শুক্রবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ

পৃথিবীর যে কোনো বাদ্যযন্ত্রই বাজাতে পারতেন

হোসেন আবদুল মান্নান

পৃথিবীর যে কোনো বাদ্যযন্ত্রই বাজাতে পারতেন
একদিন পার্শ্ববর্তী সরাইল এলাকা থেকে কিছু লোক একটা ভাঙা বেঞ্জু নিয়ে এসে ওস্তাদ আলাউদ্দিনকে দেখিয়ে বললেন, এই তারছেঁড়া বেঞ্জুটা যদি বাজাতে পারেন তাহলেই আমরা বুঝব আপনি সত্যিকারের একজন ওস্তাদ। প্রথমে ওস্তাদ তাদের শান্ত হতে বললেন এবং এটা হাতে নিয়ে কতক্ষণ নাড়াচাড়া করে দেখলেন। বললেন, ‘এটাতে তো বোতাম নাই, কোথায় পেলে এটা? তবে সেদিন তিনি সেই বেঞ্জুতেও মধুর সুর তুলে উপস্থিত সবাইকে বিস্মিত করে দিয়েছিলেন’। বাস্তবতা হলো, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ পৃথিবীর যে কোনো বাদ্যযন্ত্রই বাজাতে পারতেন।

ভারত সরকারের পদ্মভূষণ ও পদ্মবিভূষণ-প্রাপ্ত বাঙালি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে নিয়ে একটা পুস্তক রচনার সুপ্ত বাসনা নিয়ে সম্প্রতি কলকাতা সফর করি। এবার কলকাতায় মাত্র চার দিন ছিলাম। সেখানকার কলেজ স্ট্রিটসহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত বইয়ের বিতানসমূহে তন্নতন্ন করে খুঁজেও আলাউদ্দিন খাঁ’র ওপরে লেখা তেমন গবেষণামূলক বা বিশদ জীবনভিত্তিক কোনো রচনা পাইনি। যা পেয়েছি তা বাংলাদেশের শাহবাগের বই পাড়াতেই সহজলভ্য। বলা যায়, নতুন কিছুর সন্ধানে সীমান্ত পেরিয়ে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে আসা। যদিও হাতের কাছে পেয়ে যাওয়া দুয়েকটা চটি বই নিয়ে ফেরত আসি। ভাবছিলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ বা দিজেন্দ্র লাল রায় (ডি.এল রায়) এঁদের সমসাময়িক কালে জন্ম নেওয়া এবং ১১০ বছর জীবিত থাকা একাডেমিক শিক্ষাবিহীন অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষটি হয়তো কলকাতায় কখনো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেননি। অথচ মাত্র নয় বছর বয়সে কলকাতা শহরই তাঁকে প্রথম আশ্রয় দেয়। হাওড়া ব্রিজের নিচেই তাঁর প্রথম রজনী কাটে। পরক্ষণে তাও ভেবেছি, ঢাকায় বসে উভয় বাংলার পাঠকের পাঠ উপযোগী একটি তথ্যবহুল বই রচনা করতে বাধা কোথায়? এমন দায়িত্ব তো আমরাও নিতেই পারি।

২.

এই কিংবদন্তি সংগীতগুরু ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে নিয়ে আমার প্রগাঢ় কৌতূহল সৃষ্টি হয় মূলত ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময়ে। এর আগে তিনি এবং তাঁর পরিবারের অপরাপর সদস্য সম্পর্কে যৎকিঞ্চিত ধারণা ছিল। তখন পর্যন্ত দেশের বরেণ্য সংগীত বিশেষজ্ঞগণের টেলিভিশন আলোচনা বা টকশো থেকে শোনা ছাড়া তাঁর বিষয়ে জানার খুব বেশি সুযোগ আমার ছিল না। ২০১০ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলাপ্রশাসক হিসেবে যোগদান করার অব্যবহিত পরেই ওস্তাদজী সম্পর্কে বিচিত্র কিছু জানার এক চমৎকার উপলক্ষ চলে আসে। তৎকালে সেখানকার একজন বইপ্রেমী, শিক্ষানুরাগী ও বৃক্ষবন্ধু মুহাম্মদ মুসা আমাকে সেই ব্যবস্থা করে দেন। তিনিই ওস্তাদের গল্পগাঁথার জীবন কাহিনি, পারিবারিক পরিচয়, বিয়ে সংসার জীবন, ভারতের নাগরিক হয়ে মধ্য-প্রদেশের মন্দিরের শহর মাইহারে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করাসহ সবই বলেছেন। একই সঙ্গে তিনি তৎসংক্রান্ত কিছু তথ্যাদি এবং পুস্তিকা আমাকে সরবরাহ করেছিলেন। জনশ্রুতিগুলিও ধীরে ধীরে আমার চিত্তের খোরাক এবং কল্পনার জগৎকে সুবিস্তৃত করতে থাকে।

৩.

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের প্রাণকেন্দ্রেই অবস্থিত ‘সুর সম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন’। একখানা টিনশেড লম্বাটে ঘর এর বেশি কিছু নয়। একটুখানি মঞ্চসহ শতেক জনার আসন গ্রহণের আয়োজন। তবে এটাই এখন পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম প্রধান জলসাঘর। জানা যায়, সেখানকার জমিটা ওস্তাদের নিজস্ব অর্থে ক্রয় করা হয়েছিল। এক সময়ে তিনি স্বয়ং ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন, জীবনের শেষ কালটা তাঁর জন্মস্থানের মহকুমা শহরেই কাটাবেন। পরবর্তীতে নানাবিধ পারিপার্শ্বিকতার কারণে মত পরিবর্তন করেন। এবং শেষাবধি ভারতের মাইহার শহরে স্থায়ী হয়েছিলেন। আমার সময়েই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গবেষক মুহম্মদ মুসা, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব মনজুরুল আলম এবং আরও কয়েকজন সংস্কৃতিপ্রাণ ব্যক্তির সহযোগিতায় আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গনের অভ্যন্তরেই স্থাপন করা হয় আলাউদ্দিন জাদুঘর (গঁংবঁস)। তখন সেখানটায় উস্তাদের ব্যবহৃত জায়নামাজ, টুপি, চাদরসহ অসংখ্য ছোটখাটো জিনিস স্থান পেয়েছিল। পদাধিকারী হিসেবে জাদুঘরের সঙ্গে আমি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য! মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে স্থানীয় মৌলবাদী দুর্বৃত্তায়নের হাতে জাদুঘরটা ধ্বংস হয়ে যায়। মনে পড়ে সেদিন রাতেই ড্রইংরুমে বসে টেলিভিশনের পর্দায় দেখছিলাম, নিজের হাতে গড়ে তোলা নান্দনিক প্রতিষ্ঠানটি কী পৈশাচিক তান্ডবের শিকার হলো। আমি নীরবে শুধু অশ্রুসজল হয়ে ছিলাম।

৪.

২০১৭ সালে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে যোগদানের পর পুনর্বার আর্থিক সহায়তা দিয়ে মুহম্মদ মুসাদের উদ্যোগে এর রেপ্লিকা তৈরি করে জাদুঘরটা চালু রাখা হয়। উল্লেখ্য, সেখানকার ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ মিউজিয়ামটা পরে আরও একবার অন্ধকারের সহযাত্রী এবং কুসংস্কারের ধ্বজাধারীদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

মাঝেমধ্যে এ-ও ভাবি, মানুষের গোঁড়ামি অজ্ঞতা আর নির্মমতার বিষয়টা আমাদের বুঝতে অনেক সময় লাগলেও আলাউদ্দিন খাঁ ষাটের দশকেই অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

৫.

২০১২ সালের শুরুর দিকের ঘটনা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আরেক কৃতী সন্তান বরেণ্য লেখক ও কথাসাহিত্যেক অদ্বৈত মল্লবর্মণের পৈতৃক ভিটেবাড়ি উদ্ধারপূর্বক বহিরাঙ্গনে তিতাস পাড়ে তাঁর আবক্ষ ভাস্কর্য নির্মাণ উপলক্ষে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেশের বিশিষ্ট লেখক ও সাবেক সচিব হাসনাত আবদুল হাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। পরদিন দুপুরে মুহাম্মদ মুসাসহ স্থানীয় কয়েকজন সংস্কৃতিসেবীকে সঙ্গে নিয়ে সড়ক পথে শিবপুর গমন করি। সেদিন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র পূর্বপুরুষের বাড়ি ও তাঁর মা-বাবা, নিকটাত্মীয় স্বজনের কবরস্থান, আলাউদ্দিন খাঁ মহাবিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকা পরিদর্শন করি। পরে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সেখানকার রাস্তাঘাটের সংস্কার করার উদ্যোগ নিই। এতদিন পরে এখন শুনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিবপুর গ্রাম একটা পর্যটন এলাকায় পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন দূরদূরান্তর থেকে আলাউদ্দিন খাঁ, আফতাব উদ্দিন খাঁ, মোবারক হোসেন খান বা এ বংশের প্রথিতযশাদের ঠিকানা খুঁজতে মানুষ আসেন। উল্লেখ্য, এই শিবপুর এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামেই গোড়াপত্তন হয়েছিল বিখ্যাত ‘মলয়া’ সংগীতের।

জনশ্রুতি আছে, তিনজন প্রকৃতি প্রদত্ত সংগীত প্রতিভার নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে মলয়া সংগীতের নামকরণ হয়েছিল। এরা হলেন মনমোহন দত্ত, লববাবু আর আফতাব ফকির। তিনজনই জন্মগতভাবে নবীনগর বা শিবপুর এলাকার মানুষ ছিলেন। সংগীতের শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক সময় চালু হয়েছিল ‘আলম ব্রাদার্স’ নামে বিখ্যাত বাদ্যযন্ত্রের দোকান। সেখানে সরোদ, হারমোনিয়াম ছাড়াও বিভিন্ন প্রকার বাজনার সামগ্রী পাওয়া যেত। এর পেছনেও ছিল ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এবং তাঁর ভাইদের সরাসরি উদ্যোগ এবং সহযোগিতা। আলম উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র ডাকনাম ছিল। জানা যায়, সেই সত্তরের দশকেও সর্বত্র আলম ব্রাদার্সের অস্তিত্ব বহাল ছিল।

৬.

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চাকরিকালে আলাউদ্দিন খাঁ এবং তাঁর পুত্র ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ সম্পর্কে নানা গল্প এবং মিথের কথা শুনেছি। এমন একটি গল্পের উল্লেখ করা যায়।

‘একদিন পার্শ্ববর্তী সরাইল এলাকা থেকে কিছু লোক একটা ভাঙা বেঞ্জু নিয়ে এসে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে দেখিয়ে বললেন, এই তারছেঁড়া বেঞ্জুটা যদি বাজাতে পারেন তাহলেই আমরা বুঝবো আপনি সত্যিকারের একজন ওস্তাদ। প্রথমে ওস্তাদ তাদের শান্ত হতে বললেন। এবং এটা হাতে নিয়ে কতক্ষণ নাড়াচাড়া করে দেখলেন। বললেন, ‘এটাতে তো বোতাম নাই, কোথায় পেলে এটা? তবে সেদিন তিনি সেই বেঞ্জুতেও মধুর সুর তুলে উপস্থিত সবাইকে বিস্মিত করে দিয়েছিলেন’। বাস্তবতা হলো, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ পৃথিবীর যে কোনো বাদ্যযন্ত্রই বাজাতে পারতেন।

লেখক : গল্পকার ও কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর