বোঝা যায় নারে বোন। সন্তানের শরীর খারাপ হলে, মন্দ খবর শুনলে কারও কিছু না হোক, মা টের পায়। বাবার কষ্টও অতটা নয়, যতটুকু বেদনায় পোড়েন মা। সন্তানের উনিশ থেকে বিশ হলে মায়ের নাওয়া-খাওয়া, ঘুম হারাম হয়ে যায়। বাবা হয়তো দিব্যি ঘুমিয়ে পড়েন নাক ডেকে। মা রাত জেগে সন্তানের পাশে বসে থাকেন। বুকে তুলে রাখেন। সেই মায়ের বুকে সন্তান কতটা জুড়ে থাকে— মা হলেই টের পাওয়া যায়।

সন্ধ্যার আজান পড়ল কোথাও। দিনের শেষ আলোর আভাটুকুও দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে। পাখিরা ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। আমি বারান্দার নিচে মন্থর পায়ে হাঁটছিলাম। শরীরটা ভালো লাগছিল না। অবেলায় শুয়ে থাকা ভালো নয়— তাই হাঁটছিলাম। তখনই অল্পখানিক যৌথ কান্নার আওয়াজ উঠল। কে একজন ভেজা গলায় বলে উঠলো— ফাতেমা আপা মারা গেছে!

পা দুটো থেমে যায় আমার। অনায়াস একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক চিরে। ধীরপায়ে ঘরের বারান্দায় এসে দাঁড়াই। আশ্রমে যেভাবে জীবন বয়ে চলে, বয়ে যায় প্রতিনিয়ত— আলাদাভাবে কোনো দৃশ্য তেমন করে চোখে পড়ল না। একজন মাত্র প্রবীণ নারী দুর্বল মনে নিস্তেজ শরীরে মৃতদেহের পাশে বসে গুনগুন করে কাঁদছে। কেউ নিজের মতো ঘরের ভিতরই বসে আছে, চাদর টেনে নিয়ে শুয়ে আছে, নিঃসঙ্গ। একটা বড় মাছি ঘরময় বুঁউউ করে উড়ে চলেছে।

এই ছবিটুকুই দেখে উঠছি আমি। মনে বা চোখের পাতায় কান্নার চেয়ে খেদ কাজ করে চলছিল আমার— এখানে, আমরা এমন এক ধরনের মানুষ, আমাদের সুখ ও দুঃখে কারও কিছু এসে যায় না। মারা গেলেও না। বাড়িতে-শহরে বা গ্রামে বাবা-মা অথবা নিকটাত্মীয়, কিংবা পড়শি— কেউ মারা গেলে মানুষ যেমন ডুকরে কেঁদে ওঠে, কাঁদতে থাকে, আর্ত ও ব্যথিত মানুষের জমায়েত হয়ে পড়ে— এখানে, আমাদের জন্য কেউ কাঁদে না। কান্না করার কেউ নেইও।

ফাতেমা আপার বিছানার পাশে বসে, তার মৃত হাতটা আমার হাতে নিলাম। এখনো দেহের স্বাভাবিক উষ্ণতাটুকু তাকে ছেড়ে যায়নি। কিন্তু প্রাণটা আর নেই।

এখানে যেসব প্রবীণ আসেন— পুরুষ বা নারী, প্রত্যেকেরই একটা করে ফাইল থাকে। সেখানে নাম-ঠিকানা, ছবি এবং প্রয়োজনীয় তথ্য লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়। প্রয়োজনের মুহূর্তে যোগাযোগের জন্য সেসব দরকার হয়। রাতে, আশ্রমের বাইরে আর কাউকে মৃত্যুর খবর জানানো হয়নি। সকালেই আপার ছেলের কাছে ফোন করে জানানো হয়, মৃত্যুর খবর। সবকিছু শুনে ছেলে জানায়, সে আসবে। দুপুরের আগেই আসবে। এসে তার গ্রামের বাড়িতে মায়ের লাশ নিয়ে যাবে। বাবার কবরের পাশেই মাটি দেবে। আপারও শেষ ইচ্ছেটা তেমনই ছিল।

বৃদ্ধাশ্রমের কর্তৃপক্ষ অপেক্ষা করতে থাকে।

একটা ব্যাপার খুব খারাপ লাগল। কষ্টে আর শোকে মনটা কেমন ভোঁতা হয়ে এলো। এমন বেদনার মুহূর্তটুকুর জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না, বাবা। এ বড় বেদনার দৃশ্য। খালি চোখে যেমন স্বচ্ছ সুন্দর পানি বা সুস্বাদু দইয়ের মধ্যে পোকা দেখা যায় না, তেমনি চোখের সামনে এমন দৃশ্যটুকু দেখা যায়, সওয়া যায় না।

ফাতেমা আপার ছেলের আসবার কথা সকালে।

কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়। বিকেল নামে। নভেম্বরের শীতকালের বেলা ছোট, সন্ধ্যাও হয়ে আসছে প্রায়। ছেলের কোনো খবর নেই।

আশ্রমের কর্তৃপক্ষ ছেলেকে ফোন করেন। আবার ফোন করেন। আর একবার। কিন্তু ছেলে ফোনে সাড়া দেয় না।

ধর্মীয় বিধি মোতাবেক লাশের গোসল ও কাফনের কাপড় পরিয়ে তৈরি করে রাখা হয়েছে সেই সকালে। যাতে ছেলে এসেই মাকে নিয়ে যেতে পারে। সময় গড়িয়ে চলে। কিন্তু ছেলের কোনো নামগন্ধ নেই।

বিকেলে আমার একটু হাঁটার অভ্যেস। সেদিন হাঁটতে বেরোব, পা চলতেই চায় না। মনটাও ম্রিয়মাণ হয়ে থাকল। বারান্দায় বসে ভাবছি কত কথা আর স্মৃতি। এই মানুষটি একদিন কত জায়গায় ছুটে বেড়িয়েছেন। কাজ করেছেন। সংসার করেছেন। সন্তান ও স্বামীকে ভালোবেসেছেন। কত মানুষের দায়িত্ব নিয়েছেন। আজ তিনি নিঃস্ব,  একা। প্রাণটা বের হয়ে গেলে তবে মানুষের কোনো দাম থাকে না, খোকা? সব প্রয়োজন ও সম্পর্ক ধুয়ে মুছে শেষ হয়ে যায়?

সবাই যে-যার মতো করে কাজে বা নিজের মধ্যে ব্যস্ত। কেউ চা খাচ্ছেন বা বিস্কিট। কেউ হেঁটে বেড়াচ্ছেন। আকাশ দেখছেন। বাইরে থেকে আসা কিছু মানুষ আশ্রমের আলো-বাতাস আর পরিবেশ পরখ করছেন। কিন্তু মারা যাওয়ার পর, কাঠের খাটলিতে ধবধবে সাদা কাপড়ে রাখা লাশটা খোলা আকাশের নিচে একটা জড় পদার্থের মতো পড়ে আছে, নিঃসঙ্গ। অবহেলায়। আশপাশে কেউ নেই— কেউ দেখছে না। তাকাচ্ছে না। ভ্রূক্ষেপও করছে না। অথচ মারা যাওয়ার আগে, কিংবা গতকাল পর্যন্ত ফাতেমা তাদের মতোই একজন ছিল— অসহায়, প্রতীক্ষাকাতর একজন মানুষ। আজ তার কোনো অস্তিত্বই কেউ মনে রাখল না? এমনো হয়!

 

শেয়াল বা কুকুর যাতে লাশটা টেনে নিয়ে না যায়, সে কারণে একজন সিকিউরিটি রাখা আছে। সেও একশ গজ দূরে, অন্যদিকে তাকিয়ে, হাতে একটা লাঠি নিয়ে নিতান্তই অনিচ্ছুকভাবে বসে আছে। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই, সে লাশ পাহারা দিচ্ছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব দেখতে দেখতে বুকটা দুমড়ে মুছড়ে একাকার হয়ে এলো আমার। মাথাটা ঘুরে উঠল। বারান্দার বেন্সিতে বসে নিজেকে সামলে নিলাম।

কেউ একজন বলে উঠল, পোলায় আইসা নাকি লাশ নিয়া যাইব। পোলার তো কুনু খবর নাই?

সেই আশাত বালি দেও আপা; আর একজন বলে উঠল।

কেন? — আমি পাশ ফিরে তাকাই।

বুড়ি কথা বলে না। আমি বলি, এমন করে কেন বলছেন, আপা?

বুড়ি বলল, পোলায় আইব ক্যামনে? দুপুরের পর থিকা হের ফোন বন্ধ।

তারপর?

পরে আর কী? হে তো আর আসব না। তুমি বুঝো না বইন?

আমি বোকার মতোন জিজ্ঞেস করি, কয়টা বাজে আপা?

আমি কি টাইমের খবর রাখি রে বইন? লেখাপড়া কিছুই জানিনে। তয় আসরের আজান হইছে তাও ঘণ্টার উপরে হইব।

বিকেলের নাশতা দেয় যে, সেই মেয়েটা আবার কী কাজে এদিকে এলো। তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই। কাজের গতিতে ছন্দপতনও নেই কিছুটুকুন। তাকে কাছে ডাকলাম— হাবিবা, ফাতেমা আপার ছেলের লাশ নিতে আসার কথা, তুমি কিছু জানো?

ওই আশা বাদ দেন আম্মা গো। পোলায় এলে এতক্ষণে আইসা পড়ত। দুপুরের পর আর কথা বলা যায়নি। ফোন বন্ধ কইরা রাখছে। ওইদিকে শুনলাম, আর কিছু টাইম অপেক্ষা করব আশ্রমের লোকজন। তারপর এইখানেই গোর দিব। সব ব্যবস্থা চলতাছে...

আমি নির্বাক তাকিয়ে থাকি। হাবিবাকে দেখি। আবার দেখিও না।

কবরের পাশ দিয়ে প্রায় প্রতিদিন হাঁটি আমি, হেঁটে যাই। কিন্তু সেদিনের বিকেলটুকু কেমন অন্ধকারে ঢেকে গেল আমার। বিশেষ করে কবরের এলাকাটাকে কেমন অচেনা আর অন্ধকারের জগৎ বলে মনে হতে লাগল। রহস্যময়ও কি নয়?

এক সময় লাশ কবরস্থ করে যে যার ঘরে ফিরে গেল। দিনের আলোর শেষ রেখাটুকু তখন মিশে গেছে অন্ধকারে।

রাবেয়া বু আমাকে টেনে ঘরে নিয়ে গেলেন। আমার অবচেতন মনের কথাটুকু তিনি কি পড়তে পারলেন? কিছু বললেন না, কিছু শুধালেন না। গায়ে চাদর টেনে দিয়ে তিনি তার বিছানায় চলে গেলেন।

আমি চাদর সরিয়ে উঠে বসলাম বিছানায়।

বুবু কাছে এসে দাঁড়ালেন। আমি তার হাত টেনে কেমন আকুল হয়ে বললাম— আমি মরে গেলে কেউ মনে হয় দেখতে আসবে না। একটু কাঁদবেও না। আমার জন্য তুমি খুব কাঁদবে বুবু?

রাবেয়া বু সে কথায় জবাব না দিয়ে তীব্রভাবে ডুকরে কেঁদে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমিও।

দিন চলে যায় আশায় আশায়, তবু প্রিয় মুখের কোনো একজন মানুষ একটিবার এসে দেখে না, খোঁজটুকু নেয় না। এভাবেই জীবনের দিনগুলো গড়ায়, দিন ফুরিয়ে যায়।

দিন ফুরালে জীবনের আর কী অবশিষ্ট থাকে, বাবা!

ভালো থেকো।

ইতি, তোমার মা

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর