শুক্রবার, ৭ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

আহমদ ছফার যুগ

সলিমুল্লাহ খান

আহমদ ছফার যুগ

ছবি : নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

আমাদের যুগ আহমদ ছফার যুগ। এই কথা শুনিয়া মোটেও আঁতকাইয়া উঠিবার দরকার নাই। আমি বলিতেছি আমাদের সাহিত্যের কথা। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পাইবার কিছুদিন আগে মহাত্মা আহমদ ছফা ইংরেজি ভাষায় ‘বাংলার সাহিত্যাদর্শ’ নামে একটি নিবন্ধ লিখিয়াছিলেন। পরে ইহার একটি বাংলা তর্জমাও তিনি পেশ করিয়াছিলেন। সেই নিবন্ধে তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম-যথাক্রমে এই চারি মহাজনের নাম লইয়াছিলেন। বলিয়াছিলেন ইঁহারাই-তাঁহার বিচারে-বাংলার সাহিত্যাদর্শ। তিনি সরবে না বলিলেও আমরা ধরিয়া লইয়াছিলাম তাঁহার বিচারের চৌহদ্দি একান্ত ব্রিটিশ শাসনের যুগেই আবদ্ধ ছিল।

সঙ্গত কারণেই আমরা জিজ্ঞাসা করিতে পারি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর নজরুল ইসলামের যুগ শেষ হইবার-মানে ব্রিটিশ শাসন উঠিয়া যাইবার (খাসবিচারে ইংরেজি ১৯৪১-৪২ সালের)-পরে কি আমাদের মধ্যে আর কোন সাহিত্যাদর্শ জন্মায় নাই? এই সওয়ালের দুইটি জওয়াব হইতে পারে। হইতে পারে-তুলনীয় কোন সাহিত্যাদর্শ ইঁহাদের পরে আর সত্য সত্যই জন্মায় নাই। আবার এমনও হইতে পারে যে জন্মাইয়াছে-কিন্তু আহমদ ছফা দেখিতে পান নাই। আপনাদের কাহারও কাহারও মনে পড়িতে পারে-এমন একটা যুগও গিয়াছে-আমাদের দেশে ‘রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত’ জয়ন্তী পালিত হইত। সকলেই পালন করিতেন এমন নয়, কমিউনিস্ট পার্টির সহযাত্রী কোন কোন সংঘ-সংগঠন এই মর্মে অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন।

আহমদ ছফা জন্মিয়াছিলেন ইংরেজি ১৯৪২ কি ১৯৪৩ সালে। ততদিনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর ইহজগতে উপস্থিত আছেন এমন নহে। নজরুল ইসলামের কর্মজীবনও শেষ। ইহার মধ্যে শত শত সাহিত্য-ব্যবসায়ী এই দেশে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। এই শত ব্যবসায়ীর মধ্যে আহমদ ছফাকে আলাদা করিয়া দেখিবার কোন সার্থকতা আদৌ আছে কি? থাকিলে বা কোথায়? আহমদ ছফার প্রথম যৌবনের প্রধান ঘটনা-বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন আর স্বাধীনতা লাভ। বাংলার সাহিত্যের সহিত এই ঘটনার কোন যোগসূত্র কি আছে? থাকিলে তাহা কোথায়? আজ স্বাধীনতা লাভের পঞ্চাশ বছর পার হইতে চলিয়াছে। কিন্তু আমাদের সাহিত্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের-আরও গাঢ় ভাষায় বলিতে মুক্তিযুদ্ধের-কোন ছায়াটা পড়িয়াছে? স্বাধীনতা সংগ্রামের তিন বড় মন্ত্রের-সাম্যের, মর্যাদার, ন্যায়ের-ছায়াটা কোথায়? সাধের বাংলা ভাষাটাই বা কোন জায়গায় আজ? মুক্তিযুদ্ধের নামে যে সকল রচনা আজিকালি সংবাদপত্রের পাতা ভারি করিতেছে কিংবা একুশের বইমেলা বিজ্ঞাপনে ঢাকিয়া ফেলিতেছে তাহাতেই বা মুক্তি সংগ্রামের মর্মবাণী কতটুকু পাওয়া যায়? আমি জানি আমাদের ধুরন্ধর-বুদ্ধিজীবী-সমাজ এখনও এই প্রশ্নটি ভাবিয়া দেখিবার অবকাশ পান নাই। প্রশ্ন করিতে পারি তখনও বা আমাদের গতানুগতিক বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিসংগ্রামের পদধ্বনি কি (বা কতখানি) শুনিতে পাইয়াছিলেন? ১৯৭১ সালের মহাসংগ্রামে এই বুদ্ধিজীবীদের সক্রিয়তার হিশাব লইলে দেখিতে পাইবেন তাহাতে গৌরবের বিশেষ কিছু নাই।

আহমদ ছফার আর দশটি লেখার কথা ছাড়িয়া দিন। শুদ্ধমাত্র তাঁহার সাত-আটটি উপন্যাস বা মাত্র দুয়েকটা গল্প-কাহিনীর কথাই ধরুন না কেন। আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ‘নজর’ হইতে আহমদ ছফা নিজের দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্যও প্রত্যাহার করেন নাই। আমি এই নিবন্ধে ‘নজর’ কথাটি ইংরেজি ‘গেয়জ’ বা ফরাশি ‘লো রোগাদ’ কথাটার প্রতিকল্প জ্ঞানেই ব্যবহার করিতেছি। ‘নজর’ মানে আপনি যাহা দেখেন মাত্র তাহা নয়, ‘নজর’ মানে তাহা যাহা আপনাকে দেখে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে আপনি কোন চোখে দেখেন সেটাই শেষ কথা নহে। মুক্তিযুদ্ধ আপনাকে কোন চোখে দেখে-ইহাই বড় কথা। ‘বদনজর’ কথাটা আমল করিলেই ঠাহর হইবে। ‘নেকনজর’ ভাবিলেও চলিবে। আপনি বলিতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধের ‘চোখ’ নাই-কিন্তু আমি বলিব, অন্য কথা। তাহার আলোতেই কিন্তু আমরা আমাদের দেখি। এই কথা ভুলিলেই সব শেষ। তাই বলি-কোন আলোতে মুক্তিযুদ্ধ আপনাকে রাঙ্গায় তাহাও দেখিতে হইবে। তাহাতেই কারণটা দেখিবেন। দেখিবেন আহমদ ছফার সহিত তুলনা দিবেন এমন কোন সাহিত্যাদর্শ আজ পর্যন্ত এদেশে কেন জন্মায় নাই। আহমদ ছফা জানিতেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হইয়া উঠিয়াছিল কিন্তু এই যুদ্ধের ফলাফল অপরে আত্মসাৎ করিয়াছে। আমার যুদ্ধের সোনার ধানে অপরের তরী ভরিয়া গিয়াছে। সেখানে চাষীর ঠাঁই হয় নাই।

স্বাধীনতা অর্জন করাটা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সহজ ছিল না। আহমদ ছফা তাহা জানিতেন। “গোটা বাংলাদেশ রিক্ত, নিঃস্ব, অসহায় হয়ে যেন নিরুদ্দেশ যাত্রা করছে”-এই বাক্যটি আহমদ ছফাই লিখিয়াছিলেন ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ প্রকাশিত একটি গল্পে। গল্পের নাম ‘পাথেয়’। তাহার পরও বলিব, স্বাধীনতা লাভ করাটাই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শেষ কথা ছিল না। স্বাধীনতা গঠন ও রক্ষা করিবার কথাটাও তাহার অন্তর্গত না হইয়া পারে নাই। এই স্বাধীন দেশে মানবজীবন ক্রমশ পশুর জীবনের নীচে চলিয়া যাইবে না-এই দাবিও কি স্বাধীনতার অঙ্গে মিশিয়া ছিল না? স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচয়ে বাংলাদেশের প্রথম তিরিশ বছর পর্যন্ত আহমদ ছফা এই ঐশ্বর্যময় পৃথিবীতে নশ্বর জীবন ধারণ করিয়াছিলেন। তিনি ১৯৭১ সাল শেষ হইবার আগেই বুঝিতে পারিয়াছিলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তাহার লক্ষ্য অর্জন করিতে পারে নাই।

১৯৭৫ সালের শেষদিকের একটি লেখায় তিনি যাহা লিখিয়াছিলেন তাহাতে সেই উপলব্ধি, সেই বাসনা, সেই আকুতি-সেই আর্তিই ধরা পড়িয়াছিল। ১৯৭৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তারিখে রচিত নাতিদীর্ঘ এক নিবন্ধে আহমদ ছফা এই কথাটাই লিখিয়াছিলেন: ‘এত অশ্রুভেজা, এত গাঢ় রক্তে রঞ্জিত আমাদের স্বাধীনতা আমাদের এমনভাবে প্রতারিত করছে প্রতিদিন-সে কথা কার কাছে গিয়ে বোঝাই! এ কেমন স্বাধীনতা যে স্বাধীনতা আমাদের গোটা জাতিটাকে ভিখিরিতে পরিণত করে? এ কেমন স্বাধীনতা যে স্বাধীনতায় আমরা একটা কথাও বলতে পারব না?’

আমাদের যুগ স্বাধীনতা সংগ্রামের যুগ। আমাদের যুগ মানুষের মুক্তির যুগ। এই যুগ আহমদ ছফার যুগ। আহমদ ছফার জন্ম না হইলে এই প্রশ্ন না করার অপরাধে আমাদের সাহিত্য ইতিহাসের বিচারে অপরাধী হইয়া থাকিত। তাই বলি আহমদ ছফাই আমাদের সর্বশেষ সাহিত্যাদর্শ। আমাদের দেশে আর একটি আহমদ ছফা কখন জন্মাইবেন বলিতে পারি না। তবে মনে হয়, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মতন আরো একটি মহান আলোড়ন যতদিন না দেখা দেয় ততদিন আমরা নতুন আহমদ ছফার দেখা পাইতেছি না। দার্শনিক মহাশয়েরা যতই বলুন, ইতিহাসের সকল ঘটনা দুই দুইবার ঘটে না।

আমাদের নতুন ইতিহাসে হয়তো নয়া নোনাজল মিলিবে। কপালগুণে হয়তো মাটির আকর্ষণে নতুন খেজুরও খসিতে পারে। আহমদ ছফা শেষ পর্যন্ত এই আশার শাঁস ছাড়িতে রাজি হয়েন নাই। সেই অর্থে আহমদ ছফার যুগ এখনও শেষ হয় নাই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর