অবন্তী, এই অবন্তী!
নীলিমা বাইরে থেকে রুমে এসেই অবন্তীকে ডাকে। এরমধ্যে বেশ কয়েকবার সে অবন্তীকে ডেকেছে। কিন্তু সাড়া পাচ্ছে না। অবন্তী বারান্দায় চুপচাপ বসে আছে। তার মন খারাপ। কিছুই ভালো লাগছে না। কথা বলতেও ইচ্ছা করছে না। আজ তার দৈনন্দিন রুটিনের ব্যত্যয় ঘটেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে সে সাধারণত হাতমুখ ধুয়ে নাশতা করার জন্য ক্যান্টিনে যায়। সকালে ক্লাস থাকলে নাশতা শেষ করে রুমে এসেই রেডি হয়। তারপর ক্লাসে যায়।
আজ অবন্তী এসব কিছুই করেনি। অনেকক্ষণ একা বারান্দায় বসেছিল। রুমে ফিরে এসে গান ছেড়ে সঙ্গে সঙ্গেই তা আবার বন্ধ করে দেয়। ইংরেজি গান এখন শুনলেই তার মাথা গরম হয়ে যায়। পত্রিকা হাতে নিয়ে সে নিজের বিছানার এক কোণায় গিয়ে বসে। পত্রিকার পাতায় চোখ বুলায়। হেডলাইনগুলো দেখে আবার রেখে দেয়। এবার সে তার পড়ার টেবিলের সামনে গিয়ে বসে। বই হাতে নেয়। বিরক্তির সঙ্গে বইটি রাখে। তারপর আবার বারান্দায় গিয়ে বসে থাকে।অবন্তী টেক্সাস ইউনিভার্সিতে পড়ে। হোস্টেলে নীলিমার সঙ্গে রুম শেয়ার করে থাকে সে। নীলিমা জন্মসূত্রে আমেরিকান। ওর মা বাবা বাংলাদেশি। সেই সুবাদে বাংলায় কেবল কথা বলতে জানে। এতেই খুশি অবন্তী। অন্তত দম ফেলার একটা উইনডো তো পেল! এতেই সে খুশি।
নীলিমা আবারও অবন্তীকে ডাকে। অবন্তী শুনছিস?
অবন্তী বিরক্তির সঙ্গে বলে, কেন, কি হয়েছে?
তোকে এতো করে ডাকছি; তুই আমার ডাকে সাড়াই দিচ্ছিস না! তোর কি হয়েছে বল তো?
কিছু হয়নি। আমার কিছুই ভালো লাগছে না।
কেন?
এমনি।
এটা কেমন কথা? কোনো কারণ নেই! অথচ তোর ভালো লাগছে না!
ভালো না লাগলে আমি কী করব!
নীলিমা এবার অবন্তীর কাছে গিয়ে বসে। তারপর নরম সুরে বলে, তুই মন খারাপ করে বসে থাকলে আমার খুব অস্থির লাগে। প্লিজ, আমাকে বল না তোর কি হয়েছে?
এখানে আমার আর ভালো লাগছে না।
কেন?
সারাক্ষণ ইংরেজিতে কথা বলা, ইংরেজিতে লেকচার শোনা, ইংরেজি গান শোনা বড় বিরক্ত লাগছে।
সে কী! তুই তো ছোটবেলা থেকেই ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িস। ছোট সময় থেকে ইংরেজি গান শুনিস। গল্প-উপন্যাস পড়িস। তোর তো খারাপ লাগার কথা না! হঠাৎ কি হয়েছে তোর?
আমার কেন জানি এসব ভালো লাগছে না।
এটা কেমন কথা?
ভালো না লাগলে আমি কি করব?
রহস্যজনক ব্যাপার তো!
কোনোই রহস্যজনক ব্যাপার না।
তাহলে তোর এ রকম হবে কেন?
বারে! হতে পারে না!
না। এটা কোনো স্বাভাবিক ব্যাপার না।
তাহলে কি? কি বলতে চাও তুমি? আমি অস্বাভাবিক আচরণ করছি? আমার মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে!
আমি কি তা বলেছি?
তোর কথা শুনে সে রকমই তো মনে হচ্ছে।
না। সে রকম মনে করার কোনো কারণ নেই। যে তুই সেই তিন বছর বয়স থেকে ইংরেজি স্কুলে পড়ছিস। ইংরেজিতে কথা বলছিস। গান শুনছিস। ইংরেজিই হয়ে গেছে তোর জ্ঞানার্জনের মূল ভিত্তি। তাছাড়া ইংরেজি এখন শুধু ভাষা নয়; এটা এখন একটা কমোডিটি। এই ভাষা না জানলে তুই আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যহীন। তোর কোনো কদর থাকবে না।
সেটা আমি জানি। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয়, আমি আমার মাতৃভাষাকে অবহেলা করছি। যথাযথ মর্যাদা দিচ্ছি না।
সেটা তোর নিজস্ব ব্যাপার। তোকে তো কেউ মানা করেনি।
তা করেনি।
তাহলে!
আমার আসলে এই দেশে আর থাকতে ইচ্ছা করছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। দেশে চলে যেতে ইচ্ছা করছে।
এসব তুই কি বলিস! সত্যি বলছি, আমার একদম মন টিকছে না।
দেশে ফিরে গেলে তোর পড়াশুনার কি হবে?
দেশের কোনো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যাবো।
পাগলামি করিস না তো! তোর কি হয়েছে আমাকে খুলে বল।
আমার এখানে আর থাকতে ইচ্ছা করছে না। চারদিক থেকে আমার মাথায় চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। এতো চাপ আমি নিতে পারছি না।
কিসের চাপ?
এই দেশের ভাষা, শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি আমাকে গ্রাস করছে। আমি আমার নিজের ভাষা হারিয়ে ফেলছি। নিজের সংস্কৃতির কথা ভুলে যাচ্ছি। আমাদের শিল্প-সাহিত্যকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছি। আমার মনে হয়, আমি নিজের সঙ্গে অন্যায় করছি। নিজেকে ঠকাচ্ছি। আমি জেনে শুনে এটা করতে পারি না।
নীলিমা চুপ করে আছে। হঠাৎ অবন্তীর বদলে যাওয়া কথাবার্তা শুনে অবাক বিস্ময়ে ওকে দেখছে। কিছুক্ষণ পর অবন্তী বলল, কি ওমন করে কি দেখছ?
তোকে দেখছি। তোর বদলে যাওয়া দেখছি। তোর মুখে এমন ধরনের কথা শুনব তা কোনো দিন চিন্তাও করিনি।
তোর মাথায় এ ধরনের কথা কি কেউ ঢুকিয়েছে?
আমি কি ছোট্ট খুকি যে, কেউ কিছু মাথায় ঢুকাবে আর আমি সেই কথা শুনে নাচতে থাকব?
তাহলে এই চিন্তা তোর মাথায় কেন আসবে?
কেন আসবে? তাহলে তোমাকে একটা প্রশ্ন করি? তুমি কি এই গানটা শুনেছ?
কোন গানটা?
‘ও আমার বাংলা মা তোর আকুল করা,
রূপের সুধায় হৃদয় আমার যায় জুড়িয়ে’!
না, শুনিনি।
এই গান শোননি!
না।
সে কী!
সত্যি বলছি।
তাহলে তুমি কিছুই বুঝবে না।
মানে!
বাংলা ভাষার মর্ম বোঝার জন্যও এ ধরনের কিছু গান শুনতে হয়। তুমি আজ এই গানটা একশ’বার শুনবে। তা না হলে তোমার সঙ্গে কোনো কথা নেই।
অবন্তী!
হুম। আমি যা বলছি তা কর। এই গান না শুনলে তুমি বাংলার মর্ম বুঝবে না। তাছাড়া শুধু মুখে মুখে বাঙালি হলে চলবে না। বাংলা চর্চা করতে হবে। বাংলা সংস্কৃতিকে বুকে ধারণ করতে হবে।
তোর কি ধারনা আমি বাংলা ভালোবাসি না?
হুম।
হুম কি?
তুই বাংলা ভালোবাসিস না। তুই আমেরিকান হিসেবে পরিচিতি পেতেই বেশি পছন্দ করিস।
এটা তোর ভুল ধারণা।
কেন ভুল ধারণা হবে?
আমি তো অনেক দিন ধরে তোমার সঙ্গে আছি; তাই না?
হুম।
বাংলার প্রতি তোর কোনো টান আছে কিনা তা বুঝিনি। শুধু ভাষা জানাই কি সব! আরও অনেক ব্যাপার আছে; বুঝতে পারছিস? তাছাড়া কোনো দিন দেখিনি, তুই একটা বাংলা গান শুনছিস। একটা কবিতা পড়ছিস। কিংবা কোনো গল্প, উপন্যাস। কিছুই না। বাংলার মর্ম তুই কি করে বুঝবি? এর প্রতি মমত্ববোধ কি করে জন্মাবে?
দেখ, আমার জন্ম আমেরিকায়। বাংলা তো আমি কোনো দিন পড়িনি। মা বাবা যেহেতু বাঙালি তাই ভাষাটা শিখতে পেরেছিলাম। কিন্তু বাংলা পড়া তো দূরে থাক; বাংলা বর্ণমালা চেনার সুযোগও পাইনি।
সে কী কথা!
হুম। সত্যি বলছি। আমি বাংলা বলতে পারি ঠিকই। কিন্তু পড়তে পারি না। বাংলা বর্ণমালা কেমন তাও জানি না।
হায় রে কপাল!
তুই যতই আপসোস করিস, আমার কিছুই করার নেই। মা বাবা না শেখালে আমি কি করে শিখব? এখানে কোনো স্কুলে শেখার সুযোগ ছিল?
তারা কি কখনো বাংলাদেশে যাননি?
হয়তো আমার জন্মের আগে গিয়েছিলেন। আমি বড় হয়ে কোনো দিন দেখিনি। আমিও বাংলাদেশ দেখার সুযোগ পাইনি।
ওহ! তাই?
হুম। শুধু শুধু তুই আমার ওপর রাগ করেছিস! আমি তো ছোট ছিলাম। মা বাবা তো আমাকে বর্ণমালাগুলো শেখাতে পারতেন! পারতেন না?
হুম, পারতেন।
তাহলে তো আমি বাংলা ভাষায় কবিতা, গল্প, উপন্যাস পড়তে পারতাম।
ঠিক আছে; এবার বাড়ি গেলে আমি তোর জন্য বাংলা বর্ণমালার একটা বই নিয়ে আসব। তারপর তোকে বর্ণমালা শেখাবো। তখন তুই বাংলা পড়তে পারবে।
সত্যি! সত্যি নিয়ে আসবি?
সত্যি নিয়ে আসব। তবে, আরেকটা কাজ তুই করতে পারবি।
কি?
তুই আমার সঙ্গে দেশে চল। যদি একবার বাংলাদেশ দেখিস তাহলে জীবনানন্দ দাশের কবিতাটা বার বার মনে করবি।
কবিতাটা কি?
‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি
তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে চাই না আর।’
বাহ! এতো সুন্দর কবিতা!
তাহলে বোঝ কত কিছু জানার আছে তোর? চল, আমার সঙ্গে বাংলাদেশে যাবি।
বাংলাদেশে! এখন!
হুম। কি অসুবিধা? আমাদের ক্লাস তো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে!
মা বাবা প্লান করেছে, ইউরোপ ট্যুরে যাবে।
আরে রাখ তোর ইউরোপ ট্যুর! তুই আমার সঙ্গে দেশে চল।
মা বাবা যেতে দেবেন?
নীলিমা আপু, তুই যথেষ্ট বড় হয়েছিস। আর তুই তো কোনো ছেলে বন্ধুর সঙ্গে যাচ্ছিস না! তুই যাচ্ছিস তোর বান্ধবীর সঙ্গে। সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গে।
তা ঠিক আছে। কিন্তু মা বাবাকে তো আমি খুব একটা কাছে পাই না; তাই না?
বুঝতে পারছি। তোর যেতে হবে না। তুই ইউরোপই যা!
প্লিজ রাগ করিস না!
আমি কাল টিকিট কাটতে যাব। আমি হয়তো আর আসব না। তোর সঙ্গে আজকের দিনটাই শেষ দিন!
পাগলামি করিস না তো! তুই দেশে যা। তোকে আমি মানা করব না। কয়েক দিন থেকে আয়।
তুই আর কথা বলিস না তো! তোর সঙ্গে আমার কথা বলতেই ইচ্ছা করছে না। তোর কোনো কমিটমেন্ট নেই। না দেশের প্রতি, না ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি। শুধু বাংলায় কথা বলতে পারাই বড় কথা না।
সরি। সরি অবন্তী। এবার থাম। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি ইউরোপ যাব না। মা বাবা হাজার বললেও না। আমি তোর সঙ্গে দেশে যাব। সত্যি সত্যি যাব।
অবন্তী নীলিমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার দিয়ে বলল, সত্যি! সত্যি তুই আমার সঙ্গে যাবি?
সত্যিই তোর সঙ্গে যাব। আমি তোর কাছে বাংলা বর্ণমালা শিখব। তারপর পড়তে এবং লিখতে শিখব। আমাকে শিখতেই হবে।
এই তো! তুই সত্যিই আমার প্রকৃত বন্ধু।
তুই দুটি টিকিট কাট। আমাদের ক্লাস তো দুই মাসের জন্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই সময়টা আমরা ঢাকায় কাটাই।
সিওর! খুব ভালো হলো। আমি এটাই চেয়েছিলাম। তোকে বাংলা শেখাব। নিজের মায়ের ভাষাই যদি না জানিস তাহলে ইংরেজি ফিংরেজি জেনে কি হবে?
ঠিক বলেছিস। মা বাবা কেন যে আমাকে বাংলা শেখাননি! আসলে এখানে বাংলা শেখার সুযোগই পাইনি। এবার তোর বদৌলতে যদি শেখা হয়। আর শোন, আমাকে লেখাও শিখাবি!
অবশ্যই। তারপর দেখা যাবে তুই গল্প উপন্যাসও লিখে ফেলছিস!
হুম। অবাস্তব কিছু না। আচ্ছা শোন, আমার এখন একটা ক্লাস আছে। আমি যাই।
এখন মানে কয়টায়?
এই তো, আর এক ঘণ্টা পর।
আমিও যাব চল।
তুই কোথায় যাবি?
আমি দুটো টিকিট বুকিং দিয়ে আসি।
রিয়েলি!
হুম।
গ্রেট!
মনের আনন্দে বাইরে বের হয় অবন্তী ও নীলিমা।
বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেই নীলিমা অবন্তীকে বলে, তোর সবচেয়ে প্রিয় গানটা যেন কি?
অবন্তী কিছু না বলে সরাসরি গাইতে শুরু করে।
‘বাংলার মাটি বাংলার জল
বাংলার বায়ু বাংলার ফল
পুণ্য হোক পুণ্য হোক পূণ্য হোক হে ভগবান।
বাংলার ঘর বাংলার হাট
বাংলার বন বাংলার মাঠ
পূর্ণ হোক পূর্ণ হোক হে ভগবান।
বাঙালি পথ বাঙালির আশা
বাঙালির কাজ বাঙালির ভাষা
সত্য হোক সত্য হোক সত্য হে ভগবান।
অবন্তীর গান শুনে নীলিমার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়তে থাকে। অবন্তী নীলিমার কাছে আসে। তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে, কিরে! তোর আবার কি হলো!
গানটা সত্যিই খুব টাচি!
সত্যি তোর ভালো লেগেছে?
হুম।
এখানেই শেষ না। দুই মাস থাক। তারপর বুঝবি।
আমার বোঝা হয়ে গেছে। আমি কি না বুঝেই তোর সঙ্গে দেশে এসেছি!
অবন্তী ভীষণ খুশি। খুশিতে সে নীলিমার ঘাড়ের ওপর হাত রাখে। তারপর বাসার উদ্দেশ্য রওয়ানা হয়।
হঠাৎ অবন্তী দেখে ওর মা বাবা বিস্মিত। তাদের কাছে আগে কিছু না বলে সে ঢাকায় চলে আসবে এটা তারা ভাবতেই পারেননি। যাহোক, অবন্তীকে পেয়ে তারা ভীষণ খুশি। আর নীলিমার কথা শুনে তারা কেবল খুশিই হলেন না; বিস্মিতও। নীলিমা বাংলা শেখার জন্য দেশে এসেছে এটা শুনলে কার না ভালো লাগে।
বাংলা বর্ণমালার বই কেনার জন্য নীলিমা বিমান বন্দর থেকেই অবন্তীকে তাড়া করছিল। অবন্তী বাসায় এসে কিছু না খেয়েই ওকে নিয়ে বের হলো। বইয়ের দোকান থেকে বই কিনল। তারপর অবন্তীর কাছে শুরু হলো নীলিমার বর্ণমালা শেখা। শিশুর মতো করে অবন্তী নীলিমাকে বর্ণমালা শেখাচ্ছে। খুব দ্রুতই নীলিমা বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিত হলো। তারপর নীলিমার হাত ধরে লেখা শেখায় অবন্তী।
বাংলা শেখার জন্য নীলিমার গভীর আগ্রহ অবন্তীকে দারুণভাবে মুগ্ধ করে। ধীরে ধীরে নীলিমা বাংলা পড়া এবং লেখা দুটোই শিখে ফেলে। তারপর তার আনন্দ আর কে দেখে!