শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

আন্দালিব রাশদী

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

পর্ব-২

[পূর্ব প্রকাশের পর]

বাবা সরে যায়। মা আমার হাতে পঞ্চাশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বলে ইংরেজি বাংলা যেসব পেপারে লঞ্চডুবিতে মরে যাওয়া মানুষের নাম ছাপা হয়েছে কিনে নিয়ে আয়।

মার টাকাতেই আমি চারটি পেপার এবং মঞ্জু ভাইয়ের জন্য সস্তা দামের দুটি সিগারেট কিনে আনি। সস্তা দামেরটাই তার জন্য ভালো, মঞ্জু ভাই সিগারেটের তামাক বের করে ভিতরে গাঁজা ঢুকিয়ে প্রতি রাতে এক শলার পুরোটাই টানে। সে সময় আমাদের বাড়ির আকাশে-বাতাসে আবুল বাশার মিরধা দুম্বার মূত্রের গন্ধ পায়।

মা দুটো কাগজে উদ্ধার লাশের বিবরণ পায়। মৃত্যুর আগে মানুষের নামের একটা গুরুত্ব নিশ্চয়ই আছে, মৃত্যুর পর সবাই লাশ। দুটো পত্রিকায় মুন্নি বেগম নামটি দেখে মা নিশ্চিত হয় এবং আবুল বাশারের ওপর তার সন্দেহের অবসান ঘটে। আবুল বাশার মিরধা এর আগেও একাধিকবার আল্লাহর কসম কেটে বলেছে, মুন্নি খালার সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগই ছিল না, এমনকি খালা তাকে ভালো করে চিনতেনও না, কিন্তু মা পুরোটা বিশ্বাস করেনি।

আমাদের বাবা ডিপ্লোমা প্রকৌশলী মুন্সি শওকত হোসেন, ঢাকা পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে পাস করে বিএডিসিতে সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার পদে চাকরি নিয়ে প্রথম পোস্টিং পেল বরিশাল। শহরের দক্ষিণ আলেকান্দায় রাস্তার পাশের একটি বাড়িতে সাবলেট থাকে, তখন অবশ্য সাবলেট কথাটা চালু হয়নি, কাউকে পড়াতে হোক বা না হোক বলা হতো লজিং মাস্টার।

মাঠ পরিদর্শনের জন্য সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার অফিসের মোটরসাইকেল ব্যবহার করত। প্রতিবারই মোটরসাইকেলের শব্দে পাশের বাড়ির ক্লাস টেনের ছাত্রী মুন্নি বেগম বেরিয়ে আসত। আগ্রহ নিয়ে মোটরসাইকেল ও তার আরোহীকে দেখত; এভাবেই একটা সম্পর্ক হয়ে যায়। মুন্নিদের বাড়িতে ব্যাপারটা মেনেও নেয়। মেয়ে যখন উপযুক্ত পাত্র জোগাড় করতে পারে তাহলে বাবা-মার বোঝা তো কমলই, এ ধরনের পাত্র আবার যৌতুকের কথা মুখে নিতেও পারে না।

মুন্নিদের বাড়ি থেকেই ইঙ্গিত দেওয়া হয়, পাশের বাড়িতে আর লজিং মাস্টার থাকার কী দরকার। মেয়েটা তো দেখতে ভালোই, বিসমিল্লাহ বলে কবুল করে ফেলো এবং আমাদের বাড়িতে থাকো। আমাদের মেয়ের সঙ্গে ঘুমাও, তার সঙ্গে একটু ফুর্তিফার্তা কর, এটাই তো বয়স। চিলুমচিতে হাত ধুয়ে চিকন চালের ভাত খাও, আম চিপে দুধ খাও সবই ফ্রি। এমন সুযোগ হাতছাড়া করে কেবল ভাটির দেশের আহাম্মক।

এক মাসের মধ্যে সব ঘটে যায়। শওকত হোসেন ঘরজামাই হিসেবে মুন্নিদের বাড়িতে ঠাঁই নেওয়ার অষ্টম মাসে দুবাইফেরত মুন্নিদের এক আত্মীয় বড় বোন পান্নার দেবর আবদুজ জাহের তাদের বাড়িতে আসে। মুন্নি ও তার মায়ের সামনেই সে শওকত হোসেনকে বলল, বড় ভাই কাজটা ভালো করলেন না, কথা ছিল আমি মুন্নিকে বিয়ে করব, আপনি কোত্থেকে নাজেল হলেন? একদিন না দুদিন না আট মাস ধরে তার সঙ্গে ঘুমাচ্ছেন। এটা কেমন কথা!

মুন্সি শওকত হোসেন বিব্রত হয়ে বলল, আমি তো কিছু জানতাম না, কেউ বলেনি, আপনিও তো জানাতে পারতেন।

আমি জানলে তো জানাব। আমিও তো দুবাই থেকে দরগাবাড়ি এসে কোনোরকম রাতটা কাটিয়ে সকালে দক্ষিণ আলেকান্দা এসে শুনি আপনি কাম সেরে ফেলেছেন। আমি যে জুতার সোলের ভিতর ঢুকিয়ে কাস্টমওয়ালাদের চোখে ভেলকি লাগিয়ে তিনটি স্বর্ণের বিস্কুট আনলাম, অলংকার এখন কার জন্য বানাব?

জবাব মুন্নিই দেয়, বেয়াই, আপনি দুবাইতে কাউকে পেলেন না? বুঝলাম পাত্থর ছুড়ে মেরে ফেলতে পারে এই ভয়ে পা বাড়াননি। কিন্তু আপনাদের দরগাবাড়িতেও কি কোনো মেয়ে নেই, সবাই শুধু আপনার মা-খালা?

দুবাইওয়ালা চলে যায়। শওকত হোসেন মুন্নিকে জিজ্ঞেস করতে চায়, ব্যাপারটা কী? কিন্তু তার আগেই মুন্নি তাকে চার্জ করে, তোমার বউ নিয়ে তোমার সামনে এসব কথা বলল, তুমি কেমন পুরুষ এই বেহায়াটার নাক বরাবর একটা ঘুসিও মারলে না?

মুন্নির তখন চার মাস চলছে। পড়াশোনা যথেষ্ট হয়েছে, এসএসসি পরীক্ষা দেবে না, এখন বাচ্চা পালবে। বাচ্চাকে পড়াশোনা করাবে।

শওকত হোসেন আশ্বস্ত হয়, তাহলে সোনা চোরাচালানি বেয়াইর লাফালাফিই সার, মুন্নির তাতে কোনো সায় ছিল না। এর মধ্যে তার বদলির আদেশ হয়। তখন তাদের কন্যা তিন্নির তিন মাস। শওকত হোসেন সরকারি ছুটির এক দিন আর ফাঁকির দুদিন সব মিলিয়ে প্রতি সপ্তাহে তিনটি রাত তো বরিশালেই থাকে। দু-তিন মাসে একবার স্ত্রী ও কন্যাও পটুয়াখালীতে আসে তার অফিসঘেঁষা দেড় রুমের বাড়িতে থাকে, খায়, ঘুমায়।

তিন্নির তখন পনেরো মাস, পটুয়াখালীতে শওকত হোসেনের বাসায় যাওয়ার কথা বলে মুন্নি বেগম মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে ছুটির আগের দিন যখন শওকত হোসেন এসে হাজির হয়, শাশুড়ি জিজ্ঞেস করেন তার মেয়ে আর তিন্নি কোথায়?

মানে?

মুন্নি বলেছে অফিসের কাজের জন্য শওকত আসতে পারবে না। সে জন্য সে-ই যাচ্ছে। কিন্তু সে তো চার দিন আগের কথা।

শাশুড়িও বলছেন, আমার মেয়ে কোথায়?

শওকত হোসেনও বলছে, আমার মেয়ে কোথায়?

তর্ক এতটাই গড়ায় যে শাশুড়ি বলে ফেলেন আমার মেয়ে এনে দাও নতুবা তুমি আমার মেয়ে খুন করে লাশ গুম করেছো এই মামলা দেব।

শওকত হোসেন জবাব দেয়, আমি কি তখন আঙুল চুষব?

ব্যাপারটা অনেক দূর গড়ায়। শওকত হোসেন একই সঙ্গে বরিশাল ও পটুয়াখালীর থানায় জিডি করে আর মুন্নির চাচাতো ভাইদের সাহায্য নিয়ে শ্বশুরবাড়ির লোকজন শওকত হোসেনের বিরুদ্ধেই অপহরণ ও গুমের মামলা করে।

বরিশালের স্থানীয় পত্রিকায় মুন্নির ছবি দিয়ে সংবাদ বেরোয়। শিরোনাম : প্রকৌশলীর স্ত্রী ও কন্যা রহস্যজনকভাবে উধাও। নিচে ছোট হরফে মুদ্রিত : সন্দেহের তীর স্বামীর দিকেই।

শওকত হোসেন গ্রেফতারও হয়। তবে তার ভাগ্য ভালো তাকে আদালতে চালান করার আগেই মুন্নির বড় বোন পান্নার ভাশুর, একটি প্রাইমারি স্কুলের হেড মাস্টার, নিজে থানায় এসে লিখিতভাবে ওসিকে জানিয়েছেন, মুন্নি বেগম খুনও হয়নি গুমও হয়নি। তার মেয়ে তিন্নিও ঠিকই আছে। তার ছোট ভাই আবদুজ জাহের মুন্নি ও তার মেয়েকে নিয়ে কথিত অপহরণের পরদিনই মালয়েশিয়া চলে গেছে। তিনি শুনেছেন তারা নাকি এর মধ্যে বিয়েও করেছে। আবদুজ জাহের দুবাই থেকে এবার ফেরার পর মুন্নি মেয়েসহ বেশ কবার তাদের বাড়ি গিয়েছে, এমনকি পাসপোর্ট আর ভিসার জন্য ঢাকাও গিয়েছে। সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার সাহেব গ্রেফতার হয়েছে শুনেই তিনি থানায় এসেছেন, তিনি জানেন, শওকত হোসেন নিরপরাধ।

কোনো শত্রুতার কারণে তিনি তাদের ফাঁসাচ্ছেন কিনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, চোখের সামনে নিরপরাধ মানুষের ভোগান্তি সহ্য করাও পাপ।

যখনই ডাকবে তখনই থানায় হাজির হবে এমন একটা মুচলেকা দিয়ে শওকত হোসেন থানা থেকে বেরিয়ে আসে। পরদিনই স্থায়ীয় পত্রিকায় ছাপা হয় প্রকৌশলীর স্ত্রী অপহরণ ও গুম রহস্য উদ্ধার। প্রেমিক বেয়াইয়ের সঙ্গে মুন্নি এখন মালয়েশিয়ায় হানিমুন করছে।

থানার সেকেন্ড অফিসার মুন্নির ভাশুরের বিবৃতির একটি ফটোকপি করিয়ে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে দেন এবং বলেন, ভবিষ্যতে বিপদাপদে পড়লে এটা কাজে লাগবে। হারাবেন না।

সেকেন্ড অফিসার হেডমাস্টারকে জিজ্ঞেস করেন, ব্যাপারটা কি মুন্নির মা আর বড় বোন জানতেন না?

তিনি বলেন, আমরা একান্নবর্তী পরিবারে থাকি না। যার যার আলাদা বাড়ি। কেউ না বললে এ বাড়ির খবর ও বাড়ি যায় না। তবে শুনেছি আমার ভাই চোরাচালানি করে অনেক স্বর্ণের বিস্কুট এনেছে, শাশুড়িকে দিয়েছে, ভাবিকেও দিয়েছে, মুন্নিকে নিশ্চয়ই আরও বেশি কিছু দিয়েছে।

সেকেন্ড অফিসার তাকে বললেন, আমরা আমাদের তদন্ত করব। মিথ্যে মামলা করে আপনাকে হয়রানি করার জন্য আপনি শাশুড়ির বিরুদ্ধে একটা মামলা ঠুকে দিয়ে যান। ওসি সেকেন্ড অফিসারকে ধমক দিলেন, আগে নিশ্চিত হও যে হেডমাস্টার সাহেব ঠিক বলেছেন, আর মা ও মেয়ে সত্যিই মালয়েশিয়ায় আছে।

বাবা আর মামলা-মোকদ্দমায় যায়নি, তদবির করে ঢাকায় বদলি হয়ে এসেছে এবং মুন্নি বেগমের ঠিকানায় তালাকনামা পাঠিয়ে দায়মুক্ত হয়ে এক বছরের মধ্যেই আমার মাকে বিয়ে করে। আমার মা মুন্নি বেগমের মতো সুদর্শন নয়। আমার মার বেলায়ও এটা দ্বিতীয় বিয়ে। তার প্রথম স্বামী প্রবাসী, বিয়ের দশম মাসে স্ত্রীকে গর্ভবতী রেখে কুয়েত ন্যাশনাল রিফাইনারিতে চাকরি নিয়ে দেশ ছাড়েন, চার মাস যোগাযোগ রেখেছেন তারপর আর কারও সঙ্গেই যোগাযোগ রাখেননি, কেউ কেউ বলেছে কুয়েত থেকে আমেরিকা চলে গেছে, কেউ বলেছে সম্ভবত মরেই গেছে। এ তো আর পটুয়াখালী থেকে গৌরনদী বা ঝালকাঠির পথ নয় যে, সরেজমিন তদন্ত করে দেখে আসবে সত্যিই আছে না নেই।   

[চলবে]

সর্বশেষ খবর