শুক্রবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভাঙন

রেবেকা আসাদ

ভাঙন

অনেকক্ষণ থেকে গুম মেরে বসে আছে ছোইরোন। থেকে থেকে ও আল্লাহ বলে আহাজারি করছে। রেখে যাওয়া ঘর উঠোন কিন্তু আর নেই। নদীর খুঁজে পাচ্ছেন। ও বাপ কোতি গেলি। ও আল্লাহ কোতি গেল আমার ছ্যোল। আবার বুক বাপড়ে কেঁদে ওঠে। পাড়ার লোকজন চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না। ছোইরোনের জন্য তারাও শোকে পাথর হয়ে গেছে। ঘরবাড়ি ভেঙে ভেসে গেছে নদীর স্রোতে অনেকের। তবুও তারা ছোইরোনের জন্য শোকার্ত। রাতে ঘুমিয়েছিল তার ছেলে ঘরের ভিতর। সকালে সর্বনাশা পদ্মা তার সব চিহ্ন নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।

ও আল্লাহ আমি কাইল রাতে কবিরুলে ছ্যেলিডা কত কথা বুইললো। আমি যাওয়ার সময় দেখনু শুতে যাচ্ছে। দরজার ঝাপ লাগায়ে দিল আমি গেনু। আর এহন একি দেখছি... কেঁদে ওঠে মনিরা। আপন না হলেও অন্তরের আপন হয়ে গেছে সে। কবিরুল যখন ছোট ছিল ওর বাপ ওদের ছেড়ে চলে গেলে মনিরাই নিজের তিন সন্তানের সাথে। ছোইরোন চরে বন কেটে তা বিক্রি করে লোকের ফসল তুলে দিয়ে যা পেত তাই দিয়ে চলতো তাদের। সাত দিন আগে মেয়ের বাড়ি গিয়েছিল ছোইরোন। নদীতে পানি বাড়ছে দুদিন আগে থেকে মনটা টানছিল না যেতে। কিন্তু মেয়ের বাচ্চা হওয়ার সময় না থাকলে হবে না তাই যাওয়া। ও কবির বাবা নদীতে য্যেন গা ধুতে যাইস না। সাবধানে থাকিস। দুডো করে চাউল তোর মনি কাকিখে দিস তুমি যাও অতো চিন্তা কইরতে হবে না। আমার কাজ না থাইকলে তুমার সাথেই যাতাম। বুবুখে দেইখতে মুন চাহে খুব। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে ছোইরোন বলে যাইবা। তোর বুবুর পরথম ছ্যেলা হবে তুই মামা হবি। তোখে কি খালি হাতে যাওয়া মানাস? কাজ কাম করে তার ল্যাগা জিনিস পাতি লিতে হবে না। আনন্দে হেসে ওঠে কবিরুল। ঠিক বুলেছো। ওর ল্যাগা কত কি কিনবো। তুমি যাও। আমি য্যায়ে তুমাখে লিয়ে আসবোনি। বারবার সাবধানে থাকতে বলে চারঘাটে মেয়ের বাড়ি যায় ছোইরোন। যাওয়ার সময় প্রতিবেশীদের বলে যায় ছ্যেলাডাখে তোরা দেখিস। মেয়ের বিয়ে দিয়েছে বছর দেড়েক হলো। এর মধ্যে মেয়ের বাড়ি যায়নি ছোইরোন। মামাই বাড়ি যাচ্ছে। পোয়াতি মেয়ে। একটা ছাগল ছিল বিক্রি করে তার জন্য একটু ঘি, কাঁথা, জামা নিয়েছে। রুপার চেন আর বাজুবন্ধ ও নিয়েছে। বড় শখ ছোইরোনের। ছেলে মেয়ে যেই হোক না তাকে পরাবে।

দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়েছে। ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়ছে একনাগাড়ে। অনেক বছর পর নদীর পানি পাড় ছুঁয়ে ওপরে উঠেছে। সমস্ত বছর পর নদীর চরখিদিরপুর তো হুমকির মধ্যে আছে। প্রতিদিন কোনো না কোনো এলাকা নদীগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে।
হায় ও আল্লাহ... দীর্ঘশ্বাস ছাড়েগ ছোইরোন। হায়রে কপাল। ছোইরোনের গায়ে হাত বুলিয়ে প্রতিবেশী আনোয়ারা ওবুবু কবিরুলের বাপখে খবর দিবানা? কীসের খবর দেবো? সে বাপ ছ্যেলে মেয়া ফেলি অন্য জায়গায় গিয়ে লিকে করে সংসার কইরছে। তার কি ছ্যেলার দরকার আছে। রহিমন বিবি ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে। প্রতিবেশীদের কথোপকথনে মুখ তোলে ছোইরোন। শাকেরা আর কবিরুলের বাপের ওপর প্রচন্ড অভিমান হয় তার। ছোইরোনের জন্য সে লোকটা এতো পাগল ছিল আজ পাঁচ বছর হলো তার দেখা নেই। খবর পেয়েছে টাঙনে বিয়ে করে সংসার করছে। একটা সন্তান হয়েছে তার। একদলা থুথু ছোড়ে কাজেমের উদ্দেশ্যে। ছোইরোনের রূপে মুগু হয়ে কতদিন তার পিছে পিছে ঘুরেছে। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছিল ছোইরোন। কাজেম তখন উঠতি যুবক। বাপের মুদিখানার দোকানে বসতো। স্কুলে যাওয়া আসার পথে পথ আটকাতো তার। অনেক দিন ঘোরাঘুরির পর মত দেয় ছোইরোন। বলে আমার পাছে না ঘুরে আমার মার কাছে য্যাতে পারে না মানুষটা। এ কথা শুনে খুশিতে ছোটে ছোইরোনের মায়ের কাছে। মেয়ে একটু বড় হলেই গ্রামের বাবা-মায়ের চিন্তা বাড়ে। অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে দেখে বিয়ে দেয় ছোইরোনের। এতিম মেয়েটাকে বিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে মা।

দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়েছে। ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়ছে একনাগাড়ে। অনেক বছর পর নদীর পানি পাড় ছুঁয়ে উপরে উঠেছে। সমস্ত বছর পর নদীর চরখিদিরপুর তো হুমকির মধ্যে আছে। প্রতিদিন কোনো না কোনো এলাকা নদীগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। কবিরুলকে প্রতিবেশীরা নদীর ধার দিয়ে নৌকায় করে অনেক দূর পর্যন্ত খুঁজেছে। কিন্তু পায়নি। তারা খুঁজতে গিয়ে পেয়েছে একটি শিশু কন্যাকে। খাটের ওপর ঘুমন্ত অবস্থায়। খাট ভেসে যাচ্ছিল। কলিম মিয়া মেয়েটাকে উদ্ধার করে পুলিশের হেফাজতে দিয়ে এসেছে। শুনে হাহাকার করে ওঠে তার বৌ ফুলবানু। একটা সন্তানের জন্য হাহাকার করে তার হৃদয়। কুড়ি বছরেও কোনো সন্তান হয়নি তার। তোলপাড় জীবনে প্রচন্ড ধাক্কা খায় নদী পারের মানুষ। ঘরবাড়ি ভেঙে সংসার গুছিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে সবাই। ছোইরোন একা বসে থাকে নদীর ধারে কবিরুলের ফিরে আসার অপেক্ষায়। কেউ তাকে সরাতে পারে না। দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ আর পানি এখন একাকার। ছোইরোনের চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। আঁধারের ধূপছায়ায় হারিয়ে যায় প্রকৃতির রং। হারিয়ে যায় ছোইরোনের জীবনের রং গহন আঁধারে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর