শুক্রবার, ২৮ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

প্রেম

ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া

প্রেম

‘প্রেম’। দু অক্ষরের এমন রহস্যময় ও মোহনীয় শব্দ বোধকরি বাংলা ভাষায় বিরল। এর যে অনির্বচনীয় শক্তি, তা বোধকরি ‘মা’ শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দের মাঝে নেই। কেমন করে প্রেম মানুষকে বুকের পাঁজরে টেনে আনে, আবার কেমন করে দূরে ঠেলে দেয়- সে রহস্যভেদ মানুষের সাধ্যাতীত। ‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলিয়া দেয়’। তাহলে প্রেম যেমন আপন করে, তেমনি কি পরও করে দেয়? এ কেমন গোলকধাঁধা? আবার চোখের আড়াল হলেই সে হয়ে যেতে পারে মনের আড়াল। ক্ষণকালের আড়াল মাধুর্য বাড়ায়, দীর্ঘকালের আড়াল তাকে হত্যা করে-‘ Short absence quickens love; long absence kills it.’-এর সন্তোষ আর অসন্তোষের তো কোনো ব্যাকরণই নেই। নীতিতেও বাধা পড়ে না। আবার রীতিতেও থিতু থাকে না। প্রীতির মালাও কতক্ষণ সযত্নে রাখবে; তারও নির্ভরতা একান্ত মেজাজ-মর্জির ওপর।

মানুষ প্রেমকে পেয়েও কাঁদে, আবার হারিয়ে কাঁদে। আর প্রেম, দুঃখ পেয়েও কাঁদে, দুঃখ দিয়েও কাঁদে। আবার নিজেরাই নামকরণ করে বলে-দুঃখের অশ্রু, সুখের অশ্রু। এ-যে এক নিরন্তর বিড়ম্বনা। কিন্তু এই বৃথা দুর্ভোগের মধ্যেই মানুষ অনাদিকাল থেকে কী এক অনির্বচনীয় সুখানুভূতিকে লালন করে চলেছে অবলীলায়! কিন্তু চঞ্চলা-চপলমতি এই প্রেমের জন্মটা কোন প্রসূতির ঘরে, এর উৎস কোন অপার্থিব প্রস্রবণে, বাসা বাঁধে কোন শাখায়, কে জানে! কোন রাজ্য থেকে এ অনুভূতি-অপ্সরার নান্দনিক আবির্ভাব, কোন অমিয় ঝর্ণা ধারা থেকে এর অবাধ উৎসারণ; এর রূপ কতটা প্রকৃত স্বরূপ, কতটা অরূপ-কেউ কি তা আজ অব্দি ঠাউর করতে পেরেছে? সবই আন্দাজ-অনুমানের বিফল কসরত। মগজ খাটিয়ে কালের অবিরাম লগি ফেলেও মানুষ এর তল খুঁজে পায়নি। আমরা প্রেমীকে নিয়ে ঘর বাঁধি, ঘর বাঁধার জন্য ঘর ছাড়ি, আবার বিচ্ছেদ যাতনায় ঘর ভাঙ্গি; সংসার বাঁধি, আবার হই সংসার বিরাগী। প্রেম-লক্ষ্মীর জন্য হই পাগলপারা, আবার হই লক্ষ্মীছাড়া। মনের ক্লেশে রবিকবি’র মতো গেয়ে উঠি ‘আমরা লক্ষ্মীছাড়ার দল/ভবের পদ্মপত্রে জল/সদা করছি টলোমল/মোদের আসা-যাওয়া শূন্য হাওয়া, নাইকো ফলাফল... /যদি সুখ না জোটে দেখব ডুবে কোথায় রসাতল।’

তবুও প্রেমিক কবি নজরুলের মতো সব মানুষই যেন আকুতি জানিয়ে বলছে, ‘আর কিছু নয়, চির প্রেমময়, তোমারে ভিক্ষা চাই/এক তুমি ছাড়া এই ভিখারির কিছুই চাওয়ার নাই!’ ওমর খৈইয়াম তো আরও এক কাঠি এগিয়ে গিয়ে বলে দিয়েছেন, ‘সবার চেয়ে মধুর জেনো প্রেমিক জনের দীর্ঘশ্বাস/তার তুলনায় তুচ্ছ অতি ভক্ত হৃদের মুক্তির আশ।’ কবিগুরুর প্রশ্ন আরও শাণিত, আও আক্ষেপের-‘যদি প্রেম দিলে না প্রাণে/কেন ভোরের আকাশ ভরে দিলে এমন গানে গানে? কেন তারার মালা গাঁথা/কেন ফুলের শয়ন পাতা/কেন দখিন-হাওয়া গোপন কথা জানায় কানে কানে?’ কবিদের উক্তির সঙ্গে আমার অভিব্যক্তিরও রয়েছে নিবিড় সাযুজ্য-‘প্রেম যদি না দাও/তবে জীবন কেড়ে নাও/প্রেম ছাড়া-যে জীবন শুধু বিরান মরুময়।’

বাংলা ভাষায় ‘প্রেম ও ভালোবাসা’ আর ইংরেজিতে ‘Romance I Love’ একটা যুগান্তরের ধোঁয়াশা তৈরি করে রেখেছে। যদিও তাতে প্রেম কিংবা প্রেমিকের কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই। পাখি যখন মনের সুখে বনে বনে গান গায়, বনানী মাতিয়ে তোলে সুরের মূর্ছনায়, তখন কি পাখি জানতে চায় ওর এই গানটা সা.রে.গা.মা’র কোন সুরে পড়ল? প্রেমের বৈশিষ্ট্যও তেমনি। প্রেমের চলা নদী-প্রবাহের মতো। আপন বেগে সে পাগলপারা। বলা যায় না কোন খেয়ালিপথে তার চলা। ভিক্টর হুগোর অভিমতও সে রকম, ‘ভালোবাসা একটি গাছের মতো : এটি নিজ থেকেই বৃদ্ধি পায়, আমাদের সত্তার গভীরে এর শেকড় প্রোথিত এবং বিধ্বস্ত হৃদয়ের ওপর সে বিকাশ লাভ করে। অনির্বচনীয় সত্য হলো এই যে, এটি যতটা অন্ধ, ততটাই দৃঢ়। এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক হওয়ার আগে কখনো শক্তিশালী হয় না।’

ভালোবাসা শব্দের (এর বিশেষ্য আকারে) একটি ইতিহাস রয়েছে। প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় শব্দ leubh, যার অর্থ যত্ন বা ইচ্ছা। এটি পরে ল্যাটিন ভাষায় lubet হয়ে পড়ে libet শব্দের সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে। libet হলো libido শব্দের জনক, যা প্রেমের সঙ্গে প্রায় শেকড়ের মতোই সংযুক্ত। রোমানরা মারা যাওয়ার পরে শব্দটি এই সময় ফরাসিতে নয়, বরং জার্মানিতে ছড়িয়ে পড়ে। এখানে এটি মূল থেকে ক্রমাগতভাবে চারটি আকারে বিকশিত হয়েছে, প্রতিটিই পূর্ববর্তী স্থান নিয়েছে: lubo, liube, liebe, lob, Liube ছাড়া বাকি সব কটিরই আধুনিক অর্থ ছিল, যাকে ‘আনন্দ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই প্রেমের সঙ্গে আনন্দের অন্তরঙ্গতা এতটা নিবিড়। সে কারণেই কবিকেও বলতে শুনি, ‘আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনে’। আনন্দেরই উচ্ছ্বাসে প্রেমিক স্বতঃস্ফূর্ততায় গেয়ে ওঠে, ‘হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচেরে।’ কিংবা, ‘মোরা আনন্দ-মাঝে মন/আজি করিব বিসর্জন। ...সকল দৃশ্যে সকল বিশ্বে আনন্দনিকেতন। ...আনন্দ চিত্ত-মাঝে/আনন্দ সর্বকাজে, আনন্দ সর্বকালে/দুঃখে বিপদজালে, আনন্দ সর্বলোকে/মৃত্যুবিরহে শোকে...।’

প্রেম বিমূর্ত অনুভূতি। মানব-মানবীর পারস্পরিক আকর্ষণ মনের আবেগ যখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে, দর্শন ও মিলন ব্যতিরেকে জীবনাচরণ নিরর্থক বলে মনে হয়, তখনই তাকে বলা যায় প্রেম। মিলন, বিরহ, বেদনার অন্তর্গত রক্তক্ষরণ প্রেমেরই অনুসঙ্গ। প্রেমের উৎস রূপ কিংবা গুণে, কিংবা উভয়ে। মনোবিজ্ঞানী রবার্ট স্টেনবার্গ ভালোবাসাকে আবেগ (যৌন অথবা রোমান্টিক আকর্ষণ), অন্তরঙ্গতা (গভীর অনুভূতি) এবং সহানুভূতি (শুধু সম্পর্ককে রক্ষা করাই নয়, তাকে সসম্মানে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া)-এই তিনটি উপাদানে বিভক্ত করেছেন। আবার উপাদান তিনটিকে ভাগ করেছেন ৭ (সাত) ভাগে। যেমন, ভালোলাগা, মোহ, প্রতিশ্রুতি, রোমান্টিক প্রেম, অর্থহীন প্রেম, ঘনিষ্ঠ প্রেম, অনবদ্য প্রেম। এছাড়া, কালের বিবর্তনে নানা জাতের প্রেমকে ফর্দভুক্ত করা যায়। যেমন, প্রথম প্রেম, প্রথম দেখায় প্রেম, বন্ধুত্ব থেকে প্রেম, বিবাহোত্তর প্রেম, পরকীয়া প্রেম, অপরিণত প্রেম, কর্মক্ষেত্রে প্রেম, মোবাইল প্রেম, ইন্টারনেটে প্রেম, ত্রিভুজ প্রেম, বহুভুজ প্রেম, ঘানি টানা প্রেম, অব্যক্ত প্রেম, সুপ্ত প্রেম, চুক্তিবদ্ধ প্রেম, অসাম্প্রদায়িক প্রেম, ভাড়াটে প্রেম, ঝগড়াটে প্রেম, আজো তোমায় ভালোবাসি’ প্রেম, ব্যর্থ প্রেম, শরীর-সর্বস্ব প্রেম, ‘দুধের মাছি’ প্রেম/স্বার্থসর্বস্ব প্রেম, ঈর্ষান্বিত প্রেম, জেদের বশে প্রেম, মিথ্যে প্রেম/অভিনয় প্রেম, ২য় ইনিংস প্রেম বা পুনরুজ্জীবিত প্রেম, ব্ল্যাকমেইল প্রেম, অনিচ্ছাপূর্বক প্রেম, জোর খাটানো প্রেম, গায়ে পড়া প্রেম/নাছোড়বান্দা প্রেম : বিদেশি বা পরবাসী প্রেম, চাঞ্চল্যকর বা আলোচিত প্রেম, ঐতিহাসিক প্রেম, অমিল বা দুনিয়াছাড়া প্রেম। এবার পাঠকদের ভাবার ফুরসত দেওয়া হলো। চলুন ভাবি, আমরা কে কোন কিসিমের প্রেমে বাঁধা পড়ে আছি। মনে মনে বলছেন, না, আমি কিন্তু বাঁধা পড়িনি। বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, সত্যিই কি তাই? সেই ফাঁদে আলতোভাবে হলেও একবারও কি পা ফেলেননি?

‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে/কে কোথা ধরা পড়ে, কে জানে।’ কবিগুরু খাঁটি কথাই বলেছেন। তবে প্রশ্ন হলো, এটা কি কবির অভিজ্ঞতা, নাকি উপলব্ধি? হতে পারে দুটোই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বৌদি কাদম্বরী দেবীর সম্পর্ক আদৌ কী প্রেমের ছিল? জানি না। তবে উভয়ের মনের কোণের বনানীতে অনুরাগ-জোনাকের মিটিমিটি কোনো সোনা-আলোর কণা অহর্নিশ জ্বলে থাকত বোধ করি। কবির ‘জীবনস্মৃতি’তে পাই, যখনকার যেটি সহজপ্রাপ্য তখন সেটি না জুটিলে মানুষ কাঙাল হইয়া দাঁড়ায়। আমার সেই দশা ঘটিল। ছেলেবেলায় চাকরদের শাসনে বাইরের ঘরে মানুষ হইতে হইতে হঠাৎ এক সময় মেয়েদের অপর্যাপ্ত স্নেহ পাইয়া সে জিনিসটিকে ভুলিয়া থাকিতে পারিতাম না।’ আর কাদম্বরী দেবী সম্পর্কে ঠাকুরবাড়ির বিশেষ ঘনিষ্ঠ ও ভারতীয় সম্পাদকীয় গোষ্ঠীর অন্তর্গত বাঙালি লেখিকা শরৎকুমারী চৌধুরাণী যথার্থই বলেছেন, ‘ফুলের তোড়ার ফুলগুলিই সবাই দেখিতে পায়, যে বাঁধনে তাহা বাঁধা থাকে তাহার অস্তিত্বও কেহ জানিতে পারে না। মহর্ষি পরিবারের গৃহলক্ষ্মী শ্রীযুক্ত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী ছিলেন এই বাঁধন।’

ভুবনজোড়া পাতা যে-ফাঁদ, সেই ফাঁদে সবারই পা দেওয়ার আশঙ্কা প্রবল। সুতরাং তা থেকে কবিদেরও রক্ষা নেই। বরং কবির বেলায় সে আশঙ্কা কিংবা সম্ভাবনা আরও বেশি। মগজে চাষ হয় বুদ্ধির। বুদ্ধি বিত্ত বাড়ায়, চিত্তের খোরাক দেয় না। হৃদয়ে থাকে প্রেমের স্পন্দন।

[চলবে]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর