শুক্রবার, ১৪ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

কেরামত কুতুবের হালখাতা

গল্প ♦ মোহাম্মদ ইরফান

কেরামত কুতুবের হালখাতা

পুলিশ লাইনের শুটিং রেঞ্জে উৎসবের আমেজ আজ। উৎসব মাঠজুড়ে। মেলা বসেছে, বৈশাখী মেলা। গান হচ্ছে, বাজনা হচ্ছে। চলছে খাওয়া-দাওয়া। মিঠাই, ফুসকা, আচার, ভাজার রসালো মিশেল গন্ধ খিদের জোগান দিচ্ছে পরিপূর্ণ উদরেও। চুড়ি, গয়না, বাঁশের বাঁশি, মাটির পুতুলের পসরা সাজিয়ে বসা দোকানির সুরে-বেসুরে হাঁকডাক ক্রেতার নিরলস দরদামে বিফল প্রায়শ। মেলাপ্রাঙ্গণ মুখরিত তবু সুখি মানুষের আনাগোনা পদচারণায়।    

তবে মাঠের একপাশে সাদা একটি শামিয়ানার নিচে ওরা কারা? রূপে-রঙ্গে, রসে-রবে বৈচিত্র্যময় এই উৎসবে একটু যেন বেমানান এরা। শামিয়ানা দেওয়া জায়গাটুকুর মাঝখানটায় পেতে রাখা দু-তিনটি কাঠের বেঞ্চে বসে আছে সাদা পোশাক পরা একদল লোক। চিন্তার ছাপ এদের অধিকাংশের চোখেমুখে। প্যান্ডেলের একধারে পুরনো ধাঁচের একটি টেবিলের ওপর লাল ফিতা আর খাকি কাগজে মোড়ানো খাতাপত্র। টেবিল আর বেঞ্চগুলোর মাঝামাঝি পাতা সুদৃশ্য, ভারী আরও একটি চেয়ার। বিশেষ এই আসনটি অপেক্ষায় আছে যেন বিশেষ কোনো আসীনের। খাতাপত্র বহনকারী টেবিলের পেছনে সাধারণ মানের দুটো চেয়ারে বসে দুজন ভদ্রলোক। সামনে রাখা নামফলক দুটো মেলার মাঠের আলগা ধুলায় আবছা। কোনোমতে পড়া যাচ্ছে নামদুটো।

প্রথমজন কেরামত রকিব। জেলা দুর্নীতি পরিদর্শক। জেলা সদরে কাজ করা অন্যান্য কেরামত থেকে পৃথক করার জন্য লোকে তাকে ডাকে দুর্নীতি কেরামত। বিশেষ এই  উপাধির বিশেষণটিতে ‘র’ প্রত্যয়ও যুক্ত করে কেউ কেউ। কখনো অনিচ্ছায় কখনোবা সাগ্রহ শ্লেষে। এই আজও যেমন। নামফলকের শেষ পদের ‘পরি’ উপসর্গ অন্য সব পদের চেয়ে একটু বেশিই যেন ঢাকা পড়েছে। দুষ্টজনের এহেন হীন কাণ্ড কেরামতের গোচরে আসে না,  কিংবা গ্রাহ্যে। 

দ্বিতীয় ভদ্রলোক কুতুব আলী। কেরামতের টুআইসি। সহকারী পরিদর্শক। দুর্নীতির ছোটকর্তা। গায়ে-গতরে বড়সড়ো হওয়ায় নিকটজনরা তাকে ডাকে বড় কুতুব।” ছোট কত্তার চেয়েও বড় কুতুব নামটিই যে তার বেশি পছন্দের এ কথা আকারে-ইঙ্গিতে অফিসের লোকদের জানাতে ভোলে না কুতুব।  

দুর্নীতি দমনের ছোট্ট অফিসটি জেলা সদরেই। পরিবার পরিকল্পনার ক্লিনিক ছিল একসময়ে। পরিকল্পনাওয়ালারা দাতাদেশের টাকায় বানানো ঝকঝকে নতুন অফিসে উঠে গেলে দুর্নীতির লোকজনকে এই অফিস দেওয়া হয়। ডিসি অফিসের  গুদামঘরের তুলনায় এই নতুন অফিস অনেকটা খোলামেলা। একটিই শুধু অসুবিধা। কর্মকর্তাদের বসার মতো আলাদা কামরা এতে কেবল একটি। সবেধন নীলমণি সেই কামরার মাঝখানে আলগা পার্টিশন। ডানদিকে বসেন কেরামত, বাঁয়ে কুতুব। কেরামতের চেয়ারের পেছনে ঝোলানো তোয়ালে লম্বায় বড়। বড় কুতুবের সামনের টেবিল আয়তনে ছোট খানিকটা কেরামতেরটির তুলনায়। লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা খাকি মলাটের নথির স্তূপ দুই টেবিলেই। কেরমাতের নথিস্তূপের ভার বইছে পুরু কাচের পাত, কুতুবের টেবিল মোড়া রেক্সিনে। সযত্নে ছড়িয়ে রাখা এসব উচ্চতর চিহ্নেও সব সময় মন ভরে না কেরামতের। পুরনো ইতিহাস মনে পড়ে গেলেই বিনা কারণে হাঁক দিয়ে ওঠেন, আক্কাস, আক্কাস।

জুনিয়র কলিগের সঙ্গে একই অফিস ঘরে বসতে যথেষ্ট আপত্তি ছিল কেরামতের। কুতুবের জায়গা হয়েছিল শুরুতে তাই কেরানিদের বড় ঘরের এক কোণে। পূর্ত বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলীর সম্পত্তি বিবরণীর নথি আলোর গতিতে নিষ্পত্তি করে দেওয়ার বিনিময়ে কোনার জায়গাটুকুতে সিমেন্টের আধাআধি দেয়াল তুলে দিয়েছিল পূর্তের ঠিকাদাররা। সে যাত্রায় পদমর্যাদা রক্ষা হয়েছিল কুতুবের। কুতুবের বাড়বাড়তি থেমে থাকেনি ওই টুকুতেই। দেয়াল তোলার দুমাসের মধ্যে কেরানি কর্নার থেকে কর্মকর্তা কক্ষে উত্তরণ ঘটে তার। যাকে পটিয়ে এই কুদরতি কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল কুতুব, তার নামটিও কুদরত।

কুদরতে এলাহী সাহেব। দুর্নীতি বিভাগের সর্বোচ্চ কর্তার পদে উন্নীত হয়েই এ জেলায় সফরে এসেছিলেন। মাঠ পরিদর্শনের জন্য নিজ এলাকার প্রতি পক্ষপাত থাকে এ ধরনের বড় কর্তাদের। প্রভু জীবনের সমাপ্তি আসন্ন জেনে তাড়াতাড়ি আমি তোমাদেরই লোক হওয়ার প্রয়াস চলে প্রজাতন্ত্রের খরচে। আগে থেকে খবর ছিল কুদরত সাহেব পরিবার নিয়ে আসছেন। কুদরতের একটিই বাচ্চা, ফর্সা গোলগাল একটি ছেলে, বছর দশ/বারোর। পূর্তের বাংলোয় কুদরত সাহেবের গাড়ি এসে থামতেই দৌড়ে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে বারো বছরের সেই ছেলেকে কোলে তুলে নেয় কুতুব। ছেলেটিও বেশ মজা পায় এতে। কুতুবের প্রায় ঘাড়ে চড়েই  সফরের বাকি সময়টা কাটায় বালককর্তা। ফিরে যাওয়ার আগের রাতে এলাহী খানার আয়োজন হয় এলাহী পরিবারের জন্য। কুদরতের স্ত্রী বাংলোর বাবুর্চিদের তৈরি  বিরিয়ানি শেষ করে দই পাতে কেরামতকে ইশারায় ডাকেন। ডিনারের তদারকিতে শশব্যস্ত কেরামত সবকিছু থামিয়ে দৌড়ে কর্তা-ভাবীর সামনে এসে দাঁড়াতেই মিসেস এলাহী মৃদু আওয়াজে ধীরলয়ে কিছুটা স্নেহ স্নেহ ভাব নিয়ে ছোট্ট একটা ফরমান জারি করেন, ছেলেটাকে কেরানি-ফেরানিদের সঙ্গে ফেলে রেখেছেন কেন? আপনার ঘরে নিয়ে আসুন। দুজনে একসঙ্গে বসলে কাজে-কর্মেও সুবিধা হবে।”

ফিরে যাওয়ার আগে এলাহী সাহেবও একটি ফরমান জারি করে গেছেন। নববর্ষ ফরমান। বাংলা নববর্ষের আগেই জেলা থেকে দুর্নীতি ঝেঁটিয়ে দূর করতে হবে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা দুর্নীতি, দুরাচার দূর করার জেহাদ শুরু হবে এলাহী সাহেবের নিজ জেলা সফেদপুর থেকে। চলতি সাল শেষ হওয়ার আগেই এ উদ্দেশ্য হাসিল করতে হবে, যেকোনো মূল্যে।

চিন্তায় পড়ে গেলেন কেরামত কুতুব। কী করে এ অসাধ্য সাধন করা যায়? বৈঠক হলো দফায় দফায়। সাহায্য সংস্থার জেলা ব্যবস্থাপকরা সাদা পাজেরোতে চেপে এসে দুর্নীতির ক্যাপাসিটি বাড়ানোর চেষ্টা করলেন। জেলার তাবৎ গুণীজনও এলেন। ঘুষের আর্থ-সামাজিক প্রভাব নিরূপণে কৌটিল্য কোট করলেন অধ্যাপকরা। উপরি হিসেবে কাটারিভোগের কাটতি নিয়ে সরস আলাপে মাতালেন ব্যবসাজীবীরা। ঘন ঘন চা-হিসঙ্গাড়ার জোগান দিতে গিয়ে হিমশিম খেল আক্কাস। দুর্নীতির ময়লা দূর হবে কী, বরঞ্চ কেরামত-কুতুবের টেবিলের ফাইলের স্তূপ উঁচু হতে হতে  ছাদ ছুঁয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিল। জমা হওয়া ফাইলের তদবিরানদের খবরদারির দায়িত্ব পেয়ে আফসোস কিছুটা কমল আক্কাসের। বকশিশে খুশি না করে দিলে আক্কাসের হুঙ্কার শোনে লোকজন, আমলনামা, আমলনামা। কাজের শেষে ফল-ফলারি কিনে বাড়ি ফিরে আজকাল আক্কাস। গুনগুন করে বায়োস্কোপের গানও ধরে কোনো কোনো দিন— ‘দুই কান্ধে দুই মুহুরি, লিখতে আছেন ডায়েরি’”

বুদ্ধি একটা বের হলো শেষমেশ। জেলা স্কুলের গানের মাস্টারের মাথা থেকে। মাস্টারবাবু শৌখিন লোক। দু-তিন পুরুষ আগে জমিদার ছিলেন তার পূর্বপুরুষরা, নিদেনপক্ষে সেরেস্তাদার বড় কোনো জমিদারির। সরকারি স্কুলের বাইরেও তার নিজের গানের স্কুল আছে। জেলার বড় বড় অফিসার, ব্যবসাদার, বিশিষ্টজনের ছেলেমেয়েরা গান শিখে সেই স্কুলে। সপ্তাহান্তের ছুটির দিনে পুলিশ লাইনের পাশের শুটিং রেঞ্জে বন্দুক চালাতে যান মাস্টার সাহেব, জমিদারি নেশা রক্তে তার আজও। হাতের টিপও বেশ। শুটিং ক্লাবে সমীহপূর্ণ রসিকতায় ভরা একটি খেতাব পেয়েছেন এই সুবাদে—গানের মাস্টার টু দ্য পাওয়ার টু।

মাস্টার মশায়ের প্রস্তাব—একটি নিরপেক্ষ প্রস্তাব। তিরস্কার-পুরস্কার, ভীতি-প্রীতি, শাস্তি-প্রশস্তি সবই আছে এতে। মসজিদের মোল্লা, মন্দিরের পুরোহিত, গির্জার ফাদার, মঠের মোহান্ত সবাই সায় দিয়েছেন এই মহৎ ক্ষমাশীল প্রস্তাবে। প্রস্তাবনায় মুগ্ধ সুধীজনরা বলছেন, এটি একটি ইনক্লুসিভ সেক্যুলার সমাধান। জেলার প্রগতিপন্থিদের ভাষায়, অ্যা রিয়েল ডায়ালেক্টিক সল্যুশন। এমনকি জেলা সদরের অদূরে অবস্থিত সেনানিবাসের কমান্ডারও নাকি পাইপে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ইরশাদ করেছেন—ওয়ান্ডারফুল! আই লাইক দ্য এক্সিট স্ট্রাটেজি।

প্রস্তাবটি খুবই সরল। বাংলা নববর্ষের পূর্বপ্রহরে শেষ সুযোগ দেওয়া হবে দুঃশীলদের সবাইকে।  শুটিং রেঞ্জের মাঠের ঠিক মাঝখানটায় মাটি কেটে বড় একটা গর্ত তৈরি করা হবে। চৈত্রের শেষ রাতে রাতের নিকষ কালো আঁধারে রাতের শেষপ্রহরের আগেই যে যার দুর্নীতির খতিয়ান কাগজে লিখে বস্তায় ভরে ওই গর্তে ফেলে রেখে যাবে। যারা যারা অতীব সততা সহকারে নিজেদের দুর্নীতিনামা তুলে  ধরবেন নববর্ষের নতুন ভোরে তাদের দায়মুক্ত করা হবে এবারের মতো। আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজরা ক্ষমা চাইবেন শুটিং রেঞ্জে সমবেত জেলার জনতার কাছে। তাদের ধিক্কার না দিয়ে নতুন করে জীবনের, কর্মের হালখাতা খোলার সুযোগ দেবে লোকজন। শর্ত একটাই, সমস্ত দুষ্কর্মের বর্ণনা দিতে হবে, পুঙ্খানুপুঙ্খ আন্তরিক বর্ণনা।

প্রস্তাবে বড় রকমের আপত্তি করেন কর বিভাগের কর্মকর্তারা। কী করে বোঝা যাবে দুর্নীতির বিবরণ সঠিক? আপত্তি যথার্থ বলেই মনে হয় শুরুতে। এমনও তো হতে পারে দাগীদের কেউ কেউ ছোটখাটো চুরির খতিয়ান দাখিল করে পুকুর চুরি জায়েজ করে নেবে।   

আবারও সমাধান দেন গানের মাস্টার। সমাধানটি কী? কেরামত, কুতুব প্রয়োজনীয় তদন্ত সেরে সমস্ত ফাইল চূড়ান্ত করে নথিগুলো সঙ্গে নিয়ে চলে আসবে মাঠে সকাল ৬টায়। মাঠের গর্ত থেকে বস্তাগুলো নিয়ে আসা হবে তাদের সামনে। এক একটা বস্তা খোলা হবে আর কেরামত-কুতুবের কাছে রাখা ফাইলের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে বস্তার ভিতরে থাকা স্বীকারোক্তি। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আনীত সবচেয়ে বড় তিনটি অভিযোগের দুটোর ব্যাপারেও যদি তার ক্ষমা প্রার্থনা বা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা থাকে তবে বস্তাসহ নথিগুলো ছুড়ে ফেলা হবে গর্তে। ৬ ঘণ্টা ধরে চলবে এ কাজ।

দুপুর ১২টায় বৈশাখের গনগনে গরম সূর্য যখন মাথার ওপরে ঠিক সেই মুহূর্তে তিনটে কাজ পরপর করা হবে। গর্তে রাখা সব নথিতে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হবে সব রেকর্ড। আগুনের তাপে পুরনো সব জঞ্জাল যখন পুড়তে থাকবে ঠিক সে মুহূর্তে আপাদমস্তক সাদা পোশাক গায়ে দিয়ে জনতার সামনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে সদ্য সাবেক দুর্নীতিবাজরা। হাত তুলে প্রতিজ্ঞা করবে, এই জীবনে আর কোনো দিন চুরি ছ্যাঁচড়ামি করবে না, কাউকে ঠকাবে না, কারও জমি-বাড়ি দখল করবে না, চাকরি দেওয়ার মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে কারও টাকা খসাবে না।

তিন নম্বর কাজটি সবচেয়ে জটিল কাজ। যেসব নথি থেকে যাবে ৬ ঘণ্টার নিরীক্ষা শেষে, যে কটির সঙ্গে মিল পাওয়া যাবে না বস্তাভর্তি স্বীকারোক্তির সেসব নথিভুক্ত দুর্নীতিবাজদের এক এক করে ডেকে এনে কালো কাপড়ে মাথা মুখ ঢেকে নিয়ে যাওয়া হবে ফায়ারিং রেঞ্জে। গানের মাস্টারের হাতে তুলে দেওয়া হবে তার সবচেয়ে প্রিয় অস্ত্রটি।

আজ সেই দিন। নববর্ষের সকাল। রংবেরংয়ের বাহারি পোশাক পরে সবাই হাজির হয়েছে শুটিংয়ের মাঠে। বাচ্চাদের সঙ্গে আনতে নিষেধ করা হয়েছিল এবারের মতো—জাস্ট ইন কেস। নিষেধ মানেনি অধিকাংশই। বেশ হয়েছে এতে। বাচ্চাদের ছুটোছুটিতে বেশ একটা উৎসব উৎসব আমেজ তৈরি হয়েছে। পাশের জেলা থেকে শাহ আলম বয়াতিরা এসেছে দলবল নিয়ে। তথ্য অফিসের লোকদের বানানো মঞ্চে বসে গান ধরেছে তারা, শাহ আলমের নিজের লেখা গান—

কেরামিন, কাতেবিন, রোজ হাশরের দিন

আল্লাহর দরবারে যদি করে অভিযোগ

আমি বলব, দুনিয়ায় ছিলাম খাজা বাবার লোক।

হেড অফিস থেকে এলাহী স্বয়ং এসেছেন দুর্নীতির আবর্জনায় আগুন দিতে। কারুকাজ করা বিশাল মশাল তৈরি করেছে তার জন্য জেলা স্কুলের আর্টের টিচার আর তার ছাত্রছাত্রীরা মিলে।

দুপুর ১২টা। মাইক হাতে নিলেন কেরামত। নথির বান্ডিল আর স্বীকারোক্তির বস্তা নিয়ে পাশেই দাঁড়ালো কুতুব।

সফদর জং, পানি উন্নয়নের কনট্রাক্টর

ভাগ্যধন বড়ুয়া, ডিসি অফিসের নাজির।

কামাল নাসের, বিশিষ্ট ছাত্রনেতা

এরফান মাস্টার, ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের শিক্ষক।

আকামত উল্লাহ, পূর্ত বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী।

শাস্বতী রাণী, টেলিফোন অফিসের অপারেটর।

আদম স্টোর, কাফনের কাপড় বিক্রেতা।”

এক একজন করে এসে জনতা সামলে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। আর কুতুব তাদের নথিপত্র, দলিল-দস্তাবেজ ছুড়ে দিচ্ছে সামনের গর্তে।

সবার নাম ডাকা শেষ হতেই মশাল হাতে উঠে দাঁড়ালেন এলাহী সাহেব। অনুষ্ঠানের চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তার অতিপ্রিয় ধবধবে সাদা সাফারিটি পরে এসেছেন আজ তিনি। ডিসির মশালচি মশালে আগুন ধরিয়ে দিতেই হর্ষধ্বনি করে উঠল জনতা। এক পা দুপা করে গর্তের দিকে এগোচ্ছেন এলাহী সাহেব। সফদর আদমরা উত্ফুল্ল চিত্তে হাত তুলে শপথের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অত্যুৎসাহে এক হাতের জায়গায় দুহাত তুলেছে কেউ কেউ।

এই আবেগঘন মুহূর্তে অধস্তনদেরও শামিল করতে চাইলেন এলাহী সাহেব। পিছু ফিরে ডেকে নিতে চাইলেন কেরামত আর কুতুবকে।

কিন্তু একি। নিশ্চল হয়ে টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে কেরামত কুতুব দুজনেই। টেবিলে তখনো মোটা একটি ফাইল। কেবল একটি মাত্র।

কে এই হতভাগা? কিন্তু সাদা পোশাকের কেউ তো আর বাকি নেই শামিয়ানার ওইদিকে। একে একে সবাই এসে দাঁড়িয়েছে শপথের সারিতে।

তবে, এ কে? এ কী এ জেলার বাইরের কেউ? ভুল করে আমলনামা চলে এসেছে কেরামত-কুতুবের হাতে। হবে হয়তোবা। আর এক আধজন বাকি থাকলে কিইবা এমন এসে যায়। পরে এক সময় ধরে দেওয়া যাবে। এলাহী হাতের ইশারায় তার সঙ্গে যোগ দিতে বলেন কেরামতদের।

কেরামত নড়ে না তবুও। নড়ে না কুতুব।

আশ্চর্য, এরা কী বেয়াদব, না বোকারাম? মনে মনে ভাবেন এলাহী। বিরক্তি রাগ আর রোদের তাপ মিলেমিশে তার ফর্সা গোলগাল মুখটা বৈশাখী মেলার সঙ্গে তাল রেখেই যেন লাল বেগুনি নানান বর্ণে ঘন ঘন বদলে যেতে থাকে।

কেরমত কুতুবকে আমতা আমতা করতে দেখে এবারে এগিয়ে আসেন গানের মাস্টার। টেবিলে পড়ে থাকা নথিটি তুলে ধরেন চোখের সামনে। নথির মলাটে গোটা গোটা অক্ষরে জ্বল জ্বল করা নামটি পড়ে স্তব্ধ হয়ে যান মুহূর্তের জন্য।

আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ান অতঃপর গান মাস্টার। শরীরের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা বন্দুক তুলে লক্ষ্য স্থির করেন ধীরে-সুস্থে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর