শুক্রবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
পর্ব-৯

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

আন্দালিব রাশদী

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

পূর্ব প্রকাশের পর

আবার কথা ওঠে আমি তিন প্রার্থীর মধ্যে কাকে সমর্থন করি? আমি চুপ করে থাকি। নির্বাচন হয়, মন্টু সাহেব জিতে যান। আমি খবর পাই ভেঙে পড়া রঙ্গ থিয়েটার আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে। তিনি ভিন্নভাবে আবার গরম ডিম মঞ্চে নিয়ে আসতে চাচ্ছেন। তিন দিন আগে তিনি রঙ্গ থিয়েটারের উপদেষ্টাদের নিয়ে মশিউজ্জামানের মেয়েদের দেখতে আসেন। কমলা, আপেল ও সফেদা ফলও আনেন। এক কেজির তিনটি প্যাকেট। আমি এসে সালাম দিই। নতুন সভাপতি মোস্তফা হোসেন মন্টু উপদেষ্টা পরিষদের মুরুব্বিজনদের সামনে বলেন, আমি তিন সন্তানের জননীকে বিয়ে করব এ ঘোষণাই তো আমাকে ইলেকশনে জিতিয়েছে। ভোটারদের সঙ্গে বেইমানি করতে চাই না। আপনি রাজি হয়ে আমাকে নির্বাচনি ওয়াদা রক্ষায় সাহায্য করুন।

এরা নাটকের মানুষ। আমি মশিউজ্জামানের সব কথা বিশ্বাস করতাম না। মোস্তফা হোসেন মন্টুর কথা কেমন করে বিশ্বাস করব।

আমি চোখ তুলে বেহায়ার মতো তার দিকে তাকাই। জিজ্ঞেস করি, এটা কি নাটক?

তিনি আমার সঙ্গে মাত্র একবার চোখাচোখি করে মাথা নামিয়ে আনেন, বলেন নাটক নয়, আমি এ তিন বাচ্চাকে চাই। তা ছাড়া এটা আমার নির্বাচনের অঙ্গীকার।

আবার জিজ্ঞেস করি, আপনার তো বয়স কম, কুমারী বিয়ে করতে পারবেন। বিবাহিত ও বিধবা কেন বিয়ে করবেন?

তিনি সুন্দর জবাব দিলেন, বললেন, বিবাহিতা না হলে তিনটি বাচ্চা আসতো কোত্থেকে আর বিধবা না হলে আমি তো আপনাকে বিয়ে করার কথা বলতেও পারতাম না।

তিনি আরও বললেন, আমাকে প্রত্যাখ্যান করার মতো কারণও আপনাকে বলে দিচ্ছি, আমার তেমন আয়-রোজগার নেই। তবু বাচ্চাদের জন্য কামাই করতে চেষ্টা করব।

বিয়ে ধার্য হলো, গত সন্ধ্যায় রঙ্গ থিয়েটারেই কাজি ডাকিয়ে এনে বিয়ে হলো, আমি কবুল বললাম, কাবিনে সই করলাম। দুই লাখ এক টাকা মোহরানা ধার্য হয়। আমার তিনকন্যা সব দেখেছে। তারপর বাদ্যবাজনার আয়োজন কে করল আমার জানা নেই। খাবার-দাবারের দাম কে দিয়েছে তা-ও জানি না।

আমি কোনো কথা বলিনি। মন্টু সাহেবের সঙ্গে আমার এ নিয়ে কোনো কথা হয়নি। আর আমি তাকে আপনি সম্বোধন করেছি, তিনিও আমাকে আপনি বলেছেন। তিনি ভালো মানুষ আমার মন বলেছে। আমার চোখ আর খোলা রাখতে পারছি না। এখনই ঘুমোব।

টিয়া, তিন কন্যার মা।

 

 

চিঠি পড়া শেষ হতে হতে হাত থেকে স্পাইরাল বাইন্ডিং করা খাতাটি পড়ে যায়। নিশ্চয়ই শেহেরজাদ আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। তবে ঘুমটা দীর্ঘক্ষণের নয়, চোখ খুলতেই দেখে তার এক পাশে ডাহুক বসে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।

গত আট-দশ বছরে ঘুম ভাঙার পর চোখ খুলে কাউকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেনি শেহেরজাদ।

ডাহুক বলল, টুনটুনিদের ঘরে যাব। আমার স্কুল ব্যাগে আমার টুথ ব্রাশ ও পেস্ট আছে।

তুমি কি স্কুল ব্যাগ এনেছ?

হ্যাঁ, যখন ব্যান্ড পার্টির সঙ্গে হেঁটে হেঁটে আসি আমার পিঠেই ছিল। টুনটুনিদের ঘরে বিছানার ওপর রেখেছিলাম।

শেহেরজাদ ডাহুককে নিয়ে সেই ঘরে যায়। টিয়া তখন টুনটুনিকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে। ডাহুক বলে, হ্যালো মা সুপ্রভাত। আমি অনেক ঘুমিয়েছি। এখন পি করব, দাঁত মাজব।

মন্টু ভাই ঘরে নেই। শেহেরজাদ জিজ্ঞেস করে কোথায়?

সবার জন্য নাশতা আনতে গেছে। ছোট বক্সে দুটো করে পরোটা, একটা ডিম পোচ আর এক চামচ হালুয়া। ধোয়ার ঝামেলা করতে হবে না।

ততক্ষণে ফ্ল্যামিঙ্গোও ঘুম থেকে ওঠে। ঘুম ভাঙলেই কাঁদতে থাকে তার বিরুদ্ধে এই অপবাদটি টিকল না। তার যখন ঘুম ভাঙে তখন ওই রুমটিতে কেউই ছিল না। কান্না শোনানোর মতো কাউকে না পেয়েই সম্ভবত চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ব্যাপারটা ছোট বাচ্চাদের আছাড় খেয়ে কাঁদা ও না কাঁদার মতো। কেউ দেখলে ভ্যা করে ওঠে, কেউ না দেখলে কাপড় ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে যায়।

 

ছয়.

বাবাকে এ ধরনের পোশাকে কখনো দেখিনি। সৌদি পোশাকটি হচ্ছে একেবারে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত টানা পাঞ্জাবি, নাম সম্ভবত তোব। এ রকম একটা পোশাক বাবার আছে এ ধারণাই আমার ছিল না। সঙ্গে কাঁধ থেকে ঝোলানো একটা ব্যাগ। চোখে কালো গগলস। গগলস পরতেও তো কখনো দেখিনি। যখন বেরিয়ে যাচ্ছে জিজ্ঞেস করলাম নাশতা করবে না কোথায় যাচ্ছে?

বলল, কাকরাইল মসজিদে, সেখানে মজলিসের সঙ্গে নাশতা করবে। তিন দিন তিন রাত অবস্থান করে ফিরে আসবে। বাবা মোটেও নিয়মিত নামাজি নয়, কখনো কখনো জুমাও ছেড়ে দেয়। হঠাৎ ধর্মে মতি কি মন্টু ভাইয়ের কারণে। মানে ধর্মও হলো আর মন্টু ভাইয়ের ব্যাপারে নাক গলানোর ঝামেলা থেকে বেঁচেও গেল।

শেহেরজাদ কাল রাতে যা বলেছে তাতে তো স্পষ্ট মন্টু ভাই আমাদের অ্যাটিচিউড টেস্ট করছে। টেস্টের ফলাফল পজিটিভ হলে থাকবে নতুবা অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নেবে। বাবা তাহলে পরীক্ষায় বসতে চাচ্ছে না, ড্রপ দিচ্ছে। বাবা কি তার গগলস নিয়েছে মন্টু ভাইকে এড়াতে?

এর মধ্যে শেহেরজাদ বিরিয়ানির প্যাকেটের মতো চারটি প্যাকেট নিয়ে ওপরে উঠে ডাইনিং টেবিলে রেখে বলল, এটা কিন্তু রঙ্গ থিয়েটারের ওয়েডিং ব্রেকফাস্ট নয়, মন্টু ভাই নিজের টাকায় ঘরোয়া রেস্তোরাঁ থেকে এনেছে। বাবার, মার, আমার আর তোর। মঞ্জু ভাইয়ের প্যাকেট তার টেবিলের ওপর রেখে এসেছি, মন্টু ভাই তার ফ্যামিলির জন্য রেখেছে চার প্যাকেট। টিয়া অবশ্য বলল, চারটা বেশি হয়ে গেছে তিনটা হলেই ঠিক ছিল।

টিয়া আবার কোনটা?

শেহেরজাদ বলল, মা টিয়া মানে ভাবি, মোস্তারিন জাহান টিয়া। মন্টু ভাইয়ের বউ। আমি এখন জোর দিয়ে বলতে পারি মন্টু ভাই-ই বাবার যোগ্য সন্তান। বাবার ডিএনএ তার মধ্যে ডমিন্যান্ট। বাবা শম্পা আপুসহ মাকে উদ্ধার করেছিল আর মন্টু ভাই তিনটি ছোট পাখিসহ টিয়া পাখিকে উদ্ধার করেছে। মানবতার প্রশ্নে বাবার চেয়ে মন্টু ভাইয়ের কন্ট্রিবিউশন দ্বিগুণ। বাবা রক্ষা করেছে দুজনকে, মন্টু ভাই চারজনকে।

বেশ তাহলে মন্টু ভাইয়ের কেনা নাশতা বাবাকে খাইয়ে আয়। দেখ পারিস কি না।

পারব না মানে? কাল রাতে বাবাকে ওয়েডিং কাচ্চি বিরিয়ানি খাওয়ালাম। না তো বলেনি। অবশ্য বিছানায় বসে খেয়েছে বলে মন্টু ভাইয়ের সেকেন্ড পিচ্চিটা বাবাকে অপমান করতে ছাড়েনি।

বাবার রুম ঘুরে এসে শেহেরজাদ বলল, বাবা কোথায়?

খুঁজে বের কর আর পোস্ট ওয়েডিং নাশতা খাওয়া।

আসলে বাবা কোথায়? বাইরে গেছে?

বাইরে তো অবশ্যই। আরবি তোব আর কালো গগলস পরে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে তিন দিনের জন্য কাকরাইল মসজিদে চলে গেছে।

বাবা কাকরাইল মসজিদে!

কেন মানুষের বোধোদয় হতে পারে না? বাবার ধর্মে মতি ফিরে এসেছে।

শেহেরজাদ বলল, আজ দ্বিতীয় দিন। মন্টু ভাই আমাদের অ্যাটিচিউড টেস্ট করাতে তিন দিন সময় নিচ্ছে। বাবা তো মনে হচ্ছে টেস্টে ফেল করে গেল। দেখিস মা-ও যেন ফেল না করে। সেটা তুই দেখ। তুই হচ্ছিস নিগোশিয়েটর।

শেহেরজাদ এক প্যাকেট নাশতা নিয়ে মাকে দিয়ে বলল, মন্টু ভাই তোমার জন্য নাশতা পাঠিয়েছে। খাও, এতে পরোটা, ডিম আর হালুয়া আছে। আমারটা খেয়ে নিচ্ছি। আমার দুটো ক্লাস আছে, সেরে আসি। দুটার মধ্যে ফিরে আসব। মা যদি ভালো চাও মন্টু ভাইয়ের ঘরে চারজন না হলেও তিনজনের খাবার পাঠিও। তুমি না গেলেও আবুল বাশার মিরধাকে কাজে লাগাও।

আমার ভাগের নাশতাটার সবটুকু খেলাম। হালুয়াটা বেশ মজার।

স্কুলে যাওয়ার পথে আবার উঁকি দেয়, মন্টু ভাই নেই, টুনটুনির ডায়াপার কিনতে গেছে। শেহেরজাদ স্কুল থেকে ঘুরে আসার কথা বলে। ফ্ল্যামিঙ্গো বলল, স্কুলে গিয়ে কোনো লাভ নেই। বাসায় বসে ভালো করে পড়। তাতে লাভ বেশি। তা ছাড়া মেয়েদের শাস্তি দেওয়ার জন্য স্কুলের টিচারদের হাত নিশপিশ করে।

তবু আমাকে যেতে হবে।

তাহলে তুমি একা যেতে পারবে না। টিচারের বেতটা আমি ধরে ফেলব, এজন্য আমি তোমার সঙ্গে যাব।

সেটা অন্য দিন করা যাবে, আজ আমি একাই যাই।

সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট বাঁকা করে তার সঙ্গে গড়ে তোলা শেহেরজাদের সঙ্গে সম্পর্ক নস্যাৎ করে ফ্ল্যামিঙ্গো বলে ফেলল, আসলে তোর সঙ্গে আমি যেতে চাইও না, তুই একটা ওরাং ওটাং। আমাদের এই রুমে আর আসতে পারবি না। তোর চেহারা বান্দরের মতো।

টিয়া মেয়েকে চোখের ইশারায় বলল, ভালো হচ্ছে না কিন্তু।

[চলবে]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর