শুক্রবার, ৩ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

দান্তে-বিয়াত্রিচের প্রেম ও ‘ডিভাইন কমেডি’

ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া

দান্তে-বিয়াত্রিচের প্রেম ও ‘ডিভাইন কমেডি’

(পূর্ব প্রকাশের পর)

Kenelm Foster তাঁর ‘DanteÕs Idea of Love’ শিরোনামে রচিত প্রবন্ধে দান্তের আধ্যাত্মিক প্রেমের ধারণা ব্যাখ্যা করেন। দান্তে বিশ্বাস করতেন যে, প্রেম ‘ঈশ্বরের একটি বৈশিষ্ট্য’, যার সঙ্গে তিনি ‘মানব আত্মা’কে সংযুক্ত করেছেন, যেমন বিয়াত্রিচে এবং তুলনা করা হয়েছে ‘তারকাদের আন্দোলিত করার ক্ষেত্র ঈশ্বর প্রদত্ত গতি’। বিয়াত্রিচে দান্তের সেই প্রণয়িনী, যার জন্য মহান ইতালিয়ান কবি তাঁর বেশিরভাগ কবিতা এবং জীবনের প্রায় সমস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। দান্তের ভাষায়, সেই সময় থেকে প্রেম আমার আত্মাকে বেশ পরিচালিত করতে শুরু করে। দান্তে বিয়াত্রিচের প্রতি তার অপার মুগ্ধতা প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, যখন সীমাহীন আনন্দে বিয়াত্রিচে পরিপূর্ণরূপে দীপ্যমান হতো, আর তৃপ্ত আত্মায় আমি তার চাঁদমুখের দিকে তাকাতাম, মোহনীয় রূপের আবেশে তার উজ্জ্বল স্মিত হাসির ঝলকের দিকে চোখ তুলে আর পলক ফেলতাম না, তখন সে বলত, “Turn thee, and list / These eyes are not thy only Paradise.”

দান্তে মারা গিয়েছিলেন ১৩২১ সালে। কিংবদন্তি রয়েছে যে, তাঁর মৃত্যুর পর দেখা গেল ‘ডিভাইন কমেডি’র পান্ডুলিপির শেষ অংশ কেউ যেন সরিয়ে নিয়েছে সেখান থেকে! ফলে তাঁর দুই ছেলে জ্যাকোপো ও পিয়েত্রে মাসের পর মাস তন্ন তন্ন করে খুঁজে চললেন সেই হারানো পান্ডুলিপি। পিতার কাগজপত্র ঘেঁটে ঘেঁটে তারা রীতিমতো হয়রান। শত চেষ্টা করেও পান্ডুলিপির শেষ অংশটুকু খুঁজে পেলেন না। অবশেষে সব আশা ছেড়ে দিয়ে অন্য কাজে মন দিলেন তারা।

এভাবে কেটে গেল কিছুদিন। এক রাতে পিয়েত্রে স্বপ্নে দেখতে পেলেন তাঁর পিতাকে। সাদা পোশাক পরিহিত পিতা যেন নরম আলোতে ডুবে এসে দাঁড়ালেন পিয়েত্রের সামনে। পিয়েত্রে তখন পিতাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডিভাইন কমেডি’র শেষ অংশটুকুর কথা। বললেন, ‘পিতা! আপনি কি এ মহাকাব্য অসম্পূর্ণ রেখেই মারা গিয়েছিলেন, না অন্য কেউ তা চুরি করে নিয়ে গেছে?’ স্বপ্নের ভিতরই দান্তে তাঁর স্নেহময় পুত্রকে জানালেন, মৃত্যুর পর মূল্যবান এ মহাকাব্য বেহাত হয়ে যেতে পারে আশঙ্কা করে তিনি পান্ডুলিপির শেষাংশটুকু লুকিয়ে রেখেছেন পাশের ঘরের ভেন্টিলেটরের ভিতরে।

সকালে ঘুম থেকে ওঠে পিয়েত্রে রাতের স্বপ্নের কথা জানালেন সবাইকে। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করল না তার কথা। যারা বিশ্বাস করল তারাও তেমন একটা প্রয়োজন মনে করল না পান্ডুলিপিটি আবার খুঁজে দেখার ব্যাপারে। পিয়েত্রে তখন তাঁর এক আইনজীবী বন্ধুকে নিয়ে খুলে ফেললেন পিতার নির্দেশিত সেই ভেন্টিলেটর। খুলে তো তিনি অবাক! দেখতে পেলেন, একটি মোটা কাপড়ে জড়ানো রয়েছে অনেক অগোছালো কাগজ এবং সেগুলো ডিভাইন কমেডির শেষাংশ ছাড়া অন্য কিছুই নয়। সেদিন যদি দান্তে স্বপ্নে দেখা দিয়ে পিয়েত্রেকে পান্ডুলিপির জায়গাটি না দেখিয়ে দিতেন, তবে হয়তো চিরতরেই তা লুকানো থেকে যেত। তাতে ‘ডিভাইন কমেডি’ পরিচিত হতো একটি অসফল ও অসম্পূর্ণ পান্ডুলিপি হিসেবে।

দান্তে বিয়াত্রিচেকে বিয়ে না করলেও ১২৮৫ সালে জেমা দোনাতিকে বিয়ে করেন। এ দম্পতির ছিল চারটি সন্তান। বিয়াত্রিচের সঙ্গে নয় বছরে দান্তের দেখা হয়েছে বড়জোর দুবার। দান্তে অপর নারীর সঙ্গে সংসার পাতলেও বিয়াত্রিচেকে বিয়ে করেননি। সেটা কি ছিল দান্তের বিশ্বাসঘাতকতা? দান্তে নিজেই তার মহাকাব্যের ৩১-ক্যান্টোতে বলেছেন, বিয়াত্রিচের মৃত্যুর শেষ ১০ বছরে দান্তে কীভাবে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। দান্তে অন্যান্য মহিলাদের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন এবং তার সৌন্দর্যের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন না, যা ছিল না অন্যের মেকি সৌন্দর্য। বিয়াত্রিচে কেন বিয়ে করেনি তা জানার আগ্রহ অনেকেরই আছে। বিয়ে করতে অস্বীকার করার কারণ হিসেবে বিয়াত্রিচে বলেছেন, তিনি তার স্বাধীনতা রক্ষা করতে চায়। তিনি তার স্বাধীনতা পরিত্যাগ করে একজন নিয়ন্ত্রক স্বামীর ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করতে রাজি নন।

দান্তে তাঁর জীবনের প্রেমকে অমর করতে রাখতে ৩১টি কবিতা এবং প্রাসঙ্গিক ভাষ্য রচনা করেছিলেন। আজ আমরা জানি যে, বিয়াত্রিচের প্রতি দান্তের প্রেম কতটা খাঁটি ছিল। মিলনের স্পৃহায় উন্মত্ত না হয়ে এক পলকের ক্ষণিক দেখার আত্মিক প্রেম কীভাবে ৪০ বছর যাবৎ অনুপ্রেরণার খোরাক হয়, বিশ্বের ইতিহাসে তেমন নজির বিরল। বিয়াত্রিচে দান্তের কাছে এমন এক নারী, যার আবির্ভাব দেবদূতরূপে। সে দাঁত্যাকে পথ প্রদর্শন করতেন স্বর্গীয় দীপ্তিতে। তবে তিনি বাস্তব জগতের একজন নারী হিসেবে রয়ে গিয়েছিলেন ফ্লোরেন্সের রাস্তায় এনান্তি দান্তের হৃৎস্পন্দ হয়ে, তাঁর আত্মার আকুতিকে জয় করে, আর হৃদয়কে পরাজিত করে। আর এভাবেই বিয়াত্রিচে হয়ে ওঠেন দান্তের কাব্যদেবী, মানস ললনা। হয়ে উঠেছেন অনুপ্রেরণা, সৌন্দর্য এবং অনুগ্রহের আদর্শের প্রতিনিধি।

১২৯০ সালের ৮ জুন মাত্র ২৪ বছর বয়েসে অ্যাভিঞ্জার আলিগিয়েরোর তরোয়ালের আঘাতে বিয়াত্রিচের মৃত্যু ঘটে। বিয়াত্রিচের প্রতি দান্তের মিনতি, ‘তোমার সুরক্ষা তোমার মানবিক দুর্বলতাকে কাটিয়ে তুলুক: দেখো বিয়াত্রিচে অনেক সাধুসন্ত আমার সঙ্গে তাঁদের প্রার্থনার জোর হাত তুলছে। দান্তের বিলাপের ভাষা এ রকম-

 ‘Weep you lovers, since Love is also weeping / and hear the reason that makes himfull of tears.’...

[ সমাপ্ত ]

সর্বশেষ খবর