শুক্রবার, ২৩ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

অনুভব

সেলিনা হোসেন

অনুভব

ছয়টি পুনর্জন্মের পরে সাত নম্বর গল্পটির নায়ক-নায়িকার আর পুনর্জন্ম হয়নি। এ ঘটনাটি মোইরাং রাজপরিবারের রাজকন্যাকে নিয়ে। আগের ছয়টি প্রেমিক যুগলের পরে তাদের আত্মা আবার ফিরে আসে রাজকন্যা থোইবি ও তার প্রেমিক খাম্বার মধ্যে। রাজকন্যাকে পাওয়ার জন্য খাম্বাকে কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়। বেশ অনেক ঘটনা ঘটে। সেসব আমি বলতে চাই না। শেষ কথা ছিল যে, দুজনের বিয়ে হয়েছিল শেষ পর্যন্ত।

দেবতা থাংজিং দুই ঘুঘুকে আবার মানুষ রূপে জন্মদান করেন। কিন্তু এদের প্রেমও মিলনান্তক হয় না। এভাবে একে একে ছয়টি পুনর্জন্মের ঘটনা ঘটে।

কামাল গম্ভীর হয়ে বলে, সবগুলোই ট্র্যাজেডি ছিল?

তানিয়া ঘাড় নেড়ে বলে, হ্যাঁ তাই। আপনি এখন আর খেতে পারবেন?

সাত নম্বর শোনার আগে ফ্রাইড রাইস, চিকেন ফ্রাইগুলো তো শেষ করবো।

মুনিমা হেসে বলে, কামাল ভাই তাহলে আপনার খাওয়া মাথায় ওঠেনি?

আমিও তো তাই দেখতে পাচ্ছি। কামাল গম্ভীর হয়ে বলে এবং খায়।

তানিয়া-মুনিমা দুজনে হাসে।

কামাল মাংস চিবুনো শেষ করে বলে, এখন পর্যন্ত প্রেমের সঙ্গে বিশ্বাসহীনতার কোনো সূত্র পাইনি।

সাত নম্বর গল্পে পাবেন। আমিও খাওয়া শেষ করি।

তাহলে আমি বাকি থাকবো কেন? আমিও শেষ করে ফেলি।

তিনজনে চুপচাপ খাওয়া শেষ করে।

ছয়টি পুনর্জন্মের পরে সাত নম্বর গল্পটির নায়ক-নায়িকার আর পুনর্জন্ম হয়নি। এই ঘটনাটি মোইরাং রাজপরিবারের রাজকন্যাকে নিয়ে। আগের ছয়টি প্রেমিক যুগলের পরে তাদের আত্মা আবার ফিরে আসে রাজকন্যা থোইবি ও তার প্রেমিক খাম্বার মধ্যে। রাজকন্যাকে পাওয়ার জন্য খাম্বাকে কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়। বেশ অনেক ঘটনা ঘটে। সে সব আমি বলতে চাই না। শেষ কথা ছিল যে, দুজনের বিয়ে হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। যে রাজকন্যা দরিদ্র যুবক খাম্বাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছিল, যে খাম্বা রাজকন্যাকে পাওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের হত্যা করে জয়ী হয়েছিল সেই খাম্বা অবিশ্বাস করতে শুরু করল রাজকন্যাকে। খাম্বা থোইবির সতীত্ব পরীক্ষা করবে চিন্তা করে। মনিপুরীদের লোকবিশ্বাস এই যে, যে নারী একা বাস করে রাত্রে তার ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে লাঠি ঢুকিয়ে অবৈধ সম্পর্কের জন্য পুরুষ তাকে প্ররোচিত করে। সতী নারীরা লাঠি ভেঙে টুকরো করে দেয়। আর অসতী নারীরা পুরুষের ডাকে সাড়া দিয়ে ওই লাঠি ঘরে টেনে নেয়। একদিন খাম্বা দূরদেশে যাওয়ার কথা বলে থোইবির কাছ থেকে বিদায় নেয়। তারপর রাত্রিবেলা দরজার ফাঁক দিয়ে ঘরে লাঠি ঢুকিয়ে দেয়। থোইবি ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করে জানতে চায়, কে তুমি? খাম্বা নকল কণ্ঠস্বরে নানা প্রলোভনের কথা বলে, তখন থোইবি ক্ষিপ্ত হয়ে দরজার কাছে রাখা বল্লম নিয়ে দরজা খুলে বের হয়। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা খাম্বাকে চিনতে পারে না ও। কিন্তু বল্লম ঢুকিয়ে দেয় খাম্বার বুকে। খাম্বার আর্ত-চিৎকার ধ্বনিত হয় চারদিক। চেনা কণ্ঠস্বর শুনে থোইবি এগিয়ে যায় খাম্বার দিকে। কাছে গিয়ে খাম্বাকে দেখে ওর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। খাম্বার মাথা দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলে, কেন তুমি এ কাজ করতে গেলে? মৃত্যু পথযাত্রী খাম্বা বলে, আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও থোইবি। আমি তোমাকে অবিশ্বাস করেছিলাম। তার মূল্য দিলাম নিজের জীবন দিয়ে। থোইবি তখন খাম্বার বুক থেকে বল্লম টেনে নিয়ে নিজের বুকে বসিয়ে দেয়। বলে, তুমি বেঁচে না থাকলে আমারও বেঁচে থাকা হবে না। আমরা দুজনই একই মৃত্যুর পথে সহযাত্রী হব।

শেষ হয়ে যায় দুটো জীবন। লক্ষণীয় যে, এরপর দেবতা থাংজিং আর কোনো প্রেমিক যুগলের পুনর্জন্ম ঘটাননি।

মুনিমা জিজ্ঞেস করে, তুই এর কী ব্যাখ্যা করবি তানিয়া? কেন খাম্বা এমন করল?

তানিয়া বলে, প্রেমে অবিশ্বাসই এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দৈহিক মৃত্যু না হলেও প্রেমে অবিশ্বাসের ফলে মানসিক মৃত্যু তো হয়ে যাবে। তখন বিয়েটাকে টিকিয়ে রাখার যুক্তি নেই।

মুনিমা বলে, আমার ক্ষেত্রে এমন হলে আমি কখনোই নিজের জীবন দেব না। আমি অন্যের অবিশ্বাসের কারণে মরতে রাজি না।

তানিয়াও জোর গলায় বলে, আমিও না।

কামাল হো হো করে হাসে।

হাসলেন যে? দুজনেই ভুরু কুঁচকে তাকায়।

তোমাদের সিদ্ধান্তে আমি খুশি হয়েছি সে জন্য।

আপনার স্ত্রী অবিশ্বাসী হলে কি করবেন?

ঘর ছেড়ে পালাবো।

তানিয়া চোখ কুঁচকে বলে, নাকি খুন করবেন? পুরুষরা তো এই কাজটি সহজেই পারে।

সব পুরুষ নিশ্চয় না?

তা তো নিশ্চয়ই। এমন হলে তো মানবজাতি বিলুপ্ত হবে।

মুনিমা হাসতে হাসতে বলে, আসলে কি জানিস, কামাল ভাই বোঝাতে চাচ্ছে যে তিনি একজন ভালো মানুষ।

তানিয়া বলে, ভালো মানুষ ধারণা পাওয়ার জন্য আপনাকে অভিনন্দন। এখন আমাকে যেতে হবে। মায়ের কাছ থেকে বরাদ্দ সময় প্রায় শেষ। খোদা হাফেজ।

আবার কি দেখা হবে?

তানিয়াকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মুনিমা বলে, হবে। এবার আমি আর তানিয়া আপনাকে খাওয়াবো।

তানিয়া লজ্জায় কিছু বলতে পারে না। মৃদু হেসে বলে, যাই।

আর একদিন কামালের সঙ্গে কথা হয় ফোনে। নানা কথার পরে তানিয়া এক পর্যায়ে বলে, আমি বিয়ে করলে একজন মুমিন বান্দাকে বিয়ে করব। যিনি ঠিকমতো নামাজ-রোজা করেন। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ ঠিকভাবে মানেন।

ঠিক আছে মানলাম। কিন্তু তোমার কি একজন ভালো মানুষের দরকার নেই?

অবশ্যই আছে।

তোমার কাছে ভালো মানুষের সংজ্ঞা কি?

যিনি সৎ। ভালো আচরণ করেন। খারাপ কাজ করেন না।

মুমিন বান্দা এবং ভালো মানুষ এক হলে কি হবে?

তিনি একজন অসাধারণ মানুষ হবেন।

যদি তাই মনে কর তাহলে বিয়ের সময় আমার কথা ভেবো।

কি বললেন?

কথাটা একবারই বলা যায় তানিয়া। বারবার না।

কেটে যায় ফোন। তানিয়া অনেকক্ষণ নিশ্চুপ বসে থাকে। ওর মনে হয় ওর চারদিক তোলপাড় করছে। ইমাম বাবার মধুর কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। তিনি কোরআন তেলাওয়াত করছেন। সেই সুরধ্বনি ওর বুকের ভিতর ঢুকে গুমগুম শব্দ করছে। তানিয়ার মনে হয় বিশ্ব-সংসার নিয়ে ওর ভাবনার সময় বুঝি ফুরিয়ে গেছে।

তারপর এসব ভাবনা একপাশে রেখে ও অনার্স পরীক্ষা শেষ করে। মাস্টার্সে ভর্তি হয়। মুনিমার কাছ থেকে জানতে পারে যে, কামাল ভালো একটি চাকরি পেয়েছে। অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তানিয়ার মন খারাপ হয়।

হঠাৎ করে একদিন কামাল ফোন করে।

অনার্স পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টের জন্য ফোন করেছি। অভিনন্দন।

থ্যাঙ্কু। তানিয়ার কণ্ঠে খুশি।

প্রসঙ্গ ধরে কামাল বলে, যে ভালো মানুষ সে কিন্তু প্রেমে অবিশ্বাস করে না। ভালোবাসার মানুষকে ভালোইবাসে। অবিশ্বাস প্রশ্রয় দেয় না।

তানিয়া মৃদু হেসে বলে, কোনো ধর্মই বোধহয় প্রেমের অবিশ্বাসকে প্রশ্রয় দেয় না। প্রকৃত প্রেম মানুষের-

তানিয়া, একটা কথা বুঝেছি যে, মনিপুরীদের কিংবদন্তির গল্পে দেবতা কিন্তু এই কারণে ভালোবাসার কাহিনি রচনার জন্য আর পুনর্জন্ম ঘটাননি। রাখি।

আর কি কথা হবে?

কামালের সাড়া নেই। ফোন রেখে দিয়েছে।

বাড়িতে একদিন শোরগোল ওঠে তানিয়ার বিয়ে নিয়ে। সৌদি আরবে কাজ করে একজন বিত্তশালী যুবক। তানিয়ার বাবা খুশি। ঘোষণা দেন, ভালো পাত্র পাওয়া গেছে। তানিয়ার বিয়ে হয়ে যাক। আর অপেক্ষা করব না। তানিয়ার মা, বোন-ভাই সবাই খুশি। কেবল মন খারাপ তানিয়ার। মুখ শুকিয়ে গেছে। ইমাম সাহেব মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু আঁচ করেন। বলেন, আম্মা তোমার একটি বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে-

তিনি আরও কিছু বলার আগেই তানিয়া বলে, আব্বা আমার এমএ পরীক্ষার এখনো তিন-চার মাস বাকি।

এটা সমস্যা হবে না। এখন আকদ করে রাখব। তোমার পরীক্ষা হলে বিয়ে দেব।

আব্বা মানুষটি কেমন আপনি তো জানেন না-

মা রেগে বলে, মেয়েটার কেবল তর্ক করার অভ্যাস।

আহ তুমি থাম। তোমার কথাই রাখব আম্মা। আমি আরও একটু খোঁজখবর নিই।

কি বললেন? এত খোঁজখবরে দরকার কি? ছেলের যা অবস্থা মেয়েটাকে সোনায় মুড়িয়ে রাখবে।

আম্মা আমি কি কখনো আপনার কাছে সোনা চেয়েছি? কেবল পড়ালেখা করতে চেয়েছি।

ইমাম সাহেব ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ঠিক আছে আম্মা, তুমি এখন যাও। দাদির কাছে গিয়ে বসো।

তানিয়া দাদির কাছে এসে গলা জড়িয়ে ধরে দাদিকে বলে, আমার আব্বা আপনার একটি সোনার ছেলে।

দাদি হেসে ওর গালে চুমু দেয়।

দু’দিন পরই ইমাম সাহেব জানতে পারলেন যে অন্য আর একটি ধবধবে ফর্সা মেয়ে পেয়ে ছেলে তার মত পাল্টেছে। তিনি বুঝে গেলেন, যে ছেলে কথায় কথায় মেয়ে পছন্দ করে তাকে দিয়ে তার মেয়ের জীবনে শান্তি হবে না।

সেদিন বাড়িতে এসে তিনি জোরেশোরেই বললেন, এ বিয়ে হবে না। আমি এখানে আমার মেয়ের বিয়ে দেবো না।

দু’দিন পরে তানিয়া নিজেই কামালকে ফোন করে। কামাল মুনিমার কাছ থেকে তানিয়ার বিয়ের খবর পেয়েছে। তাই গম্ভীর কণ্ঠে বলে, কি ব্যাপার আমাকে কি মনে করে?

আপনি তো বলেছিলেন, বিয়ে করার সময় আপনার কথা ভাবতে।

তাই নাকি, এতদূর। তো ভেবেছো?

তানিয়া মৃদু হেসে বলে, ভেবেছি।

তোমার আব্বা?

আমার আব্বা মানুষ চেনেন।

তাহলে তোমার ভাবনা আটকাবে না?

না, একটুও না।

তাহলে চিরকালের সেই কথাটাই বলো?

তানিয়া হাসিতে ভেঙে পড়ে বলে, আমি তোমাকে ভালোবাসি।

সমাপ্ত

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর