শুক্রবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
নিবন্ধ

আজন্ম বোহেমিয়ান শহীদ কাদরী

এম আবদুল আলীম

আজন্ম বোহেমিয়ান শহীদ কাদরী

প্রতিকৃতি : মাসুক হেলাল

যেসব কবি মহাকালের আঁধার ঠেলে বাংলা কবিতার আকাশে আলো হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, শহীদ কাদরী (জন্ম ১৪ আগস্ট ১৯৪২; মৃত্যু ২৮ আগস্ট ২০১৬) তাদের অন্যতম। রচনার সংখ্যাধিক্যে নয়, শিল্পের উৎকর্ষে তার কবিতা অনবদ্য। মাত্র পাঁচখানি কাব্য [উত্তরাধিকার (১৯৬৭), তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা (১৯৭৪), কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই (১৯৭৮), আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দিও (২০০৯), গোধূলির গান (২০১৭)] এবং অল্প কিছু গদ্য রচনা রচনা করে তিনি বাংলা কবিতার ইতিহাসে নিজের আসন পাকাপোক্ত করেছেন।

শহীদ কাদরীর জন্ম ১৯৪২ সালে। ব্যক্তিজীবন এবং যুগ-পরিবেশ তাকে বোহেমিয়ান করেছে। জন্মেই দেখেছেন উত্তপ্ত পৃথিবী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ তা বলীলায় বিশ্ববাসীর জীবন তখন বিপন্ন; তেতাল্লিশের মন্বন্তর, অর্থনৈতিক মন্দা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ প্রভৃতি ঘটনা ও প্রবণতায় দেশবাসীর জীবনেও ছিল ত্রাহি ত্রাহি রব। মাতৃজঠর থেকে নেমেই তিনি কতকড়ে গিয়েছিলেন; সে কথা কবিতাতেও বলেছিলেন : ‘জন্মেই কতকড়ে গেছি মাতৃজরায়ন থেকে নেমে-/সোনালি পিচ্ছিল পেট আমাকে উগড়ে দিলো যেন/দীপহীন ল্যাম্পপোস্টের নীচে, সন্ত্রস্ত শহরে/নিমজ্জিত সবকিছু, রক্তচক্ষু সেই ব্ল্যাক-আউটে আঁধারে।’

বাস্তবিকই শহীদ কাদরীর জন্মস্থান কলকাতা তখন ছিল ‘সন্ত্রস্ত শহর’। এই শহরের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তার সোনালি শৈশবকে বিপন্ন করেছে। ফলে তাকে সপরিবারে পাড়ি জমাতে হয় অনিশ্চিত গন্তব্যে। কলকাতার পার্ক সার্কাসের প্রিয় বাড়িটি চিরদিনের জন্য ফেলে আসতে হয়। বেদনাবিধুর সেই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তার বয়ান : ‘সবাই ট্যাক্সিতে উঠতে যাবে ঠিক তখন আমার বুকের ভিতরটা কেমন যেন হাহাকার করে উঠলো। আমার প্রিয় সেই বাড়িটা ছেড়ে চলে যেতে হবে? আর কখনো এই বাড়িতে আসবো না? এসব ভাবতে ভাবতেই এক দৌড়ে চলে গেলাম বাড়ির প্রিয় প্রাঙ্গণটার সামনে। তারপর বাড়িটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে আবার এক দৌড়ে বড় বড় সিঁড়ি ডিঙিয়ে উঠে গেলাম দোতলায় সেই চিরচেনা ছোট্ট চিলেকোঠায় যেখানে আমি থাকতাম। সেই ঘরের প্রতিটা দেয়ালে চক দিয়ে বড় বড় করে নিজের নাম লিখলাম শহীদ কাদরী, শহীদ কাদরী।’ এই গৃহচ্যুতিই তাকে চিরজীবনের জন্য বোহেমিয়ান করে তুলেছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন বলে পৈতৃক বাড়িটির কথা কোনোদিন ভুলতে পারেননি, ভুলতে পারেননি শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত কলকাতা শহরকেও। কালটর্ন সিগারেটের প্যাকেটে করে প্রিয় জন্মস্থান থেকে আনা পাথরের মধ্যে খুঁজে ফিরতেন প্রিয় কলকাতা শহরকে। শিশুমনের ব্যথার প্রলেপ দিতে বারবার সেই পাথর বের করে দেখতেন। স্মৃতি হাতড়ে বলেছেন : ‘মন যখন খারাপ হতো, তখন সেই পাথরগুলোই ছিল আমার সঙ্গী। পাথর নিয়ে খেলতাম, পাথরগুলোর ভেতর শৈশবকে খুঁজে পেতাম।’ ঢাকায় এসে যে জীবন পেলেন, তাতে কোথাও সুস্থিরতা ছিল না। ফলে তিনি কোনো কিছুতেই সঙ্গতি খুঁজে পাননি। কী গৃহ, কী স্কুল, কোথাও মন বসেনি। তাই ঢাকার রাস্তায় ‘বেহিসেবি আড্ডা’ দিয়ে কাটিয়েছেন কৈশোর-যৌবনের দিনগুলো। কী যেন এক ভয়াল শূন্যতায় তার বুকের ভিতরটা হুহু করে উঠতো।

শৈশব-কৈশোরের বাস্তুহারা-জীবন তার মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল বলেই পরবর্তী জীবনে আর গৃহী হতে পারেননি। নিজের ভিতরের বোহেমিয়ান স্বভাবের কারণেই বোধ করি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কাটিয়েছেন ঢাকার রাস্তা আর রেস্তোরাঁয়। ‘নিঃসঙ্গতাকেই যৌবনের পরম সুহৃদ জেনে’ পথ চলেছেন। তার বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছিল ‘বোহেমিয়ান জীবনটাই হলো বেটার লাইফ।’ এই বোহেমিয়ান স্বভাবের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যেমন তার মন বসেনি, তেমনি কর্মজীবনেও কোনো কাজে স্থিরভাবে লেগে থাকতে পারেননি। এমনকি নিরবচ্ছিন্নভাবে সাহিত্যচর্চাও করতে পারেননি। এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করত তার মধ্যে। খুব বেশিদিন এক জায়গায় স্থির থাকতেন না। ‘অগ্রজের উত্তর’ কবিতায় নিজের সম্পর্কে লিখেছেন : ‘জানি না কোথায় যায়, কি করে, কেমন করে দিনরাত কাটে/চাকুরিতে মন নেই, সর্বদাই রক্তনেত্র, শোকের পতাকা/মনে হয় ইচ্ছে করে উড়িয়েছে একরাশ চুলের বদলে!’

বোহেমিয়ান এই কবির সংসার বাধার ইচ্ছা না থাকলেও, শেষ পর্যন্ত নাজমুন নেসা পিয়ারীর সঙ্গে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। নিজেদের পছন্দে বিয়ে হলেও শেষ পর্যন্ত তাদের সংসার ভেঙে গেছে। পরে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন ডিনা নামের এক বিদেশিনীকে, তার সঙ্গেও গড়ে ওঠেনি মধুর দাম্পত্য-সম্পর্ক। পরিণামে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে। শেষজীবনে নীরা কাদরীর সঙ্গে সংসার বাঁধলেও, সে-জীবনকে বিষাদগ্রস্ত করে জটিল কিডনি-রোগ। এক কথায়, শহীদ কাদরীর দাম্পত্যজীবন সুখের হয়নি। তিনি একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন : ‘আমার পক্ষে সংসার জীবন না হলেই ভালো হতো।’ কখনো বলেছেন : ‘আমার প্রথম বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি।’ এও বলেছেন : ‘আমার জীবনে আর নারীর সুখ হবে না।’ সর্বোপরি প্রবাসজীবন আর রোগ-ব্যাধি তার বোহেমিয়ান জীবনে একাকিত্বের কঠিন যন্ত্রণা দিয়েছে।

মানুষের নিষ্ঠুরতায় তিনি মর্মাহত হয়েছেন। পেয়েছেন সীমাহীন কষ্ট। এজন্য দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছেন এবং আপন মনের সেই অভিব্যক্তি প্রকাশ করে লিখেছেন : ‘আমার সেলামগুলো চুরি ক’রে নিয়ে গেছে একজন সমরবিদ,/আমার প্রেমের মূল্য ধ’রে টান মারছে অন্তরঙ্গ বিজ্ঞানী/আমার প্রাণ নিয়ে লোফালুফি করছে কয়েকজন সার্জেন্ট-মেজর/কেবল নিজের ছায়ার কাছে নতজানু হয়ে পড়ে থাকবো আমি/আর কতদিন?’ তিনি জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন প্রবাসে। সেখানে অনেকের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন, কিন্তু নিজের একাকিত্বকে কখনোই দূর করতে পারেননি। লিখেছেন : ‘একতাল শূন্যতা ও মনস্তাপ ছাড়া এই মুহূর্তে আমার কাছে আর কিছু নেই।’ নিজের চেতনার গহ্বরে ঢুকে তিনি নরক-যন্ত্রণা ভোগ করেছেন এবং নরকেই পেতে চেয়েছেন দীর্ঘ পরমায়ু। সংঘাতপূর্ণ পৃথিবীর মানুষের দিকে তাকিয়ে তিনি স্বস্তি পাননি। শুধু তাই নয়, লক্ষ করেছেন, ‘প্রেম ঝরে যাচ্ছে, ফেনিল উৎসবে ঢেকে যায় আততায়ীর মুখ, নির্যাতিত মহিলা, দগ্ধগ্রাম; বালকের মুঠো থেকে খসে পড়ে বেলুনের সূক্ষ্ম সুতো।’ পৃথিবীতে কালবেলা ঘনীভূত হতে দেখে তিনি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন, তার চেতনাজুড়ে বিরাজ করে নঞর্থক ভাবনারাশি : ‘-এইমতো জীবনের সাথে চলে কানামাছি খেলা/এবং আমাকে নিষ্কপর্দক, নিষ্ক্রিয়, নঞর্থক/ক’রে রাখে ; পৃথিবীতে নিঃশব্দে ঘনায় কালবেলা!’

বস্তুত, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ধ্বংসযজ্ঞ দেখে শহীদ কাদরীর কবিমন নিরাশাকরোজ্জ্বল হয়ে পড়েছিল। জীবনের সঙ্গে কানামাছি খেলতে খেলতে তিনি যেন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। অন্ধকার ও নৈঃশব্দকে সঙ্গী করে এক জোড়া মূল্যহীন চোখে তিনি গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন। নিজের এই বিচ্ছিন্নতাদীর্ণ কবিভাবনার প্রকাশে তিনি লিখেছেন : ‘আমি শুধু আঁধার নিঃসঙ্গ ফ্ল্যাটে নিঃসঙ্গ জবার মতো/বিপদ-সংকেত জ্বেলে একজোড়া মূল্যহীন চোখে/পড়ে আছি মাঝরাতে কম্পমান কম্পাসের মতো/অনিদ্রায়!’

সব লোকের মাঝে বাস করেও তিনি সর্বদা একাকিত্বের জ্বালা ভোগ করেছেন। জীবনানন্দের ‘বোধ’ কবিতায় কবি যেভাবে বিচ্ছিন্নতার কথা বলেছেন, ‘আমি কিছুই কিনবো না’ কবিতাতেও শহীদ কাদরী একই সুরের অনুরণন ঘটিয়েছেন। শহীদ কাদরী-কল্পিত রুটলেস লোকটির বুক স্বপ্নেভরা। তার চারিদিকে বিলাসিতার বাহারি পণ্য। সে অন্ধকার গলির মধ্যে শুনতে পায় বৃদ্ধদের সুমধুর গান। কিন্তু কোনোকিছুই তাকে টানে না। সে সবকিছুকে উপেক্ষা করে চলে যায়। উদ্ধত পতাকার নিচে সে একা এবং সন্ত্রস্ত। সেই বিচ্ছিন্ন লোকটির জবানবন্দিতে শহীদ কাদরী বোহেমিয়ান চিন্তার প্রকাশে লিখেছেন : ‘চারিদিকে রঙবেরঙের জামা-কাপড়ের দোকান/মদিরার চেয়ে মধুর সব টেরিলিনের শার্ট/ভোরবেলার স্বপ্নের চেয়ে মিহি সূক্ষ্ম সুতোর গেজি/স্বপ্নাক্রান্ত বালকের হাতেরও অধিক অস্থির/রজ্জুতে-গাঁথা রাশি রাশি, পুঞ্জ পুঞ্জ লাল, নীল উজ্জ্বল রুমাল/মেঘলোকে মজ্জমান রেস্তোরাঁর দ্বারগুলো খোলা-/আমি অবহেলে চলে যাবো, যাই/আঁধার রাস্তার রানী চকোরীর মত বাঁকা চোখে দ্যাখে/-আমি কিছুই কিনবো না।’ সাতচল্লিশের দেশভাগের পর শহীদ কাদরী ঢাকায় এসে যে জীবন-বাস্তবতার মুখোমুখি হলেন, সেখানে সামরিক শাসকদের চোখ রাঙানি আর ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তির আস্ফালনে চারদিকে বিপন্ন পরিবেশ। মানুষের মৌলিক অধিকার বলে কিছু ছিল না। এমন দেশ-কাল-পরিবেশ একদিকে যেমন তাকে প্রতিবাদী করে তুলেছিল, অন্যদিকে তেমনি করে তুলেছিল নেতিবাদী চিন্তার অধিকারী। এক তাল হতাশা আর নৈরাশ্য গ্রাস করেছিল তাকে। হতাশা থেকেই তার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল বিচ্ছিন্নতা, আর বিচ্ছিন্নতার থেকে লিখেছিলেন : ‘কেন এই স্বদেশ-সংলগ্ন আমি, নিঃসঙ্গ, উদ্বাস্তু,/জনতার আলিঙ্গনে অপ্রতিভ, অপ্রস্তুত, অনাত্মীয় একা,/আঁধার টানেলে যেন ভূতলবাসীর মতো, যেন/সদ্য উঠে আসা কিমাকার বিভীষিকা নিদারুণ!’ তার কবিচেতনায় জমা হয়েছিল আধুনিক নগরসভ্যতার ক্লেদ, ক্রন্দন, বেদনা, অস্থিরতা, হতাশা, ভণ্ডামি, ধর্মান্ধতা, উদ্বাস্তু-সংকট ও প্রেমহীনতায় ভরা মানুষের যন্ত্রণা-জর্জর জীবনের চালচিত্র। ফলে নপুংসক সন্তের মতো উচ্চারণ করেন : ‘আমার বিকট চুলে দুঃস্বপ্নের বাসা? সবার আত্মার পাপ/আমার দুচোখে শুধু পুঞ্জ পুঞ্জ কালিমার মতো লেগে আছে/জানি, এক বিবর্ণ গোষ্ঠীর গোধূলীর যে বংশজাত আমি/বস্তুতই নপুংসক, অন্ধ, কিন্তু সত্যসন্ধ দুরন্ত সন্তান।’

যুগের বৈরী পরিবেশের পাশাপাশি সমসাময়িক লেখক-বুদ্ধিজীবীদের সংকীর্ণতা, হীনম্মন্যতা, ঈর্ষা, হিংসা-বিদ্বেষ, প্রতিষ্ঠা পাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা, কাদা ছোড়াছুড়ি, আত্মপ্রচার, রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রভৃতি দেখেও শহীদ কাদরী বোহেমিয়ান হয়ে পড়েছিলেন। তখন ‘অধিকাংশ মানবতাবাদী ও বামপন্থি বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক বিকারসহ ও নির্বিকারে বেতনদাসে রূপান্তরিত ও বিচিত্র লোভের শিকারে পরিণত। বুর্জোয়া রাজনীতি ড্রয়িংরুমবাসী; বামপন্থি আন্দোলন বহুধা-খণ্ডিত আর তত্ত্ব গবেষণায় নেতৃবর্গ তখন ব্যস্ত।’ এমন যুগ-পরিবেশে দেশের মাটিতে স্বস্তির কোনো আবহ সৃষ্টি হয়নি তার জন্য। সেজন্য সিদ্ধান্ত নেন দেশ ছাড়ার এবং বেছে নেন একাকিত্ব-ভরা জীবন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন : ‘নানা ব্যক্তিগত কারণে, মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থায় দেশত্যাগ করেছিলাম। লেখকদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা, আত্মপ্রচারের ঢক্কানিনাদ, কাদা ছোড়াছুড়ি ইত্যাদির ফলে এমনই বিবমিষা আমাকে দখল করেছিল যে শুধু স্বস্তি ও শান্তির জন্য শিল্পসাহিত্যের সঙ্গে সবধরনের সংযোগ ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিই।... নিজেকে নির্বাসিত না বললেও পলাতক বলা যেতে পারে। পরশ্রীকাতর, পরচর্চালিপ্ত, রন্ধ্রসন্ধানী আমার চেনা ভূখ  থেকে পালিয়ে এসেছিলাম। এখন তো অসুস্থততার কারণে এই পা ববর্জিত মার্কিন মুল্লুকে গৃহবন্দী আমি।’

তার প্রথম কাব্য উত্তরাধিকার যুগ-যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত কবির রক্তাক্ত হৃদয়ের আর্তনাদে পরিপূর্ণ। দ্বিতীয় কাব্য তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’য় কবিসত্তার বোহেমিয়ান স্বভাবকে রাষ্ট্রীয় জীবনের সঙ্গে একাকার করে দিয়েছেন। তিনি গোলাপ! গোলাপ! চিৎকারে বাতাস ভারি হতে দেখেছেন। লক্ষ করেছেন সমকালীন সভ্যতার গায়ে যেন জমাট বেঁধেছে কালশিরা। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থের কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই নামের মধ্যেই বোহেমিয়ান সুর বেজে ওঠে। চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও-এর মধ্যে স্থান পেয়েছে প্রবাসজীবনের বেদনা, দেশের জন্য আকুতি এবং ব্যক্তিজীবনের খেদ, গ্লানি, হতাশা, বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতা। মৃত্যুর পর প্রকাশিত গোধূলির গান কাব্য হয়ে উঠেছে বিরূপ বিশ্বের বোহেমিয়ান কবি শহীদ কাদরীর যন্ত্রণা-জর্জর জীবনের রক্তক্ষরণ আর বেদনার গান।

কবিতার বিষয়ের পাশাপাশি নামকরণ, শব্দচয়ন, উপমা-রূপক এবং চিত্রকল্পের মধ্যেও শহীদ কাদরী তার বোহেমিয়ান কবিসত্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’, ‘একটি ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের জার্নাল’, ‘তাই এই দীর্ঘ পরবাস’, ‘শূন্যতা’, ‘একা’, ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’, ‘মৃত্যু’-কবিতার এ জাতীয় নামকরণে কবির বোহেমিয়ান চেতনা বাক্সময় হয়ে ওঠে। ধ্বংসের করতাল, নির্বাসিত কেতন, বর্ণমালাহীন শূন্যতায়-এমন সব শব্দ ও বাক্যবন্ধ শহীদ কাদরীর কবিতায় বোহেমিয়ান ভাবনাকে স্বতঃস্ফূর্ত করে তুলেছে। অলঙ্কার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও কবির এই চেতনার প্রকাশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অনুপ্রাস : ‘বাঁকা-চোরা হৃদয়ের ত্রাস/লুকিয়ে রাখা একটি দীর্ঘশ্বাস।’ ‘কাউকে বিশ্বাস নেই আর এই বিরূপ বিদেশে।’ উপমা : ‘আর এখন এই আমাদের আকাশজুড়ে উড়ছে অসংখ্য শোকের/পতাকার মতো কাক?’ ‘স্বাধীনতাযুদ্ধের সৈনিকদের মতো ঝরে পড়ছে,/শুধু পাতা ঝরার আর্তনাদ।’ এছাড়া রূপক, উৎপ্রেক্ষা, যমক, চিত্রকল্পসহ বিচিত্র অলঙ্কার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও শহীদ কাদরী তার কবিতায় বোহেমিয়ান চেতনার শৈল্পিক প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এই কবিস্বভাবের কারণেই তিনি আজীবন একাকিত্বের যন্ত্রণায় হাহাকার করেছেন।

সর্বশেষ খবর