শুক্রবার, ২৩ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

পো’র ছায়ার সঙ্গে এক বিকেল

কাজী জহিরুল ইসলাম

পো’র ছায়ার সঙ্গে এক বিকেল

তখন ধারণাটা আরও বদ্ধমূল হয়, এই ভয়টাই আমাকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়।

‘টু হেলেন’ যখন ছাপা হয়, ১৮৩১ সালে, তখন তোমার বয়স ২২ বছর। জেইন মারা যায় আরও বেশ ক’বছর আগে। তুমি কেন সমালোচকদের বলোনি যে, এটা তুমি জেইনকে নিয়ে লেখোনি?

আমি নিজেই কি নিশ্চিত ছিলাম?

‘টু হেলেন’ লেখার বেশ ক’বছর পরে বিয়ে করেছ তাই না?

৫ বছর পরে।

তখন তুমি ২৭ বছরের তাগড়া যুবক, বিয়ে করলে ১৩ বছরের এক শিশুকে? তাও আবার আপন চাচাতো বোন?

ভার্জিনিয়াকে দেখার পর আমার মধ্যে কী যেন হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল ওকে ছাড়া আমি এক দিনও বাঁচতে পারবো না।

চাচাতো বোনকে বিয়ে করার বিষয়ে পারিবারিক কোনো বাধা ছিল না?

একদম না। ১৯ শতকে আমেরিকায় এটাই প্রথা ছিল। খুঁজে দেখো, অনেক বিখ্যাত আমেরিকান চাচাতো, খালাতো, মামাতো, ফুপাতো ভাই-বোনের মধ্যেই বিয়ে করেছে। ১৮৮০ সাল পর্যন্ত এ ধরনের বিয়ে খুব জনপ্রিয় ছিল।

ভার্জিনিয়াকে হারাবার ভয় তোমাকে তাড়া করতো?

সব সময়। বাইরে গেলেই মনে হতো ফিরে এসে ওকে আর দেখবো না।

তোমার আশঙ্কাই সত্যি হলো।

আমি লক্ষ করলাম ওর সবুজ চোখ দুটি রং পাল্টাতে শুরু করেছে। নীল হয়ে ওঠা পাথরের বল দুটি হঠাৎ গলে গেল। হাডসনের ঢেউ এখন সেখানে।

আমরা লোহার শিক দিয়ে ঘেরা পো-কটেজের পশ্চিম দিকে দাঁড়িয়ে আছি। সৈয়দ কামরুল এবং আমি দুজনই একসঙ্গে হতাশা ব্যক্ত করলাম। এ কী অবস্থা! এত বড়ো একজন কবির বাড়ি, কেমন ধূসর, হতচ্ছাড়া। আশপাশে গাছপালা নেই, কোনো চাকচিক্য নেই।

ভালো করে তাকান, এই ধূসর দারিদ্র্যের মধ্যেও একটা নির্লিপ্ত শান্তি আছে কিন্তু।

তা আছে। তা ছাড়া সামারে নিশ্চয়ই ফুলের সমারোহও থাকে।

আমরা কটেজটিকে দেখার জন্য ওকে বৃত্তাকারে প্রদক্ষিণ করি। সব তীর্থকেই তো মানুষ প্রদক্ষিণ করে। শুধু মানুষ কেন, গ্রহ-নক্ষত্রও কি তা করছে না?

বড়ো রাস্তার সঙ্গে যে লোহার ফেঞ্চ, ওখানে লোহার কালো বোর্ড সাঁটানো। ওতে লেখা আছে, এটিই ছিল মার্কিন কবি এডগার এলান পো’র শেষ নিবাস। ১৮৪৬ সালের বসন্তে অসুস্থ স্ত্রী ভার্জিনিয়া পো এবং শাশুড়ি মারিয়া ক্লেমকে নিয়ে এই বাড়িতেই তিনি ওঠেন। বাড়িটির মালিক ছিলেন তখন জন ভ্যালেন্টাইন। ১৮৭৪ সালে খবরের কাগজে সংবাদ ছাপা হয়, অসংখ্য মানুষ কবির শেষ বাসস্থানটি দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন। তত দিনে তার জনপ্রিয়তার পারদ অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। ১৮৮৪ সালে প্যাট্রিক জে কিয়ারি এই বাড়িটি কিনে নেন। বাড়িটি কবির স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণের জন্য প্যাট্রিক নিউইয়র্ক সিটির কাছে প্রস্তাব দেন কিন্তু সিটি কর্তৃপক্ষ তাতে রাজি হননি। এর পর দ্রুত আরও কয়েকবার বাড়িটির মালিকানা হাতবদল হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯১৩ সালে নিউইয়র্ক সিটি কর্তৃপক্ষ এই বাড়িটি কিনে নেয়। ১৯৭৫ সাল থেকে এডগার এলান পোর কটেজকে একটি ঐতিহাসিক জাদুঘর হিসেবে রক্ষণাবেক্ষণ করছে ব্রঙ্কস কাউন্টি হিস্টোরিক্যাল সোসাইটি। সোসাইটিকে সহযোগিতা দিচ্ছে নিউইয়র্ক সিটি পার্ক অ্যান্ড হিস্টোরিক সোসাইটি ট্রাস্ট। ১৯৬৬ সাল থেকে নিউইয়র্ক সিটি কর্তৃপক্ষ এই কটেজটিকে একটি ল্যান্ডমার্ক স্থাপনা হিসেবে ঘোষণা করেছে।

বিশেষত্বহীন একটি দরিদ্র গোছের হাই রেঞ্চ। শাদা রং করা ভাইনিলের দেয়াল, একটি বারান্দা এবং দুটি চিমনি। ১৮১২ সালে যখন বাড়িটি নির্মাণ করা হয়, এর মাত্র ২৭ বছর আগে আমেরিকা গ্যাস ব্যবহার শুরু করে, বিদ্যুতের ব্যবহার তখনো মার্কিনিদের চিন্তায় আসেনি। কাজেই শীতকালে ঘর উষ্ণ রাখার জন্য প্রাকৃতিক ফায়ার প্লেসে ব্যবহার করা হতো কাঠের জ্বালানি। যথার্থ কারণেই বাড়িটিতে দুটি চিমনি বসানো হয়েছে। বুঝলাম, হেরিটেজ প্রোপার্টি, ঠিক যে রকম বাড়িতে কবি ছিলেন তেমনই রাখার আবশ্যকতা আছে, তাই বলে ছাদের শিঙ্গেলগুলোরও এই দশা করে রাখতে হবে? ব্যবস্থাপনায় দারিদ্র্যের কিংবা অবহেলার একটা সুস্পষ্ট ছাপ যে কারোরই চোখে পড়বে।

এডগার এলান পো ছিলেন আমেরিকার প্রথম সফল লেখক যিনি লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। তার রচনা সমগ্রের দিকে তাকালে বিস্মিত হতে হয়, যখন জানি মাত্র ৪০ বছর বয়সে থেমে যায় তার কলম, পাড়ি জমান পরপারে। ১০ ভলিউমে তার রচনা সমগ্র পাওয়া যায়, প্রতিটি ভলিউমের কলেবর ৫শ পৃষ্ঠার ওপরে।

র‌্যাভেন বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে ছিল, টু হেলেন নিয়ে বাংলা সাহিত্যে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে, আজও হচ্ছে। এর মূল কারণ হলো বাংলা ভাষার বিখ্যাত কবিতা ‘বনলতা সেন’ জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন টু হেলেন কবিতাটির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে। ভূমেন্দ্র গুহের কাছে জীবনানন্দ দাশ তা সরাসরি অস্বীকার করলেও ‘টু হেলেন’ যে তিনি পড়েছেন তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় যখন তিনি বলেন, তুমি যা পড়ো, যে পরিবেশে তোমার মনোজগৎ বিচরণ করে তোমার লেখায় তো সেই ভাষাই আসবে।

বাঙালি কবিদের মধ্যে যে কয়জনের বিদেশি সাহিত্যের পাঠ অতি উচ্চ পর্যায়ের সৈয়দ কামরুল তাদের একজন। আমি কথাটি তাকে জিজ্ঞেস করি, আপনার কী মনে হয়? টু হেলেনের প্রভাব আছে কি?

দেখেন, চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গেলে মৌলিক রচনা খুব কমই পাবেন। অনেক মহৎ শিল্পই মিউটেশন। এখন কথা হচ্ছে, কে কত ভালোভাবে সেটা করতে পারেন। কতটা নতুন রঙের প্রলেপ তাতে দিতে পারেন। জীবনানন্দ দাশ যেটা করেছেন, তিনি বিষয়গুলোকে লোকালাইজ করতে পেরেছেন সফলতার সঙ্গে।

আমার মনে হয় আপনার মন্তব্যটি যথার্থ এবং গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ তো ৩২ লক্ষ বছর ধরে জিন মিউটেড করেই আজকের অবয়বে দাঁড়িয়েছে। কাজেই অন্যের কাজ না দেখেও, অন্যের সাহিত্য না পড়েও একই ধরনের শিল্প সৃষ্টি করতে পারে। বরং পড়ে নিতে পারলে বা দেখে নিতে পারলে নতুন শিল্পীর জন্য আরও সুবিধা হয়, যতটা সম্ভব ভিন্নতা আনার চেষ্টা করা যেতে পারে। নিজের ভাষার মানুষের উপযোগী করে মিউটেড করতে পারাটাও তো এক ধরনের মৌলিকত্ব।

অন্ধকারের পাহাড়টা মাথা তুলে দাঁড়াবার আগেই আমাদের কিছু ছবি তুলে ফেলতে হবে। কটেজের চৌহদ্দির বাইরেও অনেকখানি ফাঁকা জায়গা পো-পার্কের অংশ। লৌহদণ্ডের বেড়া দিয়ে ঘেরা পুরো পার্কটি। এখানে-ওখানে খুব ছোটো ছোটো সাইন, সেগুলোতে লেখা পো-পার্ক। পার্কের পশ্চিম প্রান্তে একটি সিমেন্টের উঁচু বেদি, নান্দনিক কিছু কলামের ওপর দাঁড়িয়ে আছে বেদির ছাদ। আমরা ওরও ছবি তুলি। তখন একটি কায়াহীন ছায়া আমাদের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়।

আমরা ভূত দেখার মতো চমকে উঠি।

ছায়ার মধ্যেই টের পাই বয়স আরও বেড়ে গেছে। তবে বয়সের ভারে নয়, ছায়াটি কুঁজো হয়ে আছে অসুস্থতার কারণে।

হেই এডগার, এতক্ষণ কোথায় ছিলে, আর এ কী অবস্থা তোমার?

আমাকে এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে চলো। হয়তো আমি আর বাঁচবো না।

আমার তো মনে হয় মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানে অপ্রকৃতিস্থ হওয়া ছাড়া তোমার আর তেমন কিছুই হয়নি।

ছায়াটি স্থূল হচ্ছে, গুটিয়ে যাচ্ছে। এখন একটি গোলাকার বৃত্ত ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

এডগার, এডগার...

আমি বেশ জোরেই কয়েকবার ডাক দিই। ফাঁকা পার্কে, বাতাসের গায়ে, আমার কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হয়। ছায়াটি সম্প্রসারিত হতে থাকে। হাত, পা গজায় এবং ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়।

এবার ও জোরে জোরে হাসছে। ও কী পাগল হয়ে গেল? ছায়াটিকে শান্ত করতে কিংবা ওর মনোযোগ অন্য দিকে ফেরাতে আমি এডগারের নারীদের প্রসঙ্গ তুলি।

মেয়ে পটানোর জন্য তুমি কিন্তু অসততা করেছ।

সম্ভবত ছায়াটি উৎকর্ণ হলো।

সারাহ হেলেন হুইটম্যানকে পটানোর জন্য তুমি ওকে বলেছিলে ‘টু হেলেন’ কবিতাটি ওকে নিয়ে লিখেছ?

ছায়াটি তখন আকাশ কাঁপিয়ে হেসে ওঠে।

কবিতার শিরোনামেই তো হেলেন আছে।

সেটা তো ট্রয়ের হেলেন, প্রতীকী, আর কবিতাটি তো তুমি জেইনকে নিয়ে লিখেছ, ছাপা হয়েছে ১৮৩১ সালে। সারাহ হেলেনের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে ১৮৪৮ সালে।

তুমি একজন কবি হয়ে মূর্খদের মতো কথা বলো না তো? আমাকে আক্রমণ করতে চাও তো অন্য কিছু বলো। একটি কবিতার ব্যাপ্তি তুমি বোঝো না? এক নারীতেই কবিতাকে বেঁধে ফেলতে চাও?

আমার একটা পর্যবেক্ষণ আছে তোমার নারীদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া নিয়ে, বলবো?

হ্যাঁ, বলো।

সারাহ হেলেন হুইটম্যান ছিল তোমার চেয়ে ১০ বছরের বড়ো, জেইনও ছিল ১৪/১৫ বছরের বড়ো। আমার মনে হয় কি জানো?

ছায়াটি নীরব।

আমার মনে হয় তুমি খুব শিশুকালে মা হারিয়েছ, তাই মাতৃস্নেহের একটা প্রবল তৃষ্ণা তোমার মধ্যে ছিল। সেজন্যই জ্যেষ্ঠ নারীদের প্রেমে পড়তে। ওদেরকে একাধারে তুমি মা এবং প্রেমিকার আসনে বসাতে।

শেষ জানুয়ারির খটখটে শুকনো পার্কের মাটি ভিজতে শুরু করে।

সে কি তুমি কাঁদছো?

ছায়াটি তখনো নীরব। দুটি শীর্ণধারা ছায়ার ভিতর থেকে বেরিয়ে গড়াতে থাকে।

তোমাকে দুঃখ দিয়ে থাকলে আমি দুঃখিত। না, না, সব নারীই তো আর বড়ো ছিল না। সারাহ শেলটন তো তোমার সমবয়সীই ছিল, ভার্জিনিয়ান গার্ল।

এবার ও নিজেকে গুছিয়ে নিল।

তুমি কি একটা জিনিস লক্ষ করেছ, নারীরা আমাকে কেবল দুঃখই দিয়েছে, কেউ দুদণ্ড শান্তি দেয়নি, ভালোবাসা দেয়নি। আমরা দুজন দুটি কলেজে পড়তে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হলাম, সারাহ আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেললো। ভার্জিনিয়ার মৃত্যুর পরে খবর পেলাম সারাহর স্বামী মারা গেছে, আমি ওকে প্রস্তাব দিলাম বিয়ে করার, ও রাজি হলো না।

কিন্তু তোমার কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে সারাহই সবচেয়ে বেশি অশ্রুপাত করেছে। হাসপাতালে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়েছে মৃত্যুর কারণ জানার জন্য।

এর ১০ দিন পরেই একটা তারিখ ওকে দিয়েছিলাম, বিয়ে করার।

হয়তো ও মনে মনে রাজি ছিল। তুমিই তো সময় দিলে না। মদ গিলতে গিলতে চলে গেলে।

খুব কষ্ট হচ্ছে এখন।

ন্যান্সি কিন্তু তোমাকে খুব ভালোবাসতো।

এই এই, ন্যান্সি বলবে না, আমি ওর নাম দিয়েছি অ্যানি, অ্যানি বলবে।

দুঃখিত, অ্যানি। হ্যাঁ, জানো তো ওর স্বামীর মৃত্যুর পর নিজের নাম ও এফিডেভিট করে রেখেছে অ্যানি রিচমন্ড। তোমার দেওয়া নাম। তুমি পারতেও, এই আমেরিকার মতো দেশে বসে প্লেটোনিক লাভ। চুমু টুমু খাওনি, না?

নাহ, সুযোগ পাইনি।

ওকে নিয়ে তো একটা কবিতাও লিখেছিলে?

হ্যাঁ ‘ফর অ্যানি’। ও খুব পছন্দ করেছিল কবিতাটি।

আমি কিন্তু তোমার একটা জিনিসের খুব তারিফ করি। ভার্জিনিয়ার জীবদ্দশায় তুমি কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলেও তাকাওনি। তবে তুমি পারো বটে। ওই দুবছরেই তিন তিনটা প্রেম!

শোনো কবি, ভার্জিনিয়াকে হারিয়ে আমি পাগল হয়ে যাই। ডাল ভেঙে ধপাশ করে মাটিতে পড়ে গিয়ে আমি একটি নিরাপদ ডালের জন্য সব গাছেই ওঠার চেষ্টা করেছি। কিন্তু জীবন আমার অনুকূলে ছিল না। মৃত্যুই আমার আপন হয়ে উঠলো।

দেখো এটা একদম বাজে কথা। তোমার মতো একজন সংগ্রামী পুরুষ অ্যালকোহলের কাছে আশ্রয় নেবে এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। প্রত্যাখ্যান তো তোমার জন্মদাগ, এ তো আর নতুন কিছু নয়।

ছায়াটি হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল। কারণ ততক্ষণে দিবসের আলো নিভে গেছে।

হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২৯ জানুয়ারি ২০২৩।

[সমাপ্ত]

সর্বশেষ খবর