শুক্রবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

বই পড়া

হোসেন আবদুল মান্নান

বই পড়া

‘বিশ্ব বই দিবস’ আসছে। এ মাসেই দুনিয়াব্যাপী উদযাপিত হবে। বিশ্বে বই দিবস পালনের ইতিহাস কয়েক শ’ বছরের। স্প্যানিশরা অনেক আগেই ইউরোপে এটা শুরু করেছিলেন। তবে ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে ইউনেস্কো আনুষ্ঠানিকভাবে এমন একটি মহতী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেই থেকে প্রতি বছর ২৩ এপ্রিল ‘বিশ্ব বই দিবস’ উদযাপিত হয়ে আসছে। এ দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো, বই পড়া, বই ছাপানো, বইয়ের কপিরাইট সংরক্ষণ করা এবং বিশ্বব্যাপী মানুষের কথা ও ভাষা নির্বিশেষে পাঠক তৈরি এবং পাঠের অভ্যাস গড়ে তোলা।

 

বই পড়া নিয়ে আজকাল নানাজনের নানা মত পাওয়া যায়। বিশেষ করে কথা হয়, বাংলাদেশে বইয়ের প্রকৃত পাঠকের সংখ্যা জনসংখ্যানুপাতে বৃদ্ধি পাচ্ছে না হ্রাস পেয়েছে। একই সঙ্গে আলোচনার টেবিলে ঝড় ওঠে-পাঠক কারা, এরা কোন শ্রেণির পাঠক, কোন ধরনের বই তারা পড়ে এবং কেন পড়ে? যাঁদের বই পড়ে তাঁরা সবাই কী দেশে-বিদেশের খ্যাতিমান বড় লেখক? নাকি সাধারণ, ইত্যাদি, ইত্যাদি।

 

বাংলাদেশে বই পড়া নিয়ে আমার একটা প্রচ্ছন্ন পর্যবেক্ষণ রয়েছে, যা আমাকে মাঝে মাঝে বিচলিত করে এবং গভীরভাবে ভাবায়। শেষাবধি হাতে নিয়ে বই পড়ার সুখকর-তৃপ্তির চিরায়ত সুযোগটা টিকে থাকবে কিনা।

নাকি ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে প্রযুক্তির অভিশপ্ত রাহুর কবলে পড়ে। আমি ভ্রাম্যমাণ বই পড়ার বিপক্ষের একজন। চলন্ত পড়ার নাম বড়জোর পত্রিকা হতে পারে, বই নয়। আমি বলি, বই আমাকে একটা সময়ের মধ্যে আচ্ছন্ন করে রাখুক, বন্দি করুক। বইকে আমি এমনটা করতে চাই না।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত কিংবদন্তি জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক একবার বলেছিলেন, ‘একটা দেশ কোন্ দিকে ধাবিত হচ্ছে তা বুঝতে চাইলে কাঁচাবাজার অথবা বইয়ের দোকানে যেতে হবে। তিনি বলেছেন, দেখতে হবে মানুষ কী খায় আর কী পড়ে, তা থেকেই ধরে নেওয়া যাবে জাতির ভবিষ্যৎ।’ খ্যাতিমান উপস্থাপক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘কোটি কোটি মানুষের দেশে বইয়ের পাঠকের সংখ্যা খুবই কম। অনেকে বই সংগ্রহ করতে ভালোবাসেন, বই রাখেন এবং দেখেন। অনবরত বইয়ের নাম ও লেখার শিরোনাম দেখে যান, ভিতরে প্রবেশ করেন না বা বইকে সময়ও দেন না। কিতাবুল হিন্দের লেখক আল-ওস্তাদ আল বেরুনী বলেছেন, কিতাব বা বই সংগ্রহকারীরা মূলত কৃপণ।

 

আসলে বই পড়া হলো, মধুরতম নেশার আরেক নাম। তবে যারা এ নেশায় পড়েছে। বিস্ময়কর যে, মোবাইল বা মুঠোফোনের সর্বগ্রাসী আগ্রাসনের ভিতরেও নতুন প্রজন্মের কিছু তরুণ-তরুণীকে দীর্ঘসময় ধরে বই হাতে নিমগ্ন থাকতে দেখলে শুধু আমি কেন, কার আনন্দ না হবে! গত কয়েক মাস যাবৎ ঢাকার বেশ কিছু স্বনামধন্য লাইব্রেরি বা বুকস্টলে সময় কাটিয়ে আমার দৃঢ় আস্থা জন্মেছে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি উচ্চ বিদ্যালয় পর্যায় থেকেও দিনের একটা সময়ে ছাত্রছাত্রীরা বই বিতানে এসে একাগ্রতায় কিছুক্ষণ পাঠ করে যাচ্ছে। তাদের দেওয়া সে সময়টা কম হলেও মহামূল্যবান। কেননা তখন তারা গভীর অভিনিবেশসহ নির্বিঘ্নে কেবল পাঠেই নিমজ্জিত থাকে। এ দৃশ্য আমি শাহবাগের পাঠক সমাবেশ কেন্দ্রে, ময়মনসিংহ রোডের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এবং বাতিঘরে, ধানমন্ডির বেঙ্গল বইঘরসহ সব জায়গায় একই চিত্র দেখেছি। আমাদের সন্তানদের একটা ক্ষুদ্রাংশ হলেও এমনিভাবে অনুরাগী পাঠোভ্যাসে যুক্ত হওয়া নিঃসন্দেহে শুভকর এক আগামীর ঈঙ্গিতবাহী। এখানে আরও একটা বিষয় আমাকে নিবিড়ভাবে আকৃষ্ট করেছে, তা হলো কোন ধরনের বই তারা পড়ে বা তাদের হাতে থাকে? ওপরে উল্লেখ করা গ্রন্থকেন্দ্রসমূহে বসে পাঠরত অবস্থায় কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর হস্তগত বইয়ের নাম দেখার চেষ্টা চালিয়ে আমি নিশ্চিত হলাম যে, প্রায় ৬০% তরুণ পাঠক-পাঠিকা কোনো না কোনো ইংরেজি স্টোরি বা সাইন্স ফিকশনধর্মী বই পড়ছে। কেউ কেউ বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতীয় ও ইউরোপ আমেরিকান লেখকের বই পড়ছে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা ঢাকার অপরাপর কোনো ভালো প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত। যারা বাংলা ভাষার গল্প উপন্যাস বা ভ্রমণকাহিনি পড়ছে তারা বেশির ভাগই হুমায়ূন আহমেদসহ হালের জনপ্রিয় লেখকদের বই স্পর্শ করে যাচ্ছে। এরা বাংলাভাষায় রচিত ধ্রুপদী বা কালোত্তীর্ণ গল্প উপন্যাস বা ফিকশনে খুব কমই আগ্রহী হচ্ছে। মনে হয়, তারা বিষাদসিন্ধু, আনোয়ারা, দুর্গেশনন্দিনী, ক্রীতদাসের হাসি বা নকশীকাঁথার মাঠে আগ্রহী নন। এ ব্যাপারটি পরখ করার মানসে আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দু-একজনের সঙ্গে করা বলেছি, তাদের প্রায় সবারই যুক্তি হলো, আমাদের বন্ধুদের মাঝে পঠিত এবং আলোচিত হওয়ায় এ বই পড়তে এসেছি। মূলত, বন্ধুদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা লাভের ফলেই বই পড়ার অমন তাগিদ। এটাও এক প্রকার উদ্বুদ্ধকরণ ও সঙ্গ-সহায়ক ইতিবাচক প্রবণতা। যা অবশ্যই ভবিষ্যতের সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতিগঠনে নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে পারে।

 

বই পড়ার নিস্তব্ধতার মধ্যেও কাউকে নিঃশব্দে সতীর্থের সঙ্গে কানাকানি করে লেখার গভীরে প্রবেশ করতে দেখেছি। তারা বইটা আত্মস্থ করে এগুতে চাইলেও, শুধু চরিত্রের কিছু উত্তেজক উক্তির পেছনে ধাওয়া করে। আবার কেউ অতি দ্রুতপঠনে এগিয়ে যেতে চায়। কেউ কেউ বই বদল করে অন্য লেখকের বই খোঁজে। আবার বইয়ের গল্পের আল ধরে হেঁটে গিয়ে নিরেট নির্মল আনন্দলোকে বিচরণ করতে চায়।

 

ঢাকার একশ্রেণির বয়স্ক পাঠকেরও নিভৃত ভ্রমণের স্থান হয়ে উঠেছে এসব বইয়ের ভুবন। তাঁরা বার্ধক্যে উপনীত, অবসরপ্রাপ্ত, আপাতদৃষ্টিতে কর্মহীন। বই পড়া, লেখালেখি, গবেষণা ইত্যাদি কাজে দিনভর লাইব্রেরিতে সময় কাটাচ্ছেন। তাঁদের অখ- অবকাশে বই-ই যেন সঞ্জীবনী তুল্য। অন্যদিকে, বই পড়ায় সবাই সমানভাবে পারদর্শী নয়, সব পাঠক নিরবচ্ছিন্ন হয়ে পাঠে মনোনিবেশ করতে পারে না। বলা যায়, এটা একেক জনের ভিন্নতর একেক স্টাইল। জনশ্রুতি আছে, স্বামী বিবেকানন্দ এক পৃষ্ঠার জন্য সময় নিতেন মাত্র ১০ সেকেন্ড। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও পড়ার কাজটা দ্রুত সেরে ফেলতে পারতেন। অবশ্যই অন্যদের চেয়ে দ্রুত। নীরদচন্দ্র চৌধুরী তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দ্রুত পড়ে নিয়ে পিঁড়িতে বসে ঋজুভঙ্গিতে নিরলস কলম চালাতেন।

বই পড়া নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে

প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক ও গদ্যে চলিত ভাষার প্রবর্তক প্রমথ চৌধুরীকে

স্মরণ না করা অপরাধের মতন মনে হবে। তিনি তাঁর বই পড়া প্রবন্ধে পাঠককে নানাবিধ পরামর্শ দিয়েছেন। বই কেন পড়বেন, বইয়ের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলা, পাঠ্য পুস্তকের বাইরে গিয়ে পড়া, অকাজের পড়া, কেবল বিলাসিতার জন্য পড়া নয়, ইত্যাদি। বিখ্যাত বাঙালি লেখক শ্রী পান্থ তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় বইটার নাম দিয়েছিলেন, ‘পড়ার বইয়ের বাইরে পড়া’। কাজেই পড়ার কোনো সীমারেখা বা স্থান কাল নেই। বই পড়ার শুরু যেমন নেই শেষও নেই। অন্তহীন এই অভিযাত্রা।

 

বিশ্ব বই দিবস পালনের লক্ষ হিসেবে বই প্রকাশের বিষয়টি খুবই প্রাসঙ্গিক ও জরুরি। কেবল বাংলাদেশে নয় পৃথিবীব্যাপী পুস্তক প্রকাশনা সংস্থার একটা শক্তিশালী সংগঠন আছে। তারা নবীন প্রবীণ, ছোট বড় সব শ্রেণির লেখকেরই বই ছাপায়। যদিও কেউ কেউ বলে, তারা বই ছাপে না বিষয় ছাপে। এ কথা সত্যি, যে কোনো ভাষার কথাসাহিত্যে, গল্পে, নাটকে, কবিতা-কাব্য-গীতিতে প্রসার ও প্রচারে প্রকাশকের ভূমিকা অনন্য এবং অসাধারণ। কখনো কখনো দেখা যায়, মাত্র একটা বিশেষ বইয়ের প্রকাশক হয়েও লেখক এবং প্রকাশক উভয়ই রাতারাতি পাদপ্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন। এমনকি দেশের গন্ডি পেরিয়ে দ্রুততম সময়ে প্রকাশনা সংস্থাটির নাম বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এখানে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানসমূহের সম্মিলিত সংগঠন থাকলেও এরা ততটা কার্যকরভাবে অস্তিত্ববান নয়। এখানে প্রকাশনার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন ও নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ তথা অনুশীলন করা সর্বত্র সম্ভব হয়ে ওঠে না। এখানে হাতগোনা দু’চারজন ব্যতীত প্রকাশকগণ নিজেরা লেখক নন। তারা স্রেফ শ্রমজীবী কর্মীর মতন। ফলে তাঁরা লেখা ও লেখক নির্বাচনে সব সময় নৈর্ব্যক্তিক আচরণ করতে পারেন না। বরং ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়টি বারবার প্রাধান্যে উঠে আসে। এমনকি লেখক ও প্রকাশকের মধ্যে রয়েলিটি সম্পর্কিত আর্থিক লেনদেনের টানাপড়েন লেগেই থাকে। যদিও প্রিন্টার্স লাইনে বলা থাকে, স্বত্ব এবং সর্বস্বত্ব লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত। সম্প্রতি বাংলাভাষার বিখ্যাত ও অশীতিপর এক বরেণ্য কথাসাহিত্যিককে ক্লেদাক্ত কণ্ঠে বলতে শুনেছি, প্রকাশকগণ আজকাল লেখকের সম্মতি-অসম্মতির ধার ধারে না। তারা এখন স্বাধীন উদ্যোক্তা শ্রেণি।

 

সৃষ্টির আদিকাল থেকে পড়া নিয়ে মানুষের বিচিত্র অভিজ্ঞতার শেষ নেই। ‘পড়’ দিয়েই এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের যাত্রা শুরু; মনে হয় পড়ার মধ্যেই এর নিশ্চিত লয়। শেষে, বই পড়া নিয়ে অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথাটি স্মরণ করি, তিনি বলেছেন, ‘বই পড়াকে যে যথার্থভাবে সঙ্গী করে নিতে পারে তার জীবনের দুঃখ-কষ্টের বোঝা অনেকাংশে কমে যায়।’ কাজেই মানুষের পার্থিব দুঃখবোধের এমন যাপিত জীবনে আমাদের সবার অতি পরিচিত এবং সর্বকালের চিরসহিষ্ণু বন্ধু বইয়ের সঙ্গে কথা বলাই কী সবচেয়ে নিরাপদ নয়?            

লেখক : গল্পকার ও কলামিস্ট।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর