শুক্রবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

অন্ধ প্রেম : সাইকির প্রেম

ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া

অন্ধ প্রেম : সাইকির প্রেম

পূর্ব প্রকাশের পর

অ্যাফ্রোদিতি রাগে অগ্নিশর্মা। তার চোখে ভাসছিল তার পুত্রের যন্ত্রণাকাতর মুখচ্ছবি। সিদ্ধান্ত নিলেন, চরম শাস্তি দেবেন সাইকিকে। বললেন, সাইকিকে তার প্রেমের পরীক্ষা দিতে হবে। সাইকি হাসিমুখে মেনে নিল সব শর্ত- তা হোক যতই কঠিন।

প্রেমের প্রথম পরীক্ষা দেওয়ার জন্য অ্যাফ্রোদিতি সাইকিকে নিয়ে গেলেন এক পাহাড়ে। বিশাল এক লোহার পাত্রে তিনি গম, তিল, পপি, সরিষা আরও অনেক ছোট ছোট শস্যদানা মিশিয়ে দিলেন। বললেন, সূর্যাস্তের আগে যেন সাইকি সব শস্যদানা আলাদা করে রাখে। নইলে জীবনে সে কখনো আর কিউপিডকে দেখতে পাবে না। বেলা গড়ানোর আগেই সাইকি বুঝতে পারল, এ-কাজ তার পক্ষে পুরো অসম্ভব। সেই পাহাড়ে ছিল একদল দয়ালু পিঁপড়ে। তারা সাইকিকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। সূর্যাস্তের আগে কাজ অনুপুঙ্খ শেষ হয়ে যায়।

এতে অ্যাফ্রোদিতি মোটেও খুশি হলেন না। তিনি বললেন, আরও পরীক্ষা দিতে হবে ওকে। সাইকিকে তিনি শুতে দিলেন মেঝেতে। দিলেন না কোনো খাদ্য-পানীয়। পরের দিন সকালে তিনি সাইকিকে নিয়ে গেলেন আরেক পাহাড়ে। সেই পাহাড় থেকে দেখা যাচ্ছিল এক ভয়ংকর নদী। এই নদীর উৎস স্বয়ং স্টাইক্স নদী, যা মৃত ও জীবিতদের রাজ্যের সীমান্ত। সে নদীর পানি ঘন মেঘের মতো কাল। দেবী বললেন, সেই নদী থেকে পানি নিয়ে আসতে। সাইকি বুঝতে পারলেন, এই নদী থেকে পানি আনা মানে নিশ্চিত মৃত্যু। কারণ, নদীটা পাহাড়ের ঢালে, পাথুরে আর পিচ্ছিল। পাখা না থাকলে সেই পানি আনা পুরোপুরি অসম্ভব। নিরুপায় হয়ে পাহাড়ে বসে কাঁদতে লাগলেন অনাথিনী। এবার সাহায্য করতে এগিয়ে আসে এক ঈগল। সে পাত্র ভরে পানি এনে দিল। অ্যাফ্রোদিতি এবার আরও রেগে গেলেন। সাইকিকে পাঠালেন পাতাল রাজ্যে। মৃতদের জগতে। মৃতদের রানি প্রিসেফনির কাছ থেকে তার রূপের কিছুটা চেয়ে আনতে।

সাইকি গেলেন মৃতদের জগতে। ক্যারনের নাও দিয়ে পার হলেন স্টাইক্স নদী। সাইকির কষ্টে দয়াপরবশ হয়ে প্রিসেফনি তার রূপের খানিকটা একটা বাক্সে ভরে দিয়ে দিলেন। মৃতদের জগত থেকে ফিরে এসে রূপের বাক্স নিয়ে সাইকি এলেন অ্যাফ্রোদিতির প্রাসাদে। সাইকি জানতেন না সেখানেই আছে কিউপিড। কৌতূহলী হয়ে বাগানে বসে রূপের বাক্স খুলল সাইকি। ভাবল, রূপের খানিকটা নিজেও গায়ে মেখে নেবে! কিন্তু সাইকি জানত না যে, এই রূপ মরণশীলদের জন্য নয়! কালঘুম জড়িয়ে ধরল তাকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সাইকি।

সাইকি গেলেন মৃতদের জগতে। ক্যারনের নাও দিয়ে পার হলেন স্টাইক্স নদী। সাইকির কষ্টে দয়াপরবশ হয়ে প্রিসেফনি তার রূপের খানিকটা একটা বাক্সে ভরে দিয়ে দিলেন। মৃতদের জগত থেকে ফিরে এসে রূপের বাক্স নিয়ে সাইকি এলেন অ্যাফ্রোদিতির প্রাসাদে। সাইকি জানতেন না সেখানেই আছে কিউপিড। কৌতূহলী হয়ে বাগানে বসে রূপের বাক্স খুলল সাইকি। ভাবল, রূপের খানিকটা নিজেও গায়ে মেখে নেবে! কিন্তু সাইকি জানত না যে, এই রূপ মরণশীলদের জন্য নয়! কালঘুম জড়িয়ে ধরল তাকে।

অসুস্থ কিউপিড বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে। তার ঘরে ছিল একটি মাত্র জানালা। কোনো এক অজানা কারণে হঠাৎ তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠল। তিনি জানালা পথে উঁকি দিলেন। কে যেন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। দেখলেন, এ যে তার প্রিতমা সাইকি! সাইকির দুর্দশা কিউপিড সইতে পারল না। বুঝতে পারলেন, তার মা-ই দায়ী এসবের জন্য। তার মায়ের ক্রোধের অসহায় শিকার হয়েছে অভাগী সাইকি। কিউপিডের মনে আবার ভালোবাসা জেগে উঠল। তার সুস্থ হতে ইচ্ছা করল। ভালোবাসার শক্তিতেই আবার সুন্দর করে গজিয়ে উঠল তার ডানা দুটি। পাখা মেলে ঘরের ছাদ ভেঙে তিনি উড়ে গেলেন বাগানে; যেখানে সাইকিকে গ্রাস করেছিল কালঘুম।

সাইকিকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন কিউপিড। সাইকিকে কোলে তুলে নিয়ে উড়ে গেলেন, হাজির হলেন অলিম্পাসে, দেবরাজ জিউসে (জুপিটার)-এর সভায়। দেবতারা অসন্তুষ্ট হলেন অ্যাফ্রোদিতির ওপর। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, সাইকিকে অমরত্ব দান করা হবে। জ্ঞান, সাহস, অনুপ্রেরণা, সভ্যতা, আইন, ন্যায়বিচার, যুদ্ধকৌশল, গণিত, শক্তি, কৌশল, চারু ও কারুশিল্প এবং দক্ষতার দেবী অ্যাথেনা (মিনার্ভা) সাইকির শরীর থেকে কালঘুম উঠিয়ে আবার বন্দি করলেন সেই রূপের বাক্সে। জিউস নিজে সাইকিকে খাওয়ালেন অমৃত। অমর হলো সাইকি। এরপর এক বিশাল ভোজের আয়োজন করা হলো তাদের বিয়ে উপলক্ষে।

সাইকিকে দেবতারা সবাই মিলে প্রদান করলেন দেবত্ব। ওকে ঘোষণা করা হলো আত্মার দেবী পদে। অন্যদিকে সাইকির অমর হওয়াতে খুশি হলেন অ্যাফ্রোদিতি। কারণ কিউপিড ও সাইকি অলিম্পাসেই থাকবে। যার কারণে মানুষ ধীরে ধীরে সাইকির রূপের কথা ভুলে যাবে। আবার মানুষ অ্যাফ্রোদিতির আরাধনা শুরু করবে। শেষে হয়েছিলও তা-ই।

এখানেই গল্পের প্রভাবের শেষ নয়। কিউপিড অন্ধ হওয়ার পরও যে কোনো সময় তীর দিয়ে যে কাউকে সে আঘাত করতে সক্ষম। আবার কখনো কখনো সে একসঙ্গে অন্যজনকে আঘাত করতে ভুলে যায়। তাই প্রেম অন্ধ! ফলে প্রেম প্রায়ই বিশৃঙ্খল পাগলামো কিংবা বোকামো হিসেবে লক্ষিত হয়।

আমরা প্রায়শই দেখি যে, প্রেমিকরা প্রেয়সীর নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের প্রতি অন্ধ এবং প্রেয়সীর একটি আদর্শিক (কল্পনামূলক) চিত্র তৈরি করার প্রবণতায় আচ্ছন্ন থাকে। মানুষ যখন প্রেমে পড়ে, তারা বাস্তবের পরিবর্তে তাদের প্রেমিকের মধ্যে আদর্শিক বৈশিষ্ট্য কল্পনা করে। প্রেমে পড়লে আমরা অন্ধ হয়ে যাই। প্লেটোর মতে, ‘প্রেমের পরশে প্রত্যেক মানুষ কবি হয়ে ওঠে।’

প্রকৃতপক্ষে মানুষ প্রায়শই বলে যে, তারা তাদের প্রিয়জনের সঙ্গে তাদের স্বপ্নের মধ্যে বাস করছে। ইতিবাচক বিভ্রম আসলে রোমান্টিক প্রেমের কেন্দ্রবিন্দু। প্রেমিকরা তাদের প্রিয়জনের নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্টভাবে দেখতে পায় না। বরং এর পরিবর্তে কল্পনাপ্রসূত বৈশিষ্ট্যগুলোকে তৈরি করে। ‘অন্ধ বলেই প্রেম মনের নয়নে দেখে/সে দেখার ভাবাবেগে প্রেমের কাব্য লেখে।’

[সমাপ্ত]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর