শুক্রবার, ৬ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা
পর্ব-২

অন্ধ প্রেম : সাইকির প্রেম

ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া

অন্ধ প্রেম : সাইকির প্রেম

এক রাতে স্বামীর কাছে অনুযোগ জানালো সাইকি, দিনের পর দিন একা থাকতে তার আর ভালো লাগছে না, তার দুই বোনকে যদি কিছুদিনের জন্য আনা যেতো তাহলে খুব ভালো হতো। সঙ্গে সঙ্গে বাধা দিলেন কিউপিড। বললেন ‘এতে তোমারই ক্ষতি হবে সাইকি। তোমার বোনেরা ঈর্ষাকাতর হয়ে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দেবে।’ তবু বাধা মানল না সাইকি। বাধ্য হয়ে কিউপিড জেফাইরাসকে সাইকির বোনদের নিয়ে আসতে বললেন। কিন্তু সাইকিকে বারবার তাদের দাম্পত্য জীবনের কথা বোনদের না জানানোর অনুরোধ করলেন। পরদিন পবনদেবের রথে চড়ে সাইকির দুই বোন এলো প্রাসাদে। প্রাসাদের অমিত সৌন্দর্য দেখে তাদের বাকশক্তি যেন হারিয়ে গেল।

সাইকির হিংসুটে বোনেরা খুব খুশি হয়েছিল যে, সাইকি দানবের সংসার করছে। তারা নিমন্ত্রণ পেয়ে ভাবল, সাইকির দুর্দশা দেখে কিছু মজা পাওয়া যাবে। তাই দুই বোন সাইকির তথাকথিত দানব স্বামীর ভয় উপেক্ষা করে চলল পাহাড়ে। বোনদের কাছে পেয়ে সাইকির সে কী আনন্দ! কিন্তু তার বোনেরা হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরছে। কারণ তারা বুঝতে পারে যে, এটা কোনো দেবতার কাজ, দানবের নয়। কিন্তু তারা সাইকিকে তা বুঝতে দিল না।

এক সময় তারা কৌশলে সাইকিকে তার স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করে। সাইকি তার স্বামীর উপদেশ বেমালুম ভুলে গিয়ে বোনদের বিস্তারিত খুলে বলে। সে যে তার স্বামীকে খুব ভালোবাসে- তাও তাদের কাছে মন খুলে বলে দেয়। কিন্তু তার বোনেরা তাকে মনে করিয়ে দিল যে, স্বয়ং দেবতা অ্যাপোল বলেছিলেন, সাইকির স্বামী হবে দানব। দেববাণীর তো অন্যথা হতে পারে না। তাই তারা কূটবুদ্ধির চাল চালে। সাইকিকে বলে, সে যেন রাতে ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে। তারপর সাইকির স্বামী যখন ঘুমিয়ে পড়বে, তখন যেন সাইকি প্রদীপ আর ছুরি নিয়ে স্বামীর ঘরে গিয়ে ওকে আক্রমণ করে। তাতে সেই দানব হয় মারাত্মকভাবে আহত হবে, নয়তো মারা যাবে। কার সঙ্গে সাইকির বিয়ে হয়েছে, তখনই সেই পুরো রহস্য জানা যাবে। দেখতে পাবে, কোনো প্রতারক সাইকিকে বিয়ে করেছে। সাইকি ভাবল, তার বোনদের কথা তো যুক্তিযুক্ত। তাই সে সম্মত হয়।

সে রাতে বোনেরা চলে গেলে সাইকি ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে। পরে কিউপিড ঘুমিয়ে পড়লে সাইকি প্রদীপ এবং ছুরি হাতে কিউপিডের শোবার ঘরে যায়। ঘরে ঢুকে চমকে ওঠে। বিছানায় শুয়ে আছে অপরূপ সুন্দর কান্তিমান এক দেবতুল্য সুঠাম পুরুষ। ধবধবে শুভ্র-সাদা দুটি পাখা ভাঁজ করা। গা থেকে ঠিকরে পড়ছে আলোর দীপ্তি। পাশে সোনার তীর-ধনুক। সাইকি বুঝে গেল, এ-যে স্বয়ং প্রেমের দেবতা কিউপিড। মন্ত্রমুগ্ধের মতো কিউপিডের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকে সাইকি। তীব্র আনন্দে স্বামীকে উষ্ণ চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছা করল তার। চুম্বন করার জন্য নিচু হতেই হাতের জ্বলন্ত প্রদীপ থেকে কয়েক ফোঁটা তীব্র গরম তেল গড়িয়ে পড়ল কিউপিডের নগ্ন পায়ে। সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুটে চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে উঠে পড়লেন কিউপিড। অপ্রত্যাশিত এ ঘটনা তাকে হতবাক করে দিল। তার আকস্মিক ক্রিয়া আর পাখার ঝাপটা সাইকির হাতের প্রদীপে আঘাত করল, আর তাতেই এক ঝাঁকুনিতে প্রদীপ থেকে তপ্ত তেল কিউপিডের চোখে পড়ল। হায়! সেই গরম তেল কিউপিডকে অন্ধ করে দিল।

সাইকির হিংসুটে বোনেরা খুব খুশি হয়েছিল যে, সাইকি দানবের সংসার করছে। তারা নিমন্ত্রণ পেয়ে ভাবল, সাইকির দুর্দশা দেখে কিছু মজা পাওয়া যাবে। তাই দুই বোন সাইকির তথাকথিত দানব স্বামীর ভয় উপেক্ষা করে চলল পাহাড়ে। বোনদের কাছে পেয়ে সাইকির সে কী আনন্দ! কিন্তু তার বোনেরা হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরছে। কারণ তারা বুঝতে পারে যে, এটা কোনো দেবতার কাজ, দানবের নয়। কিন্তু তারা সাইকিকে তা বুঝতে দিল না।

সাইকিকে ওই অবস্থায় দেখে সব কিছু বুঝতে পারলেন তিনি। বেদনার্ত কণ্ঠে সাইকিকে বললেন ‘হায় রে অবুঝ মর্ত্যনারী, প্যান্ডোরার বংশধর তুমি। তুমি আমার নিষেধ সত্ত্বেও সাধারণ ঔৎসুক্য দমন করতে পারলে না। আমাদের প্রেমের যে এখানেই সমাধি হয়ে গেল।’ আর্তনাদ করে সাইকি কিউপিডের পায়ে পড়ে। কিন্তু নিষ্ফল হলো সব রোদন-বিলাপ। সাইকিকে শেষ বিদায় জানিয়ে ধনুঃশর নিয়ে কিউপিড পাখা মেলেন আকাশে। উড়ে যেতে যেতে বলে গেলেন, ‘যেখানে বিশ্বাস নেই, সেখানে ভালোবাসা থাকতে পারে না’।

এক লহমায় সুবর্ণ প্রাসাদ অদৃশ্য হয়ে গেল। বুকভরা নিঃসীম রিক্ততা নিয়ে সাইকি একা দাঁড়িয়ে রইল। তার কাছে স্মৃতি ছাড়া আর কোনো আশ্বাস থাকল না। সাইকি মরণপণ-প্রতিজ্ঞা করল, কিউপিডকে সে খুঁজে বের করবেই। কিন্তু নিয়তিও তার পিছু নিল।

জ্বলন্ত পাখায় ভর করে বেশিদূর উড়ে যেতে পারলেন না কিউপিড। মুখ থুবড়ে পড়লেন। মা! মা! বলে আর্তনাদ করতে লাগলেন। তার আকুল ডাক শুনে মর্ত্যে ছুটে এলেন মা অ্যাফ্রোদিতি। কিউপিডকে দেখে তিনি বুঝে গেলেন সব। এদ্দিন কিছু জানতে পারেননি তিনি। কারণ, অ্যাপোল জাদু করে রেখেছিলেন অ্যাফ্রোদিতির প্রাসাদের ওপর। তাই দেবী আগের ঘটনাপ্রবাহের আদ্যোপান্ত কিছুই জানতেন না। যখন তিনি জানলেন যে, সাইকির স্বামী কোনো দানব নয়, বরং স্বয়ং তার সন্তান কিউপিড, ক্রোধে ফেটে পড়লেন দেবী। কিউপিডকে নিয়ে গেলেন স্বর্গে তার নিজের প্রাসাদে। দগ্ধ কিউপিড বিছানায় শুয়ে কাতরাতে লাগলেন, আর ভাবতে থাকলেন সাইকির বিশ্বাসঘাতকতার কথা।

ওদিকে বিরহকাতর সাইকি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কী সর্বনাশ ঘটে গেল একপলকে! কী লক্ষ্মীছাড়া কাণ্ড ঘটালো সে! নির্বোধের মতো নিজের পায়েই সে নিজে কুঠার মেরেছে। যখন সে বুঝল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। পাগলপারা হয়ে ছুটে আসে বহিরাঙ্গনে। তখন সবই শেষ। কোথাও পেল না কিউপিডকে। কাঁদতে কাঁদতে পাহাড়ে পাহাড়ে সে খুঁজতে লাগল প্রেমিককে। আর তখনই উপস্থিত হয় অ্যাফ্রোদিতি। অ্যাফ্রোদিতিকে দেখে হাত জোড় করে বসে পড়ে সাইকি। বলে, সব দোষ তার। দেবী যেন তাকে ক্ষমা করে দেন। তার স্বামীকে সে খুবই ভালোবাসে। যখন থেকে সে তাকে ভালোবাসে, তখন সে জানতোই না যে, তার স্বামী স্বয়ং কিউপিড। না, কোনো অনুনয়-বিনয় দেবীর নিষ্ঠুর মন গলাতে পারল না।

[চলবে]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর