শুক্রবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
ভ্রমণ

গোল্ডেনডেইল শহরের কটেজ

মঈনুস সুলতান

গোল্ডেনডেইল শহরের কটেজ

মিসেস সিলভিয়া স্ক্রিবল বোধ করি রিক্লাইনার জাতীয় ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে অনেকক্ষণ বসে থেকে রীতিমতো ঘুমিয়ে পড়েছেন। তার দু’আঙুলে ধরা রঙিন ক্রেয়ন আলগা হতে হতে টুক করে পড়ে যায় কাঠের ফ্লোরে। গেল মিনিট বিশেক হলো তিনি কথাবার্তা কিছু বলেননি। নার্স তাকে অপিয়েট বলে এক ধরনের বেদনা-নাশক ওষুধ দিয়েছে। তার কোলের ওপর এখনো পড়ে আছে ক্লিপবোর্ডে আটকানো চিত্রটি। গত দিন দুয়েকে অল্প অল্প করে ক্রেয়ন দিয়ে তিনি চিত্রটি তৈরি করেছেন। নার্স আঙুলের ইশারায় আমাকে বলে, মিসেস স্ক্রিবলের শরীরে এখন জ্বর একশ তিনের মতো। তার ঘুম সহসা ভাঙবে বলে তো মনে হয় না। আমি কি পাশে বসে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখব?

হঠাৎ করে মিসেস স্ক্রিবল পাশ ফিরতে গিয়ে যেন জেগে উঠে আমার দিকে চেয়ে বলেন, ‘ইউ সো দ্যাট? নো, মনে হয় তুমি দেখতে পাওনি, টু ব্যাড, বে-উইন্ডোর কাছে গিয়ে তাকাও, আমি তো এখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি মাউন্ট রেনেয়ার, আগ্নেয়গিরির লাভা উদ্গিরণ থিতিয়ে এসেছে, কিন্তু এখনো দেখছ কী রকম মেঘের মতো চূড়ায় উড়ছে ধোঁয়া।’ মিসেস স্ক্রিবলের স্পষ্টত ডিলিরিয়াম হচ্ছে। আমরা বসে আছি ম্যাসাচুসেটসের একটি মফস্বল শহরের হসপিস বা বয়স্ক মৃত্যুপথযাত্রীদের জন্য নির্ধারিত একটি আবাসে। মাউন্ট রেনেয়ার তো এখান থেকে হাজার মাইল দূরে-ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের একটি আগ্নেয় পাহাড়। পাহাড়টি সুপ্ত, তা থেকে লাভা উদ্গিরণ হবে কেন?

মিসেস স্ক্রিবল আমার নেইবার। মাস দুয়েক হলো এ সত্তোরর্র্ধ্ব বয়সের বৃদ্ধার শরীরের সর্বত্র ছড়িয়েছে ক্যান্সারের জীবাণু। তার সংসারে কেউ আছেন কিনা বলা মুশকিল। আরিজোনার কোথায় যেন তার এক ভাই বাস করেন। কিন্তু মিসেস স্ক্রিবলের কাগজপত্র তালাশ করে কোথাও তার টেলিফোন নম্বর পাওয়া যায়নি। হসপিসে তার চিকিৎসা হচ্ছে, ইন্সু্যুরেন্স খরচ জোগাচ্ছে। তবে দিন কয়েক হলো তিনি খুব নিঃসঙ্গ বোধ করছেন। তাই আমরা, তথা পাড়ার পরিচিত পড়শিরা কাজের অবসরে পালা করে এসে ঘণ্টাখানেক পাশে বসে তাকে সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছি।

গেল এক সপ্তাহে যতবার আমি হসপিসে এসেছি, মিসেস স্ক্রিবল প্রতিবারই ওয়াশিংটন রাজ্যের গোল্ডেনডেইল বলে ছোট্ট একটি শহরের কথা বলেছেন। ওখানেই তার পৈতৃক বাড়ি। বাড়িলাগোয়া জমিতে আপেল অর্চাড। তার বাবা ওখানে রেড ডেলিশাশ ভ্যারাইটির আপেলের চাষ করেন। বার দুয়েক কথা বলতে বলতে বালিশের পাশ থেকে তিনি খুঁজে বের করেন পুরনো হতে হতে হলুদ হয়ে আসা একটি ছোট্ট অ্যালবাম। তাতে শনে ছাওয়া শৌখিন কেতার একটি কটেজের ছবি। পরের পাতার ছবিটি আপেল অর্চাডের। তিনি লাল রঙের কতগুলো ঝুলন্ত রেড ডেলিশাস আপেলের ফটোগ্রাফে আঙুল বুলিয়ে বলেন, ‘বিলিভ ইট অর নট, দে আর দ্য জুসিয়েস্ট সুপার সুইট আপেল ইন দ্য হৌল ওয়ার্ল্ড। আমার ড্যাডি নিজ হাতে চারা কলম করিয়ে এগুলো অর্চাডে লাগিয়েছিলেন।’

খুব ছোটবেলা মিসেস স্ক্রিবলের অ্যারোপ্লেন চড়ার শখ ছিল। বাবা কাঠ দিয়ে অ্যারোপ্লেনের মডেল তৈরি করে দেন। মডেলটি এখনো আপেল বাগানে রাখা আছে। বাগানের ভেতর দিয়ে চলে গেছে সরু একটি সড়ক। সড়কের পাশের ছোট্ট পুকুরের পাড়ে তার মা ট্রেতে কাটা আপেল সাজিয়ে রাখেন বাচ্চা হরিণদের জন্য। বাবা পেশায় কাঠমিস্ত্রি, বাগানেই তার ওয়ার্কশপ, তার ওপর তলায় মিসেস স্ক্রিবলের ছবি আঁকার স্টুডিও। মিসেস স্ক্রিবল আমাকে অনুরোধ করেন, ‘তুমি আমার জন্য ক্লিপবোর্ড, কাগজ আর কয়েকটি রঙিন ক্রেয়ন নিয়ে এসো। আমি তোমাকে আমাদের বাড়িটা এঁকে দেখাব। তাহলে সব তোমার কাছে স্পষ্ট হবে। নিজের চোখেই দেখবে- কি সুন্দর আমাদের ঘরবাড়ি। মা-বাবার কটেজ থাকতে এরকম হসপিসে পড়ে থাকার আমার কোনো দরকারই নেই।’

দিন তিনেক আগে আমি তাকে কাগজ আর ক্রেয়ন এনে দেই। আজ এসে দেখি তিনি দিব্যি সুন্দর চিত্র তৈরি করেছেন। আপেল বাগানে কটেজের মতো একটি ঘর। অনেকক্ষণ কেশে হাঁপিয়ে তারপর দম ফিরিয়ে বলেন, ‘এসব ক্যান্সার ফেনসার কিছু না। বাড়িতে ফিরে বে-উইনন্ডোর পাশে কাউচে বসে সেলারে রাখা সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের আগেকার আমলের ওয়াইন খেতে খেতে মাউন্ট রেনেয়ারের দিকে তাকিয়ে থাকলে শরীর ভালো হতে আর কতক্ষণ? বাবা সেলারে যে ওয়াইনের বোতল রেখে ছিলেন পার্ল হারবারের বোমাবর্ষণের দিন, এ বোতলগুলোর বয়স কত হলো বলতে পারবে?’

মিসেস স্ক্রিবল গভীর ঘুমে তালিয়ে গেছেন দেখে আমি হসপিসের বারান্দায় এসে দাঁড়াই। নার্স তাকে কম্বলে ঢেকে দিয়ে আমার কাছে এসে বলে, ‘লক্ষণ ভালো মনে হচ্ছে না, তার ভাইয়ের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল কি?’

দিন তিনেক কাজের চাপ ছিল বলে মিসেস স্ক্রিবলকে দেখতে আসা হয়নি। আজ হসপিসে আসতেই গাড়ি বারান্দায় নার্সের সঙ্গে দেখা। ট্রলিতে করে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে যেতে যেতে ম্লান হেসে সে বলে, ‘একটু দাঁড়াও মিসেস স্ক্রিবল তোমার জন্য একটি চিত্র ও একটি অ্যালবাম রেখে গেছেন।’ নার্স ভেতরের কামরা থেকে অ্যালবামটি ও কাঁপা হাতে আঁকা একটি চিত্র নিয়ে আসে। তাতে অর্চাডে ঝুলছে থোকায় থোকায় লোহিত সব আপেল। পাশের পুকুড়পাড়ে দাঁড়িয়ে উঁকি দিচ্ছে বাচ্চা একটি হরিণ। মৃত্যুর আগে কিছুক্ষণ তিনি নার্সের সঙ্গে গল্পগুজব করতে করতে বলেছেন, গেলরাত্রে গোল্ডেনডেইলের পৈতৃক কটেজটি নাকি তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়েছে। তিনি তো আর অপেক্ষা করতে পারেন না, তাই একটু পর নিজেই বেরুবেন গ্রেহাউন্ড বাসের টিকিট কাটতে। আমার সঙ্গে তার যে আর দেখা হবে না, তাই আমাকে আপেল বাগানের চিত্রটি দিতে তিনি নার্সকে অনুরোধ করেছেন। আর যেহেতু তার উত্তরাধিকারী কোনো আত্মীয়স্বজনের তালাশ পাওয়া যায়নি- নার্স জানতে চান, আমি অ্যালবামটি নেব কিনা? আমি নার্সের চোখের দিকে তাকাই, তারপর নীরবে মাথা নাড়িয়ে হাতে তুলে নেই অ্যালবামটি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর