শুক্রবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ইমদাদুল হক মিলন : আমার চিত্তপটে

যতীন সরকার

ইমদাদুল হক মিলন : আমার চিত্তপটে

বিগত দশকের সত্তরের দশকেই ইমদাদুল হক মিলন- এই নামটি আমার স্মৃতিপটে মুদ্রিত হয়েছে। সে সময়ের বিখ্যাত সাহিত্যপত্র সমকালে মিলনের ‘জীবন যাত্রা’ গল্পটি পড়ে আমি মুগ্ধ হয়ে পড়ি। এই একটি গল্প পাঠেই আমি অনুভব করতে পারি, আমাদের সাহিত্যে একজন গুরুত্বপূর্ণ কথাসাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটেছে। সত্তরের দশকের শেষ দিকে, সম্ভবত ’৭৮ কিংবা ’৭৯ সালে মিলনের সাথে আমার সাক্ষাৎ ঘটে শেরপুর শহরে। তিন দিনের একটি জমজমাট সাহিত্য উৎসবের আয়োজন করেছিল শেরপুরবাসী। কবি আল মাহমুদ, কবি রফিক আজাদ, কবি মোহাম্মদ রফিক, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলন, অধ্যাপক সন্জীদা খাতুনসহ আজ আর নাম মনে করতে না পারা অনেক গুণীজন এই সাহিত্য উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন। আমরা ছিলাম বর্তমানে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বিখ্যাত শিক্ষক গোলাম রহমানের বাসায়। গোলাম রহমানের বড় ভাই তখন শেরপুরের মেয়র। গোলাম রহমান তখন শান্তিনিকেতনের ছাত্র। সেদিনের সাহিত্য উৎসবকে কেন্দ্র করে এই বাড়ির মানুষদের যে যত্ন-আত্তি পেয়েছিলাম, তা ভোলা যাবে না। আমি নিতান্ত মফস্বলবাসী মানুষ। এই সাহিত্য উৎসবকে কেন্দ্র করে আমার একটা গুণীজন সান্নিধ্যের সুযোগ হলো। উৎসবের মঞ্চে নির্ধারিত আলোচনাই চলছিল। কিন্তু বাড়ির ভেতরে অফুরন্ত আড্ডা মুডে চলছিল আমাদের সাহিত্য আলোচনা।

 

আসলে সেদিনের সেই সাহিত্য আড্ডাতেই আমি ইমদাদুল হক মিলনের ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাই। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, “আমি বসলেই লিখতে পারি।” ইমদাদুল হক মিলনের লেখার এই দ্রুততা দেখে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এত চমৎকার করে এত দ্রুত কেউ লিখতে পারে, এর আগে আমার ধারণা ছিল না।

 

দুই.

এরও অনেক পরে, ২০০৮-০৯ সালের দিকে মিলন একটি টিভি চ্যানেলে ‘প্রিয়মুখ’ নামের একটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। সে রকমই একটি অনুষ্ঠান ছিল ‘ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক’ বিষয়ে। আমার এক প্রিয় ছাত্র কবি নির্মলেন্দু গুণ ও আমাকে নিয়ে সেদিনের সেই অনুষ্ঠানটি হয়েছিল খুবই জনপ্রিয়। এর কিছুদিন পর থেকেই আমি অসুস্থ হয়ে নেত্রকোনায় গৃহবন্দি। তাই মিলনের সঙ্গে এখন আর আমার দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। তবে তাঁর সম্পাদিত ‘কালের কণ্ঠে’ লেখার সুবাদে আমি তাঁর সান্নিধ্যের স্বাদ বাড়িতে বসেও অনুভব করি।

 

তিন.

ইমদাদুল হক মিলন বহুপ্রজ লেখক। আইএসসি ক্লাসে পড়ার সময় ১৯৭৩ সালে তাঁর প্রথম লেখা ছোটদের গল্পগ্রন্থ ‘বন্ধু’ প্রকাশিত হয়। ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমির সাহিত্য পত্রিকা ‘উত্তরাধিকার’-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘যাবজ্জীবন’। এই উপন্যাস পাঠকমহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। আলোড়ন সৃষ্টিকারী লেখকরূপে কিংবা পাঠকের অন্তরে পৌঁছতে পারা লেখকরূপে ইমদাদুল হক মিলন বাংলা সাহিত্যে অনন্য। বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে তৈরি হয় কথাশিল্পের বিষয় ও ভাষা। বলতে চাই, জীবনাভিজ্ঞতাই তৈরি করে কথাশিল্পীর কলম। যেমন- ১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি জার্মানিতে কাটিয়ে এসেছেন। দুই বছরের এই বিদেশযাপনের অভিজ্ঞতাও নিশ্চয়ই শিল্পী ইমদাদুল হক মিলনের চেতনায় বিশেষ উপকরণের সঞ্চার ঘটিয়েছে। বলতে চাই, একজন কথাশিল্পী অভিজ্ঞতাকেই কলমবন্দি করেন। ইমদাদুল হক মিলনও জীবনের এই বহুবিচিত্র অভিজ্ঞতাকে তরতর করে লিখে যাচ্ছেন। বিশেষ করে তাঁর ‘নূরজাহান’ উপন্যাসটি তো বাংলা সাহিত্যে একটি মোড় ফেরানো গ্রন্থ। বাস্তবতার শিল্পসম্মত রূপায়ণের মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছে উপন্যাসটি। উপন্যাসটির ফ্ল্যাপে লেখা হয়েছে : “বাংলাদেশে যখন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে মৌলবাদ, সোনার বাংলার গ্রামগুলো যখন আচ্ছন্ন করে অশিক্ষিত কাঠমোল্লারা, রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং আইনের তোয়াক্কা না করে যখন একের পর এক ফতোয়া দিতে থাকে তারা, ফতোয়াবাজ নরপশুদের হিংস্র নখরে যখন ছিন্নভিন্ন হয় গ্রামপ্রান্তের অবলা নারী, নূরজাহান সেই নারীসমাজের প্রতিভূ। মৌলভীবাজারের ছাতকছড়া গ্রামে জšে§ছিল নূরজাহান। প্রথম বিয়ের পর স্বামী যায় নিরুদ্দেশ হয়ে। অষ্টাদশী নূরজাহানের রূপে মুগ্ধ হয়ে গ্রাম মসজিদের প্রভাবশালী মাওলানা মান্নান তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু নূরজাহানের বাবা তাকে মধ্যবয়সী মাওলানার সাথে বিয়ে না দিয়ে মোতালেব নামের এক যুবকের সাথে বিয়ে দেয়। তখন মাওলানা মান্নান ক্ষিপ্ত হয়ে ফতোয়া জারি করে, নূরজাহানের দ্বিতীয় বিয়ে বৈধ নয়। অবৈধ বিয়ের অপরাধে মধ্যযুগের আরব দেশের কায়দায় বুক অব্দি গর্তে পোঁতা হয় নূরজাহানকে। তারপর এক শ একটি পাথর ছুড়ে মারা হয়। নূরজাহানের স্বামীকে দেওয়া হয় একই শাস্তি। পিতাকে করা হয় বেত্রাঘাত। এই অপমান সইতে না পেরে সেই রাতেই নূরজাহান বিষপানে আত্মহত্যা করে। নূরজাহানের এই আত্মহত্যা আসলে মৌলবাদের বিরুদ্ধে বিশাল এক প্রতিবাদ। নূরজাহানের আত্মহত্যা আসলে ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে প্রথম সোচ্চার, বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার গায়ে কালিমালেপন। সুতরাং ঐতিহাসিক না হয়েও নূরজাহান এক ঐতিহাসিক চরিত্র। এই নূরজাহানকেই উপন্যাসের বিষয় করেছেন ইমদাদুল হক মিলন। নূরজাহানকে আশ্রয় করে ফুটিয়ে তুলেছেন বাংলাদেশের নির্যাতিতা নারীসমাজের অনুপুঙ্খ চিত্র। উšে§াচন করেছেন মৌলবাদ, ফতোয়াবাজ এবং কাঠমোল্লাদের মুখোশ। বাংলাদেশের রাজনীতি, মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, গ্রামমানুষের জীবন ছবির মতো ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে।”

এই উপন্যাসটি পড়তে পড়তে আমার ভেতরে যে আবেগের সঞ্চার ঘটেছিল, সেই আবেগের যথাযথ প্রকাশ এই মুহূর্তে আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলতে পারি, আবেগের সঙ্গে যুক্তির এবং যুক্তির সঙ্গে সমাজ-সচেতনতার এক অপূর্ব কথাশিল্প ‘নূরজাহান’ উপন্যাসটি। উপন্যাস নামক শিল্প প্রকরণটিকে বলা হয়ে থাকে এ যুগের মহাকাব্য। প্রাক-আধুনিককালে মহাকাব্যের মাধ্যমে যে বক্তব্য প্রচারিত হতো, আধুনিককালে সেই বক্তব্য প্রকাশের বাহন হচ্ছে উপন্যাস। তবে একালের ঔপন্যাসিককে সময়ের ও সমাজের দায় বহন করতে হয়। ইমদাদুল হক মিলন সময়ের সন্তান হয়ে সময়ের দায় ও দায়িত্ব লিখে যাচ্ছেন। অন্তত ‘নূরজাহান’ উপন্যাসের ক্ষেত্রে এ কথা সত্য।

 

চার.

যদি আমি সুস্থ থাকতাম, তাহলে কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলন সম্পর্কে একটি মূল্যায়নধর্মী লেখা লিখতে চেষ্টা করতাম। কিন্তু সেটি সম্ভব হলো না বলে আমি নিজেকে অত্যন্ত অপরাধী মনে করছি।

যা হোক, মিলনের উনসত্তরতম জন্মদিনে আমার আশীর্বাদ রইল। ইমদাদুল হক মিলন সামনে এমন কিছু নির্মাণ করবেন, যার মধ্য দিয়ে আমাদের উত্তর প্রজন্ম ধন্য হবে।

সর্বশেষ খবর