শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
নীরদ চন্দ্র চৌধুরী

কিশোরগঞ্জ থেকে অক্সফোর্ড

নিবন্ধ ♦ মো. আবদুল মান্নান

কিশোরগঞ্জ থেকে অক্সফোর্ড

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভুবনে যে কজন ক্ষণজন্মা পুরুষের আগমন ঘটে নীরদ চন্দ্র চৌধুরী তাদের অন্যতম। আলোচনায় -সমালোচনায়, তর্কে-বিতর্কে, পাণ্ডিত্যে ও অহংকারে ভরপুর তাঁর এক শতাব্দীর অধিক জীবনকাল। ১৯৫১ সালে চুয়ান্ন বছর বয়সে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘The Autobiography of An unknown Indian’ সহ ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় প্রকাশিত তাঁর অসংখ্য রচনাবলিতে সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজ, রাজনীতি, ভূগোল, সংগীতসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি লিখেছেন। মাতৃভূমি ও বাঙালির যে স্বপ্নচিত্র তিনি নীরবে এঁকেছেন এর তুলনা হয় না। 

নীরদ চৌধুরীকে নিয়ে কিছু লেখার দুঃসাহস করা আমার মতো অপেশাদার, অলেখকের হয়তো সঠিক হয়নি। তবু বলে রাখি তাঁর পৈতৃক ভিটা আমার পৈতৃক ভিটা হতে মাত্র চার-পাঁচ কিমি দূরত্বে অবস্থিত। এই সুবাদে আমি নিজে একাধিকবার বনগ্রামে গিয়েছি। বর্তমানে জেলা শহর কিশোরগঞ্জ যাওয়ার পথেও বনগ্রাম হয়ে যাই। একই মাটিতে জন্ম নেওয়া এ অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষটির রচনাবলি পড়লে নিজেকে নিতান্তই অনুজ্জ্বল, অনগ্রসর মনে হয়। কিশোরগঞ্জবাসীসহ বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে তাঁকে সামান্য পরিচয় করিয়ে দেওয়ার তাগিদ থেকেই তাঁর সম্পর্কে ক্ষুদ্র আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি।

নীরদ চন্দ্র চৌধুরী ১৮৯৭ সালের ২৩ নভেম্বর কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের খরমপট্টিস্থ সরকারি পুকুর পাড়ের কোনো একটি বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা উপেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ময়মনসিংহ থেকে এন্ট্রান্স পাস করে মোক্তারি পড়েন এবং ১৮৯৪ সালে কিশোরগঞ্জ মহকুমা শহরে এসে মোক্তারি পেশায় যোগ দেন। তিনি ফৌজদারি মামলার ভালো মোক্তার ছিলেন যা নীরদ চৌধুরীর বর্ণনায় পাওয়া যায়। বর্তমান কটিয়াদী উপজেলাধীন বনগ্রাম তাঁর পূর্বপুরুষদের ভিটেবাড়ি। তিনি ১৯০০ সাল থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত পূজা-পার্বণ, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে যোগ দিতে একাধিকবার এসেছেন। এটিও তাঁর বিভিন্ন রচনায় বার বার এসেছে। উল্লেখ্য, বনগ্রামে তাঁরই পূর্বপুরুষদের প্রচেষ্টায় ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আনন্দকিশোর উচ্চ বিদ্যালয় এবং পরবর্তীতে তাদেরই এস্টেটে গড়ে ওঠে নানান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা। কিশোরগঞ্জ-বনগ্রাম-কিশোরগঞ্জ-কালিকচ্ছ (মাতুলালয়)-কলকাতা-দিল্লি-অক্সফোর্ড করে ১০২ বছরের মহাকাব্যিক জীবনের অধিকারী এ মানুষটি যখন একশ বছর বয়সে নিজ জন্মস্থান, নিজগ্রাম, নিজ শহরের বর্ণনা দেন তখন অবাক বিস্ময়ে তাঁর অভূতপূর্ব স্মৃতিশক্তির জয়গান না গেয়ে উপায় থাকে না। একশ বছর বয়সে লেখা তাঁর শেষ বই ‘আজি হতে শতবর্ষ আগে’ পাঠ করে তাঁর কিশোরগঞ্জের বর্ণনা পেয়ে আমার মন আনন্দে ভরে ওঠে। কারণ, এটি আমারও শহর। আমার কলেজজীবন, আমার যৌবনকালের পদচারণায় মুখর এ শহর। কিশোরগঞ্জ ও তৎকালীন বাংলার প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর নিজের মুখে শোনা যাক একটি মনোজ্ঞ বর্ণনা— ‘বড় হইয়া নিজেকে জিজ্ঞাসা করিতে আরম্ভ করিলাম, সত্যই কি বাংলাদেশের কোনও নৈসর্গিক সৌন্দর্য আছে? একদিন বিকালে বেড়াইবার সময়ে কিশোরগঞ্জ শহর হইতে রেল লাইন ধরিয়া মাইল কয়েক উত্তর দিকে যাইবার পর একটা জলে ডোবা ধানক্ষেত্রের ওধারে একটা বাস্তুভিটা দেখিতে পাইলাম। মাঝখানে একটা পুকুর। তাহার উঁচু পাড়ের উপর ছয়-সাতটা আটচালা। উল্টাদিকে বাঁশের ঝাড়। স্থির নিস্তরঙ্গ জলে আটচালার স্পষ্ট ছায়ার সম্মুখে নীল আকাশ ও সন্ধ্যার রক্তিম মেঘের প্রতিবিম্ব পড়িয়াছে। সমস্তটা কনস্টেবলের ছবির মতো। তখনই বুঝিলাম, বাংলাদেশেরও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আছে। উহার দিকেও মুখ ফিরাইয়া মুগ্ধনেত্রে চাহিয়া থাকিতে হইবে। এই নূতন দৃষ্টি ফিল্ম-স্টারের রূপ হইতে চোখ ফিরাইয়া ঘরের মেয়ের রূপ দেখিবার মতো।’ তিনি বাংলার রূপ-জলে, বাংলার-রূপ স্থলে, বাংলার-রূপ মনে এবং প্রেমে ইত্যাদি শিরোনামেও লিখেছেন। বলেছেন, ‘নদী, জল, উন্মুক্ত উদার নীল  আকাশ, কাজলকালো বা মরালশুভ্র মেঘ বাঙালি জীবনে প্রাণের অবলম্বন। ইহাদের ছাড়িয়া জীবন্ত বাঙালি কল্পনা করা যায় না।’

নীরদ চৌধুরীকে নিয়ে গল্পের কোনো শেষ নেই। ১৯৫১ সালে ইংরেজিতে লেখা দুখণ্ডে আত্মজীবনী প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি আরও ৪৮ বছর বেঁচে ছিলেন। আত্মকথা লেখার ইতিহাসে এটি কিংবদন্তি। মজার ব্যাপার হলো, মৃত্যুর আগে তিনি দেখে গেছেন ‘The Autobiography of An unknown Indian’ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থের তালিকায় স্থান পেয়েছে। ১৯৮৮ সালে ডেইলি টেলিগ্রাফ লিখেছিল, ‘মানুষ যতদিন বই পড়বে ততদিন তাঁর দুখণ্ড আত্মজীবনীর পাঠকের অভাব হবে না।’ তিনি বলেছেন, ‘১৯৩৭ সালের পর আমি আর বাংলায় লিখি নাই। কারণ বাঙালিদের জন্য লিখে লাভ নাই তারা কোন সাড়া দিতে জানে না। এই জন্যই ইংরেজিতে লিখা শুরু করি। তবে ১৯৬৫ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্রের অনুরোধে শিল্পী নন্দলাল বসুকে নিয়া লিখিতে গিয়া আবার বাংলায় ফিরিয়া আসি এবং ১৯৬৭ সালে আমার প্রথম বাংলা বই ‘বাঙালি জীবনে রমণী’ প্রকাশ করি।’

নীরদ চৌধুরীর বিখ্যাত গ্রন্থগুলোর মধ্যে ১০টি ইংরেজিতে এবং ৫টি বাংলায় সর্বাধিক আলোচিত হয়েছে— আত্মজীবনী ব্যতীত ‘দাই হ্যান্ড গ্রেট এনার্ক’, ‘আ প্যাসেজ টু ইংল্যান্ড’, ‘ম্যাক্স মুলার ও ক্লাইভের জীবনী’, ‘দি কন্টিনেন্ট অব সার্সি’, ‘হিন্দুইজম’, ‘দি ইন্টেলেকচুয়াল ইন ইন্ডিয়া’, ‘কালচার ইন দি ভ্যানিটি ব্যাগ’, ‘থ্রি হর্সমেন অব দি নিউ অ্যাপোক্যালিপ্স’ ইত্যাদি-বাংলা বইয়ের মধ্যে ‘বাঙালী জীবনে রমণী’, ‘আত্মঘাতী বাঙালী’, ‘আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ’, ‘আমার দেবোত্তর সম্পত্তি’, ‘আমার দেশ আমার শতক’, ‘আমি কেন লিখি’, ‘আমি একাধারে বাঙালী ও ইংরেজ’, ‘জীবনের কাহিনী’, ‘আমি সাম্রাজ্যবাদী কেন’, ‘আমি কেন বিলাতে আছি’ ইত্যাদি নানা জবানবন্দিমূলক রচনা রয়েছে।

জ্ঞান-গরিমায়, বিদ্যায়-বুদ্ধিতে, সৃষ্টিশীলতা ও মননশীলতায় যেসব লেখক শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতিতে বিশ্বব্যাপী ঝড় তুলেছিলেন তাদের মধ্যে যাঁরা দীর্ঘ জীবন পেয়েছেন-জর্জ বার্নার্ড শ ৯৬ বছর, ব্রাট্টান্ড রাসেল ৯৮ বছর, পাবলো পিকাসো ৯২ বছর, অন্নদাশংকর রায় ৯৭ বছর। তুলনা করলে নীরদ চৌধুরী প্রাণশক্তিতে অনেক বেশি প্রাণবন্ত ছিলেন। আলোচনা-সমালোচনায়-বিতর্কে তিনি অধিকতর পরিচিতি পেয়েছেন বলে অনেকেই মনে করেন।

একশ দুই বছরের জীবনকালে ৪৮ বছর বয়সেই তিনি পুরোপুরি দন্তহীন। চশমা চোখে পরেছেন তারও আগে। তিনি নিজে বলেছেন, ‘আমার উচ্চতা পাঁচ ফুট আধ ইঞ্চি, ওজন এক মণের সামান্য ঊর্ধ্বে সারাজীবন ধরিয়া; দেহ হাড়-জিরজিরে কৃকলাশের মতো।’ মেঝেতে বসে লেখার অভ্যেস করেছিলেন। স্বাস্থ্য খারাপ বলে বিজ্ঞাপন দেখে ‘স্যান্টোজেন’ খেয়েছিলেন। যদিও এতে ফল পাননি। স্বাস্থ্য কোনো দিনই তাঁর ভালো ছিল না। অনেকে মনে করেন এটাই হয়তো আশীর্বাদ ছিল। শ্রীপান্থ তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, ‘কখনো কখনো স্ববিরোধিতা, কখনো রক্ষণশীলতা এবং প্রায়শ বিশেষ থেকে সামান্যে পৌঁছবার জন্য বিপজ্জনক প্রবণতা সত্ত্বেও বলব নীরদ চৌধুরী একালের এক আশ্চর্য বাঙালি ভাবুক। তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা শুধু প্রসারে দিগন্ত বিস্মৃত নয়, দৃষ্টিভঙ্গিতেও গভীর এবং কখনো কখনো তির্যক। চলমান ইতিহাসে অসংখ্যের ভিড়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে তিনি নিতান্ত দর্শক। কিন্তু এক অসাধারণ মনোযোগী দর্শক।’

খুশবন্ত সিং বলেছেন, ‘তিনি এমন একজন যাকে আমি বুদ্ধিজীবী বলব। কারণ, তাঁর জীবৎকালে তাঁর সমকক্ষ মানুষ আমি আর দেখিনি। জীবনে অনেক কঠিন সময় তিনি মোকাবিলা করেছেন। এক সময় কে কে বিড়লা তার অভাবের খবর পেয়ে তাঁকে ভাতা দিতে চেয়েছিলেন যে কোনো অঙ্কের তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।’ নীরদ চৌধুরীর স্ত্রী অমিয়া চৌধুরানী তাঁর পূর্বেই প্রয়াত হয়েছেন। তবে বাষট্টি বছরের দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন শেষে ১৯৯৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিন ছেলে ধ্রুব নারায়ণ চৌধুরী, কীর্তি নারায়ণ চৌধুরী ও পৃথ্বী নারায়ণ চৌধুরী। ১৯৩২ সালে তিনি বিয়ে করে ঘর বাঁধেন। ছেলেদের নামের সঙ্গে বনগ্রামের পূর্ব-পূরুষের নামের অংশ ‘নারায়ণ’ যুক্ত করে দিয়েছিলেন। নিজের নামও ভাইদের নামে ‘চন্দ্র’ ছিল। বিয়ের পর এক দিনের জন্যও স্ত্রীকে কাছছাড়া করেননি। তাঁর লেখালেখির জীবন স্ত্রীর জন্যই সফলতা পেয়েছে। অনেক সময় স্ত্রী তাঁর লেখা টাইপ করেও দিয়েছেন। এটি তাঁর নিজের ভাষ্য।

নীরদ চৌধুরী ভারতীয় রাজনীতি ও ভারতবর্ষে ইংরেজ এবং ব্রিটিশ শাসন নিয়েও নানা মত-অভিমত দিয়েছেন। বিশেষ করে তার ‘আমার দেশ আমার শতক’ গ্রন্থে তিনি স্মৃতিচারণমূলক অনেক মন্তব্য করেছেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন ও পূর্বাপর ঘটনাবলি তিনি কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি ১৯২১ সালে প্রথম কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। ইতিহাস নিয়ে অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান পেয়েও আর্থিক কারণে নানাবিধ কর্মে যুক্ত হতে হয়েছিল তাঁকে। তবে একটানা বেশি দিন কোথাও চাকরি করেননি। ১৯৩৭ সালের জুলাই মাসে তিনি বিখ্যাত বাঙালি নেতা শরৎ বসুর একান্ত সচিব হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর বড় ভাইয়ের একান্ত সচিব থাকায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মূল কুশীলবদের তিনি কাছে থেকে দেখেছেন, তাঁদের সঙ্গে কাজ করারও সুযোগ পেয়ে যান। ফলে মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত নেহেরু, প্যাটেল, মৌলানা আজাদ, জিন্নাহ এবং শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সম্পর্কে তাঁর প্রত্যক্ষ মন্তব্যগুলো আকর্ষণীয় এবং তথ্যবহুল। হিন্দু মুসলিম বিরোধ, দাঙ্গা, অসহযোগ আন্দোলন, সুভাষ বসুর শিক্ষা, উত্থান, রাজনীতি, দেশত্যাগ ইত্যাদি বিষয়ও অকপটে এসেছে তার রচনায়। ১৯২৮ সালে মডার্ন রিভিউতে চাকরি করেছেন। ১৯৩৪-১৯৩৬ সাল পর্যন্ত কলকাতা মিউনিসিপাল করপোরেশনে চাকরি করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতা রেডিওতে ধারা ভাষ্যকার ছিলেন। ১৯৪২ সালে All India Radio-তে চাকরি নিয়ে দিল্লি চলে যান। আটাশ বছর দিল্লিতে অবস্থান করেন। ১৯৭০ সালে ঙীভড়ত্ফ-এ যান এবং ব্রিটিশ নাগরিকত্ব নিয়ে জীবনাবসান অবধি সেখানে থেকে যান।

নীরদ চৌধুরী আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ নামে দুখণ্ডে প্রকাশিত বইয়ে রবীন্দ্র জীবনের নানা অনুজ্জ্বল দিক নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করলেও রবীন্দ্রনাথের বাইরে যে বাঙালির সংস্কৃতি খানিকটা অস্তিত্বহীন তাও বলেছেন বাঙলা ও বাঙালির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক জন্ম-নাড়ীর সম্পর্ক। বাংলায় না জন্মালে রবীন্দ্রনাথকে কিছু মাত্র না জানলে বাঙালির বাঙালিত্ব বজায় থাকে না। রবীন্দ্রনাথকে জানার চেষ্টা বাঙালির স্বরূপ-উপলব্ধিরই প্রয়াস মাত্র। তিনি রবীন্দ্রনাথকে ৪০ বছর, ৬০ বছর ও ৮০ বছর বয়সে তাঁর কবি কৃতি, তাঁর প্রতিভা, তাঁর প্রখর মননশীলতা নিয়ে সমসাময়িক কালের বিশ্বসাহিত্যের প্রতিভাগণের সঙ্গে তুলনা করেও তাঁকে শ্রেষ্ঠত্ব দিতে কার্পণ্য করেননি। রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান, গল্প ও উপন্যাসের প্রতিটি বাক্য মনে হয় তিনি পড়েছেন, বুঝেছেন, আত্মস্থ করেছেন। তাঁর সমগ্র রচনাবলিতে রবীন্দ্রকাব্যের প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতিতে ভরপুর। যেন তাঁকে ছাড়া সবকিছুই অসম্পূর্ণ, অসমাপ্ত। ১৯৩২ সালের ২৩ এপ্রিল তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের রাতে রবীন্দ্রনাথের একটি নতুন গান গাওয়া হয়েছিল যা তাঁকে সারাজীবনই আলোড়িত করে রেখেছিল। তিনি বলেছেন ‘নিজের জীবনের প্রারম্ভ ও শেষের কথা মনে করিয়া এই গানটি আমি সময় সময় শুনিয়া থাকি।’ ‘আমার মল্লিকা বনে যখন প্রথম ধরেছে কলি/তোমারি লাগিয়া তখনি, বন্ধু বেঁধেছিনু অঞ্জলি।/তখনো কুহেলীজালে সখা, তরুণী উষার ভালে/শিশিরে শিশিরে অরুণমালিকা উঠিতেছে ছলোছলি।’

তাঁর ১০০তম জন্মদিনে বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতা এখনো আমাকে কাঁদায়। রবীন্দ্রনাথ। আমায় ফেলে আসা বাংলাদেশ। প্রয়াত ঘরণী। এই তিনই আমার চোখে জল এনে দেয়।’ তাঁর শবযাত্রার সময়ও রবীন্দ্রনাথের গান—‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়, এই আকাশে’ গীত হয়। শেষ বয়সে এসে নীরদ চৌধুরী অহংকার করে বলতেন, ‘একশো বছরেও আমার একটা বই বেরোচ্ছে। এর আগে আর কোনো লেখকের এরকম হয়নি।’ স্বামীর ৯৭ বছর বয়সে স্ত্রী আমিয়া দেবী চৌধুরানীর মৃত্যু হয়। স্বামীর শতায়ু হওয়াটা দেখে যেতে পারেননি আমিয়া দেবী। তিনি অহংকার করে বলতেন, ‘লন্ডনের বিখ্যাত ‘ইলাস্ট্রিয়াস উই্কলি’ পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু আর আমাকে নিয়েই পূর্ণপৃষ্ঠা প্রচ্ছদ করেছে। এর আগে কোনো ভারতীয়কে তারা এত গুরুত্ব দিয়ে করেনি।’ এমন উন্নাসিকতা ও ছেলেমানুষী করার নজিরও তাঁর জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বিষয় হিসেবে থেকে গেছে। 

অক্সফোর্ডে বাসকালে তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক মনীষী, লেখক, কথাসাহিত্যিক সাক্ষাৎ করেছেন। পরবর্তীতে তারা অনেকেই তাঁকে জীবন্ত ‘এনসাইক্লোপিডিয়া’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। জীবদ্দশায় শুধু নিন্দা, বিতর্ক আর সমালোচনার সম্মুখীনই হননি তিনি, অনেক সম্মানও পেয়েছেন। ১৯৮৯ সালে Oxford থেকে ডিলিট উপাধি পান। একই বছর পান ‘আনন্দ’ পুরস্কার। ১৯৯৩ সালে ইংল্যান্ডের রাণি কর্তৃক তাঁকে দেওয়া হয় সিবিই ‘কমান্ডার অব ব্রিটিশ এম্পায়ার’ পদক। ১৯৯৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে ‘বিদ্যাসাগর’ পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করে। জীবিত অবস্থায় ভারতের একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি Oxford এ তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। পেয়েছেন, ‘দেশিকোত্তম’ পদক।

নীরোধ চৌধুরী কিশোরগঞ্জ থেকেই স্বপ্ন দেখতেন ইংল্যান্ডের আর ইংল্যান্ডে থেকে বারবার স্মৃতিকাতর হয়েছেন কিশোরগঞ্জকে নিয়ে। তা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, সারা জীবন অক্সফোর্ডে নিজের ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন ময়মনসিংহ জেলার ম্যাপটি। মৃত্যু অবধি ভারতীয় পাসপোর্টটি না বদলিয়ে নজির স্থাপন করেন। জন্মভূমির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার জন্য আর কী নিদর্শন প্রয়োজন? মহাপ্রয়াণের পর কলকাতার ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় প্রকাশিত অসামান্য বক্তব্যটি তুলে ধরেই আমি এ  লেখাটি শেষ করব—‘অক্সফোর্ডের লাথবেরি রোডের বাড়িতে একশো এক বছর বয়সের বৃদ্ধ যে দিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন, তাঁর কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ আর কলকাতার আকাশে সে দিন কিন্তু ওই কাজলকালো মেঘেরই ছটা। বাতাসে বৃষ্টির দাপাদাপি। ওটা শ্রাবণ মাস। ক্যালেন্ডার জানাচ্ছে, ১৫ শ্রাবণ চলে গিয়েছেন নীরদ চোধুরী। যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর চোখে জল আনতেন, তিনিও চলে গেলেন এমনই জল ঝরঝর এক শ্রাবণেই।’

সর্বশেষ খবর