শুক্রবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা
পর্ব - ১

দান্তে-বিয়াত্রিচে’র প্রেম ও ‘ডিভাইন কমেডি’

ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া

দান্তে-বিয়াত্রিচে’র প্রেম ও ‘ডিভাইন কমেডি’

‘প্রেমের আনন্দ থাকে শুধু স্বল্পক্ষণ/ প্রেমের বেদনা থাকে সমস্ত জীবন’। রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতার এ কবিতাকণাটি বোধ করি ইতালীয় প্রভাবশালী কবি দান্তের প্রেমের বেলায় অবিতর্কিতরূপে যুতসই।

দান্তে। মধ্যযুগের স্বনামধন্য প্রভাবশালী ইতালীয় কবি, দার্শনিক। পুরো নাম দুরান্তে দেইলি আলিগিয়েরি। জন্ম ইতালির ফ্লোরেন্সে। তাঁর পরিবার বিত্তশালী না হলেও আভিজাত্যে ছিল সুবিদিত। ইতালীয় ভাষা ও সাহিত্যকে এক অত্তুচ্চ মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার অনন্য কাজটি সম্পন্ন হয়েছে তাঁরই হাত ধরে। মাতৃভাষাকে দাঁড় করিয়েছেন সুদৃঢ় শক্ত পাটাতনে। তাঁর ধ্রুপদি কাব্য ‘ডিভাইন কমেডি’। এ কাব্যগ্রন্থে মৃত্যু-পরবর্তী জীবন সম্বন্ধে প্রকাশিত হয়েছে কাল্পনিক ও রূপকধর্মী মধ্যযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গি।

স্রষ্টার সৃষ্টি প্রেমেরই নিদর্শন। প্রেমের মহিমা-মাহাত্ম্য ছাড়া সৃষ্টির এত বৈচিত্র্য, রহস্য, ছন্দময়তা, বিশালতা, শোভা, সৌরভ, বাহার, মোহময়তা, সৌন্দর্য, সৌকর্য, সামঞ্জস্য, নান্দনিকতা, শৈল্পিক নিখুঁত নৈপুণ্যের সমাহার ঘটানো অকল্পনীয়। আর মানবসৃষ্টিও বিধাতার এক অপার ও সর্বোৎকৃষ্ট প্রেমের নিদর্শন। তাই যেখানে মানুষ, সেখানেই প্রেমের উপস্থিতি অবধারিত। মহাকবি দান্তের ঈশ্বর- ধারণার সাথে ভালোবাসা সম্পর্কিত এবং পরিত্রাণের যোগ্যতা অর্জনের জন্য একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হওয়া উচিত বলেও তিনি মনে করেন। অন্যদিকে ভালোবাসাকে বিশ্বের জিনিস বা মানুষের প্রতি আকাক্সক্ষা হিসেবেও দেখা হয় ইতালীয় আধ্যাত্মিক প্রেমের কবি দান্তের মতাদর্শে। তাঁর প্রেমের আখ্যানটি দেশে-দেশে, কালে-কালে দেহাতীত এক আত্মিক প্রেমের নিদর্শন হয়ে আছে।

দান্তে ছিলেন একাধারে মহাকবি, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, যোদ্ধা এবং মধ্যযুগের পাশ্চাত্য সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। তিনি তাঁর মাস্টারপিস ‘দ্য ডিভাইন কমেডি’ মহাকাব্যটি ১৩০৮ সাল থেকে লেখা শুরু করেন। আনুমানিক ১৩২১ সালে, তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে তা লেখা শেষ হয়। প্রকাশিত হয় এটির মূল নাম ‘দিভিনা কোমেদিয়া’ নামে। তবে ইংরেজিতে এটি ‘ডিভাইন কমেডি’ নামেই পরিচিত। এ মহাকাব্য যারা পড়েছেন তারা জানেন, এতে নরক (Inferno)’র বর্ণনা কতটা ভয়াবহ অথচ শৈল্পিকভাবে অংকিত হয়েছে। ইনফার্নো (জাহান্নাম) হলো দান্তের মহাকাব্যের প্রথম অংশ। এতে ঐতিহাসিক এবং সাহিত্যিক খ্যাতিসম্পন্ন খলনায়কদের চিরন্তন চূড়ান্ত পরিণতি বিবৃত হয়েছে এবং এভাবে পরখ করা হয়েছে মানব প্রকৃতির পাপাচার এবং ট্র্যাজেডির প্রভাবগুলোকে।

এ মহাকাব্যে বিয়াত্রিচের প্রসঙ্গ থাকলেও এর বিষয়বস্তু কেবল প্রেম নয়। এখানে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কবির গভীর দার্শনিক-চিন্তার অত্যন্ত সুন্দর প্রকাশ ঘটেছে। কাহিনিটি এ রকম যে- এক বনের মধ্যে দান্তের দেখা হয় প্রাচীন খ্রিস্টপূর্ব যুগের মহাকবি ভার্জিলের সঙ্গে। স্বর্গে অবস্থানরত বিয়াত্রিচে ওই সময় ভার্জিলকে সেখানে পাঠিয়েছেন, ভার্জিল যেন দান্তেকে মৃত্যু-পরবর্তী ভুবনে পথ দেখিয়ে স্বর্গে নিয়ে আসেন।

ডিভাইন কমেডি আসলে একটি রূপক কাহিনি। হৃদয়ের আবেগ, নিখুঁত বর্ণনা, দার্শনিক-চিন্তা এবং ইতিহাস ও পুরাণের অসামান্য সুন্দর মিশ্রণের জন্যই এটি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাকাব্যগুলোর একটি রূপে কালজয়ী হয়ে আছে। বিশ্বসাহিত্যে দান্তে অনন্য স্থান অধিকার করে আছেন তাঁর এ মহাকাব্যের জন্যই। মধ্যযুগে পাশ্চাত্য গির্জাগুলোয় কীভাবে জীবনযাত্রা বিকশিত হয়েছিল, তা দান্তের এ কাব্যের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ১৪২৩৩ লাইনের এ মহাকাব্য তিন ভাগে বিভক্ত : ইনফার্নো (নরক), পুরগাতোরিও (বিশোধক) এবং পারাদিসো (স্বর্গ)। এগুলোর প্রতিটি আবার ৩৩টি ভাগে বিভক্ত। দান্তে তাঁর এ মহাকাব্যে একটি পরলোক যাত্রার কথা বর্ণনা করেন, যা এ তিন রাজ্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। তাঁর কল্পনাত্মক এবং রূপকাত্মকতা মধ্যযুগের খ্রিস্টানদের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা মৃত্যুর পরের জীবন, যা ক্যাথলিক গির্জাগুলোর মাধ্যমে বিকশিত হয়েছিল।

এ মহাকাব্যের অন্যতম চরিত্র বিয়াত্রিচে। পৃথিবীতে ভালোবাসার যেসব বাস্তব কাহিনি রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে দান্তের জীবনের কাহিনিটি যেমন মধুর, তেমনি বিস্ময়কর। তাঁর বয়স যখন ৯ বছর তখন ‘মে দিবস’ এর এক অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় বিয়াত্রিচে নামের একটি মেয়ের। মেয়েটির বয়সও ৯ বছর। এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে, বিয়ত্রিচে হলো নিশ্চিতরূপে এক বিস্ময় ও স্বর্গীয় লাবণ্য এবং অনুগ্রহের শক্তির প্রতীক। দান্তের জবানিতেই শুনুন, ‘আমি যখন ওকে প্রথম দেখি তখন আমার বয়েস প্রায় ন’-এর কোঠা পেরুচ্ছে। ওর আবির্ভাব নজরকাড়া। পোশাকে বনেদি রঙের আভিজাত্যের ছাপ। সংযত, অমলিন, টুকটুকে লাল জামা। এমন মনোরম সাজে সজ্জিত যা ওর কোমল বয়সের জন্য পুরো যুতসই। হলফ করে বলছি, এ যেন এক প্রাণবন্ত আত্মা। আমার হৃদয়ের গহিন কোঠায় যার বসবাস। আমার হৃদয়ে জাগিয়ে তোলে অদম্য শিহরণ। প্রচন্ডভাবে স্পন্দিত হতে থাকে আমার অন্তরাত্মা। কম্পিত কণ্ঠে আমি অবলীলায় বিড়বিড় করে বলতে থাকি, ‘দেখুন! আমার চেয়েও শক্তিশালী এক দেবী, যিনি আসছেন, আমাকে শাসন করবেন।’

প্রথম দেখার সময় দুজনের মধ্যে কোনো কথা হয়নি। পরবর্তী সময়ে সারা জীবনে দু-তিনবারের বেশি দুজনের দেখাও হয়নি। কিন্তু দান্তে জানিয়েছেন, প্রথম দেখার দিনই তিনি বিয়াত্রিচের প্রেমে পড়েন (Love at first Sight), ‘প্রথম দর্শনে প্রেম’ এমন একটি মুহূর্ত যা এর পেছনে কোনো যুক্তি ছাড়াই অন্য ব্যক্তির প্রতি তীব্র আকুলতা এবং চরম আকর্ষণ দ্বারা চিহ্নিত। ইংরেজি সাহিত্যের জনক জিউফ্রে চসার তাঁর ‘ট্রয়েলাস এবং ক্রেসিডায়া’ মহাকাব্যে নায়কের প্রতি নায়িকার রোমান্টিক আকর্ষণকে প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, “She loved right from the first sight.” যা হোক, প্রথম দর্শনের এ প্রেম দান্তের সমগ্র জীবনকে নিয়ন্ত্রিত ও মহান করেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, দান্তের এই একনিষ্ঠ ভালোবাসার কথা কখনো জানতে পারেননি বিয়াত্রিচে। একসময় দান্তে ও বিয়াত্রিচে দুজনেরই বিয়ে হয়ে যায় ভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ১২৯০ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে বিয়াত্রিচে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পরও দান্তে তাঁকে কখনো ভুলতে পারেননি। ২০ বছর বয়সের সময় থেকে তিনি বিয়াত্রিচের উদ্দেশে কবিতা লিখতে শুরু করেন। ‘ডিভাইন কমেডি’র মধ্যেও তিনি বিয়াত্রিচের প্রসঙ্গ উল্লেখযোগ্যভাবে এনেছেন। এ মহাকাব্যের প্রথম সর্গে দান্তে বিয়াত্রিচের যে মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন, তা থেকে বলা যায়- ‘Beatrice looks up to God and her eyes mirror Heaven/Dante looks into that mirror and finds himself gradually carried up above.’

 এ মহাকাব্যে বিয়াত্রিচের প্রসঙ্গ থাকলেও এর বিষয়বস্তু কেবল প্রেম নয়। এখানে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কবির গভীর দার্শনিক-চিন্তার অত্যন্ত সুন্দর প্রকাশ ঘটেছে। কাহিনিটি এ রকম যে, এক বনের মধ্যে দান্তের দেখা হয় প্রাচীন খ্রিস্টপূর্ব যুগের মহাকবি ভার্জিলের সঙ্গে। স্বর্গে অবস্থানরতা বিয়াত্রিচে ওই সময় ভার্জিলকে সেখানে পাঠিয়েছেন, ভার্জিল যেন দান্তেকে মৃত্যু-পরবর্তী ভুবনে পথ দেখিয়ে স্বর্গে নিয়ে আসেন। দান্তে জীবন্ত আত্মা নিয়ে ওই ভ্রমণের নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথাই এই মহাকাব্যে বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে স্বর্গ, নরক ও পার্গেটরির বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। যেসব আত্মা শেষ পর্যন্ত ত্রাণ লাভ করে স্বর্গে যাবে, পার্গেটরি বা প্রেতভূমিতে নানা কষ্ট ও পীড়নের মধ্য দিয়ে তাদের পাপ ধুয়ে-মুছে তাদের পবিত্র ও শুদ্ধ করে তোলা হয়। ভার্জিল দান্তেকে প্রথমে নরক, তারপর পার্গেটরি এবং সব শেষে স্বর্গের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন।  

[চলবে]

সর্বশেষ খবর