শুক্রবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা
শেষ পর্ব

একুল নেই ওকুল নেই

সমরেশ মজুমদার

একুল নেই ওকুল নেই

[পূর্বে প্রকাশের পর]

মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলে চেয়ারে বসল কমল। ফরমটা তুলতে তুলতে দেখল দিশা তার দিকে তাকিয়ে আছে, চোখাচোখি হতে দিশা জিজ্ঞাসা করল, ‘কয়েকটা তথ্য যে চাই। এখানে তোমার বাবার নাম, বাড়ির ঠিকানা, পাসেপোর্টে যে নাম লেখা আছে সেটাই লিখে দাও। আমারগুলো এই কাগজে লিখে রেখেছি। এটা নাও, তোমাকে তোমার ফরমে লিখতে হবে।’

ভালো করে ফরম পড়ল কমল। যা জানতে চাওয়া হয়েছে তা খুব স্বাভাবিক। শূন্যস্থান পূরণ করতে একটুও দেরি হলো না। দিশার দেওয়া কাগজ থেকে তথ্য নিয়ে লিখতে অসুবিধে হলো না। ইতোমধ্যে সেই প্রৌঢ় ফিরে এসে ফরমগুলো নিয়ে নিলেন। তারপর শিবকুমারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি এদের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কিত?’

‘আমরা একসঙ্গে চাকরি করি।’ শিবকুমার জবাব দিল।

‘গুড। আপনি নিশ্চয়ই বিয়ের ব্যাপারে ওদের দুজনের প্রতিনিধিত্ব করবেন?’

‘হ্যাঁ. বলুন কী করতে হবে?’

‘বলছি।’ প্রৌঢ় ফরম দুটো নিয়ে অন্য দরজা দিয়ে অন্য একটি ঘরে চলে গেলেন। এ ছাড়া ডেস্কের ওপাশে বসে থাকা মহিলাদের প্রত্যেকে মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করলেন ‘আপনার কি বিয়ের সময় আপনাদের ধর্মাচরণ করতে ইচ্ছুক?’

প্রশ্ন শেষ করলেন মহিলা কমলের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই দিশা কথা বলল। ‘ধর্মাচরণ বলতে আপনি কী বলতে চাইছেন?’

মহিলা হাসলেন, ‘আপনারা যদি একই ধর্মের মানুষ হন তাহলে সেই ধর্মে বিয়ের সময় যা যা নিয়ম আছে তার কথা বলছি। আর যদি আলাদা ধর্মের হন তাহলে নিজের নিজের ধর্ম অনুযায়ী যা করণীয় তা করতে পারেন।’

‘আমি যে ধর্মে বিশ্বাস করি সেই ধর্মে বিয়ের ব্যাপারে এমন কোনো নির্দেশ নেই।’ হাসিমুখে বলল দিশা।

‘তাই, কিছু মনে করবেন না, আপনি কোন ধর্মের মানুষ?’

‘আমার ধর্ম মানবধর্ম।’

‘ও আচ্ছা!’ মহিলা ঢোক গিলে কমলের দিকে তাকালেন।

কমল মাথা নাড়ল, জানাল তার কোনো বক্তব্য নেই। সে চট করে ভেবে নিল, ধর্ম নিয়ে তর্ক করে কোনো লাভ নেই। বস্তুত সে এই বয়স পর্যন্ত কোনো ধর্মাচরণ করেনি। ছেলেবেলায় পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় মায়ের নির্দেশে ঠাকুরের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে নত হতো। পরে সেটাও বন্ধ হয়েছে। তা ছাড়া এখানে যা হবে তার শেষ এখানেই হয়ে যাবে। কলকাতা দূরের কথা, এলএতেও কেউ এসব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবে না।

 

কমল শিবকুমারের দিকে তাকাল, ‘অফিস ওটা পেয়ে কী করতে পারে? আমাকে সার্ভিস রেকর্ডে রেখে দেবে না সমস্ত স্টাফকে জানিয়ে দেবে?’

‘এটা ওদের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করছে।’ শিবকুমার বলল, যা-ই করুক, তোমাদের তো কোনো অসুবিধে নেই। এই বিয়ে তো লাসভেগাসের আইনসম্মত। তবে এলেতে এটার মান্যতা নেই। তবু একেবারে মুখের ওপর অস্বীকার সচরাচর করে না। সামাজিক জীবনে কে বিয়ে করেছে, কে করেনি তা নিয়ে মাথা ঘামানোর দিন শেষ হয়ে গেছে।’

বাস টার্মিনালে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা। শিবকুমার টয়লেটে গেলে কমল পাশে দাঁড়ানো দিশাকে জিজ্ঞাসা করল,  ‘আপনি কি বাড়িতে খবরটা দেবেন?’ ‘একেই আমায় নিয়ে ওঁদের অনেক দুশ্চিন্তা, আরও বাড়িয়ে কী লাভ।’

 

কিছুক্ষণ পর অন্য মহিলাটি তাদের বলল, ‘আপনারা আমার সঙ্গে আসুন।’ মহিলাকে অনুসরণ করে ওরা সেই ঘরে প্রবেশ করল যেখানে প্রৌঢ় একটু আগে নিয়ে গিয়েছিলেন। সুন্দর সাজানো ঘর। ওপাশের দেয়ালে যিশুর ছবি। সেই প্রৌঢ় যাজকদের পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছেন। তার হাতে একটি বাইবেল। মহিলা বললেন, ‘আপনারা নিশ্চয়ই বিয়ের জন্য প্রস্তুত?’

দিশা মাথা নাড়ল। তাকে দেখাদেখি কমলও।

মহিলা এবার শিবকুমারের দিকে তাকালেন, ‘আপনি অনুগ্রহ করে একবার আমাদের অফিস থেকে ঘুরে আসুন।’

‘অফিস কোথায়?’ কপালে ভাঁজ পড়ল শিবকুমারের।

প্রৌঢ় ইশারা করতে মহিলা শিবকুমারকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন, প্রৌঢ় বললেন, ‘আপনারা যে ধর্মেই বিশ্বাস করুন না কেন আমরা জেসাস ক্রাইস্টের সামনে শপথ নিতে বলি। এতে আপনাদের আপত্তি নেই তো?’

দিশা মাথা নাড়ল, ‘না’। কমল কোনো কথা বলল না।

একটু পরে ফিরে এলো শিবকুমার, সঙ্গে মহিলা। প্রৌঢ় তার দিকে তাকালে মহিলা মাথা নেড়ে নিঃশব্দে জানাল, ‘কাজ হয়ে গেছে।’

এরপর বিয়ের মন্ত্র পড়া শুরু হলো। তারপর প্রৌঢ় বললেন, ‘আপনারা একে একে আমার বলা এ কথাগুলো উচ্চারণ করুন। প্রথমে নিজের নাম এবং আমেরিকার ঠিকানা বলে পরিষ্কার উচ্চারণ করবেন, আমি স্বইচ্ছায় ভালোবেসে শ্রীমতী অমুককে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করছি। আমি ঈশ্বরের নামে থপথ করে বলছি আমার স্ত্রীর পাশে সুখে দুঃখে, বিপদে সব সময় দাঁড়িয়ে থাকব। কোনো দিন যদি আমাদের বিয়ে ভেঙে দিতে ইচ্ছে করে তাহলে কখনই বাধা দেব না। এরপরে আজকের তারিখ এবং এখানকার ঠিকানাটা বলবেন।’ প্রৌঢ় একটি কাগজ এগিয়ে দিলেন, ‘এখানে সব লেখা আছে। দেখে দেখে পড়ুন। মনে রাখবেন আপনারা যখন পড়বেন তখন টেপরেকর্ডার চালু থাকবে। প্রথমে বর পড়বেন, তারপরে কনে। নিন শুরু করুন।’

প্রথমে কমল ওই কাগজ দেখে লেখাগুলো পড়ল। প্রৌঢ় দিশাকে কাগজটা দিলে সে স্পষ্ট গলায় কথাগুলো উচ্চারণ করল।

এবার প্রৌঢ় বললেন, ‘লাসভেগাসের আইন অনুযায়ী তোমাদের দুজনের বিয়ে সংগত বলে ঘোষণা করছি। আজ থেকে তোমরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছ।’

আরও কুড়ি মিনিট পর স্বামী-স্ত্রীর যুগল ছবি দুজনকে দিলেন প্রৌঢ় বিয়ের সার্টিফিকেটসমেত।

ওদের ফুলের তোড়া দিলেন দুই মহিলা। প্রৌঢ় বললেন, ‘আপনাদের বিবাহিত জীবন সুখের হোক। ঈশ্বর আপনাদের মঙ্গল করুন।’

তিনজনে বাইরে আসার পর দিশা শিবকুমারকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওদের এ বিয়ে বাবদ আপনাকে কত ডলার দিতে হলো?’

‘মোট দুই শ কুড়ি ডলার।’ জবাব দিল শিবকুমার।

ব্যাগ খুলে পার্স বের করে দুই শ কুড়ি ডলার বের করে দিশা এগিয়ে ধরল।

একটু ইসস্তত করে কমলের দিকে তাকাল শিবকুমার। কমল পকেটে হাত দিল। কিন্তু মাথা নাড়ল দিশা, ‘তোমাকে দিতে হবে না।’

‘কেন?’ জিজ্ঞাসা করল কমল।

‘প্রয়োজনটা প্রথমে আমার ছিল। পরে তোমাকে জোড়া হয়েছে।’

দিশার কথা শেষ হওয়া মাত্র শিবকুমার বলল, ‘কিন্তু বিয়ে তো একজনের হয়নি।’

‘তা হোক।’ তারপর ডলারগুলো ধরিয়ে দিয়ে দিশা বলল, ‘তোমরা কি ক্যাসিনোগুলোতে ঘুরবে?’

‘আগে খেয়ে নিলে ভালো হতো। লাঞ্চটা আমি খাওয়াতে চাই।’ বলল কমল।

দিশা হেসে ফেলল, ‘টাকাটা শেয়ার করতে দিলাম না বলে বোধহয় আঁতে লাগল। চল যাই।’

খাওয়ার বিল দেখে একটু অবাক হলো কমল। এলেতে এত কম দামে সাধারণ রেস্টুরেন্টেও খাবার পাওয়া যায় না। তিরিশ ডলারেই হয়ে যাওয়ায় বিয়ের খরচের অর্ধেকটা দেওয়া হলো না।

শিবকুমার বলল, ‘একটা কথা বলতে একদম ভুলে গেছি।’

দুজনে ওর দিকে তাকালে শিবকুমার নমস্কারের ভঙ্গি করে বলল, ‘নবদম্পতিকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন।’

দিশা বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ। আচ্ছা, আমরা তো কালই অফিসে গিয়ে বিয়ের এই সার্টিফিকেটের কপি জমা দিয়ে নিজেদের স্ট্যাটাস পাল্টে ফেলতে পারি।’

‘হ্যাঁ, এখন তো সেটা করাই যেতে পারে।’ শিবকুমার বলল।

কমল শিবকুমারের দিকে তাকাল, ‘অফিস ওটা পেয়ে কী করতে পারে? আমাকে সার্ভিস রেকর্ডে রেখে দেবে না সমস্ত স্টাফকে জানিয়ে দেবে?’

‘এটা ওদের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করছে।’ শিবকুমার বলল, যা-ই করুক, তোমাদের তো কোনো অসুবিধে নেই। এই বিয়ে তো লাসভেগাসের আইনসম্মত। তবে এলেতে এটার মান্যতা নেই। তবু একেবারে মুখের ওপর অস্বীকার সচরাচর করে না। সামাজিক জীবনে কে বিয়ে করেছে, কে করেনি তা নিয়ে মাথা ঘামানোর দিন শেষ হয়ে গেছে।’

বাস টার্মিনালে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা। শিবকুমার টয়লেটে গেলে কমল পাশে দাঁড়ানো দিশাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কি বাড়িতে খবরটা দেবেন?’

‘একেই আমায় নিয়ে ওঁদের অনেক দুশ্চিন্তা, আরও বাড়িয়ে কী লাভ।’

‘আমার মনে হয় আপনিও দেবেন না।’ দিশা বলল।

‘বাবা খুব আঘাত পাবে।’ কমল বলল।

‘ও। আপনি নিজে পাননি তো?’

উত্তর খুঁজে না পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল কমল।

লস অ্যাঞ্জেলেসে পৌঁছে ভদ্রভাবে বিদায় নিয়ে দিশা চলে গেলে শিবকুমার হেসে বলল, ‘এ কী করলে? নিজের বউকে পৌঁছে দিতে গেলে না?’

‘ওঃ, আমি ঠিক-!’ ইসস্তত করল কমল।

‘ঠিক আছে, মজা করে বললাম, চলি ভাই।’ শিবকুমার চলে গেল।

নিজের ঘরে ফিরে জামাকাপড় না ছেড়েই বিছানায় শুয়ে পড়ল কমল। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল তার। আজ হুড়মুড় করে যা ঘটে গেল তার জন্য সে তো প্রস্তুতই ছিল না। শিবকুমারের কথা সে ফেলতে পারেনি। কিন্তু দুম করে তার বিয়ে হয়ে গেল? একই সঙ্গে বউ সে পেয়ে গেল। কোনো মন্ত্র না পড়ে। দিশা অবশ্যই সুন্দরী কিন্তু বড্ড বেশি ব্যক্তিত্ব ওর। এই যে বিয়ে হলো তাতে একবারও কনের মতো আচরণ করল না।

কী রকম অসহায় বোধ হলো তার। তার পরই মনে হলো, এ বিয়ে ভেঙে না যাওয়া পর্যন্ত শুধু লাসভেগাসে বৈধ। আর কোথাও নয়। কিন্তু এ কথাগুলো দিশা বলার আগে তার মুখ খোলা উচিত হবে না। এখন তার চুপচাপ থাকাই উচিত।

সমাপ্ত

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর