শুক্রবার, ২ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

শুভ জন্মদিন কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল

মামুন রশীদ

শুভ জন্মদিন কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল

মিউজিয়ামের মাদারল্যান্ড প্যারিসে গিয়েছি, কিন্তু প্যারিস রোডে যাইনি।

প্যারিস রোড ফ্রান্সে নয়, মতিহারে।

মতিহারে শেইন নদী নেই, আইফেল টাওয়ার নেই,

আছে পদ্মা, আছে ফিলিপাইনি বংশোদ্ভূত গগনশিরীষ গাছের গৌরব,

আছে ঘন ছায়ার ক্যানেলে ছড়ানো রোদের পাপড়ি!

 

নাজমুন-আসমারা প্যারিসে যায়, ফ্রান্সে যায়

তারা কুড়ায় ডায়নার স্মৃতি, ভাঙ্গা চুড়ি আর চুমু।

 

তাদের কাছে-ওয়ালিউল্লাহ’র কবর কিংবা মধুসূদনের ঘর, নভেরার খবর

অথবা শাহাবুদ্দীনের রংতুলির গুরুত্ব গৌণ।

 

এই গ্রীষ্ম বা বর্ষায়, এই শরৎ বা হেমন্তে, এই শীত বা বসন্তে

ভ্যাংকুভারের বদলে রাজশাহী যাবো,

প্যারিস রোডে হাঁটবো। হাঁটতে হাঁটতে খুঁজবো-ওয়ালীউল্লাহর কবর,

খুঁজবো-রু দ্য শাঁতিয়ের সেই ১২ নম্বরের বাড়ি।

(প্যারিস রোড : সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল)

 

সতত সৃষ্টিশীল শব্দশিল্পী সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল। নানামুখী তাঁর কাজের ক্ষেত্র। গদ্য ও পদ্য দু মাধ্যমকেই তিনি নিজেকে প্রকাশের বাহন করে তুলেছেন। বিংশ শতাব্দীর সাতের দশকের কবি, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের সৃষ্টিশীলতা তাঁর অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। যেখানে একদিকে রয়েছে নিজেকে নির্মাণ অন্যদিকে সমর্পণ। তাঁর কবিতা শেকড়ের সঙ্গে ঐতিহ্য সংলগ্নতা গড়ে তোলার যে ভিত্তিভূমি তৈরি করে তা পাঠ করতে করতে পাঠককে ঢুকে যেতে হয় ভাবের গভীরে। তিনি অবহিত করেন, পাঠককে সূত্র দেন কখনো কখনো, আবার সিদ্ধান্তও এড়িয়ে যান। টুকরো টুকরো ঘটনা জোড়া দিতে দিতে তিনি পাঠককে একটি বড় পরিসরের ভিতরে ঠেলে দেন। যা তাঁর সৃষ্টিরহস্যের উন্মোচনে উদগ্রীব করে।  তিনি প্রকৃতি ও মানুষের শক্তিকে উপেক্ষা করেননি, বরং সযতেœ তাকে লালন করেন, অনুভব করেন প্রকৃতির অলঙ্ঘ রূপ।

‘বাদামী কফির ঘ্রাণ, চুমুক দাও/ পাঠ করো পিঠ/ তারপর গ্রন্থ/ দেখে নাও মুগ্ধ মুক্তমাঠ!/ মিশে যাও/প্রকৃতির সাথে।/ পাহাড়ে উঠো, চূড়োয়/ অরণ্যে যাও,/ প্রবেশ করো গুহায়.../ স্নান, নদীতে/ সমুদ্রসাঁতার।/ তৃষ্ণার্ত তরুণী সঙ্গমানন্দে/ কাঁদছে।/ কাঁপছে তির তির, তির তির/ জল পড়ে, পাতা নড়ে!’ (ভ্রমণকাহিনী : সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল)

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল কবিতার ভাষা, বিষয়ের মধ্য দিয়ে জাগিয়ে তোলেন নিজেকে। তাঁর প্রকাশভঙ্গির ভিতর দিয়ে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে প্রসঙ্গের পর প্রসঙ্গ, যা তাঁর কবিত্ব শক্তিরই প্রকাশ। বৈচিত্র্যে ভরা তাঁর কবিতার বিষয়। সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল,  এক্ষেত্রে স্বার্থের সংঘাতকে যেমন কবিতায় বিবেচ্য বিষয় করে তুলেছেন, তেমনিভাবে আঞ্চলিক ও সাম্প্রদায়িক অসাম্যের বিশ্লেষণও তাঁর কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায়। ব্যক্তির চৌহদ্দিকে ছাড়িয়ে তিনি সম্পর্ক বিস্তার করেন, ফলে একরৈখিক গন্ডির ভিতরে আটকে থাকে না তাঁর কবিতার বিষয়-আশয়। দেশজ-আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটকে মেলাবার অদম্য চেষ্টার ফলে তিনি জীবনের সর্বস্তরের  মাত্রাকে পৌঁছে দিতে চান একটি পরিণতির দিকে। যেখানে তিনি কখনো কখনো শিল্পের স্বাভাবিক গন্ডিকে অমান্য করে আগ্রাসী পথেও হাঁটেন।

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, রাজনীতি-সচেতন কবি। তিনি রাজদন্ডকে জীবনের স্বাভাবিক বন্ধনের ভিতরে রেখেই ব্যক্তির ঘাত-প্রতিঘাতকে মিলিয়েছেন। সেখানে অসম্পূর্ণতা নেই। রয়েছে ইতিহাসের অসীমতাবোধের ইঙ্গিত। তিনি আত্মীয়তা বোধ করেছেন-স্তরে স্তরে ছড়িয়ে থাকা হৃদয়বৃত্তিক সম্পর্কের শ্রীবৃদ্ধির দিকে। তাঁর কবিতায় সংগ্রাম আছে, গ্রামপ্রধান দেশ আছে, ভুবনগাঁয়ের বেদনাদায়ক পরিক্রমা আছে, সমসাময়িকতার তাৎপর্যকে তিনি ধারণ করেছেন, ফলে একই সঙ্গে সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের কবিতা আজকের ভাবনাচিন্তাকে যেমন ধারণ করেছে তেমনিভাবে অক্ষুণœœ রাখতে চেয়েছে সাহিত্যের প্রবহমান ধারাকেও। তবে কবিতায় তিনি উচ্চকণ্ঠ নন, স্লোগানমুখী নন। তিনি ধারণ করতে চেয়েছেন জীবনের বেদনাকে, তাকে নম্র সুরেই প্রকাশ করেছেন। আর যেখানে তিনি রাগী, তাকেও ধারণ করেছেন মানবিক বোধে। সামাজিক দায়বদ্ধতাতেই শুদ্ধ স্বরে তিনি সমাজের চিত্র, ক্ষত তুলে ধরেছেন। সেখানে হিসাব-নিকাশের খাতাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেননি। তিনি সীমানার ভিতরে থাকলেও সত্তর দশকের বাংলা কবিতায় তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষণীয়।  কারণ, শেষাবধি তিনি আত্মায় ধারণ করেছেন মানুষ। যে মানুষ নানাভাবে, নানারূপে তাঁর উপস্থিতি জানান দিয়েছে। তাঁর কবিতায় শব্দের যে ব্যঞ্জনা, তা মধ্যস্থতা করে ভাব ও ভাষার সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ততায়।

সতত নানামুখী সৃষ্টিশীলতায় ভরা কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল-এর জন্মদিনে শুভেচ্ছা, শুভ কামনা।

সর্বশেষ খবর