শিরোনাম
শুক্রবার, ৪ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

স্বাধীনতার অনুষঙ্গ

নিবন্ধ ♦ ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া

স্বাধীনতার অনুষঙ্গ

স্বাধীনতাও কিন্তু এক রকমের অধীনতা। কার অধীনতা? স্ব-অধীনতা। পরের অধীন নয় বলেই এর এতটা সমাদর; এতটা কদর। তবে অধীন-সে আলবৎ। ব্যবধান কেবল আপন পরের। নিজের অধীন হলে স্বর্গসুধা। আর পরের অধীন হলে ঘৃণ্য গরল। যে নিজের অনুগত—সে স্বাধীন। অন্যের আনুগত্য পরাধীনতা। স্বীয় অধিকার যেমন স্বাধিকার; স্বীয় অধীনতা তেমন স্বাধীনতা। পরাধীনতা থেকে মুক্তি মানেই স্বাধীনতা—অন্যের নিয়ন্ত্রণ থেকে নিষ্কৃতি—অন্যের আনুগত্য থেকে অব্যাহতি—গ্লানি থেকে পরিত্রাণ। ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’। এর অন্যথা মানেই গর্বের শির খর্ব। অন্যের অধীন হওয়া যতটা সহজ, নিজের অধীন হওয়া ততটাই কঠিন। নিজকে নিজের বশে রাখতে হলে আগে নিজেকে জানতে হয়, নিজেকে খুঁজতে হয়, নিজেকে আবিষ্কার করতে হয়। নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে জানার পাশাপাশি সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও সচেতন হতে হয়। এ কাজটি দুরূহ বলেই দুর্লভ। এ আত্মনিয়ন্ত্রণের মাঝেই আত্মশাসন, আত্মদমন, আত্মসংযম ও আত্মসংবরণের পরিচর্যা করতে হয়।

ব্যষ্টিক, সামষ্টিক এবং রাষ্ট্রিক—তিন পর্যায়েই আত্মনিয়ন্ত্রণের মর্ম ও মানসের অনুশীলন করা জরুরি। প্রতিটি ব্যক্তি রাষ্ট্রেরই খুদে অংশী। এ ক্ষুদ্র সত্তার সম্মিলনই জনতা। স্বাধীনতার বৃহত্তর সাম্রাজ্যে পা রাখতে হলে ঢুকতে হয় ব্যক্তি স্বাধীনতার সরু ফটক দিয়ে। তাই ব্যক্তিক ও সামাজিক—উভয় ক্ষেত্রেই স্বাধীনতার মননের চর্চা অতি আবশ্যিক। ‘মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন হলেও সর্বত্রই সে শেকলাবদ্ধ’—এ বক্তব্যকে ইতিবাচক অর্থেও নেওয়া যায়। আর তখন অবাধ স্বাধীনতা আর স্বাধীনতার সসীমতার মধ্যের আসল ফারাকটা ধরা যায়।

আত্মত্যাগের শক্তির মাঝেই মুক্তির মুক্তো লুকিয়ে থাকে। একে কিনতে হয় রক্তের দামে। ভূষিত করতে হয় ত্যাগের মহিমায়। সমৃদ্ধ করতে হয় শ্রম আর ঘামের সুষমায়। প্রকৃতি প্রতিটা মানুষের অন্তরে স্বাধীনতা-প্রীতি বা মুক্ত-আকাঙ্ক্ষার বীজ বপন করে দিয়েছেন—যা সহজাত। তাই মুক্তির আকুতি জন্মগত। ‘জীবনের সাথে মুক্তিকামনা একযোগে হলো দান/তবু বিধাতার কাছে জীবনের চেয়ে মুক্তি মূল্যবান’— ইংরেজ কবি ড্রাইডেনের এ উক্তি মুক্তিকামী মানুষের যুগান্তরের অনুপ্রেরণা। আর তখনই সে বলতে পারে, ‘আমি উপাড়ি ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব-সৃষ্টির মহানন্দে।’

স্বাধীনতা যেমন এক রকমের অধীনতা; মুক্তি তেমন এক রকমের বন্ধন। ‘বন্ধ ফিরিছে খুঁজিয়া আপন মুক্তি/মুক্তি বাঁধিছে বাঁধনের মাঝে বাসা।’ এ বন্ধন কর্তব্যের, দায়িত্বের, ত্যাগের। জর্জ বার্নার্ড শ’র ভাষায় ‘স্বাধীনতা মানেই দায়িত্ব, তবুও মানুষ স্বাধীনতা চায়।’ দায়িত্বহীন স্বাধীনতা, ভোগ-বিলাসী মুক্তজীবন, কর্তব্যবিমুখ অবাধ অধিকার স্বাধীনতার বৈরী। ‘অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময় লভি মুক্তির স্বাদ’— এ হচ্ছে মুক্তির মূলমন্ত্র। মুক্তির জন্য চাই মুক্তপ্রাণ, মুক্তবায়ু, মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধি, মুক্তমন, মুক্তকণ্ঠ, মুক্তহস্ত আর মোহমুক্তি। এভাবেই নিশ্চিত হয় স্বাধীনতার আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু। স্বাধীনতার ইতিহাস—প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের ইতিহাস। স্বাধীনতার বৃক্ষমূলে অত্যাচারীর রক্ত সিঞ্চনে কালে কালে সে বৃক্ষ পল্লবিত, পুষ্পিত ও ফলবতী হয়েছে—এ কথা যেমন সত্য, তেমনি মুক্তির নেশায় যুগে যুগে মুক্তিসেনাদের আত্মত্যাগে শোণিত সাগরের বিস্তৃতি ও গভীরতাও অসীম। ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে/ কতো প্রাণ হলো বলিদান লেখা আছে অশ্রুজলে।’

আত্মত্যাগে স্বাধীনতা অর্জিত হয়। আর স্বার্থত্যাগে হয় স্বাধীনতা রক্ষিত। স্বাধীনতা রক্ষায় ত্যাগ এক চলমান প্রক্রিয়া। এ গতি যতিহীন। ত্যাগ যত গভীর, স্বাধীনতা তত সুরক্ষিত। ভোগ যত বিস্তৃত, স্বাধীনতা ততই ভঙ্গুর। ‘আমরা মনে করি, যেটা ইচ্ছা করেছি সেটাকে হাতে করে পাওয়াই স্বাধীনতা, কিন্তু আসলে যেটা ইচ্ছা করেছি সেটাকে মনের মধ্যে ত্যাগ করাই স্বাধীনতা।’ (রবীন্দ্রনাথ, ঘরে বাইরে)। স্বাধীনতা এমন এক জিনিস যা অন্যকে না দেওয়া পর্যন্ত নিজে পেতে পারে না। নিজে বাঁচ এবং অন্যকে বাঁচতে দাও—এ হচ্ছে স্বাধীনতার চিরন্তন তাগিদ। অন্যের নাকের যেখানে শুরু, আমার স্বাধীনতার সেখানে শেষ—এ মানসিকতার অব্যাহত চর্চা ছাড়া স্বাধীনতা অর্থবহ হয় না।

যথার্থ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র সমান বয়সী। গণতন্ত্র স্বাধীনতার ঢাল; দেশপ্রেম স্বার্বভৌমত্বের তলোয়ার, সমৃৃদ্ধি স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্বের বর্ম। এতেই সুরক্ষিত হয় জাতি-রাষ্ট্রের গর্ব— চিরায়ত অহংকার। ‘স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গৌরব। সুতরাং একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই স্বাধীন মানুষেরা বসবাসের ইচ্ছা পোষণ করবে—’ দার্শনিক প্লেটোর এ বক্তব্যকে মেনে নিয়েই বলা যায়—অসহিষ্ণু মনোভাব নিয়ে স্বাধীনতা রক্ষার আকাঙ্ক্ষা আত্মবিনাশেরই নামান্তর। কারণ, পরমত সহিষ্ণুতা যথার্থ স্বাধীনতার দোসর। একটা বিশেষ মত যখন পথ হারায় তখন ভিন্নমত হতে পারে প্রকৃত পথের দিশারী। বহুমত আর বহুপথ গণতন্ত্রের সৌন্দর্য; স্বাধীনতার অলঙ্কার এবং অহংকার। বহুপথ যখন বিশেষ এক অভিন্ন গন্তব্যে মিলিত হয়—তখনই হয় ঐতিহাসিক অর্জন। যেমন আমাদের মহান স্বাধীনতা। বহুবাচনিক সমাজ মানেই সহিষ্ণু জনপদ। বহুদল মানেই দলাদলি নয়। বরং দলে দলে সৌভাগ্যের মোহনায় মহামিলন। দলাদলি তখন পরিণত হয় প্রাণের কোলাকুলিতে। আর তখন বলা যায়, আমার জীবন গেলেও আমি আপনার মতের সঙ্গে একমত হব না সত্য; তবে আপনার মত প্রকাশের অধিকার রক্ষায় আমি আমার জীবন দিতেও রাজি।

বিতর্ক মানেই কিন্তু বিবাদ নয়। তবে সেই বিতর্কে যুক্তি না থাকলেই বিবাদ বাঁধে। ঘটে বিপত্তি। যুক্তি মুক্তচিন্তা আর মুক্তবুদ্ধি চর্চার কষ্টার্জিত ফসল। মুক্তিযোদ্ধা এবং যুক্তিযোদ্ধা—উভয়েরই লক্ষ্য স্বাধীনতা। মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগে স্বাধীনতা অর্জিত হয়, আর যুক্তিযোদ্ধার যুক্তি—ন্যায্যতায় স্বাধীনতা হয় রক্ষিত। যুক্তির জোর ভালো; তবে জোরের যুক্তি স্বৈরতান্ত্রিক। দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, আমরা শিক্ষায় যতটা এগিয়েছি, যৌক্তিক হওয়ার ক্ষেত্রে যেন ততটাই পিছিয়ে পড়ছি নিত্যদিন। জোরের যুক্তি কদর পেলে গণতন্ত্র সে জনপদে নীড় বাঁধে না। পালিয়ে যায় যোজন যোজন দূরে। তাই গণতন্ত্রে সংখ্যাগুরুর মতো যেমন গ্রহণীয় হয়, তেমনি সংখ্যালঘুর মতামতও উপেক্ষিত না হয়ে বরং শ্রদ্ধা লাভ করে। একান্ন শতাংশ মানুষ ঊনপঞ্চাশ শতাংশ মানুষের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে—ব্যাপারটা সে রকম নয় বলে উল্লেখ করেছেন টমাস জেফারসন।

স্বাধীনতা রক্ষার জন্য গণতন্ত্রের সারথী হিসেবে সমৃদ্ধিও জরুরি। অনায়াস আয়েশ নিশ্চিত করাই সমৃদ্ধির কাজ নয়। সুখের পাশাপাশি সমৃদ্ধি যদি স্বস্তি আনে—তবে সে সমৃদ্ধি হয়তো প্রবৃদ্ধি বাড়াবে, কিন্তু ঘুম কেড়ে নেবে। গণতন্ত্র যেমন স্বাধীনতার শোণিত প্রবাহ, আত্মনির্ভরতা তেমনি এর রক্ষাকবচ। কারণ পরনির্ভরতা আর পরাধীনতা সমার্থক। দাতার হাত উপরে থাকে, আর গ্রহীতার হাত নিচে।  নিতে হলে হাত পাততে হয়। হাতপাতা, হাত কচলানো আর হাতজোড় করার মধ্যে কোনো গৌরব নেই। আর স্বাধীনতা এমন বৈশিষ্ট্যের বৈরী। স্বর্ণলতার বাহার আছে; মর্যাদা নেই। আকর্ষণ আছে, নিবেদন নেই। কারণ সে পরজীবী। পরজীবী আক্ষরিক অর্থেই পরাধীন। পরের দ্বারে ভিক্ষে করে ঝোলা ভরা যায়; হয়তো গোলাও ভরা যায়। এ ধনে প্রাণ বাঁচলেও মান বাঁচে না— বরং মানের বিসর্জন ঘটে। ঘটে আত্মমর্যাদার আত্মাহুতি, চরম অবমাননা। পরান্নে উদরপূর্তি হয়, তবে ভাবমূর্তি রসাতলে যায়। স্বাধীন মানুষ মানেই আত্মমর্যাদাবান মানুষ। আর আত্মমর্যাদাবান মানুষ মানেই আত্মনির্ভরশীল মানুষ। অন্য কথায়, আত্মনির্ভরতা আর আত্মমর্যাদা সমার্থক। এ আত্মনির্ভরতার জন্যই চাই শ্রম, সুহিষ্ণুতা, একতা। চাই সততা, নিরাপত্তা, কর্তব্যনিষ্ঠা, জ্ঞানমনস্কতা  ও সুশাসন। ‘সিক্রেসি বিগেটস টাইরানি।’ তাই স্বচ্ছতাও গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ।

স্বাধীন মানুষ দাঁড়ায় মাথা উঁচু করে। তারা হাতাহাতি করে না— হাতে হাত ধরে দাঁড়ায়। মুখোমুখি নয়; পাশাপাশি দাঁড়ায়। আর গণতন্ত্রের অভিধানে ‘আমি’ শব্দটার স্থান নেই। সে জায়গাটা দখল করে নেয় ‘আমরা’। আর এ ‘আমরা’র অনুশীলনে মানুষ অপরের জন্য ত্যাগ করতে শেখে। ভোগকে সে মনে করে অমর্যাদাকর। ত্যাগের মাঝেই সে ভোগ করে অপার অলৌকিক আনন্দ। সে নিতে চায় না, দিতে চায়। আর এ মানসিকতার অব্যাহত চর্চায় শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়ায় দেশপ্রেম। একের সঙ্গে অপরের দূরত্ব কমে আসে ক্রমেই। তখন উঁচু-নীচু, আশরাফ, আতরাফ, উচ্চ-তুচ্ছ ‘সকলের তরে সকলে আমরা’।

স্বাধীন দেশে প্রতিযোগিতা চলে যোগ্যতার। সে প্রতিযোগিতায় প্রগতি এগিয়ে যায়। সৎ প্রতিযোগিতায় হানাহানি নয়, মানামানি থাকে। পরস্পরের প্রতি থাকে সম্মানবোধ। সম্মানই এমন সম্পদ, যা দিলে পাওয়া যায়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ থাকে সেতুবন্ধনে আবদ্ধ। এর মাঝে অতীত ও বর্তমান অতি গুরুত্ববহ এ কারণে যে, এ দুয়ের ওপর নির্ভর করেই রচিত হয় স্বর্ণালী ভবিষ্যৎ। অতীতের গর্ভ থেকে জন্ম নেয় বর্তমানের শিশু। আর বর্তমানের শিশুর মাঝেই ঘুমিয়ে থাকে ভবিষ্যতের পিতা, ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। আজকের দিনটা গতকালের স্মৃতি আর আগামীকালের স্বপ্ন। তাই অতীত এবং বর্তমানের বিবাদ মানেই ভবিষ্যতের সর্বনাশ, নিদারুণ স্বপ্নভঙ্গ। আর স্বপ্নহীন জাতি ডানাকাটা পাখির মতো। এ পাখি কোনো সম্ভাবনার ডানা মেলতে পারে না। মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে নিষ্কর্মার মতো। আবার অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি মানে অচলায়তন। সে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সোনালি ভবিষ্যেক বিনির্মাণ করতে হয় বর্তমানের সৃদৃঢ় ভিত্তির ওপর।

গণতন্ত্র জমাট-বাঁধা হিমশৈল বা তুষারস্তূপ নয়। বরফ-জমা হিমাচল নয়। বরং গণতন্ত্র বরফ গলা নদী। বহমান স্রোতধারা। অভিমান ও অবিশ্বাসের বরফ জমতে দেওয়ার সুযোগ নেই গণতন্ত্রে। খোলামনের উষ্ণতা দিয়ে সে বরফকে গলাতে হয়। আর তখনই গণতন্ত্রের স্রোতধারা প্রাণ পায়। স্বাধীনতার সোনাফসলও ঘরে তোলা যায়।

একে একে মিলে একতা হয়; জনে জনে মিলে জনতা। জনতা একতার একাগ্র বন্ধনে আবদ্ধ থাকলেই সিদ্ধ হয় যথার্থ মুক্তির বাসনা। বিভক্ত জাতি না পায় সমৃদ্ধি, না পায় মুক্তি। মুক্তির জন্য চাই সুদৃঢ় বন্ধন, ঐকান্তিক ঐক্য। ‘মুক্তি যেখানে বন্ধনকে অস্বীকার করে সেখানে তা উন্মত্ততা, বন্ধন যেখানে মুক্তিকে মানে না সেখানে তা উত্পীড়ন।’ সীমান্ত রক্ষণ মানেই কিন্তু স্বাধীনতা রক্ষা নয়। সীমান্ত স্বাধীনতার বাহ্যিক সীমানা। কিন্তু এর অন্তর্গত আত্মা জনতার একতার অমিয় শক্তি। আর সে শক্তির অপর নাম সার্বভৌমত্ব। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে একে রক্ষা করা আরও কঠিন। তাই সীমান্ত রক্ষার পাশাপাশি শুভ বুদ্ধিকেও রক্ষা করতে হয়। সহিষ্ণুতাকে লালন করতে হয়, ত্যাগের মহিমাকে উচ্চকিত করতে হয়। অনুশীলন করতে হয়  গণতান্ত্রিক রীতি-নীতির। আর তখনই স্বাধীনতা হয় অর্থবহ। তখনই স্বাধীনতা পায় হৃদিস্পন্দন। মুক্তি মেলে আলোয় আলোয়। বর্ণালী স্বর্ণশোভার দ্যোতিচ্ছটায় উদ্ভাসিত হয় স্বাধীনতা। মুক্তিমন্ত্রের কী অসীম শক্তি— সে বিষয়ের একটা গল্প দিয়েই শেষ করছি।

একদা এক দেশে ছিল এক বাঘ। চিড়িয়াখানায় পিঞ্জরবন্দী হওয়ার আগে এর গায়ের রং ছিল চোখ ধাঁধানো। গা-ভর্তি ছিল তেলতেলে, ঝকঝকে ইয়া মোটা মোটা সাদা-কালো ডোরাকাটা। সেই ডোরাকাটা তেজি বাঘের হাল এখন বড়ই বেহাল। গায়ে রঙের বাহার নেই। কেমন ফিঁকে-তামাটে হয়ে গেছে। যেন পাংশু-পাণ্ডুর-বিবর্ণ। রঙের আকর্ষণে ছিটেফোঁটাও নেই সারা শরীরে। দেহটা যেন আদ্যিকালের সাদা-কালো ছায়াছবির ঝাপসা চালচিত্র। কিংবা বিবর্ণ চিত্রপট। এর এমন অস্বাভাবিক বিবর্ণতাই যেন একে ওই তল্লাটে বিখ্যাত করে তুলেছে। নামিদামি আঁকিয়েরা আসছে দূরদূরান্ত থেকে। চিত্রশিল্পীরা দিচ্ছেন নানান নিদান। পটু পটু পটুয়ারা রংতুলি-বুরুশ নিয়ে ভিড় জমাচ্ছেন চিড়িয়াখানা এলাকায়। সবারই ঐকান্তিক চেষ্টা— কি করে বাঘের হারানো রং পুনরুদ্ধার করা যায়। সবাই এসে নানা কায়দায় নানা বর্ণের রং মাখে বাঘের গায়ে। ডোরাকাটার চেষ্টা চালায় শৈল্পিক দক্ষতায়। কিন্তু না, ফল শূন্য। বাঘের গায়ে কোনো রংই টিকছে না। পাকা রংও স্থায়ী হচ্ছে না এর লোমশ শরীরে। ফোঁটায় ফোঁটায় গলে পড়ে যাচ্ছে গায়ে লেপ্টে দেওয়া সব রং। ক্ষয়ে ক্ষয়ে গড়িয়ে পড়ছে রঙের ধারা। কি মুশকিল! সবই নিষ্ফল চেষ্টা।

সবশেষে এলো এক আজব পটুয়া। খেপাটে রুক্ষ মূর্তি। পাগলাটে হাবভাব। এসেছেন অকূলপাথার পাড়ি দিয়ে। অদ্ভুত আঁকিয়ে। খোশ মেজাজে তুলি-বুরুশ নিয়ে হাজির হয়েছেন চিড়িয়াখানায়। যথারীতি খুলে দেওয়া হলো বাঘের খাঁচার দরজা। গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পটুয়া ঢুকে যায় বাঘের খাঁচায়। হাবভাবে বোঝা যাচ্ছে, সে-ই পারবে বাঘের গায়ে ডোরা কাটতে। কারণ বাঘের গা থেকে এ পটুয়ার মাখানো রং চুইয়ে পড়ে যাওয়ার কোনোই আশঙ্কা নেই। কেন?  কারণটা পরিষ্কার। এ পটুয়া তার বুরুশে বাস্তবে কোনো রঙই মাখায়নি। শুকনো বুরুশটাকে এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে বাঘের গায়ের এপাশ-ওপাশে বুলিয়ে দিচ্ছে। যেন বাতাসের গায়ে রঙের ডোরা কাটা চলছে। তার এ আজব ও অভিনব অঙ্কনের নমুনা দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে উত্সুক দর্শনার্থীরা। কারণ রংহারা পাংশু বাঘকে রংহীন তুলি দিয়ে বর্ণিল করে তোলার এমন মজাদার শিল্পকর্ম এর আগে ওরা আর কখনো দেখেনি।

যাই হোক। পটুয়ার পটুতা চলতে থাকে। সে বাঘের আরও কাছাকাছি ঘেঁষে। কানের কাছে মুখ রাখে সতর্কতার সঙ্গে। ফিস ফিস করে কিছু একটা বলে। মনে হলো, বাঘটাও গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে পটুয়ার কানপড়া। এরপর রংবিহীন শুকনো বুরুশটাকে বাঘের গায়ের ওপর থেকে নিচের দিকে আবার চালাতে থাকে ডোরাকাটার ভঙ্গিতে। আরে, কি আজব কাণ্ড! সবাই তাজ্জব বনে যায়। বাঘের পাণ্ডুর-ফ্যাকাশে চামড়ার ওপর জাগতে শুরু করেছে রঙের চিকচিকে চমক। সবাই হতবাক। একি জাদুমন্ত্র? এরপর পটুয়া আবার বাঘের কানে কানে ফিস ফিস করে কিছু বলে। এর বাদে আবার হাওয়ায় বুরুশ চালায়। এবার বাঘের চামড়ায় ফুটে ওঠা রঙের বাহার আরও উজ্জ্বল, আরও জ্বলজ্বলে, আরও চকচকে লাগছে। পটু পটুয়া আবার বাঘের কানে কানে কথা বলে। এবারের কানাকানিটা আগের চেয়ে খানিকটা দীর্ঘ সময় ধরেই চলে। এরপর সে তার বায়বীয় চিত্রকর্মটাকে যেন খানিকটা বিন্যস্ত করে নেয়। তুলির আঁচড়গুলোকে শেষবারের মতো ঠিকঠাক করে নিয়ে যেন অঙ্কন কাজের সমাপ্তি টানবে। হ্যাঁ, ফলাফল অবিশ্বাস্য। এখন বাঘের গায়ের রং পরিপূর্ণ প্রাণবন্ত। ঝকঝকে রঙের নজরকাড়া গভীর ডোরাকাটা বাঘটা যেন শার্দূল শাবক। এমন মস্ত রঙের চকচকে বাহার তাবৎ দুনিয়ার কোনো বাঘের গায়ে দেখা যাবে না— দর্শনার্থীরা হলফ করে বলে। যাক। বাঘ তার হারানো রং ফিরে পেল। কিন্তু সবাই কৌতূহলী!  কী ওই পটুয়ার আসল জাদু? এমন তাজ্জব কাণ্ডের আসল রহস্যটা কি? সবাই পটুয়াকে চেপে ধরে, অনুরোধ করে বিনয়ী ভঙ্গিতে— এর ভেদটা তাদের জানাতেই হবে। অগত্যা পটুয়া ব্যাখ্যা করে। ‘আমার তুলি-বুরুশ মূর্তমান করে বাস্তবকে, চিত্রায়িত করে বাস্তব জীবনের প্রাণস্পন্দনকে। তাই এ চিত্রকর্মের জন্য কোনো বস্তুগত রঙের দরকার হয় না। মনের অন্তর্গত রংই একে জাগিয়ে তোলে। আমি বাঘের শরীরটাকে যে অতুল্য-অনন্য রঙে রাঙিয়ে তুলেছি— তা আসলে একটা বাক্য— যা আমি বাঘের কানে কানে ফিস ফিস করে বলেছি। সে জাদুমন্ত্রবলেই বর্ণিল হয়ে উঠেছে বাঘটা।’    

কি সেই অমিত শক্তিধর অমিয় বাণী? আপনারা ভাববেন, নাকি পটুয়া যে রহস্য ভেদ করেছে তা আমিই আপনাদের বলে দেব?

পটুয়া বাঘের কানে কানে বার বার ফিস ফিস করে বলে যাচ্ছিল— ‘শোন! অল্প ক’দিনের মধ্যেই তুমি বন্দীদশা থেকে নিশ্চিত মুক্তি পাচ্ছ।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর