শুক্রবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
পর্ব-১০

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

আন্দালিব রাশদী

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

পূর্ব প্রকাশের পর

শেহেরজাদ বেরিয়ে যায়। মার রান্না প্রায় শেষ পর্যায়ে, অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পরও আবুল বাশার মিরধা সাড়া দিল না। যখন দুটার দিকে এলো, মা টেবিলের খাবার নিচে দিয়ে আসতে বলল।

আবুল বাশার বলল, আমি তো পনেরো মিনিট আগে দেখলাম মন্টু সাহেব বিবি আর বাচ্চাদের নিয়ে ঘরোয়া হোটেলে খেতে ঢুকছেন। এতক্ষণে লাঞ্চ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।

মা বলল, তাহলে আমি এতগুলো রান্না কার জন্য করলাম!

আবুল বাশার রেডিমেড উত্তর নিয়েই তৈরি থাকে, আমরা আছি কী জন্য? রান্না করেছেন, ভালো হয়েছে। এটা দিয়ে ডিনার করবে। আমি সাড়ে ছ’টার মধ্যেই খাবার দিয়ে আসব, যাতে হোটেলে যাওয়ার সুযোগ না পায়।

আড়াইটায় স্কুল থেকে ফিরে শেহেরজাদ যখন শুনল মন্টু ভাই সপরিবার হোটেলে খেয়েছে, মাকে এক হাত নিল। বলল, তুমিও ফেল করে গেলে।

অবশ্য পরে মন্টু ভাইকে ছাড়ল না। আর দশ মিনিট পরে খেলে মরে যেতে নাকি? তোমার বউবাচ্চা কেউ মরত? মা যে তোমাদের জন্য রান্না করল। তোমাদের খাওয়াতে পারল না এজন্য কষ্ট পেল, এর কি কোনো দাম নেই? যাকগে রাতের খাবার কখন খাবে বল?

মন্টু বলল, পৌনে ৮টা।

বেশ, সাড়ে ৭টায় খাবার দেবে।

শেহেরজাদ খেয়েদেয়ে পরদিনের হোমওয়ার্ক সেরে যখন নিচতলায় নামল তখন ঠিক সোয়া ছটা।

বায়োলজি প্র্যাকটিকাল লিখতে একটু বেশি সময় লেগে গেছে। ব্যাঙের পরিপাকতন্ত্র জিব থেকে অন্ত্র পর্যন্ত আঁকতেই লেগে গেছে এক ঘণ্টা। তা-ও ছবিটাকে এক্সিলেন্ট বলা যাবে না।

শেহেরজাদ স্কুল থেকে বেরিয়ে একটি কনফেকশনারিতে ঢুকে একটা ফ্রুট কেক আর চারটা ললিপপ কেনে। কেকটা মাকে দেবে, সম্ভব হলে আজ নইলে কাল চায়ের সঙ্গে মন্টু ভাই ভাবিকে খাওয়াবে। বাচ্চাদের চা নিষেধ তবে কেক খেতে তো বাধা নেই, তারাও ভাগ পাবে।

যেহেতু নামতেই তার সোয়া ছটা বেজে গেছে চা করে নিতে নিতে সাড়ে ছটা বেজে যাবে তার চেয়ে শুধু কেক আর ললিপপ সঙ্গে নিয়ে নামে।

ডাহুক বলল, আমি কেক খাব না তবে কেকের বদলে দুটো ললিপপ দিতে হবে। ফ্ল্যামিঙ্গো বলল, আমাকে দুটো কেক ও দুটো ললিপপ দিতে হবে। ভাগ্যিস টুনটুনি কথা বলতে শেখেনি, তাহলে হয়তো চারটে কেক আর চারটে ললিপপ চাইত। শেহেরজাদ বলল, সরি ভাবি আমরা তোমাকে অ্যাটেন্ড করতে পারিনি।

টিয়া হেসে উঠল। ইশারায় যা বলল তার মানে পুরোটা শেহেরজাদ বুঝল না। সুতরাং টিয়াকে লিখতে হলো : শ্বশুরবাড়িতে বউদের কাজ ননদদের অ্যাটেন্ড করা। এ দায়িত্বটা আসলে আমার।

সে আধশোয়া মন্টু ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসল, হাতে এক পিস কেক।

বলল, হাঁ কর, খাইয়ে দিই।

ফ্ল্যামিঙ্গো বলে উঠল, হাঁ করতে বোলো না তোমার আঙুল কামড়ে দিতে পারে। আমি বলে দিচ্ছি, জেঞ্জারাস। ভীষণ জেঞ্জারাস। কুকুর মানুষকে কামড় দিলে পেটে কুকুরের বাচ্চা হয়। মানুষ তখন কথা বলতে পারে না, শুধু ঘেউ ঘেউ করে। আচ্ছা মানুষ মানুষকে কামড় দিলে তখন কি ওয়া ওয়া করে কথা বলে?

আমার কোনো ধারণা নেই।

ফ্ল্যামিঙ্গো বলে, আমার আছে, আমি এ রকম তিনটা বেবি দেখেছি। একটা আমাদের ঘরে আছে টুনটুনি, ওয়া ওয়া করে।

কেকটা মন্টু ভাই খেলো এবং বলল, চা খাওয়াবি না?

একটু বাড়িয়েই বলল, চা আনতে চাচ্ছিলাম, মা বলল, চা খাওয়ার পর বেশি কিছু খেতে পারো না, সেজন্য ডিনারের পর তোমাকে চা দেব।

পানিও কি পান করতে পারব না?

শেহেরজাদ এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে টেবিলে এক লিটারের পানির দুটো খালি বোতল, মানে পানি শেষ হয়ে গেছে। পানি সম্ভবত রঙ্গ থিয়েটারই সরবরাহ করেছে। এখনই আসছি বলে শেহেরজাদ খালি বোতল দুটি নিয়ে ওপরে গেল এবং ফিল্টার থেকে পানি ভরে মা কেবল তার চা-টা মুখে তুলছিল এমন অবস্থায় কাপটা আর পিরিচটা ছিনিয়ে নিয়ে চলে এলো। চায়ের কাপটা মন্টু ভাইয়ের হাতে দিয়ে বলল, কম করে খেয়ো। মা খাবার রেডি করছে।

ফ্ল্যামিঙ্গো বলল, কথাটা মনোযোগ দিয়ে শোনো। কম করে খেয়ো, বাকিটা আমি খাব।

মন্টু ভাইয়ের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে ফ্ল্যামিঙ্গোকে বলল, তোমার কী হয়?

ফ্ল্যামিঙ্গো বলল, আমি কেমন করে বলব, মা তো এখনো কিছু বলেনি। আঙ্কল না ভাইয়া আমি এখনো জানি না।

ডাহুক চুপচাপই থাকে। হঠাৎ একটা দুটো কথা বলে, আমার মনে হচ্ছে বাবাই বলতে হবে। রাতে মায়ের সঙ্গে গায়ে গায়ে লেগে শুয়েছে তো, সেজন্য বলছি। আমার কোনো সমস্যা নেই। যা ডাকতে বলবে তা-ই ডাকব। আমার অভ্যাস আছে।

এবার মন্টু ভাই মুখ খুলল, বাবাকে হাজি মাস্তান মির্জা সাজতে কে বলেছে?

কী নাম বললে?

হাজি মাস্তান মির্জা।

আমি তো জীবনেও তাকে দেখিনি, নামও শুনিনি।

আমি কি দেখেছি নাকি? তোর তো দেখার প্রশ্নই আসে না, আমারও না। ১৯৯৪ সালে হার্ট অ্যাটাকে প্রাণ হারিয়েছে। ইন্ডিয়ান স্মাগলিং গডফাদার। চোরাচালানির বড় মাফিয়া। বাবাকে সকালে যে পোশাকে দেখলাম ঠিক এমন পোশাকেই হাজি মাস্তান মির্জার একটা ছবি দেখেছি। ভাবলাম বাবা এই বয়সে নতুন কিছু শুরু করল কি না। অবশ্য বাবা আমাকে দেখেনি। বাবা যখন গেট থেকে বের হচ্ছে তখন পেছন থেকে একনজর দেখেছিলাম। এটা ঠিক বাবাকে স্মার্ট দেখাচ্ছিল।

এ সময় টিয়া ভাবি কিছু একটা বলল। মন্টু ভাই সম্ভবত তা বুঝলও এবং জবাবে তাকে বলল, সরি বাবা সম্পর্কে এটা বলা আমার ঠিক হয়নি।

শেহেরজাদ বলল, আমি ডাহুককে নিয়ে একটু হেঁটে আসছি, পনেরো মিনিটের মধ্যে ফিরব। আমাকে একটা টু-বি পেনসিল আর একটা শার্পনার কিনতে হবে।

ফ্ল্যামিঙ্গো বলল, তাহলে আমাকেও যেতে হবে। আমারও পেনসিল কিনতে হবে। ডাহুক ধমক দেয়, তোর লাগবে একটা ফিডার বোতল।

ফ্ল্যামিঙ্গো বলল, একদম ঠিক। ফিডার বোতল আর পেনসিল।

ডাহুক বলল, ধ্যাৎ।

অমনি ফ্ল্যামিঙ্গো চেঁচিয়ে উঠল মা আমাকে ধ্যাৎ বলেছে। আমি তোকে ঠিকই কামড় দেব।

সমঝোতা করে শেহেরজাদ দুজনকে নিয়ে যায়। নিজের জন্য টু-বি পেনসিল আর শার্পনার কেনে। ডাহুক নেয় ডোনাল্ড ডাক আকৃতির একটি ইরেজার আর ফ্ল্যামিঙ্গোকে কিনে দিতে হয় একটা মিস্টার বিন স্টিকার।

বাসায় ফিরতে ফিরতে সাড়ে সাতটা।

খাবার আনতে সহায়তাকারী হিসেবে ডাহুককে নিয়ে ওপরে যেতে চাইলে ফ্ল্যামিঙ্গো বলল, ডাল নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় ডাহুক আপু পড়ে যাবে, কিন্তু আমি কখনো পড়ব না।

শেহেরজাদ দুজনকে নিয়েই উঠল। ভেবেছিল প্লেটে ভাত বাড়া থাকবে, পেয়ালায় মুরগির মাংস, বাটিতে ডাল এভাবে সাজানো থাকবে। একটা বা দুটো করে হাতে নিয়ে নিচে নামবে আবার উঠবে আবার নেবে। কিন্তু তার পরিকল্পনা ভেস্তে গেল যখন দেখল মা চার বাটির বড় টিফিন ক্যরিয়ারে সব খাবার ঢুকিয়ে টেবিলে চারটা প্লেট, চামচ, আমের আচার রেডি করে রেখেছে। শেহেরজাদের একটা ‘ধ্যাৎ’ শুনতে হবে এটা মাথায় রেখে মা আক্রমণাত্মক হলো, বলল আমি চাই না কার না কার মেয়ের জন্য খাবার টানতে গিয়ে সিঁড়িতে পিছলা খেয়ে পড়ে আমার মেয়ের কোমর ভাঙুক।

কার না কার মেয়ে? আসলেই তো আমার মন্টু ভাইয়ের শ্বশুর বা শাশুড়ি কারও নামই জানি না। কিন্তু মার কথা তো বুঝিয়ে দেয় ভাবি আমাদের আপন কেউ নয়। এমনিতেই সঙ্গে এনেছে তিনটা বাচ্চা, তার ওপর শেহেরজাদ কাউকে না বলার জন্য আমাকে বলেছে, ভাবি বাকপ্রতিবন্ধী এটা মা জানলে তো মন্টু ভাইয়ের ওপর রাগটা আরও এক ডিগ্রি বাড়িয়ে দেবে।

শেহেরজাদ বিতর্কে না গিয়ে প্রথম দফায় চারটা প্লেট নামিয়ে দিয়ে এলো। ততক্ষণে তিন সন্তানের বড়টা ডাহুক আমার গায়ের পাশে দাঁড়িয়ে সম্ভবত আমার উচ্চতা মাপার চেষ্টা করল এবং বলল, হায় খোদা, কী আশ্চর্য! তুমি এমন কেন?

আমি কেমন তা বলার আগে আবারও শেহেরজাদ পানির বোতলটা দিল ডাহুকের হাতে, নিজের এক হাতে বড় টিফিন ক্যারিয়ার অন্য হাতে আচারের বোতল ও দুটো বড় চামচ নিয়ে নিচে নেমে গেল। মা তখন চেঁচিয়ে বলল তোর খাবার এখানে আছে, এটা ওদের।

খাবারটা ওদেরই কিন্তু মন্টু ভাই টিফিন ক্যারিয়ার খুলে একটা একটা করে টেবিলে সাজিয়ে বলল, খাবার যা দিয়েছে তাতে তোর হয়ে আরও কিছু থাকবে। কাজেই ওপরের খাবার মাকেই খেতে বলে দিস। টিয়া নিজের হাতে প্লেটটা জোর করেই শেহেরজাদের হাতে তুলে দিয়ে টিফিন ক্যারিয়ারের ঢাকনা উল্টে তাতে নিজের জন্য ভাত ও তরকারি নিল। ফ্ল্যামিঙ্গো বলল, আমি ডাল খাব, কিন্তু আমার ডাল কাপে দিতে হবে। আমি কাপ থেকে চায়ের মতো করে খাব। তিন মিনিটের মধ্যে ওপরে গিয়ে কাপ নিয়ে নিচে আসা সম্ভব কিন্তু টিয়া শেহেরজাদকে ধরে রাখল, ও বাড়াবাড়ি করছে। এটাকে পাত্তা দেওয়া ঠিক হবে না, তাহলে ঘাড়ে চড়ে বসবে। যেভাবে আছে সেভাবে যদি খায় খাবে, না হলে আর সাধা হবে না, ক্ষুধায় চেঁচালেও খাবার দেওয়া হবে না। এটাই ফাইনাল।

একটুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থেকে ফ্ল্যামিঙ্গো বলল, ঠিক আছে খাব, আমাকে বড় রানটা দিতে হবে। ছোটটা দিলে হবে না।

খেতে খেতে মন্টু বলল, মার হাতের ডালটা দারুণ। তোর ভাবিকে শিখিয়ে দিতে বলিস।

[চলবে]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর