শিরোনাম
শুক্রবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

আনন্দমোহনের সত্যনিষ্ঠা ও মুক্তচিন্তা

যতীন সরকার

আনন্দমোহনের সত্যনিষ্ঠা ও মুক্তচিন্তা

আনন্দমোহন বসুর (১৮৪৭-১৯০৬) জীবন ও কৃতি সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের প্রায় সবাই অনবহিত। ময়মনসিংহ শহরে তার নামে প্রতিষ্ঠিত আনন্দমোহন কলেজের ছাত্রছাত্রীরাও এই মনীষী সম্পর্কে তেমন একটা সচেতন নয়। তাদের ভিতর সেই সচেতনতা সৃষ্টির কাজে প্রবীণরাও কি এগিয়ে এসেছেন? মনে তো হয় না। কলকাতা নগরীকে কেন্দ্র করেই যে এই উপমহাদেশে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন ঘটে, সে বিষয়টি বিতর্কাতীত সত্য অবশ্যই। কিন্তু আমরা মনে রাখি না যে, কলকাতা নগরীর সীমানা ছাড়িয়ে সেই শিক্ষার আলো যদি দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে না পড়ত, বিভিন্ন মফস্বল শহরে এবং কিছু কিছু গ্রামগঞ্জেও যদি সেই শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত অনেক মনীষীর অভ্যুদয় না-ঘটত, তাহলে সে শিক্ষা দেশের কোনো কাজেই লাগত না। এতদিন যাদের কথা তেমনভাবে স্মরণ রাখিনি, মফস্বল এলাকায় জন্ম নিয়ে ও সেখান থেকেই জীবন গড়ার মৌলিক শিক্ষা নিয়ে দেশে ও বিদেশে প্রকৃত আধুনিকতার আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন যেসব মনীষী, তাদের কথা সকৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করার প্রয়োজন ও দায়িত্ববোধ থেকেই আজ আমি নবীন প্রজন্মের মানুষদের সামনে মনীষী আনন্দমোহন বসু সম্পর্কীয় কিছু কথা তুলে ধরতে প্রবৃত্ত হচ্ছি।

সে সময়কার ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার জয়সিদ্ধি গ্রামে ১৮৪৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আনন্দমোহন বসুর জন্ম। তার বাবা পদ্মলোচন বসু ছিলেন একজন ভূস্বামী। শৈশবেই আনন্দমোহনকে তার বাবা জয়সিদ্ধি গ্রাম থেকে ময়মনসিংহ শহরে নিয়ে এসে প্রথমে হার্ডিঞ্জ বঙ্গবিদ্যালয়ে ও পরে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে ভর্তি করে দেন।

ময়মনসিংহে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার পত্তন ঘটে ১৮৫৩ সালে জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে। আনন্দমোহন বসু এ জিলা স্কুলের ছাত্ররূপেই ১৮৬২ সালে প্রবেশিকা (এন্ট্রাস) পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। জিলা স্কুলের ছাত্রাবস্থাতেই আনন্দমোহনের চিন্তার দিগন্ত অনেক প্রসারিত হয়ে যায়। সে সময়ে জিলা স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্রদের উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘মনোরঞ্জিকা সভা’ নামে একটি সংস্কৃতি সংগঠন। নতুন যুগের ভাবধারা বিস্তারে এ সংগঠনটির অবদান অপরিসীম। ছাত্রজীবনে মনোরঞ্জিকা সভার একজন সক্রিয় সভ্য রূপেই আনন্দমোহন বসুর চিত্তে অগ্রসর চেতনার বীজ রোপিত হয়। পরবর্তীকালে সেই বীজেরই পরিণতি মহীরূহ রূপে। এর ফলেই উনিশ শতকের বাংলা তথা ভারতবর্ষে আধুনিক ভাবধারার বিস্তারে আনন্দমোহন বসুর পক্ষে একান্ত অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়েছিল।

উনিশ শতকের ‘বঙ্গীয় রেনেসাঁস’ বলা হয় যাকে, দীর্ঘকাল ধরে তা নিয়ে চলছে অনেক বাদ-প্রতিবাদ ও বিবাদ-বিসংবাদ। সেই রেনেসাঁসের স্থপতিদের অনেকের কথাই বিভিন্নজনের আলোচনা-পর্যালোচনায় ওঠে এলেও সেসবের কোনোটিতেই আনন্দমোহন বসুর নামটি যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে উচ্চারিত হয় না। অথচ আনন্দমোহনের কীর্তি বাংলার নবজাগরণে এমন কিছু নতুন মাত্রা যোগ করেছে যাতে সেই জাগরণ অনেক বেশি উজ্জ্বল ও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করতে হয় তার রাজনৈতিক ভাবনা ও কর্মকাণ্ডের কথা। তখনকার ঔপনিবেশিক পরিমণ্ডলে আধুনিক শিক্ষাগ্রহণরত ছাত্র সমাজই ছিল সবচেয়ে বেশি মাত্রায় রাজনীতি-সচেতনতার ধারক। এ সচেতনতাকে কাজে লাগাতে হলে যে ছাত্রদের সংঘবদ্ধ করে তোলা প্রয়োজন, এ উপলব্ধি থেকে আনন্দমোহনই প্রথম এদেশে ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলেন। প্রখ্যাত বিপ্লবী বিপিন চন্দ্র পাল (১৮৫৮-১৯৩২) ছিলেন এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। বিপিনচন্দ্র তার আত্মজীবনী ‘সত্তর বৎসর’-এ আনন্দমোহন সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন,— “... ১৮৭৫ ইংরেজির প্রথমে আমি কলিকাতায় আসি। ইহার মাস দুই পূর্বে ১৮৭৪ ইংরেজির ৩ নভেম্বর তারিখে আনন্দমোহন বসুর নাম শুনিয়াছিলাম। ...আনন্দমোহন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করিয়াছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিহাসে তার নাম উজ্জ্বল বর্ণে লিখিত আছে। এম এ পরীক্ষায় গণিতে প্রথম স্থান অধিকার করিয়া আনন্দমোহন প্রেসিডেন্সি কলেজের গণিতের সহকারী অধ্যাপকের পদ প্রাপ্ত হন। তারপর প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি লইয়া বিলাতে যাইয়া কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন এবং সেখানেও গণিতের পরীক্ষায় অতি উচ্চস্থান অধিকার করেন এবং ব্যারিস্টারের সনদ লইয়া কলিকাতায় ফিরিয়া আসেন।

আনন্দমোহন বিলাত হইতে কলিকাতায় ফিরিবার পথে বোম্বাইয়ে দিনকতক থাকিয়া সেখানকার ছাত্র সমাজের কাজ দেখিবার সুযোগ পাইয়াছিলেন। বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অবসরকালে দল বাঁধিয়া দেশসেবায় নিযুক্ত হইতেন। বিশেষভাবে তাঁহারা সমাজে স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের চেষ্টা করিতেছিলেন। ইহাদের দেশসেবার চেষ্টা দেখিয়া আনন্দমোহনের অন্তরে বাঙালি ছাত্রদের মধ্যেই এইরূপ প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তুলিবার আকাঙ্ক্ষা হয়। কলিকাতায় আসার কিছুদিন পরেই এই বাসনার বশবর্তী হইয়া আনন্দমোহন কলিকাতা ছাত্রসভা বা স্টুডেন্টস এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠা করেন। আমার কলিকাতা আসার অল্পদিন পরেই এই এসোসিয়েশনের জন্ম হয়। প্রেসিডেন্সি কলেজের অগ্রণী ছাত্রদের প্রায় সকলেই এই সমিতিতে যোগদান করেন। যতদূর মনে পড়ে নবকৃষ্ণ বসু মহাশয় এই ছাত্রসভার প্রথম সম্পাদক ছিলেন। ...শ্রীযুক্ত ব্যোমকেশ চক্রবর্তীও সে সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রতিষ্ঠাবান ছাত্র ছিলেন। তিনিও পরে এই ছাত্রসভার সম্পাদক হইয়াছিলেন। সেকালের আর একজন কৃতী ছাত্র সূর্যকুমার ন্যায় অগুন্তি মহাশয়ও স্ট্যাটুঢরি সিভিলিয়ান হইয়াছিলেন। ইহারা সকলেই নিজেদের জীবনের শ্রেষ্ঠতম প্রেরণা এই কলিকাতা ছাত্রসভা হইতে পাইয়াছিলেন।”

এই ‘প্রেরণা’ ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আটকে থাকেনি, বিস্তৃত হতে থাকে অনেক দূরের স্থানে ও কালে। নিকট অতীতে বা প্রবহমান বর্তমানে যেসব ছাত্রসংগঠনের কার্যক্রম চলেছে ও চলছে, সেসবেরই মূলটি অভিন্ন। এগুলো ১৮৭৫ সালে আনন্দমোহন প্রতিষ্ঠিত ‘ক্যালকাটা স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’-এর উত্তরাধিকারেরই ধারা বহনকারী। কিন্তু সেই উত্তরাধিকারের মর্যাদা যে রক্ষিত হচ্ছে না, সেও তো এক বেদনাদায়ক সত্য। ছাত্র সংগঠন তৈরির পাশাপাশিই আনন্দমোহন মনঃসংযোগ করেন স্বদেশপ্রেম-সঞ্চারক রাজনৈতিক সংগঠন গড়ার কাজেও। ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’-এর অব্যবহিত পূর্বসূরিই ছিল ১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’। এ প্রতিষ্ঠানের স্থপতি আনন্দমোহনই ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত ছিলেন এর সম্পাদক এবং পরে ১৮৯৬ থেকে ১৯০৬ সাল পর্যন্ত সভাপতি। ১৮৮৫-তে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পেছনেও আনন্দমোহনের ভূমিকা খাটো করে দেখা চলে না। কংগ্রেসের জন্মাবস্থা থেকে আনন্দমোহন এর সক্রিয় নেতৃত্বে ছিলেন, এবং মাদ্রাজ্যে অনুষ্ঠিত এর চতুর্দশ সম্মেলনে তিনি সভাপতির আসন গ্রহণ করেছিলেন।

এরপর ১৯০৫ সালে কূটকৌশলী ইংরেজ শাসকদের প্রবর্তনায় ঘটে যাওয়া ‘বঙ্গভঙ্গ’ নিয়ে দেশের রাজনীতির ধারাপ্রবাহে যে তরঙ্গাভিঘাত সৃষ্টি হয়েছিল, দেশের মানুষের চেতনা যেটি অভূতপূর্ব ও অচিন্তিতপূর্ব আলোড়নের সঞ্চার ঘটিয়েছিল, এবং সেই জাতীয় জাগরণের ভিতরে সাম্প্রদায়িকতার বীজও যে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল— সেসব নিয়ে আমাদের ইতিহাসবিদদের মধ্যে আজও চলছে অনেক আলোচনা-সমালোচনা। কিন্তু সেসব আলোচনা-সমালোচনার প্রায় কোনোটিতেই বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে আনন্দমোহন বসুর বিশিষ্ট অবদানের বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে উল্লিখিত ও মূল্যায়িত হয় না। আনন্দমোহন ১৯০৩ সালেই দুরারোগ্য ব্যাধির আক্রমণে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। আমৃত্যু সেই শয্যাতেই শয়ান থাকতে হয় তাকে। কিন্তু শয্যাগত থেকেও দেশহিতৈষার ভাবনা থেকে তিনি নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে পারেন না, বঙ্গভঙ্গ তার চিত্তে প্রচণ্ড বিক্ষোভ ও বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তার দুর্দমনীয় আগ্রহের কাছে নতি স্বীকার করে শুভানুধ্যায়ীরা তাকে অসুস্থ অবস্থাতেই বিছানায় শুইয়ে ১৯০৫-এর ১৬ অক্টোবর ‘অখণ্ড বঙ্গদেশ স্থাপনের উদ্দেশ্যে ফেডারেশন হলের জমিতে অনুষ্ঠিত সভায়’ নিয়ে যান। শুয়ে থেকেই তিনি সে সভায় সভাপতিত্ব করেন ও হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সেদিন তার রচিত ‘প্রতিজ্ঞাপত্র’ পাঠ করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এর দশ মাস পর ১৯০৬-এর ২০ আগস্ট আনন্দমোহন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

রাজনৈতিক সংগঠন গড়া ও পরিচালনার মতোই দেশে শিক্ষা বিস্তারের কাজেও তিনি সমান মনোযোগী ছিলেন। বিশেষ করে নারীশিক্ষা। উনিশ শতকের শেষ পর্বেও দেশে নারীশিক্ষার তেমন একটা প্রসার ঘটেনি। এ বিষয়টি আনন্দমোহনের ভাবনাবৃত্তে বিশেষ স্থান করে নিয়েছিল বলেই দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ও দুর্গামোহন দাসের মতো নারীশিক্ষাব্রতী সুধীজনের সহযোগিতায় ১৮৭৬ সালে তিনি স্থাপন করেন ‘বঙ্গমহিলা বিদ্যালয়’।

বঙ্গভঙ্গকে উপলক্ষ করে স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ার ময়মনসিংহে অত্যন্ত প্রবল বেগ ধারণ করে। সে জোয়ার সৃষ্টিতেও আনন্দমোহন বসুই ছিলেন অগ্রণী। এ বিষয়ে তখনকার ময়মনসিংহের বিশিষ্ট ব্রাহ্মনায়ক শ্রীনাথ চন্দ্র তার ‘ব্রাহ্মসমাজে চল্লিশ বৎসর’ শীর্ষক স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থটিতে লিখেছেন—“যেমন ভূমিকম্পের একটা কেন্দ্র থাকে তথায় সর্বাপেক্ষা প্রবল কম্পন অনুভূত হয়, সেইরূপ ময়মনসিংহ এই জাতীয় মহাকম্পনের কেন্দ্রস্থান হইয়াছিল। লর্ড কার্জনও তাহা বুঝিতে পারিয়াই চির উপেক্ষিত ময়মনসিংহে পদার্পণ করিয়া রাজশক্তির উগ্রমূর্তি প্রদর্শন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। ময়মনসিংহের কৃতীসন্তান মহাত্মা আনন্দমোহন ও মহারাজ সূর্যকান্ত এই জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করিয়া চিরস্মরণীয় হইয়া রহিয়াছেন।”

শ্রীনাথ চন্দের গ্রন্থটি থেকে ময়মনসিংহে আনন্দমোহন বসুর কর্মপ্রয়াস সম্পর্কে অনেক কথাই জানা যায়। আনন্দমোহনের প্রত্যক্ষ প্রেরণায় কলকাতায় ‘স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ময়মনসিংহে তার শাখা স্থাপিত হয়েছিল। কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ বা ‘ভারত সভা’র দৃষ্টান্তে এখানেও ‘ময়মনসিংহ সভা’র প্রতিষ্ঠা হয়, এবং তার প্রথম অধিবেশন হয় ১৮৭৭ সালের ২০ আগস্ট।

শ্রীনাথ চন্দ জানিয়েছেন,—“এই সভা বহুদিন জীবিত থাকিয়া এ জেলার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট কাজ করিয়াছিল। এ জেলায় রেলওয়ে প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে ময়মনসিংহ সভার কার্য বিশেষ স্মরণীয়।”

পরবর্তীকালে ‘ভারতসভা’র মতো অন্য অন্য রাজনৈতিক সংগঠনের কার্যক্রমও ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রসারিত হতে থাকে, এবং ক্রমে দেশজুড়েই বিদেশি শাসনবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনে প্রবল গতিবেগের সঞ্চার ঘটতে থাকে। সকল এলাকাতেই আনন্দমোহনের মতো জ্ঞানযোগী ও কর্মযোগী স্বদেশপ্রেমিকদের অভ্যুদয়ের ফলেই গণজাগরণের এই বিস্তৃতি।

ধর্মবিশ্বাস ও আচরণে আনন্দমোহন ছিলেন ব্রাহ্ম। রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ— উনিশ শতকে বঙ্গীয় রেনেসাঁসের আলোর বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছেন যারা, তাদের সকলেরই হৃদয়লোক আলোকিত ছিল ব্রাহ্মভাবনায়। বলতে গেলে, সেই রেনেসাঁসের স্থপতিদের প্রায় সকলেই কোনো না কোনোভাবে ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

ময়মনসিংহের মতো মফস্বল এলাকাতেও আধুনিক ভাবনা-চিন্তার প্রতিষ্ঠা ও প্রসার ঘটে ব্রাহ্মসমাজের প্রবর্তনাতেই। ময়মনসিংহে জিলা স্কুল স্থাপিত হলে তার হেডমাস্টার হয়ে আসেন ভগবান চন্দ্র বসু। তার বাড়িতেই প্রতি সপ্তাহে ব্রাহ্মমতের অনুসারীগণ প্রার্থনা সভায় মিলিত হতেন। স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থাতেই আনন্দমোহন অনেকবার সেই সভায় যোগ দিয়েছেন। এভাবে ময়মনসিংহেই কিশোর আনন্দমোহনের চিত্তে ব্রাহ্ম ভাবনার বীজ রোপিত হওয়ার ফলে বাইশ বছর বয়সে ১৮৬৯ সালের ২২ আগস্ট কলকাতায় ব্রহ্মানন্দ কেশব চন্দ্র সেনের কাছে সস্ত্রীক ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। [প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভগবান চন্দ্র বসুর জ্যেষ্ঠ কন্যার সঙ্গেই আনন্দমোহন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু ছিলেন ভগবান চন্দ্রের পুত্র।]

কেশব চন্দ্রের প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিই ব্রাহ্মসমাজকে অনেক অগ্রসর ভাবনা ও কর্মের বাহক করে তোলে। এতে এক সময়ে ‘ব্রাহ্মধর্মে’র প্রকৃত প্রবর্তক মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গেও তার বিচ্ছেদ ঘটে যায়। কেশব চন্দ্রের নেতৃত্বাধীনে গঠিত হয় ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ’, এবং আগেরটি ‘আদি সমাজ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। কেশবচন্দ্র জাতিভেদ প্রথার ঘোর বিরোধী ও স্ত্রী স্বাধীনতার দৃঢ় সমর্থক ছিলেন। বাল্যবিবাহের বিরোধী রূপে তিনি কনে ও বরের বয়সের নিম্নসীমা যথাক্রমে ১৪ ও ১৮ নির্ধারণ করে দেন। বিবাহসহ সকল প্রকার অনুষ্ঠানে পৌত্তলিক আচার নিষিদ্ধ করা হয়।

কিন্তু এক সময় কেশব চন্দ্রের আচার-আচরণে অনেক স্ব-বিরোধিতা দেখা দেওয়ার ফলে ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ’-এও ভাঙন ধরে। এ বিষয়ে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ এ এফ সালাহউদ্দিন আহমদ লিখেছেন—

“...কেশব সেনের নির্দিষ্ট কিছু ধারণা ও কার্যকলাপ তার অনুসারীবৃন্দ, বিশেষত যুবা ও চরমপন্থীদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে। তারা ব্রিটিশ সরকারের প্রতি তার অত্যুৎসাহী আনুগত্য প্রকাশকে অপছন্দ করত এবং কুচবিহারের রাজার সাথে তার কন্যার বিবাহের ব্যাপারে তার আচরণ নিয়েও ক্ষুব্ধ ছিল। কনে ও বর উভয়ই অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছিল এবং সনাতন হিন্দু ধর্মীয় আচার অনুযায়ী ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা এ বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পাদন করে। এতে ঘটেছিল ব্রাহ্ম সমাজের ধর্মবিশ্বাস ও প্রথার নিধারুণ লঙ্ঘন। কেশবের কর্তৃত্বপরায়ণতা ও অযৌক্তিক আচরণও তার অনুসারীদের অনেকের উত্তেজিত হওয়ার কারণ ঘটিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত শিবনাথ শাস্ত্রী (১৮৪৭-১৯১৪) ও আনন্দমোহন বসুর (১৮৪৭-১৯০৬) নেতৃত্বে আমূল সংস্কারের পক্ষপাতী শ্রেণির লোকজন কেশব সেনের সমাজ থেকে বের হয়ে আসে এবং ১৮৭৮ সালে ‘সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ’ গঠন করে। এটি প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে একটি গঠনতন্ত্র তৈরি করে এবং একটি সর্বজনীন ধর্ম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নিতে এর আকাঙ্ক্ষা জনসমক্ষে ঘোষণা করে।”

কেশব চন্দ্র সেনের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, সমর্থন-প্রত্যাহার— এসবের মধ্যেও আনন্দমোহন বসুর সত্যনিষ্ঠা ও মুক্তচিন্তার পরিচয়ই ধরা পড়েছে। সত্যনিষ্ঠা, মুক্তচিন্তা, গণতন্ত্র ও সামাজিক দায়বদ্ধতার ঘনিষ্ঠ অনুসারী রূপেই আনন্দমোহন তার সকল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মতান্ত্রিক ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করে গেছেন। কোথাও কোনোক্রমেই কোনোরূপ অন্ধতা বা স্বার্থ চিন্তাকে প্রশ্রয় দেননি বা প্রবলের প্রতাপের সামনে নতি স্বীকার করেননি।

শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ১৮৭৯ সালে কলকাতায় তিনি ‘সিটি কলেজ’ নামে যে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন তারই শাখা খোলা হয় ময়মনসিংহ শহরে তার নিজের বাসাবাড়িতে। আনন্দমোহনের মৃত্যুর পর ১৯০৬ সালে সেই কলেজটি উঠে যায়। এর দু’বছর পর ১৯০৮ সালে ময়মনসিংহের শিক্ষানুরাগী সুধীবৃন্দের তৎপরতায় এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার ব্ল্যাকউডের বিশেষ উৎসাহে কলেজটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে এর নামকরণ করা হয় ‘আনন্দমোহন কলেজ’। আনন্দমোহন বসুর নিজ বাসায় স্থাপিত বিদ্যালয়টি ‘সিটি কলেজিয়েট স্কুল’ নামে এখনো বিদ্যমান।

বাংলা ভাষায় আনন্দমোহনের কোনো পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ নেই। ইংরেজিতে লিখিত ও হেমচন্দ্র সরকার প্রণীত অ খরভব ড়ভ অহধহফধ গড়যধহ ইড়ংব বইটি কলকাতায় সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৯ সালে। এর অনেক বছর পরে, ১৯৯৮ সালে কলকাতা থেকেই এর দ্বিতীয় সংস্করণের প্রকাশ ঘটে। বাংলাদেশে এর একটি বঙ্গানুবাদ প্রকাশের উদ্যোগ কেউ গ্রহণ করতে পারেন না? যথাযোগ্য মর্যাদায় আনন্দমোহনের জন্ম-মৃত্যু দিবস পালনও কি আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না?

সর্বশেষ খবর