মার্কিন সাহিত্যিক ফ্রাঙ্ক রিচার্ড স্টকটন (১৮৩৪-১৯০২) কৌতুক কাহিনী ও শিশুতোষ রূপকথার গল্প লেখক। জন্মেছেন ফিলাডেলফিয়ায়। বাবা ছিলেন স্বনামধন্য ধর্মমতী মিনিস্টার। ধর্মাচারে নিবেদিত বাবা ছেলেকে পেশাদার লেখক বলতে নিরুৎসাহিত করতেন নিত্যদিন।
১৮৬০ সালে বাবার মৃত্যু অবধি বেশ ক’বছর কাঠ খোদাই করে পরিবারের রোজগারে সাহায্য করতেন। এরপর তাঁর ভাইয়ের প্রতিষ্ঠিত খবরের কাগজে লেখালেখি করেছেন বিস্তর। প্রথম রূপকথার গল্প ‘তিঙ-অ্যা-লিঙ’ ‘রিভার সাইড সাময়িকী’তে প্রকাশিত হয় ১৮৬৭তে। গল্প সংকলন বের হয় ১৮৭০ সালে। সম্পাদনা করেন ‘হেল্থ অ্যান্ড হোম’ সাময়িকী ১৮৭০-এর গোড়ার দিকে।
নীতিশিক্ষা কিংবা হিতোপদেশ—যা সাধারণত শিশুতোষ গল্পের মূল উপজীব্য—স্টকটন সচেতনভাবেই সে ধারা পরিহার করতেন। বরং তার বদলে তিনি হাস্যরসাত্মক উপায়ে কাল্পনিক চরিত্র চিত্রণের মাধ্যমে সমাজের তথা মানুষের লোভ, হিংস্রতা, জবরদস্তি, জুলুম, ক্ষমতার অপব্যবহার, মানব-চরিত্রের অন্যান্য বিচ্যুতি, অসংলগ্নতা, নিষ্ঠুরতা, অবিচার ও অসামঞ্জস্যতাকে তুলে ধরেছেন শৈল্পিক কুশলতায়। তাঁর গল্প ‘দ্য লেডি, অর দ্য টাইগার’ (১৮৮২), ‘দ্য গ্রিফিন অ্যান্ড দ্য মাইনর ক্যানন’ (১৮৮৫), ‘দ্য বি-ম্যান অব ওর্ন’ (১৮৮৭) সে স্বাক্ষর রেখেছে সবিশেষ। তাঁর দুঃসাহসী ভ্রমণকাহিনী ‘দ্য অ্যাডভেন্চার্স অব ক্যাপটেন হর্ন’ ১৮৯৫ সালে তৃতীয় বেস্ট সেলার হিসেবে সমাদৃত হয় মার্কিন মুলুকে। রহস্য গল্পের ধারায় লিখিত তার ‘মিজ ব্রেসগার্ডল’স নাইট অব ফিয়ার’ শীর্ষক গল্পের অনুবাদ ‘সেই ভয়ের রাত’।এটা মিজ ব্রেসগার্ডলের প্রথম ফ্রান্স সফর। সে সচরাচর দেশের বাইরে ছুটি কাটাতে যায় না। সৌভাগ্যক্রমে সে খানিকটা ফরাসি ভাষা জানে। তার ভাবনাটা এরকম—‘ফ্রান্সে কটা দিন কাটানো তেমন কঠিন কোনো ব্যাপার না। কেবল এটুকু বুঝলেই হয় যে, ফ্রান্স তার বাসস্থান এজিংস্তক থেকে বেশ অন্যরকম।’
এক এক করে সে তার জিনিসপত্র ব্যাগ থেকে বের করে। গুছিয়ে রাখে যথাস্থানে যত্ন করে। নিজের বাড়িটার কথা ভাবে; প্রতিটা ঘর কেমন ফুল আর পারিবারিক ছবিতে সাজানো। ভাবে তার বেচারা ভাইটার কথা! কী হাড়ভাঙা খাটুনিইনা খাটে অভাগা ভাইটা! ক্ষণিকের জন্য মনটা আচ্ছন্ন হয়ে যায় বিষণ্নতায়। অবশ্য ফ্রান্সে সে থাকবে মাত্র দিন কয়েক। তারপর শিগগিরই বাড়ি ফিরবে। যাকগে। রাতে একটা ভালো ঘুম দিতে হবে। এর আগে দরকার উষ্ণ জলে একটা ঝরঝরে গোসল।
দিনের জামা-কাপড় ছেড়ে পরে নেয় রাতের পোশাক। গোসলের জন্য দরকারি জিনিসপত্র হাতে লয়। বেড রুমের দরজাটা আলতো হাতে বন্ধ করে ওয়াশ কর্নারে যায়। শরীরটাকে এলিয়ে দেয় উষ্ণ জলের টবে। ভাবে, হোটেলের মেয়েটা গোসলের আয়োজনটা বেশ ভালোই করেছে। এ হোটেলের লোকগুলো সবাই বন্ধুবৎসল। সব সময় সাহায্য করতে প্রস্তুত। এখানের অনেক কিছুই তার ভালো লেগেছে। ভাবে, বাড়ি ফিরে ভাইকে সব বলবে আদিঅন্ত।
গোসলখানা থেকে বের হয়ে আবার রাতের পোশাক পরে নেয়। গোসলখানাটাকে বেশ ভালো করে পরিষ্কার করে। সে চায়না ফরাসীরা এমন ধারণা পোষণ করুক—যে ইংরেজরা খুব নোংরা। গোসলখানা ছেড়ে সে দ্রুত পায়ে হেঁটে ফিরে যায় তার বেডরুমে। আলো জ্বালায়। বন্ধ করে দেয় রুমের দরজা।
আর তক্ষুণি ঘটে হতচ্ছাড়া কাণ্ডটা : দরজার হেন্ডেলটা খট করে ছুটে চলে আসে তার হাতে। হাতলটাকে আবার দরজায় লাগিয়ে দিতে সে প্রাণপণ চেষ্টা করে। না, সব চেষ্টা বৃথা। গভীর ভাবনায় পড়ে যায় সে—‘এখন কী করি? দরজা খোলাইতো এখন ভারি মুশকিল! আমি কি ঐ মেয়েটাকেই ডাকব আমাকে সাহায্য করতে! কিন্তু, রাত-যে অনেক হয়েছে। মেয়েটা বোধ করি এতক্ষণে ঘুমিয়েও পড়েছে।’
দরজার কাছ থেকে খানিকটা দূরে সরতেই আচমকা চোখে পড়ে এমন কিছু, যা দরজার ভাঙা-হাতলের চেয়ে আরও অনেক বেশি মন্দের। তার বিছানায় শুয়ে আছে এক পুরুষ। নজর পড়ে লোকটার ঘন কালো চুল আর ইয়া মোটা গোঁফ জোড়ার দিকে। ভয়ে কুঁচকে যায় সে। আড়ষ্ট হয়ে আসে সারা শরীর। দু-এক মিনিটের জন্য যেন হারিয়ে ফেলে ভাববার সব ক্ষমতা। পরক্ষণেই সচেতন হয়। ভাবে, ‘এখন আমার চিৎকার-চেঁচামেচি করা চলবে না।’ দাঁড়িয়ে থাকে নির্বিকার। যেন অসাড় দেহ। ভাবলেশহীন। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে লোকটার কালো চুল ভর্তি মাথাটার দিকে আর চাদরে আধা ঢাকা ওপর হয়ে পড়ে থাকা বিশাল বপুর দিকে। ভাবতে থাকে গভীর ভাবনা।
এবার তার ভাবনায় আসে ভিন্নতা : ‘আমি কি ভুল কোনো কক্ষে চলে এলাম! এটা কি এ লোকটারই কক্ষ?’ চোখ ফিরিয়ে দেখে চেয়ারের উপর পড়ে আছে লোকটার কোট-প্যান্ট, মেঝেতে কালো রঙের মস্ত বড় জুতা জোড়া। না, আর দেরি নয়। এক্ষুণি বেরিয়ে যেতে হবে এ ঘর থেকে। কিন্তু কীভাবে? সে আবার দরজাটা খুলবার চেষ্টা করে তার আঙ্গুল ব্যবহার করে। না, তাতেও কোনো ফল হয় না।
হায়! এই তার অবস্থা। এখানে একটা পর-পুরুষের সঙ্গে এক কামরায় বন্দী হয়ে আছে এক ফরাসি জানানা! তার যে উপায় একটা বের করতে হবেই। আরও ভাবতে হবে। উপায় করতে হবেই হবে। ভাবে, হোটেলটার কমন ওয়াশ কর্নারই ঘটিয়েছে যত্তো বিপত্তি। এটাচ্ড ওয়াশ রুম থাকলে এমন অনর্থ ঘটতে পারত না। আনমনে সে ঢুকে পড়ত না অন্যের কামরায়।
বাতি নেভালে নিশ্চয়ই লোকটা জেগে যাবে না- এমনটা ভাবতে ভাবতে সে বাতির সুইসটা আলতো হাতে অফ করে দেয়। ভাবে, ‘আর কি উপায় করা যায়? সময়তো অনেক লেগে যাচ্ছে! লোকটা যদি জেগে যায়—তাহলে কী বিচ্ছিরি হবে ব্যাপারটা! সে তো আসল সমস্যাটা বুঝতে চাইবে না। শুধু এ লোকটা কেন, দুনিয়ার কেউই এ কাহিনীটাকে বিশ্বাস করবে না। ভাববে গুল, গাঁজাখুরি গল্প ফেঁদেছি আমি। বিলেতে হলে না হয় হতো। কিন্তু এখানে? না, কেউই বিশ্বাস করবে না। সুতরাং যে করেই হোক, এ কামরা থেকে বের হতেই হবে। আমি কি লোকটাকে জাগিয়ে সব বলব? নাকি চেঁচামেচি করব? নাকি ঐ মেয়েটাকেই ডাকব? আবার ভাবে—না, সেটা বোধকরি ঠিক হবে না। চেঁচামেচি করলে লোক জড়ো হবে বটে, তবে তারা এসে কী দেখতে পাবে? দেখবে এজিংস্তকের মিজ ব্রেসগার্ডল মধ্যরাতে একটা পর পুরুষের বেডরুমে। ছিঃ, কী লজ্জা, কী লজ্জা! কী দুরবস্থা হবে যখন এসব কথা স্বদেশে তার বন্ধুদের কানে যাবে! আচ্ছা! জানালা দিয়ে বের হবার চেষ্টা করলে কেমন হয়? আবার ভাবে, এই লোকটা যদি পায়ে ধরে টেনে আবার হিড়হিড় করে ওকে নামিয়ে আনে?
তক্ষুণি দরজার বাইরের পথে কেউ একজন দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে বলে মনে হয়। সে চিৎকার করে ডাকতে চাইল। কিন্তু না, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। পায়ের আওয়াজ দূরে মিলিয়ে গেল।
হঠাৎ তার মাথার আরেকটা বুদ্ধি এলো। এখন রাত প্রায় শেষ। সকাল হতে আর মাত্র ঘণ্টাখানেক বাকি। হতে পারে ঘুমন্ত লোকটা তেমন ভয়ানক কেউ নয়। সকাল সাত-আটটা নাগাদ লোকটা নিশ্চয়ই জাগবে, কাজে বেরোবে। ‘আর তখন আমিও কামরা থেকে বের হবার একটা মওকা পাব। এখন একটা কাজ করা যাক! খাটের নিচে লুকিয়ে থাকা যাক! সকালে লোকটা কামরা থেকে বেরোনোর সময় যখন দেখবে দরজার হাতল ভেঙে মেঝেতে পড়ে আছে, তখন হয় সে নিজে দরজা খোলার একটা ব্যবস্থা করবে, কিংবা ঐ মেয়েটাকে ডেকে আনবে। তখন আমি খাটের নিচ থেকে বের হব। আর পুরুষেরা কখনো পেছন ফিরে তাকায় না। লোকটা আমাকে দেখতে পাবে না। দরজাটা খোলা মাত্রই আমি চট করে বেরিয়ে শাঁ শাঁ করে নিজের কামরায় চলে যাব। কেউ টেরটিও পাবে না।’
এমন ভাবতে ভাবতে সে খাটের নিচে ঢুকে যায়। গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে খালি মেঝেতে। তার উপরে বিছানায় শুয়ে থাকা লোকটার ওদিক থেকে কোন সাড়াশব্দ কানে এলো না। তার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে তার বাড়ির নিজের চমৎকার ছিমছাম ধবধবে শাদা তুলতুলে বিছানাটা। আর তখনই শক্ত মেঝেটা প্রতি মুহূর্তে আরও পাথুরে মনে হতে থাকে। তার রুম নম্বরটা মনে করার চেষ্টা করে— একশ পনের? নাকি একশ ষোল? বরাবরই সে সংখ্যা মনে রাখার ব্যাপারে বড্ড আনাড়ি। শক্ত মেঝেতে শুয়ে শুয়ে ভাবে তার পাঠশালা জীবনের কথা, কত্তো মজার মজার জিনিস শিখেছে।
হঠাৎ তার বোধ হলো যেন হাঁচি আসছে। শত চেষ্টা করেও থামানো গেলে না। দীর্ঘ-গভীর-সশব্দ হাঁচি। ভাবে, ‘এবার সব শেষ। এক্ষুণি এই ফরাসি লোকটা লম্ফ মেরে নামবে বিছানা থেকে। আলো জ্বালাবে। এরপর খাটের নিচে তাকাবে, আর হিড়হিড় করে টেনে বের করে নেবে আমাকে। এরপর... এবং এরপর...। এরপর আমি কী করব? যদি সে আমার গায়ে হাত দেয় তাহলে আমি চেঁচামেচি করে লোক জড়ো করতে পারি। তবে ওরকম কিছু ঘটবার সুযোগ না দিয়ে এক্ষুণি বরং চেঁচিয়ে ওঠা ভালো। তা না হলে লোকটা আমার মুখ চেপে ধরে আমার চেঁচামেচিই বন্ধ করে দিতে পারে।’
কিন্তু তার মুখ থেকে যে কোনো আওয়াজই বেরুচ্ছে না। ভয়ে শরীর আড়ষ্ট, দাঁত-কপাটি। শুয়ে থাকে অনড়, শান্ত ভঙ্গিতে, কানখাড়া করে। ‘লোকটা কি ওর ঐ মোটা জুতোগুলো দিয়ে আমাকে মারবে? হতে পারে! কিছুই অসম্ভব নয়! না, সে রকম কিছু ঘটল না। কিন্তু মিজ ব্রেসগার্ডলের কাছে হঠাৎই অসহ্য হয়ে ওঠে শক্ত মেঝেটা। আর এক মুহূর্তও যেন তিষ্টুতে পারছে না। নাহ্। অসহ্য। তারচেয়ে বরং খাটের তল থেকে বের হয়ে লোকটাকে জাগিয়ে তার কাছে ঘটনার পুরো বিবরণ দেয়াই বোধ করি উত্তম কাজ হবে।’ শত খতরা সত্ত্বেও সে খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে এসে উঠে দাঁড়ায়। আলোটা জ্বালায়। বিছানার দিকে মুখ ফিরিয়ে যতটা সম্ভব দৃঢ়কণ্ঠে বলে, ‘মঁসিয়ে!’
না, কোনো সাড়াশব্দ নেই। লোকটার দিকে তাকিয়ে আবার ডাকে ‘মঁসিয়ে, ও মঁসিয়ে, শুনছেন!’ এবারও কোনো উত্তর এলো না। সে বিছানার কাছে আরও ঘেঁষে। লোকটার চুল আর গোঁফের রং কুচকুচে কালো দেখালেও ওর মুখায়ব বড্ড ফিকে-ফেকাসে। নিস্তেজ-বিবর্ণ। মুখটা হাঁ-করা; কিন্তু চোখ দুটো বুজা। তৃতীয়বারের মতো ঐ রাতে ভয়-আতঙ্কে মিজ ব্রেসগার্ডলের মরে যাওয়ার অবস্থা হয়। আচমকা তার পা-দুটো টলতে শুরু করে। যেন থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়বে। কারণ সে বুঝতে পারে বিছানায় পড়ে থাকা লোকটা আসলে মৃত। জীবনে এই প্রথম সে একটা মৃত লোকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। না, কোনোই সন্দেহ নেই যে লোকটা মৃত। কোনোই ভুল হচ্ছে না তার। মিজ ব্রেসগার্ডল কেবল মুখ ফুটে বলতে পারল—‘হি ইজ ডেড। হি ইজ ডেড।’
নিজের সমস্যাটা এখন তার কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং মৃত মানুষটার জন্যই সে এখন দুঃখ-ভারাক্রান্ত—যে কিনা এখানে হোটেলের কামরায় মরে পড়ে আছে সবার অলক্ষ্যে। আচমকা একটা আওয়াজে তার ভাবনা টুটে যায়। দরজার বাইরে কিছু জুতা রাখবার শব্দ—জুতা পলিশ করে রেখে যাচ্ছে ছেলেটা। ছেলেটার পায়ের আওয়াজ দ্রুতই মিলিয়ে যায়। আর সেও ভাবতে থাকে, ‘এখন আমি কোথায়!’
অপরিচিত কোনো পুরুষের শোবার ঘরে রাত কাটানো নিঃসন্দেহে একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার। কিন্তু তারও চেয়ে অনেক অনেক বাজে অবস্থা একটা মৃত লোকের সঙ্গে রাত কাটানো! লোকজন এসে এ অবস্থায় তাকে দেখলে নিশ্চয়ই ভাববে—এই মহিলাই লোকটার খুনি। ভাবতে ভাবতে তার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে একটা চিত্র : পুলিশ তাকে থানায় ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে, হাজতে তালাবদ্ধ করে রাখছে... তার বোন এসে হাজির হতে বেশ কয়েক ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে... ইত্যাদি ইত্যাদি।
না, এভাবে আর চলতে পারে না! চটজলদি একটা কিছু করতেই হবে। আর এক লহমা দেরি না করে বেরোতে হবে এ কামরা থেকে। ‘এমন অবস্থায় কাউকে সাহায্যের জন্য ডাকা ঠিক হবে না।’ ভয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে সে নিজেকে নিজে বলে, ‘একটা কিছু কর মিলিসেন্ট! এক্ষুণি না পারলে আর কক্ষনো পারবি না !’ কিন্তু কী করবে সে? কামরার ভিতর পায়চারী করতে থাকে পাগলের মতো। এদিক-ওদিক খোঁজে। যুৎসই কিছু একটা যদি পাওয়া যায় হাতের কাছে। না, দরজা খুলবার মতো তেমন উপযুক্ত কিচ্ছুই পেল না। শেষে লোকটার জেকেটটা তুলে নেয় হাতে। এটার ভিতরের পকেটে খুঁজে পায় ছোট্ট একটা চাকু। ছুরিটা দরজার পাশে গলিয়ে দেয়—ধীরে ধীরে সতর্ক হাতে। খট করে খুলে যায় দরজা। চট করে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে চায় কাল বিলম্ব না করে। কিন্তু তা না করে সে থামে। এদিক ওদিক উঁকি মেরে চায়। চোখ-কান খোলা রাখে। না, কেউ নেই কাছে পিঠে। ভয়ে ভয়ে পা-টিপে টিপে সন্তর্পণে কামরা থেকে বের হয়। দরজাটা চাপিয়ে দেয় ক্ষিপ্র হাতে। বাতাসের বেগে ছুটে যায় নিজের কামরার দিকে।
ধপাস করে শুয়ে পড়ে বিছানায়। ভয় কাটতে থাকে ধীরে ধীরে। যাক, ভালোয় ভালোয় সামলানো গেছে সব ঝুট-ঝামেলা! কিন্তু না, পিছু ছাড়ছে না সমস্যা। ভর করে আরেক জীবন্ত ভীতি। মৃত লোকটার কামরাতেই ফেলে এসেছে তার গোসলের সব জিনিসপত্র। ওগুলোর গায়ে লেখা রয়েছে তার নাম। ঐ কামরায় গিয়ে আবার ফিরে আসা প্রথমবারের চেয়ে আরও মুশকিলের। কিন্তু না গিয়ে-যে উপায়ও নেই! তার নামাঙ্কিত জিনিসপত্রকে ঐ কক্ষে ফেলে রাখা যায় না। ‘লোকজন এসে যদি ওগুলো সে কামরায় দেখে, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠবে—এগুলো সে কামরায় গেল কী করে? তখন তারা আমাকেই ঐ লোকটার খুনি ঠাওরাবে। কী সাংঘাতিক! ঐ কক্ষে ফিরে গিয়ে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে আসা ছাড়া আর-যে কোনো উপায়ই নেই।’
অগত্যা আবার সে ঐ কক্ষে যায়। বিছানার দিকে তাকায় না। নিজের জিনিসপত্র চটজলদি ব্যস্ত হাতে তুলে নিয়ে এক দৌড়ে ফিরে আসে নিজের কামরায়। যাক বাবা। সব বিপদ কেটে গেছে। এবার সারা শরীরে নেমে এসেছে রাজ্যের ক্লান্তি। শুয়ে পড়ে বাতি নিভিয়ে। অন্ধকারে চোখ বুজে শুয়ে থাকে। ভুলবার চেষ্টা করে বিচ্ছিরি ঘটনাটা। চেষ্টা করে ভয়কে জয় করার।
এগারোটা নাগাদ ঘুম ভাঙে। সূর্যের তেজ অনেক বেড়েছে আর রাতের ভীতিকর ঘটনাটাও ক্রমে মন থেকে মুছে যাচ্ছে। দিনের আলোয় রাতের সেই ব্যাপারটা বিশ্বাস করা কঠিন। ভয় সরিয়ে অন্যকিছু ভাববার চেষ্টা করছে সে।
শেষতক ঐ মেয়েটা আসে মিজ ব্রেসগার্ডলকে জাগাতে। তার চোখ-মুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। অস্থির কণ্ঠে বলে, ‘জানেন মাদাম! কী অনর্থ ঘটে গেছে কাল রাতে! একশ সতের নম্বর কামরার লোকটা আছে না—মারা গেছে। আমি যে আপনাকে এ খবরটা দিয়েছি, দয়া করে সেটা কাউকে বলবেন না যেন! ওখানে পুলিশ এসেছে, এসেছে ডাক্তার, নানান লোকজন।’
মিজ ব্রেসগার্ডল চুপ করে থাকে। কিচ্ছু বলে না। আসলে বলবার কীইবা আছে? কিন্তু মেয়েটার উৎসাহ-উত্তেজনায় ভাটা পড়ে না। বলেই চলে সে—‘জানেন মাদাম, ঐ মৃত লোকটা কে? লোকজন বলাবলি করছে, ঐ লোকটার নাম নাকি বোলধু—কুখ্যাত খুনি, দাগি ফেরারি আসামি। পুলিশ তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। গত বছর নাকি এক মহিলাকে খুন করে টুকরা টুকরা করে কেটে নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল সে। আর গত রাতে সেই খুনিটা মারা গেল—এই হোটেলে—এই যে পাশেরই কামরায়! তবে কীভাবে মারা গেল— সেটা কেউ জানে না। আপনাকে কফি দেব মাদাম?’
—‘না, ধন্যবাদ তোমাকে। শুধু এক কাপ চা— কড়া করে, কেমন?’
—‘ঠিক আছে মাদাম।’