শুক্রবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

ডাইরির পাতায় রাখবো সযত্নে

গল্প - ফরিদুর রেজা সাগর

ডাইরির পাতায় রাখবো সযত্নে

যারা ইউরোপ যান, কখনো সখনো বা নিয়মিত তাদের বিষয়টি জানা। কেউ কেউ হয়তো বা ওটাতে চড়েছেনও! লন্ডন থেকে প্যারিস পর্যন্ত এ যন্ত্রটির চলাচল। এই রুটে জাহাজটি যাত্রীদের ট্রিপ দিত। এখনো এর নিয়মিত অস্তিত্ব আছে কিনা জানা নেই।

যাত্রী বাহক যন্ত্রটিকে এই জাহাজ বলা যাবে কি না তাতেও আমি সন্দিহান। চলে পানির ওপর দিয়ে। কিন্তু গতিটা উড়োজাহাজের মতো। দৈত্যকায়। যেন বাতাস কেটে যায় এতটা মসৃণ। আরামদায়ক। নিরাপদ। পানির ওপর দিয়ে চলে যেমন, ডাঙ্গাপথেও চলে। ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ফ্রান্স পৌঁছে যেত। তারপর ফ্রান্সের ভিতর দিয়ে আরও অনেক দূর...। এক সময় গাড়ি রাস্তা ধরে একটা বিশাল রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে ক্ষান্ত দিত।

এর নাম হচ্ছে, হোবারক্রাফট।

হোবারক্রাফটে উঠতে হতো লন্ডনের ট্যাক্সি চেপে বেশ খানিকটা পথ গিয়ে এর স্টেশনে।

অসম্ভব গতিসম্পন্ন হোবারক্রাফট প্রায় প্লেনের মতোই।

ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে লাগত খুব জোর পঁয়তাল্লিশ মিনিট। তারপর প্যারিস শহরে যেতে নিত আর পনেরো মিনিট। অর্থাৎ হোবারক্রাফটে উঠলে এক ঘণ্টায় লন্ডন থেকে প্যারিস।

যতবার এ দ্রুতগতির যন্ত্রটায় উঠি, ততবার ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়ার সময়েই আমাদের দেশের সাঁতারু ব্রজেন দাসের কথা মনে আসে।

চ্যানেলের ফেনা ওঠা পানির দিকে তাকিয়ে ভাবি। এ দেশটার অনেক গর্বের জায়গা আছে। নিজের দেশটাকে ‘দুখী’ ভাবার কোনো কারণ নেই। পানিতে চোখ রাখি, আর বুক ফুলে ওঠে গর্বে, এই ইংলিশ চ্যানেল সাঁতরে পাড়ি দিয়েছেন আমাদের মাটির ছেলে ব্রজেন দাস।

জাহাজভর্তি মানুষ। প্রচণ্ড গতিতে চলছে। জাহাজের ভিতর গরম কফি খেতে বসলে গতির ব্যাপারটা টের পাওয়া যায় না। কেউ কেউ কফি খাচ্ছে। কেউ কেউ বোতল মুখে কোকোকোলা। কোনো রকম ঝাঁকি নেই। লোকজন করছিলও তাই। কেউ হাঁটাহাঁটি করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউবা আয়েশী ভঙ্গিতে আরাম চেয়ারে বসে গল্পে মাতোয়ারা। প্রচণ্ড গতি উপভোগ করছে বাকিরা।

আমি ভাবলাম, একটু হেঁটে এমন একটা জায়গায় যাই যেখানে সচরাচর যায় না কেউ।

মাথায় এলো, যিনি এই পাগল-গতির জাহাজটা চালাচ্ছেন তার সঙ্গে একটু গপসপ করে এলে কেমন হয়!

সিদ্ধান্ত নিয়ে আর বিলম্ব করলাম না।

গেলাম। দেখলাম, ইঞ্জিন রুমে সুন্দর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোক চালাচ্ছেন। বয়স বড়জোর সাতাশ-আটাশ। সুদর্শন। ক্লিন সেভ করা গালগুলোতে নীল আভা।

প্রশ্ন করলাম, তুমি কোথাকার? ফ্রান্সের, না ব্রিটেনের?

হেসে উত্তর দিল, ‘আমি ফরাসি।’

‘হোবারক্রাফট চালাচ্ছ কত বছর?’

‘তিন বছরের কিছু বেশি।’

হাসলাম আমিও। সৌজন্যের হাসি।

এবার তার কাছ থেকে প্রশ্ন, ‘তুমি কোন দেশের?’

মনে মনে আশা করছিলাম প্রশ্নটা আসুক।

নিজেকে বাংলাদেশি বলে পরিচয় দিতে খুব ইচ্ছে করে বাইরে কোথাও এলেই।

মাথা নাড়লেন হোবারক্রাফটের চালক, ‘খুব ভালো, খুব ভালো। বাংলাদেশকে আমি চিনি।’

‘কীভাবে?’

‘আমার নেশা হচ্ছে, সময় আর সুযোগ পেলেই পৃথিবীর ম্যাপের দিকে চোখ বোলানো। ছোট-বড় সব দেশের ইতিহাস জানা আমার খুব পছন্দের বিষয়।’

তরুণ ছেলেটির কথা শুনে খুশি হয়ে গেলাম।

একটা ব্যাপার অনেকেরই জানা, ইউরোপ কি আমেরিকা, সব পশ্চিমা দেশে কোথাও যাওয়া-আসার ভাড়া একসঙ্গে কিনলে রেয়াত পাওয়া যায় সহজে। কোথাও যাওয়ার টিকিটের দাম যদি হয় দশ পাউন্ড কি দশ ডলার, তবে যাওয়া-আসার টিকিটের দাম হবে পনেরা পাউন্ড অথবা পনেরো ডলার। কখনো ওয়ানওয়ে টিকিট করলে সেটা হয়ে যেতে পারে চৌদ্দ পাউন্ড বা চৌদ্দ ডলার।

সে কারণেই লোকজন যাওয়া-আসার টিকিট এক সঙ্গেই করে ফেলে।

আমিও তাই করেছি।

প্যারিস থেকে ফেরার টিকিটসহ সস্তায় কিনেছি।

হোবারক্রাফটে ওঠার আগে জরুরি ফোনে সিদ্ধান্ত বদলাতে হলো। ঠিক করলাম, প্যারিস থেকে এক মিটিং অ্যাটেন্ড করতে যেতে হবে জার্মানি।

লন্ডনে ফেরার দরকার হবে না।

তাহলে কি দাঁড়ালো ব্যাপারটা? ফেরার টিকিটটা নষ্ট হবে।

এতগুলো টাকা গচ্চা যাবে?

এক পাউন্ডের কনভার্ট করলেও অনেক টাকা।

টিকিটটা এভাবে ফেলে রেখে যাওয়ার কোনো মানে হয়?

চিন্তা করছিলাম।

হোবারক্রাফটের চালকের সঙ্গে ততক্ষণে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে।

তাই তাকেই বললাম, ‘ভাই তোমাকে একটা গিফট দিতে চাই। তোমার প্রয়োজন না হলে কাউকে দিয়ে দিয়ো।’

ড্রাইভার বললো, ‘তাই?’

বললাম, ‘তোমাকে একটা উপহার দিলে তুমি নেবে?’ কিছু মনে করবে না তো?

‘কি উপহার?’ ড্রাইভারের চোখে-মুখে কৌতূহল, ‘তাছাড়া আমাকে গিফট দেবে কি জন্য?’

হেসে বললাম, ‘তুমি আমার দেশ চেনো, ম্যাপ দেখে হলেও আমাদের চেনো!’

তরুণ ড্রাইভার বলল, ‘তুমি মজা করছ বুঝতে পারছি। তবে হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে গল্প করে ভালো হলো। আমি তো কখনো বাংলাদেশি কাউকে দেখিনি। তোমাকে দেখে ভালো লাগল।’

মনে হলো, হয়তো তরুণ ছোকরা ভাবছে, বাংলাদেশের মানুষ ফ্রান্সের মানুষকে কি আর গিফট দেবে!

ইতস্তত করে ড্রাইভার ছেলেটি বললো, ‘আমাদের তো গিফট নেওয়ার নিয়ম নেই। ছোট এ চাকরিটা পরে তোমার গিফট নেওয়ার কারণে চলে যেতে পারে।’

মাথা ঝাঁকাতে লাগলাম, ‘এটি বড় সাইজের কোনো উপহার না, নিলে কোনো সমস্যা হওয়ারই কথা না। তুমি যদি নিতে রাজি থাকো দিতে চাই।’

‘ওকে, সেই গিফটটা কি?’

বললাম, ‘দেখো, আমি তোমার হোবারক্রাফটে যাওয়া-আসার প্ল্যান করেছিলাম। সেভাবেই দুটো কিনেছিলাম। এখন প্যারিস থেকে হঠাৎ করেই জার্মানি চলে যেতে হচ্ছে। আমার এক বন্ধু আমার যাত্রাপথের সঙ্গী। তাই তুমি যদি অফ ডিউটিতে তোমার কোনো বন্ধুকে নিয়ে প্যারিস থেকে লন্ডনে আসা-যাওয়া করো আমাদের টিকিটে, তবে আর রিটার্ন টিকিটজোড়া নষ্ট হয় না।’

হাঁ করে আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকলো তরুণ ড্রাইভার।

বললাম, ‘যদিও তুমি এই কোম্পানিতে চাকরি কর। তোমার ভাষায় ছোট্ট চাকরি, তবু টিকিটগুলো নষ্ট হওয়ার চেয়ে ভাবছি যদি কাজে লাগে!’

ছেলেটি বিনয়ের সঙ্গে জানালো, ‘তোমার মনোজগতের ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি জীবনে ব্যস্ত থাকার জন্য এই জাহাজটা চালানোর চাকরি করছি। অন্যভাবে কথাটাকে নিয়ো না। আমার কিন্তু একটা গাড়ি আছে।’

‘কি গাড়ি?’

‘মার্সিডিজ। তো এই গাড়িতেই আমি মুভ করি। অহরহ যেখানে সেখানে যাই। তাই টিকিট কাটাকাটি করে কোথাও মুভ করার দরকার হয় না।’

বোধোদয় হলো আমার।

আমি এমন একটা দেশের নাগরিকের সঙ্গে কথা বলছি, যারা প্রত্যেকে চকচকে লেটেস্ট মডেলের গাড়ি চালায়। কখনো টিউবে, কখনো বাসে, কখনো হোবারক্রাফটেও চলাচল করে।

যখন ধন্যবাদ দিয়ে ফিরে আসছি, পেছন থেকে ডাকল তরুণ। বলল, ‘তুমি তোমার বাড়তি টিকিটগুলো আমাকে দাও। আমি কাউকে দেব না। নষ্টও করব না। বিশেষ উপহার হিসেবেই রেখে দেব। আমার ডাইরির পাতার ভাঁজে সযত্নে রাখা থাকবে শেষ পর্যন্ত!’

সর্বশেষ খবর