শুক্রবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
পর্ব - ১

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

আন্দালিব রাশদী

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

গাঁজা নিয়ে মন্দ কিছু বলা নিষেধ আছে। ওস্তাদের নিষেধ।

ওস্তাদ আবার কে?

মঞ্জু ভাই বলল, শরৎ চ্যাটার্জি।

শরৎ চ্যাটার্জি!

আরে হ্যাঁ, পথের দাবীতে আছে।

পথের দাবীতে? আমার তো চোখে পড়েনি!

কেমন করে পড়বে, ওটা তো ইন বিটুইন দ্য লাইনস, বুঝে নিতে হয়। ওটাই হচ্ছে চেতনা। চেতনা বোঝার মতো বিদ্যে বাবার নেই।

কী বললে, বাবার বিদ্যে নেই! ম্যাট্রিকুলেট উইথ ডিস্টিংশন, ঘাস খেয়ে তো আর পাস করেনি।

ঘাস খেলে তো ভালোই ছিল, বুঝত গাঁজাটা ভেজেটারিয়ান ডিশ। এর মধ্যে কোনো অ্যানিমেল ফ্যাট নেই, হাইরিস্ক কোলেস্টেরল নেই। বাবাকে বলে দিস, আমাকে যা ইচ্ছে বলতে পারে, কিন্তু গাঁজা নিয়ে নিন্দে-মন্দ করলে কিন্তু এটা আমার সইবে না। শরৎ চ্যাটার্জিরও সইবে না।

বেশ, সবই বুঝলাম, ওই গন্ধটা সামলে রেখো। প্রত্যেক দিন বাবা গালাগাল দেয়, আমার ঘুম ভেঙে যায়।

কিছু মনে করিস নে। বাবার জন্য একটু সেক্রিফাইস কর। গালাগাল দিলে টেনশন রিলিজড হয়। বাবাও তো একটা মানুষ, তাই না? বাবারও তো টেনশন হয়। টেনশন রিলিজ করার একটা মিডিয়াম তো লাগে। বাবা ভাগ্যবান, তবু তো আমাকে পেয়েছে, যে বাবার গঞ্জিকাসেবী ছেলে নেই তার কথা একটু ভেবে দেখ, বেচারাকে সব টেনশন বুকের ভিতর জমিয়ে রেখে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মরতে হয়।

ধ্যাৎ, তোমার এসব ফালতু কথা রাখো, আমার কাজ আছে।

মঞ্জু ভাই রাতে একবার গাঁজা খায়, বারোটা থেকে সাড়ে বারোটার মধ্যে, বারো মাসই খায়। হালকা ঘূর্ণি বাতাস থাকলে গাঁজার ধোঁয়াটা মিলিয়ে গেলেও গন্ধটা আমাদের সাড়ে তিন কাঠা জায়গার ওপরে ও নিচে, চার দেয়ালের মধ্যে কিছুক্ষণ ঘুরপাক খেতে খেতে একসময় মিলিয়ে যায়। মিলিয়ে গেলেও একটা রেশ থেকে যায়, গন্ধটার সঙ্গে যারা পরিচিত তারাই কেবল বুঝতে পারে ওটা শেষ হয়েও শেষ হয়নি, বাতাসের ঘূর্ণায়মান চক্রের কোনো একটি নিজের ভিতর একটুখানি গন্ধবীজ লুকিয়ে রেখেছে।

এই গন্ধটা কেমন এ নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে কিন্তু ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কেউ বলেছে পচা তারপিনের, কেউ বলেছে পোড়া কাঁচা ঘাসের, একজন বলেছে ঘিমাখা গরম ভাতের, একজন বেশ জোর দিয়ে বলছে, আরে আমি জানি, দুম্বার মূত্রের। দুম্বার মূত্রের গন্ধের কথা বলেছে আমাদের বাড়ির কেয়ারটেকার কাম দারোয়ান আবুল বাশার মিরধা। আমরা বলেছি নামের শেষটা মিরধা হবে না হবে মৃধা? বাশার বলেছে, নামটা আমার। আমার চেয়ে বেশি তোমরা কেমন করে জানবে। আমার নাম আবুল বাশার মিরধা, আমার আব্বার নাম আবুল হোসেন মিরধা, দাদার নাম নজু হোসেন মিরধা। আমার ছেলের নাম হবে আবদুল্লাহ সালমান বিন বাশার মিরধা। আমাদের মানতেই হয় নজু মিরধার নাতি কিংবা মিরধার পুত্র তো মিরধাই হবে। বাশার অবশ্য দুম্বার মূত্র বলেনি বলেছে দুম্বার মুতের গন্ধ। আমরা আপত্তি করেছি মুত কথাটা খারাপ শোনায় ওটা মূত্র হবে। এটা বাশার মেনে নিয়েছে, তা হতে পারে বাচ্চা দুম্বারটা মুত আর ডাঙর দুম্বার মূত্র। ডাঙর শব্দটা আমাদের জন্য নতুন, হাঙরের সঙ্গে ছন্দমিল রয়েছে।

গাঁজার গন্ধের তুলনা খুঁজতে আরবীয় দুম্বা পর্যন্ত পৌঁছার বড় কারণ আবুল বাশার সৌদি আরবের তাবুক নামের একটি জায়গায় খেজুরবাগানে দুই বছর চাকরি করেছে, পাশেই ছিল দুম্বার খামার। তার সঙ্গী বাঙালিদের চাকরি-পরবর্তী দুই বছরের জন্য নবায়ন করা হলেও তারটা নামঞ্জুর হয়েছে, তার মতে তার ভাষা ব্যবহারের সামান্য ভুলচুকের কারণেই এটা ঘটেছে। তাদের ফার্ম সুপারভাইজার শিখিয়ে দিয়েছিল মালিক যেদিন এসে তোমাদের জিজ্ঞেস করবে আরও দুই বছর থাকবে না দেশে ফিরে যাবে, তখন চুপ থেকে কয়েকবার মাথা ওপর-নিচ করবে, তাতে তিনি বুঝে যাবেন যে তোমরা থাকতে ইচ্ছুক। কিন্তু আবুল বাশার মিরধা কেবল মাথা নাড়ার মানুষ নয়। দুই বছরে যে সে কম আরবি শেখেনি সেটাও মালিককে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য মাথা না নেড়ে আরবিতে ব্যাখ্যা করে বলেছে। সর্বনাশ তখনই হয়ে গেছে। একজন বাদে সবার চাকরি দুই বছর করে বাড়ানোর আদেশ দিয়ে মালিক আহমদ সাদুল্লাহ বরকতি চলে গেলেন। কেন আবুল বাশারেরটা হলো না এটা নিয়ে গবেষণা হলো। মালিকের সামনে যা বলেছে সে কথার পুনরাবৃত্তি করলে সুপারভাইজার হেসে উঠলেন। আবুল বাশার তাকে বলতে চেয়েছিল আমার নিজের দেশে কি মরার জন্য ফিরে যাব? আমার ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু আরবিতে মালিককে যা বলেছে তার মানে দাঁড়ায়, তোমার দেশে কি মরার জন্য থাকব? আমার থাকার কোনো প্রশ্নই আসে না!

শুনেই মালিক অসন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তাকে দুম্বাপ্রসূত বলে একটা বাজে গাল দিয়েছেন।

আরবি ভাষার অন্যতম বলি বাংলাদেশের আবুল বাশার মিরধা আমার বাবার প্রয়াত প্রথম স্ত্রী মুন্নি বেগমের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। সৌদি আরবে দুই বছর পূর্ণ করে এয়ারপোর্টে নেমে সিএনজি অটোতে সোজা আমাদের বাড়ি। বাবাকে বলল, বরিশাল ফিরে গেলে তার ভবিষ্যৎ একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তার মা জোর করে তাকে বিয়ে করিয়ে দেবে। ট্যারা চোখের একজন পাত্রীও ঠিক করে রেখেছে। বিয়ে করলেই সে জনমের মতো ফেঁসে যাবে। বাবাকে বলল, তার চেয়ে খালু আমাকে আপনার বাসায় রেখে দেন, ফুট ফরমাশ খাটব, বেতন দিতে হবে না, মাথাটা বিছানোর মতো এক চিলতে জায়গা আর ডালভাত খাওয়াই যথেষ্ট। আমি নতুন করে সৌদি আরব যাওয়ার আর একটা চেষ্টা করব, মক্কা কিংবা মদিনায়, এবার আরবিতে কোনোভাবেই মুখ খুলব না।

তারপর সাড়ে তিন বছর কেটে গেছে। আবুল বাশার মিরধা সৌদি আরব ফিরে যাওয়ার সুযোগ পায়নি, ওমানে যাওয়ার একটা সুযোগ এসেছিল, কিন্তু ওমান তার ভাষায় বাংলাদেশের লক্ষ্মীপুরের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো স্থান না হওয়ায় সুযোগটা প্রত্যাখ্যান করেছে। আমাদের হাউস বিল্ডিং ফিন্যান্স আমলের চার তলা বাড়ির কেয়ারটেকার কাম দারোয়ান কাম বাজার সরকারের ভূমিকা পালনসহ আইনি-বেআইনি অনেক কাজের ভার বহন করেছে আবুল বাশার মিরধা, কিছু বেতন তাকে দেওয়া হতো, কিন্তু আমার বাবা সম্ভবত সাবেক স্ত্রীর আত্মীয় হওয়ার কারণেই তার তেমন মূল্যায়ন করেনি।

আমার মা প্রথমে সন্দিহান ছিল সাবেক সতীনের আত্মীয়টি আবার তার গোয়েন্দা-টোয়েন্দা নয় তো? মা আমাদেরও বলেছে বাশারকে চোখে চোখে রাখিস, তার মনে কী আছে কে জানে। মুন্নি বেগম যদি শেষ বয়সে আবার ফিরে আসতে চায়! কিন্তু তার আগমনের এক বছরের মধ্যেই খবর আসে ঈদের দুই দিন আগে অতিরিক্ত যাত্রী বহনকারী যে লঞ্চটি গৌরনদীর কাছাকাছি এসে ডোবে এবং তাতে সরকারি হিসেবে ৩৭ যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানায়, তাদের মধ্যে হতভাগ্য মুন্নি বেগমও ছিলেন। বাবার সাবেক শ্বশুরবাড়ির কোনো এক আত্মীয় বাবাকে এ খবরটা জানায়। বাবা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সেই স্ত্রী মুন্নি বেগমের গর্ভে বাবার একটি সন্তান মানে আমাদের একটি বোন জন্মগ্রহণ করেছিল। তার নাম তিন্নি বেগম, স্বামী-সন্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট স্টেটে বসবাস করে। আমাদের সঙ্গে তেমন কোনো যোগাযোগ নেই, সম্ভবত বাবার সঙ্গে একটু থাকতে পারে।

এই সংবাদটা বাবা একাই হজম করতে পারত, মাকে না দিলেও পারত। কিন্তু মার বকা খাওয়া বাবার পুরনো অভ্যাস। মাসে দু-এক বার জবরদস্ত বকা না খেলে তার দিন কাটে না। মা বাবাকে ধমকে উঠল, এখন কী আর করবেন, পাটি বিছাইয়া দুই পা ছড়াইয়া বেটি মানুষের মতো কান্দা জুইড়া দেন।

মা এখানেই থামেন না। দেখেন, জোর দিয়ে বলে আল্লাহর গজব তার ওপর নাজেল হয়েছে। পনেরো মাসের বাচ্চা নিয়া যে বাড়ি থেকে পালায় সে কি সতী নারী? ঝগড়া তো আমিও কম করিনি, আমি কি একটা সন্তান নিয়ে এক দিনের জন্যও বাড়ি ছেড়েছি? আল্লার মাইর দুনিয়ার বাইর!

                [চলবে]

সর্বশেষ খবর