শুক্রবার, ৬ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আসাদ চৌধুরী শিল্পের সৌন্দর্যে পূর্ণ মহিরুহ

আবিদ আজম

আসাদ চৌধুরী শিল্পের সৌন্দর্যে পূর্ণ মহিরুহ

জন্ম ১১ ফ্রেব্রুয়ারি ১৯৪৩- প্রয়াণ ৫ অক্টোবর ২০২৩

মিসেস সাহানা চৌধুরী, আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় ভাবি প্রথমে আমাকে বিষয়টি জানালেন। বাসায় একটু দূরে আসাদ ভাই বসা।

এক রকম ফিসফিস করেই ব্যাপারটা বললেন আমাকে। বিষয়টা জানার পর ভয়ানক দুশ্চিন্তা গ্রাস করলো আমাকে। বিষয়টা কী?

আসাদ ভাইয়ের শরীরে ভয়ানক কোন ব্যাধির আশঙ্কা করছেন ডক্টর। ভাবি বললেন, ব্লাড ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা আছে। ওনাকে কিছুই বইলো না। সে কিছু জানে না। জানলে খুব দুশ্চিন্তা করবে।

বিষয়টা শুনে আমি অসহায়ের মতো আসাদ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। কী চমৎকার একজন অসাধারণ মানুষ। শিল্প-সাহিত্যের সেরা শুদ্ধ ও শুভ্র মানুষ। মহাজীবনের অধিকারী তিনি। সাহিত্যের সব্যসাচী কবি আসাদ চৌধুরী। তার গুণ বা কীর্তির কথা নতুন করে কিছু না বললেও চলে।

আসাদ ভাই বললেন, আবিদ চুপ করে আছো যে!

-না, ভাইয়া এই তো।

আমি চোখের জল লুকানোর চেষ্টা করলাম। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা উপলক্ষে দেশে এসেছিলেন আসাদ ভাই। তখনকার কথা এটি। কবির নাতনি মিষ্টি, আমাদের শাওলী ম্যামের কন্যা, ওর বিয়ে উপলক্ষেও আসাদ ভাইয়ের দেশে আসা। গত বছরের শেষের দিকে কানাডা থেকে দেশে আসছিলেন আসাদ ভাই। করোনার আগে থেকেই সপরিবারে কানাডাতে বসবাস করছিলেন তিনি।

নিজের জীবনের প্রায় সমস্ত বই-পত্তর ট্রাক ভরে আমাকে দিয়ে একদিন কানাডাতে উড়াল দিয়েছিলেন তিনি। তখন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কবে ফিরবেন আসাদ ভাই? তিনি বললেন, নিশ্চিত বলতে পারছি না।

এবারের ফেব্রুয়ারিতে কবি যখন কানাডাতে ফিরে যান, প্রায় নিশ্চিত ছিলাম, তাঁর সঙ্গে এটাই শেষ দেখা। আজ আমার সেই আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করে দিয়ে তিনি অনন্তলোকে পাড়ি জমিয়েছেন। আসাদ ভাইয়ের একটা কবিতার বইয়ের নাম ‘ঘরে ফেরা সহজ নয়’। সত্যিই আসাদ ভাই আর কল্যাণপুরের ‘সাহানা’ ভিলাতে ফিরবেন না, এটা কী করে জানলেন?

২০১৭ সালে আব্বার ইন্তেকালের পর কবির কন্যা নুসরাত জাহান চৌধুরী শাওলীকে একদিন বললাম, ‘তোমার আব্বাকে একটু আব্বা বলে ডাকি?’ তিনি ভীষণ ভালোবেসে অনুমতি দিয়েছিলেন। আড়ালে আসাদ ভাইকে ‘আব্বা’ই মনে করতাম। সরাসরি বলার সাহস পাইনি, লজ্জায়। আসাদ ভাই এমনি ছিলেন তারুণ্যের অনন্য অভিভাবক। বাংলায় ভর্তি হবো বলে অনার্সে বাসা থেকে আমাকে টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। পরে আসাদ ভাইয়ের টাকায় ভর্তি হয়েছিলাম। এমন কত স্মৃতি মনের গহিনে উঁকি দিচ্ছে তার হিসাব নেই।

কবি আসাদ চৌধুরী বাংলা কবিতার অনন্য বরপুত্র। কবিতা, গদ্য, স্মৃতিকথা, জীবনী, ছড়া ও শিশুসাহিত্য, সর্বত্রই নিজের কৃতিত্বের ‘সিগনেচার’ রেখেছিলেন এই মহিরুহ। আমি মনে করি, আসাদ ভাইয়ের অবদানের তুলনায় প্রাপ্য সম্মান সেভাবে পাননি। কারণ, ‘যাদের হৃদয়ে প্রেম নেই প্রীতি নেই করুণার আলোড়ন নেই, পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া’। ভাবা যায়, এমন এক মহাজীবনের অধিকারী বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্বকে এখনো স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়নি। রাষ্ট্রের এই দীনতা কাব্যপ্রেমীদের ভীষণভাবে পীড়িত করে। জানি না, কর্তাব্যক্তিরা বিষয়টি কীভাবে দেখেন।

কানাডায় হাসপাতালে আসাদ ভাই দ্বিতীয়বার যখন ভর্তি হলেন তখন তার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা হয়েছে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে তিনি হেসে বলেছিলেন, ‘আমার জন্য সবাই দোয়া করেছে। কয়েকজন নাস্তিকও শুনলাম আমার রোগমুক্তি প্রার্থনায় নামাজ পড়ে রোজা রেখেছে। ভাবতে পারো আবিদ।’ আসলেই আসাদ ভাই এমনি সবার প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। অনেকটা যেন অজাতশত্রু।

কবি আসাদ চৌধুরী, নিজের বর্ণাঢ্য জীবনে কীর্তিতে, অবদানে কিংবা ব্যক্তিত্বের দ্যুতিতে নিজেকে এতটা উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যা খালি চোখে নয়, আমাদের দেখতে হবে মাইক্রোস্কপ যন্ত্র চোখে লাগিয়ে। শিল্পর চেয়ে শিল্পীকে যেভাবে আরও উত্তীর্ণ ও মহৎ হতে হয়, সম্ভবত আসাদ ভাই ছিলেন দেশে এমন একমাত্র মানুষ। প্রিয় কবির আকস্মিক বিদায়ে হৃদয়টা ভার হয়ে আছে। বেশি কিছু লিখতে পারছি না আর। ‘প্রিয় আসাদ ভাই, আপনাকে অন্তিম অভিবাদন।’ অগোছালো এই তাৎক্ষণিক লেখাটি শেষ করবো কবির ‘সত্য ফেরারী’ কবিতা দিয়ে...

 ‘কোথায় পালালো সত্য?

দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো

রেস্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে,

গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে,

টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে,

নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো...

 

এক নজরে কবি...

আসাদ চৌধুরী ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বাকেরগঞ্জ জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া জমিদারবাড়িতে একটি সম্ভ্রান্ত বাঙালি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতার নাম সৈয়দা মাহমুদা বেগম। আসাদ চৌধুরীর স্ত্রীর নাম সাহানা বেগম।

আসাদ চৌধুরীর প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থগুলো হচ্ছে- তবক দেওয়া পান (১৯৭৫), বিত্ত নাই বেসাত নাই (১৯৭৬), প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড় (১৯৭৬), জলের মধ্যে লেখাজোখা (১৯৮২), যে পারে পারুক (১৯৮৩),

মধ্য মাঠ থেকে (১৯৮৪), মেঘের জুলুম পাখির জুলুম (১৯৮৫), আমার কবিতা (১৯৮৫), ভালোবাসার কবিতা (১৯৮৫), প্রেমের কবিতা (১৯৮৫), দুঃখীরা গল্প করে (১৯৮৭), নদীও বিবস্ত্র হয় (১৯৯২),

টান ভালোবাসার কবিতা (১৯৯৭), বাতাস যেমন পরিচিত (১৯৯৮),

বৃন্তির সংবাদে আমি কেউ নই (১৯৯৮), কবিতা-সমগ্র (২০০২),

কিছু ফল আমি নিভিয়ে দিয়েছি (২০০৩), ঘরে ফেরা সোজা নয় (২০০৬)। প্রবন্ধ-গবেষণা- কোন অলকার ফুল (১৯৮২)।

শিশুসাহিত্যের বইগুলো হচ্ছে- রাজার নতুন জামা (রূপান্তর, ১৯৭৯), রাজা বাদশার গল্প (১৯৮০), গ্রামবাংলার গল্প (১৯৮০), ছোট্ট রাজপুত্র (অনুবাদ : ১৯৮২), গর্ব আমার অনেক কিছুর (১৯৯৬), ভিন দেশের মজার লোককাহিনী (১৯৯৯), তিন রসরাজের আড্ডা (১৯৯৯), কেশবতী রাজকন্যা (২০০০), গ্রামবাংলার আরো গল্প (২০০০), তোমাদের প্রিয় চার শিল্পী (জীবনী, ২০০০), জন হেনরি (আমেরিকার লোককাহিনী, ২০০১), মিকালেঞ্জেনো (জীবনী, ২০০১), ছোটদের মজার গল্প (২০০১), সোনার খড়ম (২০০৬), মুচি-ভূতের গল্প (২০০৬)।

জীবনীগ্রন্থ- সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু (১৯৮৩), রজনীকান্ত সেন (১৯৮৯), স্মৃতিসত্তায় যুগলবন্দী (২০০১)। ইতিহাসগ্রন্থ- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (১৯৮৩)। অনুবাদগ্রন্থ- বাড়ির কাছে আরশিনগর : বাংলাদেশের উর্দু কবিতা (২০০০), প্যালেস্টাইন ও প্রতিবেশী দেশের প্রতিবাদী কবিতা (২০০৫)। সম্পাদনাগ্রন্থ- যাদের রক্তে মুক্ত এদেশ (১৯৯১ যুগ্মভাবে),

ছয়টি রূপকথা (১৯৭৯)।

পুরস্কার ও সম্মাননা : আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৫),

অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার (১৯৮২), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৭), শম্ভুগঞ্জ এনায়েতপুরী স্বর্ণপদক (১৯৯৯), ত্রিভুজ সাহিত্য পুরস্কার, বরিশাল বিভাগীয় স্বর্ণপদক, অশ্বিনী কুমার পদক (২০০১),

জীবনানন্দ দাশ পদক, অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার (২০০৬), বঙ্গবন্ধু সম্মাননা ১৪১৮, একুশে পদক (২০১৩),

শব্দভূমি আজীবন সাহিত্য সম্মাননা (২০১৮)।

সর্বশেষ খবর