শুক্রবার, ৬ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা
পর্ব-৩

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

আন্দালিব রাশদী

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

বাবা যখন মাকে বিয়ে করে শম্পার তখন দেড় বছর। বাবাও খুশি তিন্নির বদলে শম্পা পেয়েছে, আমার মা-ও খুশি তার মেয়ে উপেক্ষিত হবে বলে মনে করেছিল কিন্তু শম্পা উপেক্ষিত হচ্ছে না, সম্ভবত প্রকৃত বাবার আদরের চেয়েও বেশি আদর পাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন মায়ের আগের শ্বশুর। পুত্র হিসেবে শম্পার বাবার যতটুকু সম্পদ প্রাপ্য ছিল পুরোটাই নাতনির নামে লিখে দিয়েছেন। সাবালক না হওয়া পর্যন্ত সেই সম্পত্তির হেফাজতকারী হিসেবে মা দায়িত্ব পালন করবে। শম্পার এক চাচা ও এক ফুপু বাধা দিয়েছিল এত সম্পত্তি দেওয়ার কী দরকার। ভাবি তো কাউকে না কাউকে বিয়ে করেই ফেলবে।

তাদের কথা শুনে শম্পার দাদা মানে আমার মায়ের প্রথম শ্বশুর বলেছেন, শম্পা পাবে তার বাবার সম্পত্তির পুরোটাই আর বউমাকে আমি দেব আবার বিয়ে করার খরচ। আমি তাকে বউমা করে ঘরে এনেছিলাম, আমার ছেলে নিরুদ্দেশ হয়ে তাকে ঠকিয়েছে। তার বাবা তো তার জন্য বিয়ের খরচ একবার করেছেই। এবার তাকে আমার ছেলের বিকল্প খুঁজে নেওয়ার জন্য সব খরচ আমাকেই দিতে হবে।

শম্পার বড় ফুপু বলেছিল, আব্বা আপনি বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন। এটা মোটেও ঠিক না।

তখন তিনি বলেছিলেন, আমি চাই না তোমার স্বামী তোমার ভাইয়ের মতো নিরুদ্দেশ হয়ে যাক। তার পরও যদি নিরুদ্দেশ হয় তখন বুঝতে পারবে আমি আমার দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি মাত্র।

সম্পদের মালিকানা বিবেচনা করলে শম্পা আমাদের বাবার চেয়ে বেশি সম্পদের মালিক। তা যদি না হতো, কেবলই নিঃস্ব একটি মেয়ে যদি হতো তাহলে কি বাবার কাছে, আমাদের কাছে তার এত গুরুত্ব থাকত?

শম্পা পড়াশোনায় ভালো, দেখতে সবার চেয়ে সুন্দর, বৃত্তি পেয়ে পেয়ে এগিয়ে গেছে। বাবার তেমন কোনো খরচই হয়নি। ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে মাইক্রোবায়োলজি। মাস্টার্স আর অনার্স দুটোতেই ফার্স্ট ক্লাস থার্ড হয়েছে। দলবাজিতে নেই বলে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট সেকেন্ড এবং থার্ড কেউই ইউনিভার্সিটিতে মাস্টারির জন্য নির্বাচিত হয়নি। নকল করা, ভয় দেখিয়ে ফার্স্ট ক্লাস আদায় করা এবং কারও কারও মতে বাসস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি করা ফার্স্ট ক্লাস ফিফথকে লেকচারার হিসেবে নেওয়া হয়েছে। তাকে দেওয়ার জন্যই পাঁচজনকে ফার্স্ট ক্লাস দিয়েছে। শম্পা বলেছে তাতেও সমস্যা নেই, আমি একটা বড় স্কলারশিপ পাবই।

সত্যিই পেয়েছে। উড়োজাহাজের টিকিটসহ একটা ফুললি ফান্ডেড স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডি করতে ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনে চলে গেছে। ওটাও একেবারে শেষের দিকে, ডিগ্রি হয়ে যাবে এটা নিশ্চিত করেই ওখানেই একটা পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চের জন্য পয়সাকড়ি পেয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাও চূড়ান্ত পর্যায়ে। তার পিএইচডির ক্ষেত্রটা বেশ বড় : ইভালুশনারি অ্যান্ড জিনমিক মাইক্রোবায়োলজি। আমি যদিও ওসব বুঝি না তবু আমাকে ইমেইল করে জানিয়ে রাখে। পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চের এরিয়া হচ্ছে : হোল জিন শটগান অ্যানালাইসিস। এতে মানুষের কী কল্যাণ হবে এ নিয়ে একটা ঝাড়া লেকচার আমাকে শুনতে হবে।

শম্পার যখন আড়াই বছর, মানে আমার বাবা-মার বিয়ের প্রথম বছরের শেষে তাদের যমজ পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে : মঞ্জু আর মন্টু। তারা কেউই পড়াশোনার ধারেকাছে নেই। একই মায়ের পেটে জন্ম হোক বাপ ভিন্ন। মেয়েটা কত ভালো, বৃত্তি পেয়ে পিএইচডি করে আর ছেলে দুটোর একটাও ইউনিভার্সিটিতে চাঞ্চ পায়নি। মঞ্জু দিনের বেলা ঘুমায়, রাতের বেলা গাঁজা খেয়ে দুম্বার মূত্রের গন্ধ ছড়ায় আর মন্টু যে কী করে একমাত্র খোদাতায়ালা জানেন। ছয় মাস আগে বাবা খত লিখে দিয়ে থানা থেকে ছাড়িয়ে এনেছে। মঞ্জু সারা দিন বাসায়, মন্টু সারা দিন বাইরে। দুজন আবার আইডেন্টিক্যাল টুইন। দেখতে একই রকম। কিন্তু স্বভাবে উল্টো। মঞ্জু পারতপক্ষে কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বলে না। মন্টু কেবল মেয়েদের সঙ্গেই মেশে, কথা বলে।

আমাদের এলাকাটায় এখনো ডেভেলপার ঢোকেনি, বাড়িগুলো হাউস বিল্ডিংয়ের ঋণে করা চার তলা, কেউ কেউ অবৈধভাবে পাঁচ কি ছয় তলাও করেছে, আমাদেরটাতে ওপরে এক রুমের একটি কেবল চিলেকোঠা।

এক তলায় দুই ভাই মঞ্জু আর মন্টু, একটা রুম গেস্টরুম হিসেবে রাখা আছে, গত তিন বছরে কোনো গেস্টকে রাতে থাকতে দেখিনি। সর্বশেষ যিনি ছিলেন বাবার দূর সম্পর্কের একজন চাচাতো ভাই, মধ্যরাতে নাকি তার গায়ে শ্মশানের বাতাস লেগেছে আর যে গন্ধটা পেয়েছেন তা চিতায় দগ্ধ মেয়ে মানুষের। এ বাড়িতে অবশ্যই মন্দ আসর আছে। যত দ্রুত সম্ভব বাড়িটা বেঁচে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার পরামর্শ তিনি দিয়ে গেছেন।

দরজা খুলতেই ড্রয়িংরুম। কার্পেটের ওপর পাতলা তোশক বিছিয়ে আবুল বাশার মিরধা ঘুমায়। দোতলাটা আমাদেরই। তিন ও চার তলা ভাড়া। অসমাপ্ত একটি চিলেকোঠাও আছে। দোতলায় এক রুমে বাবা মা, এক রুমে আমি এক রুমে ক্লাস টেনের ফার্স্ট গার্ল শেহেরজাদ। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে একমাত্র শেহেরজাদই শম্পার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারবে। আমার অবস্থা মঞ্জু আর মন্টুর মতো না হলেও আমি তেমন বেশি কিছুর উপযুক্ত নই। শরীরই আমার বাধা। এ নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই। যদিও স্কুলের পরীক্ষায় ‘আমার জীবনে লক্ষ্য’ এ রচনাটি বারবার যেমন মুখস্থ করেছি, ক্লাস সিক্সে লিখেছি চিকিৎসক হওয়া, ক্লাস এইটে চিত্রশিল্পী হওয়া এবং ক্লাস টেনে রাজনীতিবিদ হওয়া প্রতিটি লেখাই পরীক্ষা পাসের উদ্দেশ্যে, আমার আসলে কোনো কিছু হওয়ার ইচ্ছাই নেই, আমার পক্ষে সম্ভবও না। আমি এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফিসের টাকাটা নষ্ট করিনি। আমাকে কিছু না কিছু কেন হতে হবে?

দুই.

মন্টু ভাই একটা কিছু করে এবং হয়ে দেখার জন্য সত্যিই একটা কিছু করেছে এবং হয়েছে।

মন্টু ভাই বিয়ে করেছে। স্বামী এবং বাবা হয়েছে।

মাত্র তিন মাস আগে মন্টু ভাই রঙ্গ থিয়েটারের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচন মানে সদস্যদের ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। এটা বাংলাদেশের এমপি-মন্ত্রী-সরকার বানানোর যেমন খুশি তেমন নির্বাচন নয়।

[চলবে]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর