শুক্রবার, ৫ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ

রশীদ এনাম

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ

বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির যথার্থ ইতিহাস রচনায় আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের (১৮৭১-১৯৫৩) উত্তরাধিকার আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করে দুই বাংলার সারস্বত সমাজ। তিনি মুসলমান সমাজের প্রথম প্রজন্মের ইংরেজি শিক্ষিত ম্যাট্রিকুলেট হলেও গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা আর চট্টগ্রাম শহরে সরকারি শিক্ষা দপ্তরে কেরানির চাকরি করে মূলত নিজ গ্রাম পটিয়ার সুচক্রদন্ডিতে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। সুচক্রদন্ডি থেকেই তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল কলকাতা ও ঢাকার সুধী মহলের সঙ্গে। তিনি ছিলেন সবার শ্রদ্ধার পাত্র।

তিনি চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলে শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে তিনি যোগ দেন সীতাকুন্ড ইংরেজি স্কুলের অস্থায়ী প্রধান শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে কার্যকাল ফুরিয়ে আসলে তিনি চট্টগ্রামে প্রথম সাবজজ আদালতে ‘এপ্রেনটিস’ হন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি পটিয়া দ্বিতীয় মুন্সেফি আদালতে বদলি হন। ১৮৯৮ সালের জানুয়ারি মাসে অ্যাকটিং ক্লার্করূপে কমিশনার অফিসে বদলি করিয়ে নেন। চাকরি জীবনে নবীন চন্দ্রের প্রীতিই আবদুল করিমের বিপদ ডেকে আনে। নবীন চন্দ্রের একটি বিপক্ষ দল ছিল তাদের ষড়যন্ত্রের কারণে তাকে চাকরি হারাতে হয়। সে সময় আনোয়ারা থানায়  ইংরেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য হলে তিনি ওই পদে নিযুক্ত হলেন। তিনি বলতেন, চাকরি জীবনের মধুর কাল তথা ‘স্বর্ণযুগ’ আমার এখানেই। ১৯০৬ সালে বিভাগীয় স্কুলে ইন্সপেক্টর অফিসে কেরানির পদে নিযুক্ত হন। ২৮ বছর চাকরি পর ১৯৩৪ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি অবসর নেন।

তার সাহিত্যিক জীবনে দুটি ধারা লক্ষ্য করা যায়-একটি হলো প্রাচীন পুঁথিপত্র সংগ্রহ ও তার তথ্য সন্ধান করা। তার মধ্যে কোনো হিন্দু বৌদ্ধ-খ্রিস্টান মুসলিম ভেদাভেদ ছিল না তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম সবার বাড়িতে গিয়ে তিনি পুঁথি সংগ্রহ করতেন। পুঁথি সংগ্রহের কাজটা কিন্তু সমগ্র দেশেই তিনি প্রথম শুরু করেন। সে সময় তিনি প্রবন্ধ লিখতেন। ত্রিশটি পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হতো। সাহিত্য, সংহিতা, সুধা, পূর্ণিমা, নবনূর, অর্চনা, ভারত সুহৃদ, অবসর, প্রদীপ, বীরভূমি, কোহিনূর, প্রকৃতি, আরতি, আশা, ইসলাম প্রচারক, এডুকেশন গেজেটে তিনি নিয়মিত লিখতেন।

চট্টগ্রাম থেকে পূজারি ও সাধনা নামক দুটি পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করেছিলেন। সাহিত্যবিশারদ নবনূর পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন। সাহিত্যানুশীলনের ক্ষেত্রে তার বিশেষ কীর্তি, প্রাচীন পুঁথিপত্র সংগ্রহ প্রাচীন কবিদল, বিশেষত মুসলিম কবিগণকে কোথায়, কি করছেন তার তথ্য সংগ্রহ ছিল তাঁর ব্রত। সমগ্র দেশে পুঁথি সংগ্রহের জন্য তার নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদকে ভীষণ স্নেহ করতেন। তিনি তাকে কলকাতা মেট্রিকুলেশনের বাংলার পরীক্ষক নিযুক্ত করেন। সৈয়দ এমদাদ আলী, ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ তাকে বড় ভাইয়ের মতো জানতেন। সাহিত্যবিশারদের রচিত চট্টগ্রামের ইতিহাস ইসলামাবাদ, ১৩২৫ সালের মাসিক সওগাত পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। পুঁথি সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ গবেষণায় বাঙালি মুসলমানদের মাঝে তিনিই ছিলেন অগ্রগামী। এই চেতনার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা বিশেষভাবে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদরেই অবদান। তাঁর আজীবন সাধনার ফলে আহরিত বিপুল তথ্যপ্ঞ্জু সমান মানসে ওই চেতনার জন্ম দিয়েছে এবং আত্ম ঘোষণার এক অনমনীয় সঙ্কজ সঞ্চারিত করেছে।

সাহিত্যবিশারদ আবদুল করিমের কৃতি ও কীর্তি অতুলনীয়। তিনি তাঁর শ্রমনিষ্ঠ ও সাধনায় বিপুল পুঁথির সংগ্রহ ও বাংলা সাহিত্যের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস পুনর্গঠনে শুধু ভূমিকা রাখেননি। তাঁর মানবপ্রেমও ছিল বেশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নায়ক সূর্য সেনপন্থি ‘পটিয়ার ভাটিখাইনবাসী হরিপদ ভট্টাচার্য চট্টগ্রামের পুলিশ-সুপার খান বাহাদুর আহসানউল্লাহকে নিজাম পল্টনে ফুটবল খেলার মাঠে হত্যা করেন। তিনি হরিপদকে নির্দোষ বলে মত দেন এবং একজন জুরারকে অনুনয় করে স্বমতে আনেন। ফলে সংখ্যাগুরুর মতে হরিপদ নির্দোষ সাব্যস্ত হন, তবু সংখ্যাগুরুর মতো অগ্রাহ্য করে ষোল বছর বয়স্ক হরিপদকে ফাঁসির বদলে জেল দেওয়া হলো। এদিকে অন্যান্য মুসলিম জুরার এবং শহরের মুসলমানরা আবদুল করিমের প্রতি ক্ষুব্ধ হলেন। কয়েক মাস তাঁকে ভয়ে ভয়ে পথ চলতে হয়, উল্লেখ্য যে আহসানউল্লাহ হত্যার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের তথা ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট কমিশনারের গোপন প্ররোচনায় ও নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়ে মুসলিম গুপ্তারা হিন্দুর দোকান-লুটপাট করে। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রদর্শনী ও চট্টগ্রাম সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণে তিনি বলেন, ‘স্নেহ প্রীতি চিরকালই অন্ধ। ইহা তাঁহাদের সেই অন্ধ স্নেহ প্রীতিরই নিদর্শন। না হয় এই সভায় সভাপতিত্ব করার কোনো যোগ্যতাই আমার নাই। ইহা আমার মামুলি বিনয় প্রকাশ নয়। সত্যই আমি গুণী নই, পন্ডিত নই, উচ্চশিক্ষিত লোকও আমি নই। আমি পূর্ব্ব বাংলার একজন গ্রাম্যলোক, গেঁয়ো মানুষ। পশ্চিমবঙ্গের ভাইরা আমাকে বাঙ্গাল বলিতে পারেন। আমার জীবনযাত্রায় কোনো চালচলনে যেমন নাই কোনো চাকচিক্য, তেমনি আমার ভাষা ও লেখায় এক কথায় আজীবন আমি যে সাহিত্যের সাধনা করিয়াছি তাহাতেও নাই কোনো চাকচিক্য এবং নাই আধুনিক সাহিত্য পাঠকদের আকর্ষণীয় ঔজ্জল্য। আমি পূর্ব্ববঙ্গের মাটির মানুষ।’

পুঁথি গবেষক ও সংগ্রাহক আবদুল করিমকে ১৯০৯ সালে সাহিত্য বিশারদ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এ প্রজন্মের দাবি পটিয়া সুচক্রদন্ডী গ্রামে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ একাডেমি ও পুঁথি গবেষণা ইনস্টিউট স্থাপন করা হোক। পুঁথির সাহিত্যের মাঝে অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন তিনি।

সর্বশেষ খবর