শুক্রবার, ৩ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
পর্ব-৫

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

আন্দালিব রাশদী

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

পূর্ব প্রকাশের পর

শেহেরজাদ বলল, মা বাচ্চা সিঙ্গুলার। এটা প্লুর‌্যাল হবে, বহুবচন, বাচ্চারা। তিনটি বাচ্চা। সব কিউট, একটার চেয়ে আরেকটা বেশি কিউট। এটাকে দেখ না তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। এটার নাম টুনটুনি।

আমি টুনটুনির গাল টিপে দিই। টুনটুনি এতে বিরক্ত হলো না খুশি হলো বুঝতে পারলাম না। গাল টেপার পর ঠোঁটের এক পাশ গড়িয়ে লালা ঝরল।

শেহেরজাদ বলল, মা বড়টার নাম ডাহুক। সাড়ে চার বছর। সব ঠিক আছে মেয়েটার বাঁ চোখটা ট্যারা। হিন্দিতে কথা বলতে পারে। মাঝখানেরটা মানে ওয়েডিং প্রসেশনে যেটা বাবার কোলে ছিল ওই মেয়েটার একটা ইংলিশ নাম, ফ্ল্যামিঙ্গো। পাখিটা দেখতে দারুণ। বলতে পার পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর পাখিগুলোর একটা। দক্ষিণ আমেরিকায় বেশি পাওয়া যায় আর টুনটুনিকে তো দেখলেই। পুরো ব্যাপারটাই এখন তোমাদের অ্যাটিচিউডের ওপর নির্ভর করছে।

মা বলল, কার না কার বাচ্চা?

আমাকে মুখ খুলতে হয়নি। শেহেরজাদই বলল, অবশ্যই ভাবির বাচ্চা এবং প্রত্যেকটাই মানুষের বাচ্চা।

মা বলল, আমি সেটা বলিনি। আমি জিজ্ঞেস করেছি বাচ্চাগুলোর বাপ কে?

কেন? মন্টু ভাই। বিয়ে করার সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাডাপ্ট করে ফেলেছে। মা এটা অটো, মানে অটোম্যাটিক হয়ে গেছে। ওয়াইফ মানে শুধু ওয়াইফ না মা, বাচ্চা-কাচ্চাসহ ওয়াইফ। মন্টু ভাইকে আমি বোকা ভাবতাম এখন দেখতে পাচ্ছি সবচেয়ে বুদ্ধিমান মন্টু ভাই। শম্পা আপুর চেয়েও। একেবারে রেডিমেড তিনটা বাচ্চা।

আবার দরজায় ধাক্কা। আমিই খুলি। এবার অন্য একটি ছেলে, পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, মাথায় কিস্তি টুপি, বলল এ ফ্লোরে আপনারা চারজন তাই না? চার প্যাকেট আলাদা করে এ পলিথিন ব্যাগে দিয়ে দিয়েছে। রঙ্গ থিয়েটারের সভাপতির বিয়েতে এটা হচ্ছে ওয়েডিং ডিনার। সরি, রাত বেশি হয়ে গেছে। আমাদের উপায় ছিল না। আমাদের সভাপতি শুধু জিলাপির কথাই বলেছিলেন। পরে আমাদের দুজন সহসভাপতি সিদ্ধান্ত নেন ১০০ প্যাকেট কাচ্চি বিরিয়ানিও হবে, খরচ তারা দিয়েছেন। সিলেক্টেড কজনকে দেওয়া হবে।

আমি জিজ্ঞেস করি, আপনাদের সভাপতিকে দিয়েছেন তো?

জি, তিন প্যাকেট, দুই বাচ্চা এক প্যাকেট আর সভাপতি আর স্ত্রী দুই প্যাকেট। পাশের রুমে সভাপতি স্যারের ভাইকেও এক প্যাকেট দিয়েছি। সঙ্গে পানির বোতল দিলে ভালো হতো, কিন্তু দেওয়া হয়নি কারণ এতে টাকা নষ্ট হতো; সব বাড়িতেই খাওয়ার পানির ব্যবস্থা আছে।

প্যাকেট বের করে দেখি ওপরে একটা রঙিন কাগজে লেখা রঙ্গ থিয়েটারের সৌজন্যে মোস্তফা হোসেন মন্টুর ওয়েডিং ডিনার।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা প্যাকেট পাবে তো?

ছেলেটি বলল, অবশ্যই পাঁচজন ভলান্টিয়ার পাঁচ প্যাকেট।

তিন.

শেহেরজাদ বলল, আমার প্যাকেট কোনটা? আমি এখন হাফ খাব বাকিটা কাল দুপুরে মাইক্রোওয়েভে গরম করে খাব।

আমি বললাম, খুব হাঙ্গরি, সবটাই খাব।

শেহেরজাদ বলল, ভাবির নামটা বলা হয়নি, মোস্তারিন জাহান ডাকনাম টিয়া। এজন্যই সব মেয়েরই পাখি নাম।

শেহেরজাদ মাকে বলল, তোমার অ্যাটিচিউড বোঝার জন্য বসে আছি।

আমাদের মা মুখ খুলল, বলল, আমারটা বুঝে কী হবে? তোমাদের বাবা শওকত হোসেনেরটা আগে বোঝ। এ বাড়িটা তার।

শেহেরজাদ বলল, তার আগে যে কথাটা এখনো বলিনি এটাও শোন। ভাবি কিন্তু দেখতে অনেক সুন্দর। তোমার এবং বাবার চৌদ্দগোষ্টিতে এমন সুন্দর কেউ নেই। শম্পা আপুর চেয়েও সুন্দর।

আবার দরজায় ধাক্কা। আমিই খুলি। এবার অন্য একটি ছেলে, পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, মাথায় কিস্তি টুপি, বলল এ ফ্লোরে আপনারা চারজন তাই না? চার প্যাকেট আলাদা করে এ পলিথিন ব্যাগে দিয়ে দিয়েছে। রঙ্গ থিয়েটারের সভাপতির বিয়েতে এটা হচ্ছে ওয়েডিং ডিনার। সরি, রাত বেশি হয়ে গেছে। আমাদের উপায় ছিল না। আমাদের সভাপতি শুধু জিলাপির কথাই বলেছিলেন। পরে আমাদের দুজন সহসভাপতি সিদ্ধান্ত নেন ১০০ প্যাকেট কাচ্চি বিরিয়ানিও হবে, খরচ তারা দিয়েছেন। সিলেক্টেড কজনকে দেওয়া হবে।

আমি বললাম, মন্টু ভাইয়ের টেস্ট আছে।

শেহেরজাদ বলল, গত বছর কিডন্যাপ অ্যাটেম্পটের যে মামলাটায় মন্টু ভাই অ্যারেস্ট হয়েছিল, বাবা থানা থেকে ছাড়িয়ে এনেছে সেই নাতাশাও তো দেখতে আমাদের জয়া আহসানের মতো।

শেহেরজাদ বলল, আমার কথাটা তো শেষ করি। শোনো মা, ভাবি কিন্তু বোবা। একেবারে বোবা। আচ্ছা এটা সত্যি নাকি বোবারা নাকি বধিরও হয়, মানে কানে শোনে না।

মা থ হয়ে বলল, বোবা! মানে বোবা।

শেহেরজাদ বলল, অবশ্যই বোবা, তাতে সমস্যা কী?

আমি শেহেরজাদের প্রশ্নের উত্তর দিই, বোবারা কানে শোনে না এটা অপপ্রচার। দুটোই শরীরের দুই ধরনের অঙ্গ। আমরা সেগুনবাগিচার মুখ ও বধির বিদ্যালয় ঘুরে আগেই জেনেছি এটা গুজব। তবে যদি কেউ বোবা ও বধির হয়ে জন্মগ্রহণ করে কিংবা কোনো জন্মসূত্রে বোবা যদি পরে শ্রবণশক্তি হারায় তাহলে বলা যায় বোবাটা কালাও বটে। কালা মানে জানিস তো? কালা মানে ব্ল্যাক নয় কিন্তু, কালা মানে যারা কানে শোনে না।

মা বলল, মন্টু আর কোনো মেয়ে খুঁজে পেল না!

শেহেরজাদ বলল, তোমাদের যার মনে যা-ই থাকুক আমি স্পষ্টভাবে আমার অ্যাটিচিউড জানিয়ে দিচ্ছি, আমারটা পজিটিভ এবং তা মন্টু ভাইয়ের পক্ষে। কেন পজিটিভ সেটাও বলছি, মন্টু ভাই কাকে বিয়ে করবে কাকে করবে না এটা তার ব্যাপার, আমি কারও পারসোনাল ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করার পক্ষে নই। আমার পজিটিভ থাকার কারণ হচ্ছে তিনটা কিউট বেবি, আমি ওদের রেখে দিতে চাই।

মা বলল, একটা বেবি পালতে গেলেই পড়াশোনা চাঙ্গে উঠবে, তিনটা পালবে। তিনটা বাচ্চা আর বউ মানে বাড়তি চারজন মানুষ পালা মুখের কথা নয়। মন্টু তো এ জীবনে কামাই করে পাঁচ শ টাকাও আমাকে দিতে পারেনি। মুন্সি শওকত হোসেন সাহেব যদি খরচ জোগাতে পারেন জোগাবেন।

এর মধ্যে শেহেরজাদ টুনটুনিকে নিয়ে বেডরুমে ঢুকল, বাবা শুয়ে শুয়ে পড়ুক বা না পড়ুক বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে। টুনটুনিকে বাবার বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলল, বাবা বেবিটাকে একটু দেখ তো, আমি একটু বাথরুম থেকে আসছি।

ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, কীসের বেবি, বিছানায় তো পেশাব করে দেবে।

শেহেরজাদ বলে সমস্যা নেই, ডায়াপার পরানো আছে। এটা মন্টু ভাইয়ের বেবি। মানে ভাবির বেবি।

এ বাড়িতে একমাত্র শেহেরজাদই বাবার মুখের ওপর কথা বলতে পারে। অন্যরা ভয় পায়। পড়াশোনায় যারা ভালো, কড়া টাইপের মা-বাবাও তাদের খাতির করে।

টুনটুনিকে বাবার বিছানায় রেখে শেহেরজাদ বাবা-মার ঘরের অ্যাটাচড্ বাথরুমে ঢুকে পড়ল। একটা প্লেটের ওপর কাচ্চি বিরিয়ানির প্যাকেট বসিয়ে আমি বাবার সামনে গিয়ে বললাম, পিচ্চি দেখছি তোমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। মন্টু ভাইয়ের ওয়েডিং ডিনার দিয়ে গেছে। খাবারটা তোমাকে এ রুমে দেব না ডাইনিং টেবিলে বসবে।

বাবা একবার বেবিটার দিকে তাকিয়ে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল, ওয়েডিং ডিনার তোর মাকে খাওয়া। দুটো বদমাশকে আশকারা দিতে দিতে আজ এ অবস্থায় এনে ঠেকিয়েছে। আমি তো ১০ বছর আগেই বের করে দিতে চেয়েছিলাম।

আমি বাবার মুখের ওপর কিছু বলতে পারি না। বাথরুম থেকে বেরোতে বেরোতে শেহেরজাদ বাবার কথা লুফে নিয়ে তার মুখের ওপর বলল, বেশ বাবা আমিই এখন বলে আসছি টুনটুনি নিয়ে এক্ষুণি, মানে রাত ১২টা বাজার আগে বাবা তোমাদের এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছে। দাও টুনটুনিকে দাও, আমিই বলে আসছি।

বাবা বলল, না আমি সে কথা বলিনি।

তাহলে কোন কথা বলেছ? মানে থাকতে বলেছ, বেশ তাহলে কাচ্চি বিরিয়ানিটা খেয়ে নাও, আমি বলে আসব বাবা থাকতে বলেছে।

কেন আমাকে কাচ্চি বিরিয়ানি খেতে হবে?

কারণ ঘরে অন্য কোনো খাবার নেই। ঢোলবাদ্য শুনতে গিয়ে মা আপসেট হয়ে গেছে, রান্না করেনি। রঙ্গ থিয়েটার থেকে অনেক রাতে হলেও চার প্যাকেট কাচ্চি বিরিয়ানি না দিয়ে গেলে না খেয়েই আজ রাতে শুতে হতো। ক্ষুধায় ঘুম আসত না।

ঠিক তখনই টুনটুনি হাত-পা ছুড়ে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে শুরু করল। শেহেরজাদ কোলে তুলে নিয়ে বলল, ভাবির কাছে রেখে আসছি। বাবা তুমি যতটুকু পারো খাও, সবটা না পারলে প্লেটেই রেখে দিও, আমি খেয়ে নেব।

[চলবে]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর