শুক্রবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

ও দোলনচাঁপা

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ

ও দোলনচাঁপা

এক.

গাড়ির বাঁ-পাশের পেছনের দরজার কাচটি নামাতেই ছুটে এলো মেয়েটি। ‘ছার, একটা তোয়াইল্যা নেন। দেখেন কী সুন্দর। নরম আছে।’ বলতে বলতে একটি একটি করে তোয়ালে মেলে ধরতে লাগল মেয়েটি। শাদা, গোলাপি, হলুদ, নীল, পিত রং।

তার কাঁধে বড় বোঝা তোয়ালের। কতগুলো হবে? গোটা শতেক তো হবেই মনে হচ্ছে। এগারো কি বারো বছরের কাঁধ। তাতেই এত ভার! ভাবতে ভাবতে একটা তোয়ালে নিলাম ওর হাত থেকে।

ঘড়ি ধরে চলে গুলশানের এই সিগন্যাল। কখনো-সখনো পাঁচ-সাত মিনিটেরও বেশি। তোয়ালেটা খুব মোলায়েম না হলেও খারাপ না। হালকান্ডপাতলা ডাস্টিংয়ের কাজ চালিয়ে নেওয়া যাবে।

‘দাম কত খুকি?’

‘শয়টা নেবেন ছার?

কিছু একটা বলব তার আগেই এসে দাঁড়াল আরও একজন। মেয়েটির পাশেই। পরনে ঘামে-ময়লায় হলদে হয়ে যাওয়া পাঞ্জাবি। কাঁধ, কলার, বুকের দিকটায় ফেঁসে গেছে। পথের পাশের বৈদ্যুতিক পিলারের ছায়া পড়েছে তার মুখে। তাতে যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, চুলগুলো আলুথালু। তামাটে আঁশের মতো। থুঁতনিতে শুকনো পেঁয়াজের শিকড়ের মতো দাঁড়ি। গোঁফও তেমনই। চোখের কোণে পিচুটি জমে আছে মাখনের মতো। চোয়ালের হাড়গুলো ভেসে আছে। টিলার মতো উঁচু কণ্ঠনালি। হা করে শ্বাস নেওয়ায় ওঠানামা করছে বারবার। মানুষটা বেঁকে গেছে গাছের মতো। বাঁ হাতটা বাঁ পায়ের হাঁটুতে রাখা। লুঙ্গিটা তোলা তার কাছাকাছি। ডান হাতটি বাড়িয়ে দিল খোলা কাচের দিকে। অস্ফুট এক শব্দ বেরিয়ে এলো মুখ থেকে। ‘উঁ উঁ উঁ’।

‘হেয় কিন্তু এক্কেরে ভালা। হাঁটতে পারে। ল্যাংড়া না। আপনেগো দেখলেই খালি অ্যাঁ, অ্যাঁ করে।’ ঘুরে তাকাতেই বলল মেয়েটি। লোকটির চোখেমুখে বিরক্তি। কপালে ভাঁজ। চোখ দুটো গোল করে তাকাল মেয়েটির দিকে। মনে হচ্ছে, পারলে গিলে খায়। এ নিয়ে ভাবনা নেই তার। বরং মুখ টিপে হেসে আমাকে ফের বলল, ‘বুঝছি স্যার তোয়াইল্যা নিতেন না। দেন জাইগা।’ বলেই হাত থেকে তোয়ালেটি নিয়ে উঠে গেল ফুটপাথে। হতবাক আমি। কিছু বলার আগেই ঘটে গেল সব। লোকটি এখনো হাত বাড়িয়ে আছে আমার দিকে। ‘উঁ উঁ উঁ’ শব্দটা করছে থেমে থেমে। নাছোড়। খালি হাতে ফিরবে না। কিন্তু মেয়েটি যা বলল, তারপর তার হাতে কীভাবে কিছু দিই? ‘আপনি কি আসলেই হাঁটতে-চলতে পারেন না?’ বলতেই লোকটি আর মুহূর্ত দেরি করল না। সরিয়ে নিলো হাত। ‘এই যে, শুনুন আপনি কি কথাও বলতে পারেন না?’ পেছনে না তাকিয়ে ছুটতে লাগল অন্য গাড়ির দিকে।

হর্ন বাজাতে শুরু করল সিগন্যালে আটকে থাকা গাড়িগুলো। একজন থামে তো শুরু করে অন্যজন। সিগন্যালে দাঁড়িয়ে এভাবে হর্ন বাজানোর কোনো মানে আমি খুঁজে পাইনি আজও। তাদের কান্ড দেখে মনে হয়, হর্ন দিলে উড়ে চলে যাবে সামনের গাড়িটা। জায়গাটা খালি হলে সেও চলে যাবে অনায়াসে। হর্ন আর মানুষের হল্লায় আমার কথাগুলো লোকটির কানে পৌঁছাল কি-না বোঝা গেল না তাও। সিগন্যাল ছেড়ে দেওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। লাল, সবুজ বাতির ওপরের টাইম কাউন্টিং বোর্ডে কয়েক সেকেন্ড বাকি। ড্রাইভার সাহেব গাড়ি স্ট্যার্ট করলেন। জেগে উঠল পেছনের গাড়িগুলোও। হর্ন বাড়ছে ক্রমশ। এ যেন তাদের আনন্দ প্রকাশ। লুকিং গ্লাসে দেখতে পেলাম, সেই লোকটি হাঁটুতে ভর দিয়েই খোঁড়াতে খোঁড়াতে উঠে গেল ফুটপাথে। সিগন্যাল ছেড়ে দিয়েছে। গাড়ি এগোচ্ছে আস্তে আস্তে। ফুটপাথে ওঠার সময় লোকটির হাত হাঁটু থেকে সরে উঠে গেল ঊরুতে। তারপর কোমরে হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল। দিব্যি ভালো মানুষ! সামনে হালকা ঝুঁকে আরও দেখা গেল, অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা তোয়ালে কাঁধের মেয়েটির দিকে এগোচ্ছে লোকটি। মেয়েটি অন্যমনস্ক হয়ে হাতের ওপর রেখে ভাঁজ করছিল তোয়ালেগুলো। লোকটি গিয়ে সন্তর্পণে দাঁড়াল ওর পেছনে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই, ওর ময়লা-মলিন ফ্রকের ওপাশ থেকে উঁচু হয়ে থাকা বুকে চাপ দিল শক্ত হাতে। ‘মাগো’ বলে চিৎকার করে উঠল মেয়েটি। চিৎকারে এতটাই জোর ছিল যে, শত কোলাহল ছিন্ন করে ক্ষীণ হলেও পৌঁছাল কানে। তেড়ে গেল লোকটির দিকে। ততক্ষণে দৌড়ে ডিসিসি মার্কেটের গলিতে সিঁধিয়ে গেল সেই ল্যাংড়া ভিখেরি। কাঁধে বোঝা নিয়ে মেয়েটি ছুটছে তার পিছু। লুকিং গ্লাসে আর কিছুই দেখা গেল না।

দুই.

তারপর কয়েকদিন গুলশানের ওই পথে যাওয়া-আসা হয়নি। ফের যেদিন গেলাম মনে মনে খুঁজতে লাগলাম মেয়েটিকে। ল্যাংড়ার অভিনয় করা ভিখেরিটিকেও। গাড়ি সিগন্যালে আটকে আছে গ্লোরিয়া জিনসের সামনে। এপাশের রাস্তায় দামি দামি সব গাড়ি আর মানুষের সমাবেশ। কত বাহারি মানুষ! কী তাদের সাজ-পোশাক! ধোপদুরস্ত পোশাকে নারীরা। হালকা হলদে আলোয় চেকনাই রূপ। সুশ্রী-কুশ্রী যাই হোক, ওয়েস্টার্ন-মডার্ন পোশাকে সব কেমন মানিয়ে যায় চোখে। পুরুষরাও কম যায় না।

এসবে যখন ফেঁসে গেছে চোখ, তখন হঠাৎ সেই অভিনেতা ভিখেরিটিকে দেখলাম, একই রকম। গ্লোরিয়া জিনসের সামনের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। বাঁ-হাতটা হাঁটুর ওপর রাখা। কফি হাউসের দুয়ারেই গিয়ে থামছে গাড়ি। উঠে যাচ্ছে একে একে। যাদের গাড়ি নেই কিংবা পাশের গলিতে পার্কিং করেছে তারা বেরিয়ে আসছে ফুটপাথে। হাই-হিলের টুকটুক ছন্দ তুলে। ভেলভেট ফরেস্ট উড, আইল্যান্ড কিস, এসকাডা, ভার্সাচির ভুরভুরে গন্ধ ছড়িয়ে পার হয়ে যাচ্ছে। আছে সুঠাম পুরুষের গায়ে জোভান, অ্যাজারোর সুবাসও। তাদেরই দু-একজনের পিছু পিছু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে লোকটা। কেউ তাকাচ্ছে না তার দিকে। একবার যদিও বা চোখ ফেরাচ্ছে, নাক সিটকে সরে যাচ্ছে দূরে। লোকটিও নাছোড়। যতক্ষণ না ফায়দা হাসিল হচ্ছে, পিছুপিছু খোঁড়াচ্ছে। তোয়ালে বিক্রেতা মেয়েটির কথা ভাবছিলাম। হঠাৎ ডানপাশের দরজার কাচে ঠকঠক শব্দে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। তাকাতেই দেখি বেশকিছু বই হাতে দাঁড়িয়ে একজন। বইগুলো থরেথরে এমনভাবে রাখা যে, তার মুখটাই ঢেকে গেছে।

‘বই নিবেন ছার?’ গ্লাসটা ওপাশ থেকে নেমে যেতেই গাড়ির প্যা-পু শব্দের সঙ্গে ঢুকে পড়ল কথাটিও।

‘আরে খুকি, তুমি! কেমন আছ?’ কথাগুলো মুখ থেকে এমনভাবে বেরিয়ে এলো যে, মেয়েটি যেন আমার কতদিনের চেনা! অথচ আজ নিয়ে দুদিন দেখা।

‘ভালা নাই ছার। মায়ের অসুখ। বই নিবেন একটা?’ কাতর গলায় উত্তর দিল মেয়েটি। ‘অনেক ইংরাজি বই আছে। কমদামে দিমু। নেন না ছার।’

নিদারুণ আকুতির অসহায়ত্বে আর্দ্র হয়ে উঠল মনটা। তার হাত থেকে নিয়ে দেখতে লাগলাম, ‘রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড’, ‘থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ’, ‘গুড ইকনোমিকস ফর হার্ড টাইম’, ‘সেপিয়েন্স’, ‘দ্য কাইট রানার’, ‘নরওয়েজিয়ান উড’-আরও কত কী।

‘তোমার মায়ের কী হয়েছে বললে?’

‘বুকের অসুখ। শ্বাস নিতে খুব কষ্ট।’ মেয়েটি উত্তর দেয়।

‘আর কেউ নেই তোমার বাড়িতে?’ জানতে চাইলাম।

‘আছে ছার। ভাই আছে। রিকশার গ্যারেজে কাম করে। বাপ নাই। ছাইড়া গেছে আমাগো। কই গেছে জানি না।’ মেয়েটি ব্যস্ত গলায় বলতে থাকে, ‘সিগন্যাল ছাইড়া দিব ছার। বই নিবেন না?’ ছয়টি বইয়ের দাম মিটিয়ে দিতেই প্রশান্তির এক হাসি ফুটল মেয়েটির মুখে। ততক্ষণে সবুজ হয়েছে লালবাতি। স্টার্ট নিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল গাড়িগুলো। মেয়েটি তার ভেতর দিয়েই দৌড়ে উঠল ফুটপাথে। এতগুলো বই একসঙ্গে বিক্রি করতে পেরে খুব খুশি মনে হলো তাকে। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আমার গাড়িটি লক্ষ্য করে কপালে হাত তুলে সম্মান জানাচ্ছে তখনো। মৃদু হেসে হাত নাড়লাম আমিও। হঠাৎ মনে পড়ল সেদিনের কথা। আমাকে কথাটা বলার কারণে আর কী খেসারত দিতে হয়েছিল তাকে। জানার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু কথাটা বলা যেত কীভাবে? ওইটুকু মেয়ে, লজ্জা পেত নিশ্চয়ই।

তিন.

দিন দশেক পরের কথা। ফিরছি গুলশানের ওই পথ ধরে। সিগন্যাল পার হওয়ার বেশ আগে, লাল রংয়ের দালানটির সামনে মানুষের জটলা। নজর কাড়ল। জটলার ভেতর থেকে ভেসে আসছে নারী কণ্ঠের ক্ষীণ আর্তনাদ। ‘গাড়ি থামান।’ ড্রাইভারকে বললাম। কাচটা নামিয়ে চেষ্টা করলাম কী হচ্ছে বোঝার। একটা জোরালো পুরুষ কণ্ঠ খেঁকিয়ে উঠছে বারবার। পর মুহূর্তেই সেই নারী কণ্ঠের কান্না। ভিড় বাড়ছে উৎসুক জনতার। কী হচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ভিড়ের ফাঁক গলে চোখ রাখার চেষ্টা করছি। নাহ, ওভাবে ধরা দিচ্ছে না কিছুই। তবে দেখা গেল ওই মেয়েটিকে। আজও ওর হাতে বই। বাঁ হাতের কনুইটা ভাঁজ করে বইগুলো ঠেসে ধরেছে হার জিরজিরে বুকের সঙ্গে।

‘এই খুকি!’ কয়েকবার ডাকলাম, ‘কী হয়েছে রে ওখানে?’

ডাক শুনে দু-একজন মুখ ফেরালেও খুকি শুনলো না। তাদেরই একজনকে ইশারা করে দেখিয়ে দিলাম খুকিকে। খুকি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল চোখমুখ কুঁচকে। তারপর চিনতে পেরেই মৃদু হেসে ছুটে এলো কাছে।

‘কী হয়েছে রে ওখানে?’

‘ব্যাডায় আবার বিয়া করছে।’ খুকি হাসতে হাসতে বলতে লাগল, ‘আগের আছে দুই বউ। তারপর আরেকটা করছে। বেডি নাকি বাজারে মাছ কাডে।’

‘কে, বলত?’ কিঞ্চিৎ উৎসুক ভাব কানে বাজল নিজের প্রশ্নে।

‘আরে ওই যে ল্যাংড়ার ভন ধরে না, ওই ব্যাটায়।’ খুকি মুখটাকে জটলার দিকে ইশারা করে জবাব দিল। 

‘ও আচ্ছা।’ বললাম, ‘কোনো মহিলা কাঁদছে মনে হলো?’

‘হ, হের আগের ছোড বউ।’ বলতে থাকে খুকি, ‘ওই মাছ কাডুনি বেডির চুল ছিঁড়ছে। হেই বেডি আবার বিচার দিছে ল্যাংড়ার কাছে।’ এই শহরে যে এত উৎসুক মানুষের বাস! তাদের মধ্যে আমিও একজন। তা না হলে গাড়ি থামিয়ে ঘটনা জানার চেষ্টা করি? মানুষের জানার আগ্রহ একেক পর্যায়ে একেক রকম। কেউ হয়তো মহাকাশের অজানাকে জানতে ব্যস্ত। কেউ চুপি চুপি নিতে চায় পাশের ফ্ল্যাটের খোঁজ। আবার কেউ এই পথের ধারের কলহ। কী বিচিত্র! ‘ব্যাডায় বড় খবিশ।’ আমাকে চুপ থাকতে দেখে খুকি ফের বলে, ‘এতগুলা মাইনষে কইতাছে তাও বেডির চুল ছাড়ে না। এত কিলঘুষি দিল তাও না। মুঠির মইদ্দে কী জোর! শরীরে তাগদ (তাকত) কম না। কিন্তু খায় ভিক্ষা কইরা। কাম করে না।’ ‘বাহ! তুমি তো বেশ বোঝ।’ স্মিত হেসে বললাম।

‘ঠিকই তো আপনেই কন, বত্তা মানুষ হইয়া ল্যাংড়ার ভন ধরা কি ভালা কাম?’ খুকির কণ্ঠে ঝাঁঝ, ‘কামাই তো কম না। অনেক টেকা-পয়সা ডাইনে-বামে জমাইছে। এখন নিত্য নিত্য বিয়া করে। জাউরা ব্যাডায় কী কয় জানেন?’

‘কী বলে?’ ‘কয় তর মায়রে আমার কাছে বিয়া দিবি? তগো কুনু কষ্ট হইব না। তরও ফেরি করা লাগব না। ল্যাংড়ায় আইজ কাইল সুবিধা কম। আমি কানা সাজুম। তুই আমারে ধইরা ধইরা গাড়ির সামনে নিয়া যাবি।’ খুকি জটলার দিকে মুখ ফিরিয়ে খিস্তি করে ওঠে, ‘বেশ্যা মাগির পোলার হাউশ কত।’ খুকির চোখমুখ জ¦লজ¦ল করছে ক্রোধে। কিছু না বলেই আপন মনে সে উঠে গেল ফুটপাথে। আমি তাকিয়ে রইলাম তার ধুলো মলিন পায়ের দিকে। স্যান্ডেলটা তার পা থেকে বেশ বড়। পা টেনে পথ চলতে হয়। তাতেও যেন কষ্ট নেই তার।

চার.

ওই ঘটনার পর দীর্ঘদিন গুলশানের সিগন্যালে খুকি কিংবা ভিখেরিটা, দেখা পাইনি কারও। নতুন কয়েকজন এসেছে। ওদের জায়গায়। ওরা কোথায় গেছে, কিংবা কেন আর এখানে আসে না, প্রশ্ন মনে থাকলেও উত্তর খোঁজার চেষ্টা করিনি। পথের এই মানুষগুলো কোথা থেকে আসে কোথায় হারিয়ে যায়, কে রাখে তার খোঁজ? নগরের বিচিত্র মানুষের বিচিত্র জীবন। গন্তব্যের মানুষ, গন্তব্যহীন মানুষ। কতকিছুই ঘটে চোখের সামনে। কজনইবা মনে রাখে? এভাবেই এক সময় যখন বিস্মৃত হতে বসেছে সেই খুকি আর ল্যাংড়া ভিখেরি-ঠিক তখনই একদিন সিগন্যালের লালবাতি থামিয়ে দিল গাড়ির চাকা। গাড়িতে বসে প্রায় সময়ই চোখ থাকে মুঠোফোনে। হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ম্যাসেঞ্জারের অনবরত নটিফিকেশন। একটার পর একটায় চোখ বোলানো। রিপ্লাই দেওয়া। এই করে কাটে সময়। খুব কম সময়ই কালচে কাচের ওপাশে যায় চোখ। মুঠোফোনের স্ক্রিনে চোখ ঝলসে যাওয়ার উপক্রম হলে স্বস্তির জন্য দৃষ্টি দিলাম বাইরে। কাচের এপাশ থেকে বাইরের জগৎটাকে মনে হচ্ছে কালচে-ধূসর চাদরে ঢাকা। সেই আবছায়ার ভেতর গুচ্ছ গুচ্ছ শাদা ফুলে আটকে গেল চোখ। তার চেয়ে চমকে দিল ফুল হাতের মানুষটি।

সবুজ পাতায় চারপাশ মোড়া তোড়াগুলো ধরা একহাতে। অন্য হাতটির ভর ক্রাচে। লুঙ্গিটা হাঁটুর কিছুটা নিচে ঝুলে আছে। তার ফাঁক দিয়ে বাঁ পা-টি ঠেকেছে মাটিতে। ডান পা-টি হাঁটুর খানিক নিচে নেমে থেমে গেছে। গায়ে রংচটা নীল পাঞ্জাবি। উশকো চুল। শুকনো পেঁয়াজের শিকড়ের মতো অবিন্যাস্ত দাড়ি-গোঁফ। পরিচিতি মনে হলো মুখটা। সুইচ চেপে দরজার কাচটা নামিয়ে দিতেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল ঝলমলে আলো। স্ট্রিটল্যাম্পের আলোয় ভেসে যাচ্ছে সন্ধ্যা। ধবধবে ফুল হাতের মানুষটি আর অচেনা রইল না। ক্রাচে ডান বাহুর ভর দিয়ে খটখট শব্দে এ গাড়ি থেকে ও গাড়ির কাছে ছুটছে। কালো কালো কাচের সামনে বাঁ-হাতে তুলে ধরছে দোলনচাঁপার তোড়া। তার পিছু পিছু সেই খুকিটিও। তার হাতে বেতের তৈরি ছোট ছোট ঝুড়ি।

‘এই খুঁকি, এই!’ ডাকতেই মুখ ফেরাল মেয়েটি। দৌড়ে এলো কাছে। ‘ছার ভালা আছেন?’ মেয়েটির মুখে উজ্জ্বল হাসি।

‘এতদিন দেখিনি যে, কোথায় ছিলি?’ জানতে চাইলাম।

‘বাড়িত গেছিলাম ছার। মেলা দিন থাকলাম।’

‘আচ্ছা ফুল হাতের ওই লোকটি কি তোর সেই ল্যাংড়া ভিখেরিটা না?’  মেয়েটি মাথাটা ওপরে-নিচে দোলালো। মলিনভাব তার চোখেমুখে। ‘হ ছার, তয় এখন হেয় সত্যি সত্যি ল্যাংড়া।’ ‘বলিস কী, কীভাবে হলো?’

‘হাঙ্গা করার বিচার। হের দুই বউ মিইলা একদিন জুইত মতো ধরছে। বাঁচার লাইগা হেও দিছে আন্দাগোন্দা দৌড়। পড়ছে গিয়া কভারভেনের নিচে।’ মেয়েটি সড়ক বিভাজনের কাছাকাছি ল্যাম্পপোস্টার দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘ওই যে খাম্বাডা দেখতাছেন না, ওইখানে গাড়ির তলে পইরা পাও ছেইচ্যা গেছে। এখন হেয় ফুল বেঁচে।’

বলতে বলতেই খটখট শব্দ তুলে এদিকে আসতে লাগল লোকটি। বাতাসও তার আগে আগে ভাসিয়ে আনছে সৌরভ। কাছাকাছি এসে একটি তোড়া বাড়িয়ে ধরল খোলা কাচের দিকে। ‘ফুল নিবেন ছার? কী সুন্দর বাসনা। নেন একটা।’

মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল। এক তোড়া ফুল নিলাম তার কাছ থেকে। লোকটি টাকাটা পকেটে গুজে নিতেই খুকিটি তার হাত ধরে টানতে টানতে বলল, ‘আব্বা আসেন গাড়ি ছাইড়া দিব। পার হইয়া যাই।’ ওর কথাটা কানে আসতেই অবাক হলাম। লোকটিকে কিছুদূর এগিয়ে দিয়ে ফের আমার কাছে ছুটে এলো সে। লাজুকু কণ্ঠে বলল, ‘আমার মায়েরে হেয় বিয়া করছে ছার। আমরা এহন একলগেই থাকি।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর