শুক্রবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
পর্ব - ১

বানরটি কি আসলেই বানর

ইমদাদুল হক মিলন

বানরটি কি আসলেই বানর

আমার বাবা আরেফিন সাদিক বেড়াতে খুব পছন্দ করেন। তবে একা নয়, পরিবার নিয়ে। সময় সুযোগ পেলেই তিনি আমাদের নিয়ে বেড়াতে বেরোন। এই কারণে বাংলাদেশের প্রায় সব জেলায় বেড়ানো আমাদের হয়ে গেছে। দেশের ঐতিহাসিক স্থানগুলো প্রায় সবই আমরা দেখে ফেলেছি। বাকি ছিল দিনাজপুরের কান্তজিউর মন্দির। এই কারণে বাবা এবার আমাদের নিয়ে দিনাজপুরে এসেছেন। পাঁচ দিন আমরা দিনাজপুরে কাটাব। দিনাজপুরে ভারি সুন্দর একটা রিসোর্ট আছে। রিসোর্টের পরিবেশ যেমন সুন্দর নামটিও তেমন সুন্দর, ‘মায়াপুরি’। আমরা এসে ‘মায়াপুরি’তে উঠেছি।

ঢাকা থেকে দিনাজপুর বহুদূর। ট্রেনে এলে আট দশ ঘণ্টা লাগে। গাড়ি নিয়ে এলেও তাই। এতটা সময় গাড়িতে বসে থাকা খুবই কষ্টের। তিন চারঘণ্টার দূরত্ব হলে ঠিক আছে কিন্তু আট দশ ঘণ্টা? বাপরে! কোমর ব্যথা হয়ে যাবে। যদিও গাড়ি নিয়ে কোথাও গেলে বাবা ইউরোপ আমেরিকার নিয়মটা মেনে চলেন। দেড় দুই ঘণ্টা পর পর কোথাও না কোথাও গাড়ি থামানো হয়। চা কফি খাওয়া, ফ্রেশ হওয়া। তারপর আবার যাত্রা। তাতে অবশ্য খারাপ লাগে না। আমাদের বহুদিনের পুরনো ড্রাইভার এনায়েত। এসব যাত্রায় সে আমাদের গাড়ি ড্রাইভ করে। আরেকজন ড্রাইভার আছে রফিক। দূরের যাত্রায় তাকে নেওয়া হয় না। রফিকের গাড়ি চালানো বাবা পছন্দ করেন না।

এবার আমরা গাড়ি নিয়ে বেরোইনি। ঢাকা থেকে প্লেনে এসেছি সৈয়দপুর পর্যন্ত। সেখানে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন বাবার অফিসের মোরশেদ সাহেব। তাঁর বয়স পঞ্চাশের মতো। দীর্ঘদিন ধরে বাবার সঙ্গে আছেন। বাবার গার্মেন্টের বিজনেস। খুব বড় নয় আবার খুব ছোটও নয়। মাঝারি মাপের ব্যবসায়ী বাবা। বনানীতে দশ কাঠার ওপর আমাদের বাড়ি। আমাদের দু’বোনকে নিয়ে চারজনের সংসার। ব্যবসা শুরুর দিকে বাবা খুবই পরিশ্রম করতেন। কয়েক বছর ধরে তেমন আর করেন না। ডায়াবেটিস আছে, প্রেসার আছে। তবে তিনি খুবই নিয়ম মানা লোক। যেখানেই বেড়াতে যান সেখানেই ঠিক সকালবেলা ওঠে ঘণ্টাখানেক হাঁটবেন। সুগার এভয়েড করেন। সকালে তাঁর খাবার দু’খানা আটার রুটি, সবজি আর একটা সিদ্ধ ডিম। দুপুরের মুখে কোনও না কোনও ফল। দুপুরে দু’কাপ ভাত, মাছ বা মুরগি আর সবজি। রাতে রুটি সবজি আর মাছ বা মুরগি। বিকেলবেলা স্যুপ আর সুগার ফ্রি বিস্কুট দু’খানা। কখনও লিকার চা আর ওই বিস্কুট। এতটা মেনটেইন করেন বলেই বাবাকে দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না তাঁর ডায়াবেটিস আছে। ছাপ্পান্ন বছর বয়সেও তাঁকে দেখায় চল্লিশ বছরের সতেজ মানুষের মতো।

আমাদের মা’ও একেবারেই তরতাজা। তাঁর কোনও অসুখই নেই। অতি পরিচ্ছন্ন ছিমছাম ধরনের মানুষ। ভুলেও কোনও রিচফুড মুখে দেবেন না। ফল খাবেন পরিমাণ মতো। ডিম দুধ খাবেন। দুপুরে ওই একবেলাই সামান্য ভাত। অন্য দু’বেলা রুটি সবজি। সকালে আর বিকেলে দু’কাপ চা। বিকেলের চায়ের সঙ্গে বিস্কুট বা চিপস। মিষ্টি মুখেই দেন না। মা’র বয়স বাহান্ন। কিন্তু তাঁকে দেখায় অন্তত দশ বছর কম। বাবার সঙ্গে খুবই মানায় তাঁকে। আমরা যেখানেই যাই, মা বাবাকে দেখে মানুষ মুগ্ধ হয়। মা কথা বলেন কম আর বাবা হচ্ছেন হৈ চৈ প্রিয়, আনন্দ প্রিয়। আমরা দু’বোন হয়েছি তাঁদের দু’জনার মতো। আমি মায়ের মতো। একটু চুপচাপ ধরনের। তবে আনন্দ করতে ভালোবাসি। রিয়া হয়েছে বাবার মতো, খুবই হৈ চৈ আর আমুদে থাকা মেয়ে। সে এখন বিবিএ পড়ছে। সেকেন্ড সেমিস্টার চলছে। আমার একটা সেমিস্টার বাকি আছে। তার পরই এমবিএ শেষ হবে। আমার প্ল্যান হচ্ছে এমবিএ শেষ করেই বাবার বিজনেসে ঢুকে পড়ব। তাঁর অফিসে বসব। বিজনেসটা বড় করব।

রিয়া আর কথা বলল না। ওর একটা স্বভাব খুব ভালো। যখন চাইবে তখনই ঘুমিয়ে পড়তে পারে। এখনো তাই হলো। মিনিটখানেকের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু আমার সহজে ঘুম এলো না। ব্যাপারটা নিয়ে অনেক কিছু ভাবলাম। ভৌতিক কান্ড নাকি? ভূত এসে পায়ে সুড়সুড়ি দিয়ে গেল? পৃথিবীর এত এত দেশে গিয়েছি, এত এত হোটেলে থেকেছি, বাংলাদেশের কত হোটেল মোটেল আর রিসোর্টে থেকেছি কখনো তো এরকম হয়নি! ভূতের ভয়, অশরীরী আত্মা, ভৌতিক ব্যাপার স্যাপারে আমার একদম বিশ্বাস নেই। কত ভূতের গল্প পড়ি, হরর মুভি দেখি! ওই দেখা পর্যন্তই। তার পর আর কিছুই মনে থাকে না। ওসব নিয়ে ভাবিও না। কিন্তু আজ রাতে যা হলো তার তো কোনো ব্যাখ্যা পাচ্ছি না!

আমাদের জেনারেশনের ছেলে মেয়েদের মধ্যে বিদেশে পড়তে যাওয়ার হিড়িক পড়েছে। ব্রিটেন কানাডা অস্ট্রেলিয়া, চীন জাপান আর আমেরিকা তো আছেই। একটু অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেমেয়েরা মুখিয়ে আছে কীভাবে বাইরে পড়তে যাবে। কীভাবে স্কলারশিপ জোগাড় করা যায়, এই চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছে অনেকে।

আমার বাবার সাধ্য আছে আমাদের দু’বোনকেই বাইরে পড়াবার। কিন্তু আমাদের একজনেরও আগ্রহ নেই। আমরা আমাদের দেশেই পড়াশোনা করে, দেশেই থাকব। দেশের কাজ করব। বিদেশে বেড়াতে যাব ঠিকই কিন্তু স্থায়ী হব না।

প্রায় প্রতিবছরই বিদেশে আমাদের যাওয়া হয়। আমেরিকায় যাওয়া হয়েছে। ব্রিটেনে গিয়েছি দু’বার। ইউরোপ ঘুরেছি। পৃথিবীর সুন্দরতম দেশ সুইজারল্যান্ডে গিয়েছি। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছি, কানাডায় গিয়েছি। জাপানেও বাবা একবার আমাদের নিয়ে গেছেন। চায়নার গ্রেট ওয়াল দেখা হয়েছে। আর ইন্ডিয়া নেপাল ভুটান শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুর থাইল্যান্ড ইন্দোনেশিয়া গিয়েছি, মালদ্বীপ গিয়েছি। মরিশাস নিয়ে গেছেন বাবা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এত সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখা হয়েছে, কিন্তু থেকে যেতে ইচ্ছে করেনি কোথাও। ঘুরে-ফিরে বাংলাদেশই আমাদের প্রিয়। বাংলাদেশ ঘুরে দেখতেই সবচাইতে ভালো লাগে।

সৈয়দপুরে গাড়ি নিয়ে তৈরি ছিলেন মোরশেদ সাহেব। তিনি গতকাল চলে এসেছেন দিনাজপুরে। আমাদের থাকা এবং বেড়াবার সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন।

‘মায়াপুরি’তে এসে আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। অপূর্ব পরিবেশ রিসোর্টটির। গাছ আর ফুলে ভরা বিশাল এলাকা নিয়ে রিসোর্ট। কটেজগুলো দারুণ। আমাদের জন্য যে কটেজ ঠিক করা হয়েছে, সেটির মাঝখানে বসার ঘর আর দু’পাশে দু’টো রুম। একেবারে ফাইভ স্টার হোটেলের মতো। একটাতে মা-বাবা আর একটাতে আমি আর রিয়া। বিকেলের মুখে মুখে রিসোর্টে পৌঁছেও আমরা কোথাও বেড়াতে গেলাম না। রেস্ট নিয়ে রিসোর্ট ঘুরে ঘুরে দেখলাম। বাবা মা একদিকে ঘুরতে গেলেন আমি আর রিয়া গেলাম আরেকদিকে। রাতের খাওয়াটা হলো খুব ভাল। দেশি মুরগির ভুনা, সবজি ডাল। মা বাবা রুটি সবজি মুরগি খেলেন, আমি আর রিয়া ভাত।

আমাদের কটেজের সামনে ভারি সুন্দর একটা শেড। মাথার ওপর ঘন শক্ত ঝোপের মতো আবরণ। অচেনা ফুল ফুটে আছে। শেডের চারদিকেও তাই। শুধু দুটো দিক দরজার মতো। ভিতরে প্লাস্টিকের সুন্দর চেয়ার পাতা আছে, টেবিল আছে। বসে আড্ডা দেওয়া আর চা খাওয়ার ব্যবস্থা। সন্ধ্যার দিকে দেখি শেডের ঘনঝোপে প্রচুর টুনটুনি পাখি। ফুরুৎ ফুরুৎ করে ঝোপে ঢুকছে আর বেরোচ্ছে। বুঝলাম এই ঝোপেই তাদের বাসাবাড়ি। আকাশে চাঁদ ছিল। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা চারজন শেডের তলায় বসে আড্ডা দিলাম। মা ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপের কথা বলছিলেন। মা’র খুবই প্রিয় বেড়াবার জায়গা। আবার দ্বীপটাতে তিনি যেতে চান। বাবা বললেন, এবছর শীতকালে নিয়ে যাবেন। শুনে আমি আর রিয়া খুব খুশি। বেড়াবার কথা শুনলেই আমরা খুশি হই।

মাঝরাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমের ভিতর কী রকম একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল হালকা লোম দিয়ে কেউ যেন আমার পায়ের পাতাটা ছুঁয়ে গেল। একবার না, তিন চারবার। যেন অমন করে আমার ঘুম ভাঙাতে চাচ্ছে।

আমাদের বাড়িতে দু’টো বিড়াল আছে। মিনি আর জিনি। মিনিটা মাঝে মাঝে এমন করে। আমি বা রিয়া দুপুরবেলা ঘুমিয়ে থাকলে, দরজা খোলা থাকলে সে এসে রুমে ঢোকে। আমার বা রিয়ার পায়ের কাছে শুয়ে সেও ঘুমোয়। তবে ঘুমোবার আগে লেজ দিয়ে দু’তিনবার আমার বা রিয়ার পায়ের কাছে সুড়সুড়ি দেয়।

আমার ও রিয়ার আলাদা আলাদা রুম। তবে ছুটিছাটার দিনে, বা বাড়িতে থাকলে আমরা দু’বোন সারা দিন, এমন কি রাতেরও অনেকটা সময় একসঙ্গে থাকি। একসঙ্গে খাওয়া ঘুমোনো সব। ওরকম দুপুরে গল্প করতে করতে দু’বোন কখন ঘুমিয়ে পড়ি টের পাই না। মিনি এসে পায়ে সুড়সুড়ি দিয়ে আমাদের ঘুম ভাঙায়।

আজ রাতের ব্যাপারটা ঠিক তেমন। কেন মিনি অমন করে আমার ঘুম ভাঙাচ্ছে?

আমি বা রিয়া ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঘুমোতে পারি না। আমাদের দু’বোনেরই প্রিয় রং পার্পল। বেগুনি। এজন্য দু’রুমেরই ডিমলাইট বেগুনি রঙের। আশ্চর্য ব্যাপার রিসোর্টের রুমটির ডিমলাইটও বেগুনি রঙের। ঘুমোবার আগে ওই দেখে আমরা দু’জনেই খুব খুশি।

এখন ঘুম ভাঙার পর বেগুনি আলোয় প্রথমে মনে হলো আমি যেন বনানীর বাড়িতে, আমার রুমেই শুয়ে আছি। কিন্তু সেখানে তো রাতেরবেলা মিনি বা জিনির আমার রুমে ঢোকার কথা না! ওরা থাকবে ওদের জায়গায়। গুটিসুটি হয়ে ঘুমোবে ওদের ক্যাট হাউসে।

তা হলে পায়ে ওরকম করল কে?

তার পরই মনে হলো আমি তো ঢাকায় নেই! আমি দিনাজপুরে। রিসোর্টে। এখানে মিনি জিনি আসবে কেমন করে?

যখন এসব ভাবছি আস্তে করে রিয়া আমাকে ডাকল। ‘দিয়াপু’।

আমার নাম দিয়া। রিয়া ডাকে ‘দিয়াপু’। দিয়ার সঙ্গে ‘আপু’ লাগিয়েছে। সেই ‘আপু’ থেকে ‘আ’ বাদ দিয়ে ‘পু’টা রেখেছে। ফলে ‘দিয়াপু’।

এক ডাকেই আমি সাড়া দেব এটা রিয়া আশাই করেনি। সে একটু অবাক হলো। ‘তুমি জেগে আছ?’

‘না জেগে গেছি।’

‘তার মানে তোমারও অমন হয়েছে?’

রিয়াকে পরীক্ষা করার জন্য বললাম, ‘কেমন?’

‘পায়ে সুড়সুড়ি? মিনির মতো?’

‘হ্যাঁ। ও জন্যই ঘুম ভেঙেছে।’

‘আমিও ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ মনে হলো মিনি ওর লেজ দিয়ে পায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। এজন্যই ঘুমটা ভেঙে গেল!’

‘ভয় পেয়েছিস?’

‘না তা পাইনি। অবাক হয়েছি। এখানে মিনি আসবে কোত্থেকে? ঘুম ভাঙার পর চারদিক তাকিয়েও দেখলাম। কই, কোথাও কিছু নেই!’

‘আমিও কিছু দেখিনি।’

‘তা হলে দু’বোনের একই সঙ্গে ঘুম ভাঙল, একই রকম অনুভূতি হলো কেমন করে?’

‘কী জানি! বুঝতে পারছি না। ব্যাপারটা হয়তো স্বপ্নে ঘটেছে। আমরা দু’জনে একই সঙ্গে একই স্বপ্ন দেখেছি।’

‘যা, তা কখনও হয় নাকি? দু’জন একই সঙ্গে, একই সময়ে একই স্বপ্ন দেখবে এমন তো আমাদের জীবনে কখনও ঘটেনি। আর দু’জনের একই অনুভূতি হবে, এ কী করে সম্ভব?’

‘ব্যাপারটার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। কাল মা বাবাকে বলব, দেখি তাঁরা কী বলেন! এখন ঘুমো।’

রিয়া আর কথা বলল না। ওর একটা স্বভাব খুব ভালো। যখন চাইবে তখনই ঘুমিয়ে পড়তে পারে। এখনও তাই হলো। মিনিট খানেকের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু আমার সহজে ঘুম এলো না। ব্যাপারটা নিয়ে অনেক কিছু ভাবলাম। ভৌতিক কান্ড নাকি? ভূত এসে পায়ে সুড়সুড়ি দিয়ে গেল? পৃথিবীর এত এত দেশে গিয়েছি, এত এত হোটেলে থেকেছি, বাংলাদেশের কত হোটেল মোটেল আর রিসোর্টে থেকেছি কখনও তো এরকম হয়নি!

ভূতের ভয়, অশরীরী আত্মা, ভৌতিক ব্যাপার স্যাপারে আমার একদম বিশ্বাস নেই। কত ভূতের গল্প পড়ি, হরর মুভি দেখি! ওই দেখা পর্যন্তই। তার পর আর কিছুই মনে থাকে না। ওসব নিয়ে ভাবিও না। কিন্তু আজ রাতে যা হল তার তো কোনও ব্যাখ্যা পাচ্ছি না! দেখি মা বাবা সকালবেলা কী বলেন!

তার পর ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালবেলা ব্রেকফাস্টের টেবিলে রিয়াই কথাটা তুলল। বাবা মন দিয়ে শুনলেন। মা’ও শুনলেন। তিনি কিছু বলতে গেলেন, হাত তুলে বাবা তাঁকে থামালেন। ‘আমি বলছি।’

তিনি আমাদের দু’বোনের দিকে তাকালেন। ‘ওসব কিছু না মা। নতুন জায়গায় অনেক সময় এ রকম হয়। আসলে ঘটেনি কিছুই। তোমাদের দু’বোনেরই ওই বেগুনি আলোয় মনে হয়েছে তোমরা ঢাকায় তোমাদের রুমে আছো, মিনি বিড়ালটি অমন করছে। এরকম অনেক সময় হয়। ওসব কিছু না।’

মা বললেন ‘তোমরা ভয় পেয়েছ নাকি?’

রিয়া বলল, ‘না ভয় পাইনি। ভয়ের কী আছে? তবে অবাক হয়েছি। দু’জনের একই সঙ্গে ঘুম ভাঙল, একই রকম অনুভূতি হলো!’

বাবা হাসলেন। ‘তোমাদের দু’বোনের মিল অনেক। একজন আরেক জনকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারো না। এরকম সম্পর্ককে বলে ‘হরিহর আত্মা’। তোমরা হচ্ছো ‘হরিহর আত্মা’। এজন্য এমন হয়েছে।’

বাবা তার পর কথা অন্যদিকে ঘোরালেন। ‘আজ আমরা কোথায় যাচ্ছি, জানো?’ ‘রামসাগর’ দেখতে। আমি বহু আগে একবার দেখেছি। সমুদ্রের মতো একটা দিঘি। পরিবেশটা ভারি সুন্দর। যে শব্দের আগে ‘রাম’ থাকে তা বড় হবেই। যেমন ‘রামদা, রামছাগল, রামধনু। বড় হয়েও যারা ‘খোকা’ থাকে তাদের বলে ‘রামখোকা’।’

বাবা হা হা করে হাসলেন। মাকে দেখলাম চিন্তিত চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে আছেন।

‘রামসাগর’ দেখে আমরা মুগ্ধ। বিশাল জায়গা নিয়ে দিঘিটি। হঠাৎ তাকিয়ে সমুদ্রের মতো মনে হয়েছিল আমার! এতবড় দিঘি? দিঘির চারপাশে গাছপালা, ফুলের ঝোপঝাড়, পায়ের তলায় সবুজ ঘাস। পাখি ডাকছে, হাওয়া বইছে। ভারি চমৎকার পরিবেশ। হিয়াকে দেখি অপলক চোখে দিঘির দিকে তাকিয়ে আছে। জলটা খুবই স্বচ্ছ। সেই জলে দুপুর হয়ে আসা রৌদ্রের খেলা। হাওয়ায় মৃদু ঢেউ উঠছে দিঘিতে। বাবা মা মোরশেদ সাহেব তাঁরাও দেখছেন দিঘি। ড্রাইভার এই এলাকার। তার পান খাওয়ার অভ্যেস আছে। একটা শিরীষগাছের তলায় দাঁড়িয়ে সে পান চিবোচ্ছে।

হিয়াকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমি আস্তে করে ওকে একটা ধাক্কা দিলাম। ‘এমন করে তাকিয়ে আছিস কেন?’

আমার দিকে তাকিয়ে হিয়া হাসল। ‘আমার না এই ধরনের দিঘি দেখলে শুধু মনে হয় এর তলায় কী যেন রহস্য লুকিয়ে আছে। কবে, কত শত বছর আগে এই দিঘি কাটা হয়েছে। জমিদার আমলের ভেঙে পড়া বাড়ি দেখলেও আমার এরকম মনে হয়। পুরনো মাঠ বা মন্দির, বুড়ো বট বা তেঁতুলগাছ দেখলেও মনে হয় এসবের ভিতর কোথায় যেন রহস্য আর রহস্য। আমার কেমন গা কাঁটা দেয়।’

‘এখনও কি দিচ্ছে?’

‘দিচ্ছে।’

আমি হেসে ফেললাম। ‘এই দিনেরবেলা? আমরা সবাই তোর চারপাশে তার পরও গা কাঁটা দিচ্ছে?’

‘দিলে আমি কী করব?’

‘চল দিঘির জলে হাত দিই। আমার খুব ভালো লাগছে।’

‘চলো।’

‘গা কাঁটা দেবে না তো?’

হিয়া হেসে ফেলল। ‘দিলে দেবে।’

ঘাটলার নিচের দিকটায় গিয়ে আমরা দিঘির জলে হাত দিলাম। হিয়া বলার কারণে কি না কে জানে, জলে হাত দিয়ে আমার গা কাঁটা দিল। কেন কে জানে! তবে সে কথা হিয়াকে বললাম না। একের কোনও কোনও অনুভূতি অন্যকে দ্রুত প্রভাবিত করে। আমার বোধহয় তেমন হলো। জলে হাত দিয়ে মনে হলো জলটা একটু বেশি ঠান্ডা আর এই জলের তলায় আছে এক অন্ধকার জগৎ। সেই জগৎ ভর্তি শুধুই রহস্য।

[চলবে]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর