শুক্রবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

‘ধুলোর সংসারে এই মাটি’র কবি মোহাম্মদ রফিক

ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া

‘ধুলোর সংসারে এই মাটি’র কবি মোহাম্মদ রফিক

[পূর্ব প্রকাশের পর]

নবজাগরণযুগপ্রভাতের রবি তেমন আবর্তেই বেঁধেছেন বিশ্ব-সংসারকে: ‘ধূপ আপনারে মিলাইতে চাহে গন্ধে/ গন্ধ সে চাহে ধূপেরে রহিতে জুড়ে/ সুর আপনারে ধরা দিতে চাহে ছন্দে/ ছন্দ ফিরিয়া ছুটে যেতে চায় সুরে/ ভাব পেতে চায় রূপের মাঝার অঙ্গ/ রূপ পেতে চায় ভাবের মাঝারে ছাড়া/ অসীম সে চাহে সীমার নিবিড় সঙ্গ/ সীমা চায় হতে অসীমের মাঝে হারা/ প্রলয়ে সৃজনে না জানি এ কার যুক্তি/ ভাব হতে রূপে অবিরাম যাওয়া-আসা/ বন্ধ ফিরিছে খুঁজিয়া আপন মুক্তি/ মুক্তি মাগিছে বাঁধনের মাঝে বাসা।’ তবুও মুক্তির আকুতি চিরায়ত। এই চাওয়ার ধারা নিরন্তর চলমান। কারণ, ‘Man is born free; but everywhere he is in chains।’ তাই বিদ্রোহী কবি নজরুলকে বলতে শুনি, ‘মুক্ত বিশ্বে কে আর অধীন? স্বাধীন সবাই আমরা ভাই / ভাঙিতে নিখিল অধীনতা-পাশ মেলে যদি কারা, বরিব তাই।’ কবির কিন্তু মুক্তি মেলে না। অবিরাম অনুসন্ধানের আবর্তে থাকেন আবদ্ধ। মোহাম্মদ রফিকেরও ছিল নিরবচ্ছিন্ন সেই অলৌকিক ও লৌকিক অভিযাত্রা। ঘোর তমসার মাঝেও রফিক দেশপ্রেমে নিবিষ্ট। মা-মাটি-মানুষের জন্য তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে আশা-জাগানিয়া : ‘শীত, শীত/দু’ হাঁটুতে সিঁধিয়েছে মৃত্যুভীতি/মনে লয় আসন্ন বিলয় সর্বমানুষের/দ্যাখ, দ্যাখ/ন্যাড়া কঞ্চিতে ধরেছে ফুল পূর্ণিমার।’(কালাপানি)। ‘কপিলা’য় রফিকের স্বদেশ এসেছে এই সাজে, ‘কুঁচের বরণী কন্যা মেঘের বরণী চুলে পায়ে প্যাঁক শাড়ির আঁচলে/ছেঁড়া লজ্জা ঢাকে মুখ/তবু নেই শেষ। নেই-নেই নিরুদ্দেশ/স-বু-জ/সবুজ/দেশ।                      

     মোহাম্মদ রফিকের মতো আইরিশ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটসও কবিতার মুক্তি চেয়ে বলেছেন, ‘যা কিছু কবিতা নয়, তা থেকে মুক্তি দিতে হবে কবিতাকে।’ আধুনিক কবিতার জনক ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার, যাকে জাঁ আতুর র্যাঁবো ‘প্রথম দ্রষ্টা, কবিদের রাজা, সত্য দেবতা’ হিসেবে  আখ্যায়িত করেছেন, তিনিও তা-ই চেয়েছেন। বলেছেন, ‘কবিতা হবে এমন বস্তু যার সবটুকু হবে কাব্যময়। প্রতিটি পঙ্ক্তি হীরার টুকরোর মতো জ্বলজ্বল করবে, আর প্রত্যেকটি কবিতা হবে এক একটি মণিহার।’ বদলেয়ার কবিতার কাছে প্রশ্ন রাখেন, ‘কবিতা, মানসী, তুই প্রাসাদের উপাসক জানি/কিন্তু বল, যখন প্রদোষকালে, হিমেল বাতাসে/নির্বেদে, নীহারপুঞ্জে জানুয়ারি কালো হয়ে আসে/নীলাভ চরণে তোর তাপ দিবি, আছে তো জ্বালানি?’ (‘পণ্য কবিতা’, লে ফ্ল্যর দু মাল)। জীবন অভিশপ্ত হলে মুক্তির কসরত চলে, শেষতক মুক্তি কি মিলে? ‘তুমি-আমি, অভিশাপ বয়ে-বয়ে ফিরি/লখিন্দর ও বেহুলা, নদ্যা ও মহুয়া, একই কথা/কিংবদন্তি রূপকথা উপকাহিনির/এক যুগে একখানে সাপ অন্য যুগে অন্যখানে ছুরি/যুগান্তরে একখানে বিষ যুগে-যুগে অন্যখানে রক্ত/অভিশাপ তবু মুক্ত হয় না কখনো...’ (অভিসার, অভিষেক)

কবি রফিকের কবিতা যেন চিলির বিখ্যাত কবি পাবলো নেরুদার ভাষ্যের ছায়াসঙ্গি : ‘কবিতাকে হতে হবে রুটির মতো যাতে সবাই তার স্বাদ পায়; শিক্ষিত অশিক্ষিত ও চাষা...কবিতা হবে অগণিত সদস্যবিশিষ্ট মানব পরিবারের জন্য।’ রবীন্দ্রনাথও বোধ করি কবি রফিকের অপেক্ষায় আছেন, ‘যে আছে মাটির কাছাকাছি /সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি।’ মানুষের মুক্তির মাঝেই কবিতার মুক্তি। কিন্তু সে মুক্তির উপায় কি, যখন বাস্তবতা এমন : ‘সব শালা কবি হবে/ পিপড়ে গোঁ ধরেছে, উড়বেই/ বন থেকে দাঁতাল শুয়োর/ রাজাসনে বসবেই/...হঠাৎ আকাশ ফুঁড়ে তৃতীয় বিশ্বের গঞ্জে-গাঁয়ে/হুট করে নেমে আসে জলপাই লেবাস্যা দেবতা;/পায়ে কালো বুট; হাতে রাইফেলের উদ্যত সঙ্গিন...’’ (খোলা কবিতা)। 

      ফিরে যাই আমার সূচনা ভাষ্যে। ছ’ লাইনের ‘জোনাকি’ কবিতাটার মাত্র তিনটি শব্দ নিয়ে আমি খানিক নাড়াচাড়া করেছি। তা-ও খন্ডিত। বিদগ্ধ সমালোচকের হাতে পড়লে সে আলোচনা পূর্ণতা পাবে। আমার এই আলোচনার একটা হেতু আছে। প্রেক্ষিত পরিকল্পনা। কবি রফিকের কবিতার প্রতিটি শব্দ কী অমিত তেজ ও বলিষ্টতা ধারণ করে- উপর্যুক্ত আলোচনা তারই একটা ভূমিকা।

     ‘সেরা শব্দের সেরা বিন্যাসই সেরা কবিতা।’ ইংরেজ রোমান্টিক কবি  স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ এ অভিমত ব্যক্ত করেন ১৮২৭ সালে। কবিতা শব্দের পুঁতিরমালা। তবে কবি প্রতিটা পুঁতির স্বকীয় রং এবং আকৃতি সম্পর্কে রাখেন অখন্ড সচেতনতা। প্রতিটা শব্দের অন্তর্গত সহজাত শক্তির সূক্ষ্মতার প্রতি কবির থাকে সংবেদ্য একাগ্রতা। এভাবেই শব্দের বাহুল্য কবির কলম থেকে ত্যাজ্য হয়। কবিতার ভিটায় হেতুহীন শব্দের বসতি হয় প্রতিষিদ্ধ। অপরিহার্য শব্দেরা কবিতায় নীড় বাঁধে। উৎকৃষ্ট শব্দমালা প্রকৃষ্টরূপে উপ্ত হয় কবিতার জমিনে। উত্তররৈবিক মননশীল কবি মোহাম্মদ রফিক-এর কবিতা সেই বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করেছে পরম স্বতঃস্ফূর্ততায়। কেমন স্বতঃস্ফূর্ত? বৃক্ষ যেমন পল্লবিত হয়, তরু-লতা যেমন কুসুমিত হয়, ঝর্ণা যেমন নিঝরে ঝরে, কলি যেমন পাপড়ি মেলে প্রস্ফুটিত হয়, প্রজাপতি যেমন ফুলের পরাগ ছুঁয়ে যায়, তেমন স্বতঃস্ফূর্ত, তেমন অকষ্টকল্পিত। মোহাম্মদ রফিক-এর ‘কালের মান্দাস’ কাব্যের ‘খুঁটে তোলো ধান’ কবিতাটির উদ্ধৃতাংশটি দেখুন : ‘একটি শব্দ, একটি চিত্র, একটি আরাধনা/শেষ যুদ্ধ ঘোষণা করেছে/ফিরে চলো ঘরের দুয়ারে, মাঠে-মাঠে/খুঁটে তোলো ধান/বিচ্ছিন্ন খড়ের স্তূপে মুখ ঢেকে/নাও তার ঘ্রাণ/দিকে-দিকে মিলিয়ে এসেছে আলো/যাত্রা অবশেষ/অবুঝ নেশার টান, নীরক্ত বিষাদ/শুধুই সম্বল/তুমি মাত্রা, ছন্দ ভাঙা লয়, পরিত্যক্ত পক্সিক্ত/ঘোর অপচয়!’

     উইলিয়াম ব্লেকের ভাবনা কাব্যশিল্পের তাৎপর্য প্রকাশে প্রণিধানযোগ্য : ‘বালুকা-কণায় একটি পৃথিবী দেখা/ অথবা একটি স্বর্গ; বন্য-ফুলে/ সীমাহীন কিছু হাতের মুঠোয় পাওয়া/ নিরবধিকাল; এক প্রহরের মূলে।’ কবিতা যেন ‘মাইক্রোকোজম’ বা ক্ষুদ্র বিশ্ব। এ বিশ্ব বিশাল বিশ্বকে ধারণ করে। করতলে মহাদেশ, গলিতে রাজপথ, শেকড়ে শিখর, সসীমে অসীম, বিন্দুতে সিন্ধু কিংবা বিন্দুতে বৃত্ত। চিত্রকলার উপায় যেমন বর্ণ, সংগীতের বাহন যেমন ধ্বনি, ভাস্কর্যের সাধন যেমন পাথর, কবিতার উপাদান তেমনি শব্দ। কবি রফিক তাঁর কবিতায় শব্দের রং-তুলিতে বাস্তবতাকে এঁকেছেন, সুলতান যেমন মানুষের অন্তর্গত শক্তিকে পেশিবহুল ‘আদমসুরত’-এ চিত্রিত করেছেন। কবিতার শব্দ চয়নে অসামান্য দক্ষতা তাঁকে অন্য সব কবি থেকে অনন্য করে তুলেছে। তাঁর সময়ের ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকেই তিনি বর্ণমালার চিত্রলিপি দিয়ে বর্ণনা করেছেন। কবিতা যেন ভাষার চিত্র। ভাবাবেগ, কল্পনা, স্বতঃস্ফূর্ততা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, চিত্রকল্প, রূপকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, প্রতীক, শ্লেষ, ভাব-রস, অনুপ্রাস, তাল-লয়-ছন্দের মূর্ছনা, ঝংকার, ব্যঞ্জনা, দ্যোতনা, বক্রোক্তি, চিরন্তন আবেদন, গতিময়তা, শব্দালংকার, বাক্যালংকার, কোনো অলংকারের খামতি নেই তাঁর কবিতায়! ‘কপিলা’র দুটো লাইনে ছন্দের দোলা দেখুন: ‘কার্পাসের ডালে ডালে ফাট্যা পড়ে ফুলের আগুনি/হরিণী কতোটা জানে কতোটা সে সত্যিই হরিণী।’ প্রকাশের সুষমা দেখুন, ‘কাছারি উঠোন/ভ’রে/বাও দিচ্ছে ধানের মাড়াই/ওড়ে তুষ/তুষের কুহেলি।’ কবিতার কথায় নির্ঝরের গতিময়তা দেখুন : ‘অ মাসী তুই বল না দেহি/পাগলা ঘোড়া দেখতে ক্যামন/ছুইট্যা চলে পাঁজর ভাইঙ্গা/ক্যামনে তারে সামলে রাহি।’

        ‘কবিকে রেহাই দেবে কে’ কবিতার ভাষার সৌকর্য আর আবেদনের গভীরতা দেখে চমৎকৃত হবেন যে কোনো পাঠক। সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা কেমন করে কবিতার ভাষা হয়ে ওঠে, সেই দীপ্ত-দৃষ্টান্ত এই কবিতাটি : ‘মাগো, তবে কাদের বাড়ির খুদে / ভরে উঠলো ভাঙাথালা/ কান্নায়, চিৎকারে / মাগো, তবে কাদের ঘরের ত্যানা/ আমাকে জড়িয়ে নিলো/রক্তহিম সরোবরে/মাগো, তবে কাদের গ্যাঁজালো পান্তা / পেটের ভিতরে ঢুঁড়ছে / বেদম হাত পা / মাগো, মা কাদের সোহাগে ঘেন্নায় / ভিড়মি খেতে খেতে যেন / ফুল ফুটছে তারা ডাকছে / শরীরের কন্দরে কন্দরে ক্ষত ফাটছে /যেন মসলা পিষে পিষে কেউ / মাগো, ধুয়ে ফেলছে পাটা।’ তাঁর কবিতা উচ্চকিত করেছে সময়ের প্রকৃত রূপকে। মানবজীবন ও সমাজের অবক্ষয়, অনগ্রসর মানুষের বঞ্চনা, সমাজের নানা অসঙ্গতি, অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক কপটতা, আধুনিকতার উন্নাসিকতা- সবই স্থান পেয়েছে প্রথাবিরোধী এ কবির কবিতায়।

        ‘হাওয়া বদলে যাচ্ছে, পশ্চিমা কবিরা এখন আর দুর্বোধ্য কবিতা লিখছেন না, তাদের দুর্বোধ্যতার মোহ কেটে গেছে।’ প্রমথনাথ বিশি’র এই অভিমতের প্রতিফলন দেখা যায় কবি রফিকের কবিতায়। দুর্বোধ্য ও অবোধ্য কবিতা আসলে কবিতা নয়। সকল স্তরের মানুষকে যুক্ত করতে পারলেই কবিতা দায়মুক্ত হতে পারে। কবি রফিকের ‘লাশ’ কবিতার ভাবের গভীরতা সহজিয়া ভাষায় যেমন করে সকলের সঙ্গে সমাযোগ স্থাপন করেছে, তা আধুনিক কবিতার একটি মডেল হতে পারে : ‘লাশ নামানো হচ্ছে গোরে/ঠিক সেই মুহূর্তে একটি প্রজাপতি/ কোত্থেকে, ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে উড়ে/এসে বসল লাশের বুকের ওপর/ প্রজাপতিটি নাড়াচ্ছে পাখনা/আনন্দে না বেদনায়/কে বলবে!’ কবির মৃত্যুবোধ কবিতায় সঞ্চারিত হয়ে যে চিত্রকল্প এঁকেছে, তা কালোত্তীর্ণ আবেদন  হয়ে ধরা দেয় সকল মানুষের কাছে। যেমন ‘কীর্তিনাশা’য় মৃত্যুর অমোঘ এবং শাশ্বত রূপ উঠে এসেছে অবলীলায়, ‘এইভাবে দুঃখে দৈন্যে কীর্তিনাশা কতদূর যাবে/এই দেহ কাল হবে, কেউ তাকে ঠিক ছিঁড়ে খাবে।’ তবে তাঁর ‘অন্তিম উত্থান’ কবিতায় মৃত্যুকে দেখেছেন আরেক জীবনের সূচনা হিসেবে: ‘মৃত্যু তবে শেষ নয়, শুরু/আলোতেই হোক তবে অন্তিম উত্থান!’

           পথ চলতে চলতে থমকে দাঁড়াতে হয়। কারণ পথের মোড় একসময় ঘুরে যায়। পথের বাঁকেই পথিকের পথ ফুরায়, পথিকও ফুরায় : “এই রাস্তা হেঁটে গেছে, তবে বহু দূর নয়, /থমকে আছে, মোড়ের ওধারে, গাঢ় আস্তরণে, বালুতে-কাদায়, /যেন অজগর, এইবার নিজেকে গুটিয়ে নেবে ঝোপেঝাড়ে/খাদ্যলোভে, প্রতীক্ষায়, পড়ে রইবে, দিন, মাস, বৎসর-বৎসর;” (এই স্বপ্ন এই ভোর প্রভাতের আলো)।

       যেখানে বাংলা সাহিত্যের আদি কবিদের কাব্যের বিষয় ছিল ‘নির্বাণে’র উপায় বা মোক্ষলাভ, এর বিপরীতে মোহাম্মদ রফিকের কবিতা আলো উৎসারণের, স্বপ্ন চয়নের, আশা সঞ্চারের। মাটি ও মানুষের চেতনা, বঞ্চনা-যন্ত্রণা, জীবন-জীবিকা, স্বেদ ও শোণিত, মমতার অশ্রু ও হন্তারকের হাতিয়ার, ঐতিহ্য-অহংকার, লোককথা ও পুরাণে মোহাম্মদ রফিক যুক্ত করেছেন এক আধুনিক মাত্রা। রূঢ় বাস্তবতার  সঙ্গে তিনি নিবিড় করে যুক্ত করেছেন নিজকে। দুঃখ-যন্ত্রণা, আশা-হতাশা, কামনা-নিষ্কাম, সংকট-সম্ভাবনা, সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য, দৈন্য-দুর্বিপাক তাঁর চৈতন্যে ছিল জাগ্রত। অন্তরাত্মার নির্যাসে সেই বোধকে সিক্ত করে তা কবিতায় তুলে এনেছেন। লোক-সংস্কৃতির খনি থেকে তুলে এনেছেন আত্মস্বর ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের মণি। ভাব যতো গভীরই হোক, শব্দ চয়নে তাঁর ছিল পরম পরিমিতি বোধ। সাধারণ্যের ভাষা ও যুতসই শব্দ বিন্যাসে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। সে বিবেচনায়ও তিনি এক অসামান্য আধুনিক কবি। তিরিশের আধুনিকতার প্রবাহ মানে পশ্চিমের হাওয়া। সেই হাওয়ায় ছিল নাগরিক জীবনের উদ্ভট উত্তাপ। চেনায় ছিল আভিজাত্য। বোধে-চিন্তনে আপন শেকড়ের সন্ধান ছিল উপেক্ষিত। ‘আধুনিকতা হচ্ছে অস্থায়ী, দ্রুতগামী অপ্রত্যাশিত ব্যাপার; এটা শিল্পের এক অর্ধেক, আর  অন্য অর্ধেক হচ্ছে শাশ্বত এবং অপরিবর্তনীয়।” শার্ল বোদলেয়ার’র এই আত্মোপলব্ধি  কবি রফিকেও  প্রভাবিত করেছে। ষাটের দশকের কবি মোহাম্মদ রফিক আধুনিকতার চলতি হাওয়ার পন্থি হয়ে গতানুযায়ী গা ভাসান নি। কারণ তিনিও এন্ডি হান্ট’র মতো বিশ্বাস করতেন, ‘Only dead fish go with the flow’ তাই তিনি স্বকীয় শৈলীতে কবিতায় ধারণ করলেন স্বাদেশিক ইতিহাস ঐতিহ্যকে। চেতনাকে তিনি অনুবাদ করেছেন বিশ্বাসে। হতাশাকে জেনেও মেনেছেন আশাকে। আলোয় আলোয় চেয়েছেন ভুবনকে ভরে দিতে। আলোর স্রোতে পাল তোলা দেখেছেন হাজার প্রজাপতির। ‘প্রহেলিকা’ তে তাই তিনি গেয়েছেন  মরণ-জয়ের পালাগান : এই যাত্রা, কোথায় বা শেষ হবে/স্রোত-ভাঙা শব্দ, মৃদুমন্দ ঘ্রাণ/উচাটন আমার শরীরে/অন্ধকার ভেদ করে একটি তারা/পুবের আকাশে, শুকতারা/ছায়া ফেলে খোলা চুলে, শাড়ির আঁচলে/হাওয়া দেয় শুধু হাওয়া/একটু পরে হয়তো ভোর হবে/প্রহেলিকা, ঘোর প্রহেলিকা/শেষ নেই অন্তিম অন্তের/ধরো তবে মরণ-জয়ের পালাগান।’ আর এভাবেই তাঁর আরাধ্য ‘আলোতেই হোক তবে অন্তিম উত্থান!’

 

                লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক

সর্বশেষ খবর