শুক্রবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা
বই পর্যালোচনা

বিজ্ঞাপনে বিপ্লবী বঙ্গবন্ধু

রাহাত মিনহাজ

বিজ্ঞাপনে বিপ্লবী বঙ্গবন্ধু

বিজ্ঞাপন গণযোগাযোগ তথা পণ্য পরিষেবা সম্পর্কে প্রচারের এক কার্যকর, সৃজনশীল মাধ্যম। কবি, সাহিত্যিক, যোগাযোগবিদসহ বিভিন্ন শাখার সৃষ্টিশীল মানুষ এই পরিসরে অবদান রেখেছেন। এমনকি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বিজ্ঞাপনের কপি লিখেছেন। সুলেখা কলমের কালি নিয়ে তাঁর একটি লাইন ইতিহাস খ্যাত। এই পণ্যের প্রচারে তিনি লিখেছিলেন- ‘এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো’। সব মিলিয়ে প্রায় ৯০টি বিজ্ঞাপনে নিজের উক্তি, উদ্ধৃতি বা মন্তব্য ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন কবিগুরু। শুধু রবীন্দ্রনাথের জীবনকাল নয়, ব্যবসা-বাণিজ্য ও জন অবহিতকরণে বিজ্ঞাপনের ব্যবহার সভ্যতার শুরু থেকেই ছিল। তবে মাধ্যম ছিল ভিন্ন। গণমাধ্যমের যাত্রা শুরু হলে বিজ্ঞাপন জায়গা করে নেয় সংবাদপত্র ও সাময়িকীর পাতায়। পরে চলে আসে বেতারের তরঙ্গে, টেলিভিশনের পর্দায়। বর্তমানে বিজ্ঞাপনের বিস্তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ব্যবহারকারী কর্তৃক তৈরি করা আধেয় বা ইউজিসিতে। যাই হোক, বিজ্ঞাপনের ইতিহাস বর্ণনা করা এই নিবন্ধের লক্ষ্য নয়। বরং বিজ্ঞাপনভিত্তিক একটি বই আজকের আলোচনার উপজীব্য।

প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) এর একটি গবেষণার কাজে ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সময়ের সংবাদপত্র নিয়ে কাজ করার একটি সুযোগ হয়েছিল। বলে রাখা ভাল, বাংলাদেশে পুরাতন সংবাদপত্র নিয়ে কাজ করার একটি বিশেষ স্থান বাংলা একাডেমির পুরাতন সংবাদপত্র শাখা। এখানে খুব সহজেই বাংলাদেশ ও পাকিস্তান আমলের পুরাতন সংবাদপত্রগুলো পড়ার সুযোগ পাওয়া যায়। ঐ গবেষণার তথ্য সংগ্রহের সময় ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জয়লাভের পর তাঁকে কেন্দ্র করে অনেক বিজ্ঞাপন চোখে পড়েছিল। পরাধীন পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুকে উপজীব্য করে প্রকাশিত ঐসব বিজ্ঞাপন ছিল বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। সাবলীল ভাষা ও ছবির ব্যবহারে ছিল দৃঢ়তা। যা বাঙালি জাতির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনকে আকাক্সক্ষাকে তুলে ধরে।

সম্প্রতি ১৯৭১-১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন্দ্র করে সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিজ্ঞাপন নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছে পিআইবি। বইটির গবেষক পপি দেবী থাপা। এই গ্রন্থটি হাতে পাওয়ার পর অনেক আগ্রহ নিয়ে পাতা উল্টাতে থাকলাম। এটিকে বই না বলে অ্যালবাম বলা ভালো। কারণ সুন্দর মলাটবদ্ধ এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রকাশিত সব বিজ্ঞাপনের অমূল্যসহ ছবি। ধুলো পড়া পাতা থেকে তুলে আনা বঙ্গবন্ধুকেন্দ্রিক বিজ্ঞাপনগুলো সত্যিই নতুন এক প্রেক্ষাপটকে সামনে তুলে আনে। যে বিষয়টি উল্লেখ করে গ্রন্থটির ভূমিকায় পিআইবির মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ বলেছেন, ‘সে সময়ের সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে পাওয়া যায় অনন্য উচ্চতায় ও বলিষ্ঠতায়। বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা এবং দেশ গড়াকে কেন্দ্র করে প্রচারিত এসব বিজ্ঞাপন একটি দেশের জাগরণ, উত্থানের কথা বলে। একটি দেশের স্বাধীনতা অর্জন ও অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষায় এসব বিজ্ঞাপনের ঐতিহাসিক মূল্য যথেষ্ট। ইতিহাস বাস্তবতাকে তুলে ধরার জন্য এই অ্যালবাম।’

গণযোগাযোগের তত্ত্ব কথায় সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনকে সাধারণত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। এক. ক্লাসিফাইড বিজ্ঞাপন (শুধু শব্দ থাকে, আকারে ছোট বিজ্ঞাপন), দুই. ডিসপ্লে বিজ্ঞাপন (ছবি থাকে, বড় আকারের হয়)। অ্যালবামটিতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দুই ধরনের বিজ্ঞাপনই চোখে পড়ে।

আমার আগ্রহ ছিল পরাধীন পাকিস্তানে ১৯৭১ সালের উত্তাল দিনগুলোর বিজ্ঞাপন নিয়ে। ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাকে পুবালী জুট মিলস লিমিটেডের একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। যাতে ব্যবহার করা হয়েছিল মাত্র তিনটি শব্দ ‘আমরা তোমার পিছনে’। সাথে বাংলাদেশের মানচিত্র ও বঙ্গবন্ধুর ছবি। কী অসাধারণ প্রকাশ। প্রকৃতপক্ষে তখন শুধু পুবালী জুট মিলস লিমিটেডই নয় পুরো পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষই ছিলেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পেছনে। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো মন্ত্রমুগ্ধকর নেতৃত্বগুণে একটি জাতিকে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে এগিয়ে নিচ্ছিলেন।

২১ মার্চ ১৯৭১ দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়েছিল ইষ্টার্ন ফেডারেল ইউনিয়ন ইনসিওরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের একটি ক্লাসিফাইড বিজ্ঞাপন। যাতে ব্যবহার করা হয় বঙ্গবন্ধুর একটি উক্তি। ‘মানুষের উপর মানুষের শোষণ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে, বাঙলাকে অবশ্যই বাঙলার ভাগ্য নিয়ত্তা হতে হবে।’ মার্চের উত্তাল অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোর প্রেক্ষাপটে এটি ছিল ঐতিহাসিক এক সত্য উচ্চারণ।

২২ মার্চ ইষ্টার্ণ ব্যাংকিং করপোরেশনের বিজ্ঞাপনটি ছিল আরও প্রাসঙ্গিক। যাতে ব্যবহার করা হয় বঙ্গবন্ধুর সেই অমোঘ বাণী। ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’। সাথে ছিল মুষ্টিবদ্ধ হাতে শিকল ভাঙার আঁকা ছবি। আর ২৩ মার্চ দাউদ শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের বিজ্ঞাপনে ছিল বাংলাদেশের মানচিত্র ও যার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর অবয়ব। শিরোনাম ‘বাংলাদেশের সেবায় নিবেদিত’।

জেনে রাখা ভালো, ৩ মার্চে ঢাকায় আহূত গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার সাথে সাথে বেশ কিছু সামরিক বিধি জারি করেছিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান। যার মধ্যে বেশ কয়েকটি বিধি ছিল গণমাধ্যমকেন্দ্রিক। লক্ষ্য ছিল গণমাধ্যমের আধেয়কে নিয়ন্ত্রণ করা। তবে মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সংবাদপত্রগুলোতে সংবাদ ও বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। তবে ২৫ মার্চ কালরাতের হত্যাযজ্ঞের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। সংবাদপত্রের ওপর পাকিস্তানি জান্তা পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব আরোপ করে। জারি করে আরও কঠোর সামরিক বিধি। ফলে ওই সময় আর বঙ্গবন্ধুকেন্দ্রিক কোনো কিছু প্রকাশের সুযোগ ছিল না। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন তখন আবার সংবাদে ও বিজ্ঞাপনে বঙ্গবন্ধু সংবাদপত্রের পাতায় ফিরে আসেন। যদিও উল্লেখ করা যেতে পারে ১৭ ডিসেম্বর থেকেই বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের সংবাদপত্রের প্রধান আধেয়তে পরিণত হন।

১১ জানুয়ারি ১৯৭২ দৈনিক ইত্তেফাকের একটি বিজ্ঞাপনের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। যে বিজ্ঞাপনটি ছিল দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। জনতা টোব্যাকো কোম্পানি লিমিটেডের ঐ বিজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘হে বিজয়ী, হে দেবতার বরপুত্র, তোমার বিজয়মাল্য বিশ্বময়- ছড়িয়ে দিয়েছে তোমার গৌরব কাহিনী, অমর করেছে তোমায়’। গণতন্ত্র, সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপক্ষেতা, আমরা এই আদর্শকে বাস্তবায়িত করতে সংকল্পবদ্ধ। এই বিজ্ঞাপনটি যেন ভবিষ্যতের বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। যেখানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার বাণী জোরালো কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে।

এছাড়া নানা প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সামনে রেখে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় ছিল বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে। ১৮ জানুয়ারি বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকের বিজ্ঞাপনে লেখা হয়- ‘এবারের সংগ্রাম- দেশ গড়ার সংগ্রাম’।

অমূল্য অ্যালবামে আরও আছে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব, বিজয় দিবস, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনসহ নানা অনুষঙ্গে প্রকাশিত অমূল্যসহ বিজ্ঞাপন। যেগুলো ঐতিহাসিক মূল্য অমূল্য।

১৬০ পৃষ্ঠার অমূল্য এই অ্যালবামে বঙ্গবন্ধুকেন্দ্রিক ৩৭৬টি বিজ্ঞাপন স্থান পেয়েছে। ঐতিহাসিক মূল্যমানের এসব বিজ্ঞাপনের কপিরাইটার, ডিজাইনারদের প্রতি রইলো অশেষ কৃতজ্ঞতা। যাদের মেধা, শ্রম আর প্রজ্ঞায় ফুটে উঠেছে একজন বিপ্লবী বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি। যে বঙ্গবন্ধু একটি শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জন্য। কৃতজ্ঞতা বইটির লেখক পপি দেবী থাপার প্রতি। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে ইতিহাসের অমূল্যসহ রত্ন পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন পরম মমতায় আর যত্নে। কৃতজ্ঞতা পপি দেবী থাপার, কৃতজ্ঞতা পিআইবি।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

সর্বশেষ খবর