শিরোনাম
শুক্রবার, ১৬ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

পো’র ছায়ার সঙ্গে এক বিকেল

কাজী জহিরুল ইসলাম

পো’র ছায়ার সঙ্গে এক বিকেল

একবার সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে একটা কবিতা লিখলাম। কবিতার নাম ‘ইনস্যাক্ট প্লান্ট’। কবিতাটি লিখেছি সকালবেলা, আমার অফিসে বসে। কিছুক্ষণ পরে অফিসের পিয়ন লিটন এক কাপ চা আর খবরের কাগজ এনে টেবিলের ওপর রাখলো। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জনকণ্ঠের পাতা উল্টাচ্ছি, হঠাৎ চোখে পড়ে, আজ সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণ দিবস। এমন ঘটনা প্রায়শই ঘটে। কেউ কী হিসাব মিলিয়ে দেয়? হয়তো। সম্ভবত সে জন্যই আমি কোনো বিপদে বিচলিত হই না। এরও নিশ্চয়ই একটা হিসাব আছে। যার হিসাব তিনিই মিলিয়ে দেবেন।

গত কয়েক দিন ধরেই মাথায় ঘুরছে এডগার এলান পো। কেন ঘুরছে কে জানে? আজ দুপুরে কবি সৈয়দ কামরুলকে ফোন দিলাম। কি করছেন?

কিছু না।

শরীর কেমন এখন? কভিডের ধকল কি গেছে?

অনেকটাই।

বেরুবেন?

কোথায় যাবেন?

এডগার এলান পো’র বাড়ি দেখতে।

হ্যাঁ যাবো।

একজন কবির কাছে সম্রাট, জমিদারের রাজপ্রাসাদের চেয়ে কবির জীর্ণ কুটির অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যখন কোনো শহর বা লোকালয়ে বেড়াতে যাই, খুঁজে বের করার চেষ্টা করি, আশপাশে কোনো কবি আছেন কিনা, কোনো প্রয়াত কবির স্মৃতিচিহ্ন আছে কিনা।

১৯ জানুয়ারি কবি, গল্পকার, আমেরিকার গোয়েন্দা গল্পের প্রবর্তক, বৈজ্ঞানিক কল্প-কাহিনীর জনক এডগার এলান পোর ২১৪তম জন্মদিন। কী জানি হয়তো ১৯ জানুয়ারিই আমার মাথায় পো’র পোকাটি ঢুকেছিল। মানুষ যে বিচ্ছিন্ন নয় তা আর কতবার বলবো? ৩২ লাখ বছর আগে আবিসিনিয়ায় মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়েছিল লুসি, আমি কি তার জিন বহন করছি না? মানুষ কখনই মরে না, মাংসের জামাটা বদলায় কেবল।

সৈয়দ কামরুলকে জ্যামাইকার বাসা থেকে তুলে ব্রঙ্কসের দিকে যখন যাত্রা করি তখনো বিকাল ৩টা বাজতে কিছু বাকি আছে। গাঢ় অন্ধকারের উৎসমূল থেকে মেঘের পাহাড় ভেঙে পড়ে। এক ফাঁলি রোদের উঁকি শেষ জানুয়ারির শীতে সোনার খনির মতো ঝলমল করে ওঠে।

১৮০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি বোস্টনে জন্মগ্রহণ করার এক বছরের মাথায়ই অভিনেতা পিতা ডেভিড পো ওকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন...

আমরা ব্রঙ্কস কাউন্টিতে, এলান পো’র কটেজের সামনে গাড়ি থামালাম ৪টার কাছাকাছি। ‘পার্ক নিউইয়র্ক সিটি’ অ্যাপসের মাধ্যমে পার্কিং ফি দিয়ে যখন গাড়ি থেকে নামছি এবং সৈয়দ কামরুল যখন পেছনের দরজা খুলে তার সাদাকালো স্কার্ফটি নিচ্ছিলেন, তখন চালকের পেছনের আসনে যেন কাউকে দেখতে পেলাম। নিতান্তই এক বালক। গায়ের রং শাদা, নাদুসনুদুস লম্বাটে মুখ, মাথার মাঝখানে সিঁথি, হাঁটুর ওপর যুথবদ্ধ দুই হাতের তালু। সবুজ চোখ দুটিতে গন্তব্যহীন দৃষ্টি।

হ্যাঁ, আমি চিনি এই কিশোরকে। ১৮০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি বোস্টনে জন্মগ্রহণ করার এক বছরের মাথায়ই অভিনেতা পিতা ডেভিড পো ওকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন। দুই বছরের মধ্যেই অভিনেত্রী মা এলিজাবেথ পো পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। অনাথ শিশুটির আশ্রয়দাতা জন এলান এবং ফ্রান্সিস এলান দম্পতি ওকে নিয়ে যান ভার্জিনিয়ার রিচমন্ডে।

আমাদের সঙ্গে, যেন পথ দেখাতেই, গাড়ি থেকে নামেন বালক এডগার। কিন্তু কটেজের দরজা তো বন্ধ, ঢুকবো কীভাবে?

ওয়াকওয়েটি খানিক নিচে নেমে আবার যখন উঁচুতে, পো-পার্কের ফটকের দিকে উঠছিল, তখন সিনেমার দৃশ্যের মতো বালকের খোলস ভেঙে বেরিয়ে এলো এক পুরোদস্তুর পুরুষ। লাল আভা বের হচ্ছে ওর কালচে চুল থেকে। একই মনিটরে যেন দুটি স্ক্রিন, একটিতে খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে সময়, অন্যটি দাঁড়িয়ে আছে একুশ শতকের প্রথম সিকিতে।

এলান দম্পতি কখনই ওকে নিবন্ধন করে দত্তক নেননি। জনের সঙ্গে প্রায়শই ঝগড়া হতো এডগারের। পড়ার খরচ মেটাতেও মাঝে মাঝে অনীহা দেখাত জন। একবার অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে চলেই যায় এডগার। যোগ দেয় সেনাবাহিনীতে। কিন্তু ওখানেও ফেল মারে সে। ফিরে আসে এলান পরিবারে। তখনই নিজের নিয়তি ঠিক করে ফেলে কিশোর, লেখকই হবে সে।

‘তোমাদের না, দুর্ভাগ্য আমার। আমার সৌভাগ্যের দরজা চিরকালই বন্ধ ছিল।’

এডগারের মুখ থেকে কথাটা যেন আর্তনাদের মতো বেরিয়ে এলো।

শেষ বিকালের লাল আলো ফ্ল্যাশ লাইটের মতো এসে চোখে লাগছে। সেই আলোতে ব্রঙ্কসের ২৬৪০ গ্র্যান্ড কনকোর্স রোডের বাসাটি কেকের ওপর বসানো ক্রাউনের মতো জ্বলজ্বল করছে।

এটিই তোমার বাড়ি?

ভাড়া বাড়ি।

কতদিন ছিলে এখানে?

৩ বছর। ১৮৪৬ থেকে ১৮৪৯।

ভার্জিনিয়া?

ওকে নিয়েই উঠি এই বাড়িতে। ১০০ ডলার বার্ষিক ভাড়া ছিল বাড়িটার। ভার্জিনিয়া তখন খুব অসুস্থ। যক্ষ্মাটা জেঁকে বসেছে। এই ঘরেই ও মারা যায়, ১৮৪৭-এ।

তোমার মাও তো?

হ্যাঁ যক্ষ্মায়ই।

একটা কথা বলো তো এডগার, ‘হেলেন, দাই বিউটি ইজ টু মি/লাইক দোজ নিশিয়ান বার্ক্স অব ইওর’ এই পঙ্ক্তিগুলো কি তুমি সত্যি তোমার বন্ধুর মা জেইনকে নিয়ে লিখেছিলে?

শোনো, ওরা এটা বলে বলে আমার মাথায় এমনভাবে ঢুকিয়ে দিয়েছে এখন আমিও এটাই বিশ্বাস করি।

জেইনকে ভালোবেসেছিলে?

হয়তো। ভালোবাসা কী বলো তো? হ্যাঁ জেইনের স্পর্শে আমার মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভূতি হয়েছিল।

আসলে এটাই ভালোবাসা। নিজের ভিতরে একটা ভাঙচুর।

তোমাকে একটা কথা বলি, কাউকে ভালোবাসতে আমি খুব ভয় পেতাম। আমার মধ্যে এ ধারণা কাজ করত, যদি আমি কাউকে ভালোবাসি সে শিগগিরই মারা যাবে।

বলো কি?

বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেল জন্মের পরপরই। মাকে আঁকড়ে ধরলাম। তিন বছরেই আমাকে অনাথ করে মা চলে গেলেন। জেইনকে ভালো লাগত, সেও চলে গেল।

এটা তো ঠিক, জেইনের মৃত্যুতে তুমি খুব ভেঙে পড়েছিলে?

[চলবে]

সর্বশেষ খবর