শুক্রবার, ১১ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

আমার প্রিয় শিক্ষক রফিক স্যার

ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া

আমার প্রিয় শিক্ষক রফিক স্যার

স্মৃতিকথা

‘আদিতম হনন উৎসবে/মৃত্যুই আমার উপহার’-বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও একুশে পদকপ্রাপ্ত মননশীল আধুনিক কবি মোহাম্মদ রফিক স্যারের ‘গন্ধ আসে’ কবিতার এ পঙ্ক্তি বাস্তবে রূপ নিল গত ৬ আগস্ট তাঁর জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে। না-ফেরার দেশে চলে গেলেন আমার অতি প্রিয় শিক্ষক রফিক স্যার। তাঁর আকস্মিক প্রয়াণে হৃদয় ভারাক্রান্ত। আমাদের মন শোকাচ্ছন্ন। আর কোনোদিন দেখা যাবে না তাঁর অমলিন হাসি। শোনা যাবে না কবিতার নিগূঢ় বিশ্লেষণ। জানা যাবে না সাহিত্য নিয়ে তাঁর কী গভীর ভাবনা। পড়া যাবে না তাঁর লেখা নতুন কোনো কবিতা। আর মিলবে না তাঁর কোমল স্নেহের পরশ। স্যারের দরাজ কণ্ঠে আর শুনতে পাব না, ‘লোহার গরাদ ফেটে টগবগ আষাঢ়ী পূর্ণিমা/কলমীর ঘ্রাণে মুগ্ধ বিলের ওপর দৃপ্তপায়ে/ফাঁসির দড়িতে ঝোলে হাসির জোয়ারে ভাঙাবাঁধ/ কপিলা; কাদায় জলে ঘামেশ্রমে অন্নদা স্বদেশ।’

     তবে স্যার মৃত্যুকে জয় করেছেন। শিক্ষক হিসেবেও তিনি অমর। আর কবি হিসেবেও অনশ্বর। তাঁর অগুনতি ছাত্রের স্মৃতিতে তিনি থাকবেন চিরঅম্লান। সাহিত্যের অঙ্গনে থাকবে তাঁর কালোত্তীর্ণ রচনা। ‘কিছু কিছু প্রাণ আছে মরে না/কালের কালিতে ঢাকা পড়ে না/স্মৃতির মিনার কেউ গড়ে না/প্রাণে প্রাণে পাতা থাকে তাঁদের আসন।’ বাংলার জল-মাটি ও সাধারণ মানুষের মুক্তি চেতনার কবি, দ্রোহের কবি মোহাম্মদ রফিকও স্থান করে নিয়েছেন মানুষের অন্তর-সিংহাসনে, যার ভিত ‘ধুলোর সংসারে এই মাটি’তে প্রোথিত। তাই তো জীবনানন্দের মগ্ন মুগ্ধতাকে ছাড়িয়ে জীবনের রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ানো মানুষের অসহায়ত্বকে স্যার তুলে এনেছেন পরম বিশ্বস্ততায় আর শৈল্পিক সুষমায়, ‘এইভাবে ভিজে-ভিজে কীর্তিনাশা কতদূর যাবে/এই দেশে, বন্যার কি শেষ আছে? বৃষ্টিও মেঘের/সারাপিঠে এলানো চুলের ঢেউ ভিজে ছপছপ/শীতার্ত বর্ষার ফলা বিঁধে ফেলে সমস্ত শরীর।’

    জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ছাত্র হিসেবে আমার ভর্তি ৭০-এর দশকের শেষের দিকে, সপ্তম ব্যাচে। এই সময়টাকে অনেকেই বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগরের স্বর্ণযুগ’। তখন যে সব জ্ঞানতাপস আমাদের শিক্ষক ছিলেন, তাঁদের নাম জানলেই পাঠকদের কাছে পরিষ্কার হবে যে, ‘স্বর্ণযুগ’ বলার মাঝে কোনো অত্যুক্তি নেই। সেই থেকে প্রায় পাঁচ দশক ধরে স্যারের সঙ্গে আমার নিবিড় যোগাযোগে তেমন ছেদ পড়েনি। ধন্য হয়েছি তাঁর অপত্য স্নেহে। আমি, মাহবুব, শিউলি, শিরিন, হাবিব, খান, বিলকিস, শাহ আলম, আলমগীর স্যারের সাহচর্যে এসে আমাদের অজান্তেই এক বন্ধুবৃত্তে বাঁধা পড়ে যাই। আর স্যার ছিলেন সেই বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু। ক্লাসের বাইরে আমাদের যত আড্ডা, সবই স্যারের সঙ্গে। সেই আড্ডাই মূলত আমাদের শিক্ষার মজবুত ভিত। ক্লাসে শিক্ষকদের কাছে যা শুনতাম, মনে হতো মাথার ওপর দিয়ে সব উড়ে যাচ্ছে। পরে স্যারের সঙ্গে কথা বললেই সব ধোঁয়াশা উবে যেত। কিন্তু স্যারের ব্যক্তিত্ব ছিল অত্যুচ্চ, নীতিবোধ ছিল শাণিত। সততা ছিল প্রশ্নাতীত। চারিত্রিক দৃঢ়তা ছিল অসামান্য। আমাদের স্নেহ দিয়েছেন, কিন্তু আনুকূল্য দেননি। দেননি দাফতরিক বা পদাধিকারের কোনো বাড়তি সুবিধা। তিনি আমাদের ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায়ও দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের সার্কেলের দুজন থার্ড ক্লাস পেয়ে যায়। একজন দুই নম্বরের জন্য, আর একজন তিন নম্বরের জন্য। ইচ্ছা করলে তিনি ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান হিসেবে তাদের গ্রেস নম্বর দিয়েও সেকেন্ড ক্লাসে উন্নীত করতে পারতেন। কিন্তু স্যার ছিলেন তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। স্বাভাবিক নিয়মে যা ঘটেছে, সেটাই চূড়ান্ত। এমন দৃষ্টান্ত এখন কতটা বিরল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

    আমার মনে সাহিত্যের বীজ বপন করেছেন এই সাহিত্যপ্রেমী। কবিতার প্রতি আমার যেটুকু অনুরাগ, সেটাও তাঁরই অবদান। সৃজনশীলতার যে কসরত আমি নিরন্তর করে চলেছি, তাও এই মহাপ্রাণের প্রেরণায়। বড় কবি-সাহিত্যিক হতে পারিনি সত্য; তবে অবিরাম চর্চা জারি রাখার মধ্যে যে অনির্বচনীয় সুখ আছে, সেটা স্যারের কাছ থেকেই শেখা। কবিতা যে ‘বাক বাকুম পায়রা’ নয়, তাও প্রথম তাঁর কাছেই শুনেছি। কথা কেমন করে কবিতা হয়ে ওঠে, স্যার যখন সেই চিত্র তুলে ধরতেন, মনে হতো যেন এস এম সুলতান ছবি আঁকছেন। জটিল কবিতাকে এমন সাবলীল, সরল-সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিতেন, যেন তিনি নিজেই ওই কবিতার লেখক। ভাবাবেগ আর কল্পনার বিহঙ্গ ভাষার বাতাসে ভর করে কবিতা হয়ে কেমন করে পাখা মেলে, তা এমন করে তুলে ধরতেন যেন কলি পাপড়ি মেলছে, ধীরে ধীরে ফুল ফুটছে। তন্ময় হয়ে শুনতাম তাঁর গভীর বোধের কথা। কবিতা কেমন করে সমাজ বদলের হাতিয়ার হয়, তাও জেনেছি তাঁর কাছ থেকেই, ‘হঠাৎ আকাশ ফুঁড়ে তৃতীয় বিশ্বের গঞ্জে-গাঁয়ে/ হুট করে নেমে আসে জলপাই লেবাস্যা দেবতা/পায়ে, কালো বুট; হাতে, রাইফেলের উদ্যত সঙ্গীন/লোলুপ দুর্নীতিবাজ অপদার্থের দারুণ কামড়ে/ অনুর্বর মাঠ-ঘাট, ছিন্নভিন্ন সমাজ কাঠামো/রন্ধ্রে-রন্ধ্রে পুঁজিবাদী কালো থাবা লাল রক্ত ঢালে।’

   স্যারকে নিয়ে কী লিখব! কত যে স্মৃতি আছে, তার ইয়ত্তা নেই। তাঁর স্মৃতিতর্পণ আমার পক্ষে দুরূহ। কাকে নিয়ে লিখব! কবি রফিক, শিক্ষক রফিক, মানুষ রফিক, নাকি বন্ধু রফিক? আজ মনটা বিক্ষিপ্ত। তাই তাঁর সাহিত্যকর্ম নিয়ে লেখা সমীচীন হবে না। কারণ, এ কাজে অখন্ড মনোযোগ দরকার। সে কারণে কিছু খন্ডচিত্রের মধ্যেই লেখাটাকে সীমিত রাখছি। তবে একটি বেদনার কথা এখানে না বললেই নয়। স্যারের মৃত্যুসংবাদ নানা অনলাইন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে গত ৭ আগস্ট। প্রাসঙ্গিকভাবেই সেগুলোতে স্যারের নিষিদ্ধ ‘খোলা কবিতা’র সবচেয়ে বহুচর্চিত, বহুল-উদ্ধৃত ও পাঠকনন্দিত পঙ্ক্তিগুলো উল্লিখিত হয়েছে : ‘সব শালা কবি হবে;/পিপড়ে গোঁ ধরেছে, উড়বেই;/বন থেকে দাঁতাল শুয়োর/রাজাসনে বসবেই।’ অথচ তাজ্জবের বিষয় এই যে, কিছু কিছু প্রথম সারির পত্রিকাও শেষ দুটি পঙক্তি শুদ্ধরূপে উদ্ধৃত করেনি। তারা লিখেছেন, ‘দাঁতাল শুয়োর এসে রাজাসনে বসবেই’। ‘বন থেকে’ শব্দ দুটি কোথায় উবে গেল? আর ‘এসে’ শব্দটা কোন আসমান থেকে নাজিল হলো, সেটা বুঝলাম না (দ্রষ্টব্য : প্রথম আলো/The Daily Star বাংলা/bdnews24.com)/আমাদেরসময়.কম)। প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা, ডজনখানেক পুরস্কার/সম্মাননাপ্রাপ্ত একজন প্রতিনিদিত্বশীল স্বনামধন্য কবির কবিতা উদ্ধৃতিতে এমন ঔদাসীন্য আমাকে ব্যথিত করেছে। জীবদ্দশায় শিল্পী-কবি-সাহিত্যিকরা তেমন সম্মান পান না, যেমনটা তাঁদের প্রয়াণের পর ঘটে। দেশে দেশে কালে কালে তা-ই হয়ে এসেছে। “আমার জীবনানন্দ’ গ্রন্থের ‘ভূমিকা বা উপসংহার’ অধ্যায়ে স্যারও একই কথা বলেছেন।’ কবির মৃত্যুর পর উৎসাহ বেড়েছে কবির কবিতা সম্পর্কে। প্রকৃত কবির ক্ষেত্রে এমনি ঘটে। ...কবির জন্মশতবার্ষিকীতে পৌঁছে কবিকে ঘিরে যে প্রায় বিস্ফোরণোন্মুখ পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে, তার বিশুদ্ধতা বা যথার্থতা বিচারে না গিয়ে তাঁকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া বাঞ্ছনীয়। অবশ্য মানতেই হবে যে, কোনো সৃষ্টিকর্ম বিষয়ে নিগূঢ় নিরুৎসাহ বা অতিউৎসাহ-উদ্দীপনা সমান সন্দেহজনক।’ স্যারের এই আশঙ্কা তাঁর বেলায় যেন সত্যি না হয়, সবার কাছে আমার মিনতি সেটাই।

  ‘খোলা কবিতা’ যখন বেরোল তখন আমাদের কী রোমাঞ্চকর অনুভূতি। আমরা দিন-রাত এ নিয়েই পড়ে রইলাম। একদিকে বিলি-বণ্টন, অন্যদিকে যে যেমন পারি আবৃত্তি শুরু করলাম। ‘রাজা জানে, আজ্ঞাবাহী মধ্যবিত্ত বহুদিন থেকে/সবকিছু তুষ্ট চিত্তে মেনে নিতে জো-হুকুম রাজি/তাই যত আইনের অলৌকিক প্রতাপের বলে/তার প্রতারক স্বপ্ন রাজত্ব-শাসন টিকে আছে/শমনের টান-টান দড়ি একটু ঢিল দিলে সব/সবকিছু নির্ঘাত পড়বে ঝুলে রাজছত্র, রাজা/চাপাবাজি একসঙ্গে টুপ করে ডোবায় কাদায়।’ কেউবা তখনই চেঁচিয়ে উঠছে এই বলে, ‘হবুচন্দ্র রাজা, গবুচন্দ্র মন্ত্রী অমাত্য কোটাল/কাহিনীর আঁস্তাকুড় থেকে উঠে এসে রাজপাট সাজিয়ে বসেছে।’

     এই কবিতার আছর ছিল সর্বগ্রাসী। আমার পাশের রুমে থাকতেন ভূগোলের নির্মলদা। তিনি বলতেন, ‘কবিতা শুনলে আমার গায়ে জ্বর এসে যায়।’ সেই দাদাই বাথরুমে গিয়েও ‘খোলা কবিতা’র পঙক্তি আওড়াতেন, ‘প্রেমের কবিতা লেখো। ভালবাসো কিম্বা নাই বাসো/... গালগল্প মলমূত্র ত্যাগ/এই টুকিটাকি ছাড়া সবকিছু নিষিদ্ধ এখন।’ কিন্তু স্যারকে যখন ক্যান্টনমেন্টের দিকে নিয়ে গেল তখন আমরা চরম দুর্ভাবনায়। শেষে স্যারের মুখেই শুনলাম কবি আর সেনাদের বাতচিৎ। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তবে সে বাঁচা ক্ষণিকের। জারি হয় হুলিয়া। অবশ্য জেল, জুলুম, মামলা, সেগুলোর সঙ্গে স্যারের পরিচয় হয়ে গেছে কৈশোরেই। আজ থাক সে প্রসঙ্গ।

    একদিন বিকালে গিয়ে দেখি নাট্যমঞ্চের গ্যালারিতে তিনি একা বসা। ‘শকুন্তলা’ মঞ্চস্থ হবে কদিন বাদেই। সেলিম আল দীন স্যার আর হুমায়ুন ফরীদি ভাই প্রস্তুতিতে ভীষণ ব্যস্ত। রফিক স্যার উদাস হয়ে বসে আছেন। পাতার বিড়িটা হাতেই নিভে আছে। আমাকে দেখেই যেন মুচকি হাসির অভ্যর্থনা জানাল। বললেন, কি খবর তোমার? বললাম, কি বলব স্যার, ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’র মাথা-মু-ু কিছুই তো বুঝলাম না। আসলেই স্যার, মনে হয় আমি কবিতা বুঝিই না। স্যার খানিকটা ক্ষেপলেন মনে হলো। বললেন, তার মানে হলো, কবিতা ছাড়া আর বাকি সবই তুমি বোঝ, তাই না? কবিতা তো বোঝার বিষয় নয়। উপলব্ধি, অনুভব, ভালো লাগার বিষয়, বোধের বিষয়। আগে বের কর, তুমি কি বোঝনি। ভাব, নাকি ভাষা? ভাষা বুঝলেই কবিতা বোঝা যায় না। কবিতা থাকে ভাষার অন্তরালে। ভাব বুঝতে হলে নিজেও ভাবুক হও। কবিতার মজা পেতে হলে পড়, অনেক অনেক বেশি করে পড়। পড়তে পড়তে দেখবে তুমি নিজেই নজরুলের মতো একদিন বলে উঠবে, ‘আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!’ তখন কবি হতে না পারলেও অন্তত যোগ্য কাব্য-সমালোচক হতে পারবে। এ কথা বলেই স্যার তাঁর স্বভাবসুলভ একটা মুচকি হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কি বুঝলা?

   ঠিকই বলেছেন স্যার। তিনি যতক্ষণ জেগে থাকতেন, তখন হয় পড়তেন, নইলে লিখতেন। গ্রন্থকীট যদি কেউ দেখে না থাকেন, তাহলে স্যারকে দেখলেই আপনার দেখা ষোলোকলা পূর্ণ হতো। তাঁর বাসায় গেছি বহু বহুবার। কিন্তু কোনটা তাঁর বসতঘর, আর কোনটা লাইব্রেরি, তা নির্ণয় করা রীতিমতো এক দুরূহ ব্যাপার।

[চলবে]

সর্বশেষ খবর