শুক্রবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
গল্প

খুলি রহস্য

ইকবাল খন্দকার

খুলি রহস্য

পূর্ব প্রকাশের পর

এরপর কখন যেন একটু তন্দ্রাভাব চলে আসে মামুনের। আর এরই মাঝে তার মনে হয় কপালে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ লেগেছে। বরফের মতো ঠান্ডা। ভীত-সন্ত্রস্ত মামুন বসে থাকে মূর্তির মতো। প্রায় আধঘণ্টা বসে থাকার পর তার মনে হয়, হাতের কাছে এমন কিছু রাখা উচিত, প্রয়োজনে যা দিয়ে আত্মরক্ষা করা যায়। হতে পারে সেটা লাঠি, রড কিংবা শাবল। কিন্তু এত রাতে এসব পাবে কোথায়? হঠাৎ তার মনে পড়ে একটা বরাক বাঁশের গোড়ার কথা। গতকাল যেটি এনেছিল ক্ষেতের আইলে পোঁতার জন্য। রেখেছিল খাটের নিচে।

খাট থেকে নেমে বাঁশটা টেনে বের করার জন্য হাত বাড়ায় মামুন। কিন্তু তার মনে হয় বাঁশের শেষ মাথাটা যেখানে, সেখানে সাদার কাছাকাছি রঙের কিছু একটা পড়ে আছে। কী? উপুড় হয়ে থাকা মাটির ছোট কোনো পাত্র না তো? মামুন খাটের নিচে মাথা ঢোকায়। আচমকা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আবছা অন্ধকারে ঢাকা খাটতলা। আর সে দেখতে পায় দেয়াল ঘেঁষে পড়ে আছে সেই খুলিটা।

চিৎকার করে ওঠে মামুন। প্রচণ্ড জোরে খাটে বাড়ি খায় তার মাথা। হয়তো ফেটেই গেছে। তবু বসে থাকে না সে। এক দৌড়ে চলে যায় দরজার কাছে। তারপর খিল খুলে সোজা বাইরে। সারারাত আর ঘরে ঢোকা হয় না তার।

সকালে মামুন নাশতা খেতে বসলে মা বলেন- ভাবছিলাম আগে থেইকা তোরে কিছুই কমু না। কিন্তু এখন মনে হইল, কই। তবে এইটাও কইয়া রাখি, যা কিছু হওয়ার, সব আমার ইচ্ছায় হইতে হইবো। তোর কোনো ইচ্ছা খাটবো না। আমার সব কথা শোনার পরে যে তুই বাঁইকা বসবি, এই কথা কইবি, সেই কথা কইবি, এইগুলা চলবো না। আমি যা ঠিক কইরা রাখছি, সেইটাই ফাইনাল।

মামুন বুকে ধড়ফড়ানি নিয়ে জানতে চায় কী হয়েছে। জাকির জানায় সে যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে, সে নাকি আরেকজনের সঙ্গে মাসখানেক আগে পালিয়ে গেছে। মামুন জাকিরকে ফাজলামো করতে নিষেধ করে। আর জানায় আজকে দুপুরেই সে মেয়েটাকে দেখে এসেছে। জাকির বলে- তোরা যারে দেখছস, সে সাবিনা না। রুবিনা। সাবিনার যমজ বোন।

এরপর মা জানান মামুনকে নিয়ে তিনি যার বাড়িতে যাবেন বলে ঠিক করেছেন, সেটা তার মাইনুদ্দিন মামার বাড়ি। মামুন মানুষটাকে চিনতে পারে না। তাই পরিচয় জানতে চায়। মা তার পরিচয় দেন। কিছু স্মৃতিচারণও করেন। মামুন এবার জানতে চায় মাইনুদ্দিন মামার বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হয়েছে। মা বলেন- এতক্ষণ তাইলে কী কইলাম? কইলাম না, আমি যেইটা ঠিক কইরা রাখছি, সেইটাই হইবো? আরে বেক্কল, সাবিনার কথা ভুইলা গেছস? মাইনুদ্দিনের বড় মাইয়া। কলেজে পড়ে।

সাবিনার কথা আসলেই ভুলে গেছে মামুন। তার চেহারা, উচ্চতা, গায়ের রং কোনো কিছুই মনে নেই তার। কীভাবে কথা বলত, তাও মনে নেই। কেবল নামটাই মনে আছে। নাশতা করা শেষ হয় মামুনের। অল্প খেয়ে নেন মাও। এর মধ্যে জানতে পারেন ‘আপ-ডাউন’ ভাড়া করা রিকশাটা এসে বাড়ির পেছনে দাঁড়িয়েছে। মা আর দেরি করেন না, মামুনকেও দেরি করতে দেন না। ঝটপট তৈরি হয়ে উঠে পড়েন রিকশায়। বেলা সোয়া ১টায় রিকশা পৌঁছে মাইনুদ্দিন ভূইয়ার বাড়িতে। বাড়ি তখন লোকজনে ভরপুর। অবশ্য ভরপুর থাকাটাই যৌক্তিক। যেহেতু মা আভাস দিয়ে রেখেছেন, সব ঠিকঠাক থাকলে দিন-তারিখের অপেক্ষা করবেন না। শুভ কাজ আজকেই সম্পন্ন করে ফেলবেন। মাইনুদ্দিন ও তার স্ত্রীর সঙ্গে সংক্ষেপে কুশলবিনিময় শেষে মা জানতে চান সাবিনা কোথায়। জানতে পারেন সে ঘরেই আছে। শাড়ি পরছে। এরপর বেলা আড়াইটার মধ্যে কনে দেখা হয়ে যায় মামুনের। সে মাকে জানায়, তার ষোলআনা পছন্দ হয়েছে। মা ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলেন। তারপর মাইনুদ্দিনকে বলেন বিয়ের আয়োজন করার জন্য। কিন্তু তার স্ত্রী বলেন- সাবিনার শইলডা ভালা না। এই জন্য একটা সপ্তাহ সময় চাইতাছি।

মা সময় দেন। তারপর ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। আর ক্লান্তি দূর করার জন্য গা এলিয়ে দেন বিছানায়। সন্ধ্যার দিকে মোড় থেকে বাড়ি ফিরছিল মামুন। এমন সময় তাকে কাছে ডাকে তার বাল্যবন্ধু জাকির। বলে- খুব খারাপ একটা খবর আছে। খবরটা যে তোরে ক্যামনে দিই! কিন্তু না দিয়াও পারতাছি না। খারাপ খবর পেটে রাইখা মুখে মুখে সান্ত্বনা অন্য মানুষে দিতে পারে। আমি তো তোরে দিতে পারি না। আমার দোস্ত না তুই! দোস্ত হিসাবেই তোরে অনুরোধ করি, খবরটা শুইনা তুই ভাইঙ্গা পড়িস না। জীবনে কত কিছুই হইতে পারে। তবু ভাইঙ্গা পড়লে চলে না। ধৈর্য ধরতে হয়।

মামুন বুকে ধড়ফড়ানি নিয়ে জানতে চায় কী হয়েছে। জাকির জানায় সে যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে, সে নাকি আরেকজনের সঙ্গে মাসখানেক আগে পালিয়ে গেছে। মামুন জাকিরকে ফাজলামো করতে নিষেধ করে। আর জানায় আজকে দুপুরেই সে মেয়েটাকে দেখে এসেছে। জাকির বলে, তোরা যারে দেখছস, সে সাবিনা না। রুবিনা। সাবিনার যমজ বোন। ক্যান, যমজের বিষয়টা কি তুই জানতি না? যাক, এইখানে একটা চালাকি হইছে। আর চালাকিটা করছে সাবিনার চতুর মা। যাতে তোরা জানতে না পারস তাদের মাইয়া আরেকজনের সাথে পালাইছে। এই যে বিয়ার জন্য এক সপ্তাহ সময় নিছে, এইটাও একটা চালাকি। তাদের ধারণা, এর মধ্যেই তারা সাবিনারে খুঁইজা পাইয়া যাইবো। আর খুঁইজা পাইলে তো বিয়া দিতে কোনো সমস্যা নাই।

মামুন দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। ধুলোবালির উপরই বসে পড়ে ধপ করে। জাকির বলে- আরেকজনের সাথে পালায়া যাওয়া মাইয়ারেও মানুষ বিয়া করে। এইরকম ঘটনা কত ঘটে! কিন্তু তোর ভাইগ্যটা মনে হয় একটু বেশিই খারাপ। একটু আগে খবর পাইলাম সাবিনা যেইদিন পালাইছে, সেইদিন রাতেই খুন হইছে। পুলিশের ধারণা, প্রেমিকই তারে খুন করছে।

এবার আর্তনাদ করে ওঠে মামুন।

জাকির তার পিঠে হাত রেখে বলে- সাবিনার হাড়গোড় শুধু পাওয়া গেছে। কিন্তু মাথা পাওয়া যায় নাই।    

সমাপ্ত

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর