শিরোনাম
শুক্রবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

ঘ্রাণ

শামীম আজাদ

ঘ্রাণ

স্মৃতিকথা

জামালপুরে নদীর পাড়ে জনতা পাঠাগারের সামনের রাস্তার উল্টোদিকে আমাদের টিনশেড বাড়ির বারান্দার নীলকণ্ঠ ফুলগাছের কাছে অদ্ভুত একটা গন্ধ ছিল। আজো বলতে পারি না সে গন্ধ কিসের মতো। কিন্তু তেমন সমিল কোনো ঘ্রাণ পেলেই খুলে যায় আমার জামালপুরকেন্দ্রিক সব শৈশব স্মৃতির কপাট। মনে পড়ে যায়, নীলকণ্ঠ ফুলগাছটার ঝাড়ের নিচেই ছিল আব্বার ইজি চেয়ারটা।

কাঠের ফ্রেমে আটকানো নিচে লচকানো হলুদ লাল ডোরা কাটা মোটা কাপড়। অফিস ফেরত আব্বা বিকেলের নাশতার জন্য সেটায় বসতেন। তার হাতে থাকত দৈনিক আজাদ পত্রিকা। আমরাও মুখহাত ধুয়ে গামছা দিয়ে মুখ মুছে এসে যেতাম। ইজি চেয়ারের পাশে কুটিমুটি একটি সাইড টেবিলের ওপর হাতে তৈরি নারকেলের পিঠা বা ফব নুনগড়া। নুনগড়া পিঠা হলো ঢেঁকিছাঁটা চালের গুঁড়োর সঙ্গে হলুদ দেওয়া হয় বলে এবং সদ্য ভাজা বলে গায়ের তেল চকচক করত। মনে হতো সোনালি মোহর। চেয়ারের পাশে বেতের মোড়া। সবক’টার নিচটা সাইকেলের টায়ারে মোড়ানো। কেন কে জানে!

হয়তো আমরা তাতে বসে নিচটা ঘষ্টাতে থাকতাম আর মোড়াগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগে কোমর ভেঙে পড়ে যেত তাই! উঠানে হিমসাগর আমগাছ। বাড়ির সীমানা বেড়ার কোণে বাঁধা থাকত অ্যালসেশিয়ান ম্যাক্সিম। এ সময় তাকে ছাড়া হলে সেও ভদ্রলোকের মতো নিচে উঠান থেকে মুখ হা করে লালা ফেলে ফেলে আমাদের দিকে তাকাত। আর ভাইয়া টোস্টের টুকরো ছুড়ে দিলে মাটিতে পড়ার আগে সে লাফিয়ে তা মুখে লুফে নিত। অ্যামেজিং!

এটুকু লিখে দেখি আমার আরও অনেক কথা মনে আসছে। আমি লিখে যেতে পারি তখন আমাদের বাসায় আমার বড় মইর গুণবতী কন্যা শাহানা বু থাকছিলেন। তার মাথার চেয়ে বড় খোঁপা ছিল। তার সবুজ বড় বড় চেকের একটা সুতি শাড়ি ছিল। শাহানা বু নারকেল কুরুনি দিয়ে খুব মমতার সঙ্গে নারকেল কুরাতো। আসলে নারকেলের ফব তারই বানানো। কোনো কোনো বিকেলে শাহানা বু বঁটি নিয়ে পাকা আম কাটতে বসতেন। ম ম করা কাটা আমের মিষ্টি সে ঘ্রাণ আমাদের পড়ার টেবিলে এসে গেলে আমরা বইখাতা রেখে নীলকণ্ঠ ফুলের দোলানো লতার নিচে তাকে ঘিরে বসতাম। গরমে শাহানা বু’র খোঁপার নিচটা ঘেমে যেত। চূর্ণ চুলের নিচে ঘামের রুপালি পারদ বল বড় হয়ে উঠত।

পিয়ন মন্তাজ ভাই কুয়াপাড়ে মুখ হাত ধু’য়ে তার কাদামাখা নতুন রাবারের স্যান্ডেল থেকে বসে যাওয়া মাটি ছাড়াতেন। নতুন কাটা কালো রাবার সোল আর এঁটেল মাটির একটা গন্ধ থাকে। সেটা পাওয়া যেত। একটু পরেই তিনি প্যাডেল মেরে বাড়ি যাবেন। আমি ডলির সাথে আর ভাইয়া নিজে নিজে তাঁর সাইকেলে পেটের ভেতর পা গলিয়ে কোমর বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে প্যাডেল মারা শিখেছে। আমরা ফব পিঠা খাচ্ছি আর মোড়া ঘষ্টাচ্ছি এরকম সময় আম্মা রান্নাঘর থেকে এসে একটা শক্তপোক্ত হলদেটে কাঠের চেয়ারে বসতেন। আমাদের শব্দ থেমে যেত আর তিব্বত স্নোর গন্ধে জায়গাটা ভরে যেত।

মাঝে মাঝে তাঁর গা থেকে গোলাপ জলের ঘ্রাণ আসত। গারো পাহাড়ের কাছে বলে শীতের সময় হিমেল হাওয়া এসে জামালপুরে ভীষণ ঠান্ডা পড়ত। এ সময় আমাদের সবার ত্বক মোজাইক ফাটা দিত। আম্মা তখন তিন ফোঁটা গ্লিসারিনে এক ফোঁটা গোলাপজল করতলে মিশিয়ে আমাদের মুখে মেখে দিতেন। মুহূর্তের জন্য হলেও একটা জ্বলুনি টের পেতাম। আম্মা নিচের গ্লিসারিন জল দিতেন তাঁর সুগোল পায়ের গোঁড়ালিতে- কালো ঝামা পাথরে ডলে নেবার পর। যেদিন আম্মা দীর্ঘ সময় নিয়ে তার গা ঘষতেন, আমাদের ছোট্ট গোসলখানা থেকে লাল লাইফবয় সাবানের গন্ধ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়াতো খাবার ঘর অবধি। আর কোনার দিকের জল নিষ্কাশনের নালায় ভেসে যেত সাবানের সর। সেখান থেকেও ‘ঘেরান’ হতো। কিন্তু সেটা আবার তাজা না একটু অন্যরকম। মরা। এরকম আরও নানান ঘটনা মনে আসছে। কিন্তু আজ আর তা লিখছি না। আমি ভাবছি গন্ধ ভর করে কেন বহু পুরনো স্মৃতি এত সক্রিয় হয়ে ওঠে?

এককালে যা ছিল শুধু গন্ধ তা কী করে একালে সুগন্ধ হয়ে গেল! আমাদের ইন্দ্রিয় পাঁচটি। স্মৃতি টেনে আনতে বোধ নাক সবচেয়ে কার্যকর। কেন? হয়তো পুরনো গন্ধ নাকে এলে ব্রেন নিউরোসায়েন্সের গোয়েন্দা হয়ে যায়। যেন তার লেজে আগুন লাগে। পাগল হয়ে যায়। কারণ থেকে তার কারণ খুঁজতে থাকে। কেন? জানি না। কিছুদিন আগে ফেসবুকে আমার এক স্ট্যাটাসে আমি ডাকে পাওয়া উপহার এক হাসনা-হেনা গাছের কথা লিখেছিলাম। হঠাৎ করে বিলেতে পাওয়া এ সুগন্ধি ফুল গাছটির ফুল ফোটা এবং তার গন্ধ আমাকে কত আকুল করেছে তাই নিয়েই লিখেছিলাম।

আমি বলছি সত্তর দশকের কথা। আমরা গুলশান দুই নম্বরে ১৩৭ বাড়িতে থাকতাম। তখন গুলশান থেকে তেজগাঁও শিল্প এলাকা দিয়ে শহরে গেলে রাস্তা খারাপ হলেও ভিড় কম হতো। গাড়ির চাকা সে রাস্তায় পড়লেই বোঝা যেত যে এ শিল্প এলাকা বটে! শুরু হয়ে যেত একটার পর একটা গন্ধ ও ঘ্রাণের পালা। সে গাড়ির টায়ার, পোড়া প্লাস্টিক, ওষুধ, নিউজ প্রিন্ট, কসকো সাবান কিচ্ছু বাদ যেত না। একের পর এক নাকে এসে লাগত। মনে হতো নাক চেপে ধরি।

কিন্তু অপেক্ষায় থাকতাম কখন নাবিস্কো বিস্কুট ফ্যাক্টরির সামনে যাব। ওই টুকুতে গেলেই এমন এক মিষ্টি সুগন্ধ আসত যে, সে ঘ্রাণটাই খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা হতো। আমি করতাম কী, ওখানে আসার আগে থেকেই একটু একটু করে বুকের ভেতর থেকে শেষ বিন্দু শ্বাস ধাক্কা মেরে বের করে ফুসফুস খালি করে দম বন্ধ হয়ে থাকতাম। আর কারখানার কাছাকাছি আসতে শুরু করতেই শুরু করতাম একটু একটু করে সুগন্ধ ভরে ভরে নিঃশ্বাস নেওয়া। সে নিতেই থাকতাম আর নিতেই থাকতাম দম আটকে না যাওয়া পর্যন্ত। নিজের নাককেই দাঁত বানিয়ে গন্ধ চিবুতাম। গন্ধ-চাতকের মতো আমি সুগন্ধ জল পান করতে থাকতাম। গাড়িচালক রুস্তুমও কৌতুকময় হাসিতে গাড়ির গতি ধীর করে দিত। অসাধারণ সে সুগন্ধিতে ফুসফুস ভরে তুলতে তুলতে আফসোস করতাম, আমার শ্বাস কেন আরেকটু দীর্ঘ হলো না! আমি কেন শহীদ হলাম না!

বিলেতে বসবাসের তিন দশক হয়ে গেল সে রকম কোনো সুগন্ধিই পেলাম না, যার জন্য শহীদ হতে ইচ্ছে করবে। করোনার সময় লকডাউনে বন্দী থেকে যে গাছগুলোর পরিচর্যা করি তাতে ফুল এলেও কোনো সুগন্ধ আসে না।

আমার সে ঘ্রাণের গন্ধ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করতে না করতেই আমার একঝাঁক পাঠক পাগল হয়ে পড়েছিলেন। তবে যতটা না ফুলের সুগন্ধ নিয়ে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি নাবিস্কো বিস্কুটের গন্ধ নিয়ে। বহু পাঠক ঢাকার তেজগাঁও শিল্প এলাকায় তাদের শোঁকা সেই শৈশবগন্ধ নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন। আমি তো একদম তাজ্জব!

ঘ্রাণের বিষয়ে মায়ের শাড়ির গন্ধকে সর্বোচ্চ নম্বর দিতেই হয়। এ ঘ্রাণ পেলে কোনো বান্দাকে আর বেঁধে রাখা যায় না। স্মৃতিশক্তি হারানো সত্তর পেরুনো মানুষও খাড়া হয়ে ওঠে। কত ঘটনা যে তার মনে পড়ে যায়! সে রান্নাঘরের মসলা মাখা হোক আর পন্ডস পাউডারের হোক। আমার ধারণা মায়ের সমিল চেহারা দেখলেও তা গন্ধের শিকল দিয়ে স্মৃতি দিঘির তলদেশ থেকে এভাবে খোয়াজ খিজিরসহ টেনে আনে সব উপাচার। কেন! সেটাই তো জানি না।

 

-২৯.১.২১ লন্ডন

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর