শুক্রবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

বর্ষা

মো. আবদুল মান্নান


বর্ষা

বর্ষার নতুন পানি দেখার গভীর আগ্রহ নিয়ে সেদিন সপরিবারে গ্রামের বাড়ি গেলাম। এখন বর্ষাকাল। এবার সারা বছরই বৃষ্টি ঝরছে। যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। বৃষ্টি, বৃষ্টি কেবলই বৃষ্টি। বলা যাবে না একটি বর্ষণমুখর সন্ধ্যা চাই। তবে বর্ষার নয়া পানি বলতে আশৈশব আমরা যা দেখে এসেছি এখন আর এসবের কোনো অস্তিত্ব নেই। অতীতে আসন্ন ভাদ্ররে বাড়ির সামনেই দেখেছি অথৈ জলরাশি। বিলের স্বচ্ছ জলে সূর্যের কিরণ নিয়ে যেন তরঙ্গমালা ভেসে আসতো তরী বেয়ে। এখন সেখানে আকাশ থেকে ক্রমাগত বৃষ্টি ঝরার আশীর্বাদে জমে আছে একহাঁটু জল। কেননা বৃষ্টি বর্ষা নয়। এতে বর্ষার কোনো স্বতঃস্ফূর্ততা থাকে না। একে বর্ষাকালের বর্ষাহীন অস্বস্তি বলা যায়।

ছেলেবেলায় দেখেছি আষাঢ়ের শুরুতেই সব কিছু ছাপিয়ে বর্ষা নামে। পানি বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষক তার ধান, পাট ইত্যাদি কাটার সময় ঠিক করতেন। এক বুক পানিতে পাট কাটতে কাটতে ক্রমেই পানি আরও বেড়ে যেত। তবু কৃষকের মুখে আনন্দের শেষ নেই। অনেক সময় ফসল কেটে সঙ্গে সঙ্গে নৌকায় ভরে দিত। রবিঠাকুরের সোনার তরীর মতো ‘কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা’ সে চিত্রই আমরা দেখতাম গোটা শৈশব-কৈশোর অবধি।  নতুন পানির সঙ্গে নানা প্রজাতির মাছের ঝাঁক আসত। সে সব আমরা প্রায় ভুলে যেতে বসেছি। মাছের প্রাচুর্য স্বচক্ষে অবলোকন করেছি। বর্ষার আগমনে মাছ ধরার জন্য নানা কৌশল, নানা জাল, বাঁশের ফাঁদ তৈরির হিড়িক পড়ে যেত। বর্ষার আনন্দ উপভোগের অন্যতম অনুষঙ্গই ছিল মাছ ধরা। তখন মাছ ধরার জন্য নানা ধরনের ডিঙি নৌকা ব্যবহার করা হতো। এমনকি নৌকায় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দূর-দূরান্তের হাওরে চলে যেত মাছ শিকারিরা। এসব শিকারি বংশপরম্পরা ধরে রাখত তাদের শিকার নৈপুণ্য। বাবা বা দাদা যে সব উপায় অবলম্বন করে বড় বড় মাছ ধরতেন তারাও তা অনুকরণীয় মনে করতেন এবং সে সব হাতিয়ার ব্যবহার করতেন। বড় রুই-কাতল মাছ ধরা পড়লে পাড়া-মহল্লার ঘরে ঘরে বণ্টন করে উত্সব করে খেত। তখনকার দিনে এমন অসাধারণ গ্রামীণ সম্প্রীতি দেখেছি। এখন সেই বর্ষা নেই। নেই মাছের উন্মুক্ত জলাশয় বা হাওর, বাঁওড়, বিল। মানুষের মধ্যেও সেকালের সেই ভালোবাসার অটুট বন্ধন এখন আর কোথাও অবশিষ্ট নেই। পাশাপাশি বাস করেও সবাই যেন বিচ্ছিন্ন। কেবলি পরিবার কেন্দ্রিক। আত্মকেন্দ্রিক। একা একা।

এক সময় বর্ষায় গ্রামীণ যোগাযোগের বড় মাধ্যম ছিল নৌকা। নৌকাযোগেই মানুষ এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে, হাটে-বাজারে পণ্য আদান-প্রদান করত। তখন হাট বাজারের সংখ্যাও ছিল কম। ফলে সাপ্তাহিক হাটবারেই জমজমাট হাট বসত। পুরো বর্ষাকাল ভাটি বাংলার মানুষ পানসি নৌকায় করে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যেত। মেয়েরা নাইওর যেত সেসব নৌকা করে। সারা বছর অপেক্ষায় থাকত বর্ষা আসলে বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যাবে। পাড়ায় পাড়ায় নৌকা দৌড় প্রতিযোগিতা ছিল আরেক উত্সব আয়োজন। অনেকে নতুন নৌকা তৈরির প্রতিযোগিতায়ও নেমে পড়ত।

আজকাল সেই ভাসা পানির বর্ষা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ থাকে মানুষ। বর্ষার বদলে এখন তারা অকাল বন্যার আতঙ্কে কাতর। বর্ষা আর বন্যা দুয়ের রূপ যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন। বর্ষার রূপ-মাধুর্য আর নান্দনিকতা নিয়ে বন্দনার শেষ নেই আমাদের ভাষায়, আমাদের সাহিত্যে, আমাদের কাব্য গাঁথায়। বাংলা সাহিত্যের একটি বড় অঞ্চল বা ঘটনাপ্রবাহ বিবৃত হয়েছে বর্ষাকেন্দ্রিক কল্পকাহিনী নিয়ে। মহাকবি কালিদাসের ‘মেঘদূত’ থেকে শুরু করে মৈমনসিংহ গীতিকা এমনকি নানা পৌরাণিকেও বর্ষার কিংবদন্তি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বিশদ বর্ষা বন্দনা করেছেন তার গল্পে, তার কাব্য-সাহিত্যে ও সংগীতে। তার পত্রাবলী বা ছিন্নপত্রের নানা পর্বে বাংলাদেশের বর্ষার রূপচিত্র তিনি নিপুণ হাতে এঁকেছেন।

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশকে তো বর্ষাবিহীন কবি হিসেবে চিন্তা করাই পাপ। তার বিপুল কাব্যসম্ভারে বর্ষার রূপ, বর্ষার সুধাগন্ধ অসাধারণভাবে উঠে এসেছে। বাংলার মুখ তিনি দেখিয়াছিলেন, তবে নিশ্চয় বর্ষাহীন মুখ দেখতে কখনো রাজি হতেন না। বেঁচে থাকলে এখনকার বর্ষা দেখে তার আগের মৃত্যু নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এবার অবশ্যই আত্মহত্যা করতেন।

আধুনিককালেও আমাদের ভাষায় অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক বর্ষার গান, বর্ষার গীতিনাট্য, বর্ষার নাটক, কবিতা-লিরিক রচনা করে বিখ্যাত হয়েছেন। তাই আমরা জনবান্ধব সহনশীল, শান্ত, সুবোধ প্রবহমান জলের ধারায় ফিরে আসা স্বচ্ছ পানির বর্ষা চাই।  চাই পলি মাটির বর্ষা, পরিবেশবান্ধব বর্ষা আর চারদিগন্ত স্পর্শ করা অনাবিল আনন্দের বর্ষা। কেননা বর্ষাই এ জনপদে এনে দেয় ঋতুসেরা রোমাঞ্চকর নানা পার্বণ। বর্ষা মানে বাউল মনে আনে পার্থিব প্রেমের জোয়ার, ভালোবাসার মন্ত্রে উজ্জীবিত কাব্যময় প্রকৃতি।

অন্যদিকে বন্যা আসে তাণ্ডব আর ধ্বংসের বার্তা নিয়ে। আচমকা জনপদ ডুবিয়ে দিয়ে মানুষের জীবনকে করে তুলে বিপর্যস্ত, দুবির্ষহ। কৃষকের সোনার মতন ধান, পাট, ভিটে-বাড়ি-বসতি প্লাবিত করে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করে সবুজ বনভূমিকে। প্রাণচঞ্চল জনজীবনকে সহসা পরিণত করে প্রাণহীন ভাগাড়ে। বর্ষা সবারই কাম্য। কিন্তু বন্যা অনাকাঙ্কিত, অবাঞ্ছিত। 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর