শুক্রবার, ৫ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

অমৃতসর : বিমোহিত ভ্রমণের কিছু কথা

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

অমৃতসর : বিমোহিত ভ্রমণের কিছু কথা

মানব চিত্ত বিনোদিত ও সমৃদ্ধ হয় অজানাকে জানার সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে। আর এই অজানাকে জানার একটি মাধ্যম হলো ভ্রমণ। নির্দিষ্ট ভূখন্ড থেকে বেরোলে সৃষ্টিজগতের অনেক অজানার স্বাদ নেওয়া যায়। ভ্রমণ মানুষের জীবনে দেয় অনাবিল আনন্দ ও এনে দেয় অনেক অর্জন। ইবনে বতুতা, মার্কো পোলো, আল বেরুনি প্রমুখ বড় বড় মানুষ বিশে¡র বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে ভ্রমণলব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা তাঁদের লেখায় ব্যাপৃত করে গেছেন। সেখানে উঠে আসা ভূ-প্রকৃতির বৈচিত্র্য, বিবর্তিত সমৃদ্ধি, সমাজ, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি আজও পৃথিবীর বিভিন্ন মানুষের কাছে খুবই উপজীব্য হয়ে বিরাজিত রয়েছে। বাঙালিরাও ঘরকুনো তকমা কাটিয়ে উঠে ইদানীংকালে ভ্রমণপিপাসুু হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের মানুষ সাপ্তাহিক ছুটির দিনের সঙ্গে একটি অতিরিক্ত দিন যদি যোগ করতে পারে, দেখা যায় তারা সেই তিনটি দিন দেশের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ প্রকৃতির গহিনে, সাগরপাড়ে। কক্সবাজার, কুয়াকাটা ছাড়াও শৈল শহরগুলো যেমন সিলেট, চট্টগ্রাম, নেত্রকোনার দুর্গাপুর প্রভৃতি এখন মুখরিত ভ্রমণপিপাসুদের কাছে। মহাস্থানগড়সহ কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, নওগাঁর পতিসর বা সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবিঠাকুরের কুঠিবাড়ি ইত্যাদি বহু স্থানে বিচরণ করছে ভ্রমণপিপাসুু হয়ে ওঠা আধুনিক বাঙালিরা। দেশে আজকাল ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকেই ছোট ছোট ‘ভ্রমণ স্থান’ গড়ে তুলছেন। গড়ে তুলছেন শহর থেকে দূরে গ্রামীণ পরিবেশে ঘেরা ‘অবকাশ রিসোর্ট’।

আমি নিজেও একজন ভ্রমণপিপাসু মানুষ। আমার রয়েছে প্রকৃতির মাঝে অজানা কিছু খুঁজে ফেরার প্রবণতা। দেশের কয়েকটি জেলা ছাড়া প্রায় অধিকাংশ জেলাতেই আমার পদচারণ রয়েছে। সেই সঙ্গে পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে আমার ভ্রমণ করার সুযোগ হয়েছে। তবে নিঃসন্দেহে ভ্রমণের জন্য প্রতিবেশী ভারত একটি উৎকৃষ্ট দেশ। বিভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতি-কৃষ্টির ডাইভার্সিটি দেশটিকে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। দেশ বিভাগের আগে কলকাতা ছিল অবিভক্ত বাংলার রাজধানী। কলকাতা যেন প্রত্যেক বয়স্ক বাঙালির কাছে একটি স্বপ্নের শহর। হয়তো বা তাঁর কোনো পূর্বপুরুষ কলকাতায় বসবাস করেছেন কোনো না কোনো সময়ে, কী লেখাপড়ার প্রয়োজনে বা ব্যবসায়িক কারণে। আমি নিজেও কলকাতায় গিয়েছি বহুবার। তবে আজ কলকাতা ভ্রমণের গল্প লিখছি না, অন্য কোনো সময় লিখব। আমি তুলে ধরতে চাইছি অন্যরকম একটি ভ্রমণ কাহিনি। আর সেই ভ্রমণে লব্ধ অভিজ্ঞতা।

২৬ নভেম্বর ২০২৩। বাংলাদেশ বিমানের একটি বিমানে আকাশ ভ্রমণ। সঙ্গী স্ত্রীকে নিয়ে। গন্তব্য ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। সে দেশের প্রধান বিচারপতি ডি. ওয়াই চন্দ্রচূড়ের আমন্ত্রণে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার জন্য। ২৭-২৮ তারিখে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। ‘সাধারণ মানুষের বিচার ক্ষেত্রে অভিগমনাধিকার’ এবং ‘সাধারণ মানুষের আইনগত সহায়তা প্রাপ্তির অধিকার’ বিষয়ক দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছিলেন ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি জাগদীপ ধানকার ও সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রীমতি দ্রৌপদি মুরমু। ভারতের পঞ্চাশতম প্রধান বিচারপতি ডি. ওয়াই চন্দ্রচূড় অত্যন্ত মার্জিত স্বভাবের এবং পান্ডিত্যে পরিপূর্ণ একজন মানুষ। তাঁর পিতা ওয়াই ভি চন্দ্রচূড়ও ছিলেন ভারতের ষোড়শ প্রধান বিচারপতি। ভারত তথা উপমহাদেশের আইন বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা সাধনে অন্যান্য বিচারকের মতো এই পিতা-পুত্র যুগলের অবদান অপরিসীম। আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমার বক্তব্য রাখার সুযোগ হয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে চন্দ্রচূড় আমাকে উপ-রাষ্ট্রপতি জাগদীপ ধানকারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ভারতের প্রধান বিচারপতি বিচার ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীদের অধিকার নিশ্চিতে বাংলাদেশের সঙ্গে একযোগে কাজ করার তাঁর আগ্রহের কথা আমাকে একাধিকবার বলেছেন।

সম্মেলন শেষে আরও দুই দিন আমরা ভারতে অবস্থান করি। তবে দিল্লিতে নয়, অন্য শহর অমৃতসরে। আমাদের সঙ্গে আমাদের পরিবারের আরও তিনজন সদস্য বেড়ানোর উদ্দেশে দিল্লি গিয়েছিলেন। ২৯ নভেম্বর ২০২৩ বেলা ১১টায় অভ্যন্তরীণ রুটের একটি বিমানে করে দুপুর ১২টায় পাঞ্জাবের অন্যতম শহর অমৃতসরে পৌঁছি। কভিড-১৯ শুরু হওয়ার আগে ২০২০-এর গোড়ার দিকে একবার আমাদের অমৃতসর যাওয়ার কথা ছিল। বিমানের টিকিট কেনার পরও আমরা তখন যেতে পারিনি। কারণ দিল্লি থেকে আমাদের বলা হয়েছিল অভ্যন্তরীণ রুটের হাল-অবস্থা এমন যে, যে কোনো সময় কভিড প্যান্ডেমিকের কারণে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে সে রকম অবস্থা আজ আর নেই। তাই এবার দিল্লিতে সম্মেলন অনুষ্ঠানের সময়ের সঙ্গে দুই দিন যোগ করে অমৃতসর ভ্রমণের সুযোগ করে নেই।

অমৃতসরের প্রধান আকর্ষণ শিখ ধর্মাবলম্বীদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় স্থান ‘স্বর্ণ মন্দির’। এই ‘স্বর্ণ মন্দির’ ছাড়াও তার আশপাশে অনেক স্মৃতিময় স্থান রয়েছে এবং সেগুলো পরিদর্শনের অভিপ্রায়েই অমৃতসর ভ্রমণ। এখানেই অবস্থিত জালিয়ানওয়ালাবাগ। যেখানে ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকারের বর্বর হামলায় শাহাদাতবরণ করেছিলেন সহস্রাধিক সাধারণ নিরস্ত্র মানুষ। অদূরেই পার্টিশন মিউজিয়াম যেখানে ছবির মাধ্যমে ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। অমৃতসর শহর থেকে ২০-২৫ মিনিটের দূরত্বে ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত ওয়াগা বর্ডার। এখানে প্রতিদিন দুই দেশের পতাকা সূর্যাস্তের সময় নামানো হয় ভারতের বিএসএফ ও পাকিস্তানের আধা-সামরিক বাহিনীর রেঞ্জার্সের সদস্যদের আকর্ষণীয় কুচকাওয়াজের মধ্য দিয়ে। সেটিও একটি দর্শনীয় স্থান। যে জায়গাটিতে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয় সেখানে দুই দেশের অংশেই শিখদের জন্য অনেক বড় গ্যালারি করা আছে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের কুচকাওয়াজ দেখতে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমান। দুই দিক থেকেই সৈন্যরা মার্চপাস্ট করে জিরো পয়েন্টের দিকে এগিয়ে যায় আর সঙ্গে সঙ্গেই দুই দেশের সীমান্ত দরজা যায় খুলে। এরপর উভয় দেশের দুজন সৈনিক সামরিক কায়দায় করমর্দন করে সৌহার্দ্য বিনিময় করে দুই দেশের পতাকা নামায়। সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারতের বর্ডার বেনাপোলেও এ রকম একটি অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হচ্ছে বলে শুনেছি। তবে কলেবরের দিক থেকে এটি অপেক্ষাকৃত ছোট অনুষ্ঠান বলেই জানি। আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, বাংলাদেশ এবং ভারত দুটি অত্যন্ত বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র। এখানে উভয় দিকের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে যেহেতু তেমন উত্তেজনা থাকে না তাই তাদের প্যারেড হয় অনেকটা গতানুগতিক চর্চায়। ওয়াগা সীমান্তে উভয় প্রান্তে সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে প্রায়শ যেহেতু উত্তেজনা বিরাজ করে তাই প্যারেডের সময় উভয় প্রান্তের সৈনিকদের মধ্যে অনেক বেশি ক্ষিপ্রতা পরিলক্ষিত হয়। একে অপরকে তাদের নিজ নিজ সামর্থ্যরে প্রমাণ দিতে চায় কুচকাওয়াজের মধ্য দিয়ে।

মন্দিরে প্রবেশ করার আগে একটি পানির ছোট নালার মতো আছে, যেখান দিয়ে পানি গড়িয়ে যাচ্ছে। সেটিতে পা ভিজিয়ে মন্দির অঙ্গনে প্রবেশ করতে হয়।  তারপর হাত ধুয়ে ধীরে ধীরে মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করি। গাইডরা আমাকে বললেন মন্দিরে প্রবেশের আগে হাত ও পা ধোয়া হচ্ছে পবিত্রতা এবং পরিচ্ছন্নতার প্রতীক।

ফিরে আসি অমৃতসর ভ্রমণের কথায়। ২৯ নভেম্বর ২০২৩ তারিখ অমৃতসর পৌঁছে আমরা ওয়াগা সীমান্তের এই আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজ দেখতে যাই। কুচকাওয়াজ স্থলের অদূরেই বিএসএফ মিউজিয়াম। সেখানে বিএসএফের ব্যবহৃত অনেক জিনিসপত্র রক্ষিত আছে এবং বিএসএফের সাবেক ও বর্তমান প্রধানদের ছবি প্রদর্শিত রয়েছে। মিউজিয়ামটি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বিশেষভাবে। সেখানে দেখি, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ দানরত অবস্থার ছবি, ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে যে স্বাধীনতাপত্রটি পাঠ করেছিলেন তার কপি অত্যন্ত যত্ন সহকারে সংরক্ষিত রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক ছবি এবং মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ মন্ত্রিসভার সদস্যদের একটি গ্র“প ছবিও সেখানে সংরক্ষিত রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি তৎকালীন কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীর একটি ছবিও রাখা আছে। বিএসএফের অনেক সদস্য যারা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন তাদের বেশ কিছু ছবিও মিউজিয়ামটিতে রাখা আছে।

ওয়াগা সীমান্ত থেকে লাহোর শহরের দূরত্ব মাত্র ১৪/১৫ মাইল অর্থাৎ ২১-২২ কিলোমিটার। যেসব বিএসএফ কমান্ডার প্যারেডে অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা আমার সঙ্গে ও আমার স্ত্রীর সঙ্গে ছবি তোলেন এবং আমার সহযোগীদের সঙ্গেও ছবি তোলেন। বিএসএফের একটি রেস্ট হাউসে তারা আমাদের সবাইকে আন্তরিকভাবে চা-পানে আপ্যায়িত করেন। তাদের কাছেই জানা গেল, বিকালে ওয়াগা সীমান্তের যে সীমান্ত দ্বার তারা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে খোলেন সেটি ভোর থেকেই খোলা থাকে এবং এই পথ দিয়েই ইরান-আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশ থেকে পাকিস্তানের ওপর দিয়ে অনেক পণ্য ভারতে প্রবেশ করে। বিশেষ করে শুকনো ফল-ফলারি। সম্ভবত মহাসড়কটিকে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড বা জিটি রোড বলা হয়, যা মুঘল আমলে সম্রাট শেরশাহ কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল।

১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের সময় এই রাস্তা দিয়েই অনেক শিখ ধর্মাবলম্বী স্থায়ীভাবে পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে আসেন। শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরুনানকের জন্মস্থান লাহোরে। ১৫০২ খ্রি. লাহোর থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের পাশে একটি জলাশয়ের ধারে গুরুনানক একটি মন্দির গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সে সময় তিনি এই জলাশয়ের নাম রেখেছিলেন অমৃতসাগর বা অমৃতসায়র। কেউ কেউ এটিকে বলেন অমৃত সরোবর। ইতিহাস থেকে জানা যায়, গুরুনানক মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করে যেতে পারেননি। পরবর্তীতে ১৫৮৮ খ্রি. গুরু অর্জুন সিং অমৃত সায়রের ধারে স্বর্ণ মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এই অমৃতসায়র বা অমৃত সরোবর থেকেই শহরটির নামকরণ করা হয় ‘অমৃতসর’।

ভারত বিভাগের সময় পাকিস্তান একটি ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান অংশের পাঞ্জাবে শিখদের সঙ্গে স্থানীয় মুসলিমদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়, অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। এ পরিস্থিতিতে শিখ ধর্মাবলম্বীরা তাদের জানমাল রক্ষার প্রয়োজনে পাঞ্জাবের যে অংশ ভারতের অন্তর্গত হয় সেখানে চলে আসেন। পাকিস্তানের লাহোর এবং তার আশপাশে বেশ কিছু শহরে সামান্য কিছু শিখ ধর্মাবলম্বী এখনো অবস্থান করছেন। গুরু নানকশাহীর জন্মস্থানে একটি বড় গুরুদুয়ারা প্রতিষ্ঠিত আছে। বর্তমানে ৪৭-এ ভারতের পাঞ্জাব অংশে চলে আসা শিখ ধর্মাবলম্বীরা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের লাহোরে বা যেখানে গুরুদুয়ারা আছে সেখানে যেতে পারেন, ঠিক একইভাবে পাকিস্তানে অবস্থানরত শিখ ধর্মাবলম্বীরা ভারতের অমৃতসর বা অন্যান্য জায়গায় যেখানে তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আছে সেখানে যেতে পারেন। দুই দেশের সরকারের পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে এই আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা বহাল আছে। অমৃতসর ভ্রমণে এই ইতিহাস সামনে আসে। জানতে পারি অনেক কিছু।

২৯ নভেম্বর ২০২৩ সন্ধ্যায় ওয়াগা বর্ডারের কুচকাওয়াজ দেখে ফিরে আসি রেস্ট হাউসে। রাতে আমার অবস্থান ছিল গুরুনানক দেব বিশ¡বিদ্যালয়ের রেস্ট হাউসে। রেস্ট হাউসটি বেশ সুন্দর। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর অর্থাৎ পাঞ্জাবের গভর্নরের জন্য নির্ধারিত সুইটে আমাকে থাকতে দেওয়া হয়। আমার সফরসঙ্গীরা অবশ্য সংলগ্ন অন্য একটি দালানের অন্যান্য কক্ষে ছিলেন। থাকার ব্যবস্থা খুব ভালো ছিল। পাঞ্জাব সরকার আমাকে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে বরণ করায় আমার ও আমার স্ত্রীর থাকা-খাওয়া এবং চলাফেরার জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা তারাই করেছিলেন। অমৃতসর শহর মোটামুটি জনবহুল। আমার গাড়িবহরকে যাতে কোথাও থামতে না হয় সে ব্যবস্থায় স্থানীয় ট্রাফিক পুলিশ বেশ তৎপর ছিল। তারা আমার জন্য যে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিলেন তা চোখেপড়ার মতো। উল্লেখ্য, ২৯ তারিখে যখন আমি বিমানবন্দরে অবতরণ করি সেখানে পাঞ্জাব সরকারের প্রতিনিধি এবং অমৃতসর জজকোর্টের কর্তাব্যক্তিরা উপস্থিত থেকে আমাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।

৩০ নভেম্বর ২০২৩ সকালের নাশতা সেরে আমরা বেরিয়ে পড়ি পার্টিশন মিউজিয়াম দেখতে। পার্টিশন মিউজিয়ামে অনেক দুর্লভ ছবি দেখতে পেলাম। আমরা যখন ঘুরে ঘুরে মিউজিয়ামটি দেখছিলাম তখন কিছুক্ষণ পরপরই আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ বাজানো হচ্ছিল। আমি জানতে পারলাম বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির সম্মানে তাঁরা এটির আয়োজন করেছেন। ভীষণ গর্বিত অনুভব করছিলাম। পার্টিশন মিউজিয়ামের অদূরেই জালিয়ানওয়ালাবাগ। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল অবিভক্ত পাঞ্জাব প্রদেশের এই শহরে ইংরেজ সামরিক অফিসার ব্রিগেডিয়ার রেগিনাল্ড ডায়ারের নির্দেশে এক পরিকল্পিত গণহত্যা চালানো হয়েছিল। ক্রমাগতভাবেই যখন ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ভারতবাসীরা ফুঁসে উঠছিল তখন ১৯১৯ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে পাঞ্জাব যাওয়ার পথে গান্ধীজিকে ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ গ্রেফতার করে। এতে পাঞ্জাবের সাধারণ জনগণ আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বিক্ষুব্ধ হয় আহমেদাবাদের শিল্প শ্রমিকরাও। অবস্থা বেগতিক দেখে ব্রিটিশ সরকার গান্ধীজিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। এপ্রিল মাসের ১৩ তারিখে ব্রিটিশ সরকার দুজন স্থানীয় নেতাকে অমৃতসর থেকে গ্রেফতার করার পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় জনসাধারণ এ ঘটনার প্রতিবাদ এবং ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে তাদের বক্তব্য তুলে ধরার জন্য একটি চতুর্দিক ঘেরা বাগানে বা মাঠে একত্রিত হয় সেটিই ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ’। সেখানেই এই প্রতিবাদ সভা চলা অবস্থায় ব্রিগেডিয়ার ডায়ারের নির্দেশে সাধারণ জনগণের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় ব্রিটিশ পুলিশ ও আর্মি। এতে প্রায় হাজার খানেক মতান্তরে ২ হাজার মানুষ শাহাদাতবরণ করেন। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী এ সংখ্যা ছিল ৩৭৯ জন। সে সময় এই জালিয়ানওয়ালাবাগ মাঠের ভিতরে একটি পানির কুয়া ছিল। সেই কুয়াতে প্রাণ বাঁচানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ১২০ জন মানুষ এবং তাদের প্রত্যেকে সেখানেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। সেই কুয়াটি এখনো আছে একটি কাচের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। দেয়ালে ঘেরা সেই জালিয়ানওয়ালাবাগ বর্তমানে একটি পার্কের আকার ধারণ করে আছে। শহীদদের স্মরণে সেখানে ১৯৬১ সালে যে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে সেখানে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ পুষ্পার্পণ করতে অসেন। জালিয়ানওয়ালাবাগে প্রবেশের পথটি আগের মতো এখনো বেশ অপ্রশস্ত। গুলি চালানোর সময় প্রবেশপথের বিপরীত দিকে মাঠের ওপারে উঁচু দেয়ালটি ডিঙানোর চেষ্টা করেছিল সেদিনকার হতভাগ্য মানুষগুলো। তাদের লক্ষ্য করে ছোড়া গুলির ক্ষতচিহ্ন দেয়ালগুলো এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে। স্মৃতিসৌধের পাশেই বেশ কিছু শহীদের মৃত্যুর আগের সময়কার উক্তি সংবলিত স্মৃতিফলক লাগানো আছে। এসবই প্রমাণ করে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে মুক্তি-সংগ্রামীদের কী অকুতোভয় সাহস ছিল এবং তাঁরা কতটা দৃঢ়চিত্ত ছিলেন। স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করে সেখান থেকে বেরিয়ে আসি আর পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যিনি এই বর্বর ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের’ প্রতিবাদস্বরূপ ব্রিটিশরাজ কর্তৃক তাঁকে প্রদত্ত ‘নাইট’ উপাধি পরিত্যাগ করেছিলেন।

আমরা অমৃতসরের এই জায়গাগুলো পরিদর্শনের পরিকল্পনা এমনভাবে করেছিলাম যাতে দুপুরে স্বর্ণমন্দির দেখতে যেতে পারি। জালিয়ানওয়ালাবাগ থেকে বেরিয়ে গাড়িতে চড়ে তিন মিনিটের রাস্তা পেরিয়ে স্বর্ণমন্দিরের সামনে এসে পৌঁছি। সেখানে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ এবং স্বর্ণমন্দিরের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তারা আমাদের স্বাগত জানান। স্বর্ণমন্দিরে প্রবেশের পূর্বশর্ত হলো- নারী-পুরুষ ভেদে কেশ আবৃত করে রাখতে হবে। মহিলাদের জন্য অসুবিধা নেই মাথায় কাপড় তুলে রাখলেই হয় কিন্তু পুরুষদের মাথা হয় শিখ ধর্মাবলম্বীদের ব্যবহৃত পাগড়ি দ্বারা বা ত্রিভুজাকৃতি গেরুয়া বা সাদা রঙের কাপড় দিয়ে, নিদেনপক্ষে পকেটের রুমাল দিয়ে হলেও আবৃত করে রাখতে হবে। স্বর্ণমন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করার আগেই তাদের অফিসকক্ষে আমাদের বরণ করেন আরও কিছু কর্মকর্তা। আমার সঙ্গে থাকা দুই-তিনজন গাইড আমাদের মন্দিরের ভিতরে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। মন্দিরে প্রবেশ করার আগে একটি পানির ছোট নালার মতো আছে, যেখান দিয়ে পানি গড়িয়ে যাচ্ছে। সেটিতে পা ভিজিয়ে মন্দির অঙ্গনে প্রবেশ করতে হয়। তারপর হাত ধুয়ে ধীরে ধীরে মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করি। গাইডরা আমাকে বললেন মন্দিরে প্রবেশের আগে হাত ও পা ধোয়া হচ্ছে পবিত্রতা এবং পরিচ্ছন্নতার প্রতীক। কথিত আছে- শিখ ধর্মের ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ সিংয়ের সময় মন্দিরটির উপরিভাগ ৪০০ কেজি সোনার পাতে মোড়ানো ছিল। তবে আমাকে আমার সঙ্গে যেসব শিখ কর্তাব্যক্তি ছিলেন তারা বললেন, মন্দিরের উপরিভাগে ১৬০ কেজি স্বর্ণ লাগানো আছে। ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দিরেই শিখদের ধর্মগ্রন্থ গ্রন্থ সাহিব স্থাপন করা হয়। সম্ভবত হরগোবিন্দ সিংয়ের নামেই এই মন্দিরের নামকরণ করা হয় হরবিং সাহিব বা হরমন্দির সাহিব। এই মন্দিরে ঢোকার একটি পথ। মূল মন্দিরের চারদিকের দরজাই খোলা। অবারিত দ্বার সব ধর্মের মানুষের জন্য।

মন্দিরে প্রবেশের সময় আমার সঙ্গে থাকা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন মধ্যাহ্নভোজের সময় মন্দিরের লঙ্গরখানা থেকে পরিবেশিত লঙ্গর (খাবার) খাব কি না? আমি ‘হ্যাঁ’ সূচক জবাব দিলে তারা আমাকে মন্দির পরিদর্শনের পর লঙ্গরখানায় নিয়ে গিয়েছিলেন। মন্দিরের প্রবেশপথে দেখলাম হাজার হাজার মানুষ একটি ১২-১৫ ফুট চওড়া পথ দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করছে, কিন্তু কে কার আগে যাবেন এই নিয়ে কোনো হুড়োহুড়ি নেই। এই রাস্তাটির পাশ দিয়ে তিন ফুটের মতো চওড়া একটি রাস্তা আছে। সেদিক দিয়ে কিছু বয়স্ক মানুষ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ বা বিদেশি মেহমানদের নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের সেই পথ দিয়েই তারা খুব সহজে মন্দিরের ভিতরে নিয়ে যান। সেখানে দেখলাম শিখ ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র গ্রন্থ ‘গুরুগ্রন্থ সাহিব’ অত্যন্ত কারুকার্যময় চাদরের নিচে অধিষ্ঠিত। দুই পাশে দুজন বসে লোমশ প্রকৃতির পাখা নাড়িয়ে যাচ্ছেন। আর একজন বসে গ্রন্থ সাহিব থেকে পাঠ করছেন। পাশে বসে কিছু মানুষ ধর্মীয় সংগীত গেয়ে চলেছেন। ভিতরে একটি স্নিগ্ধ ও গুরুগম্ভীর পরিবেশ। দেয়াল এবং মন্দিরের কারুকার্য অত্যন্ত সুন্দর। দর্শনার্থীরা এক দরজা দিয়ে মন্দিরে ঢুকে অনায়াসে অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারেন। এই মন্দিরটি দূর থেকে দেখতে একটি জলরাশির ওপর ভাসমান ছোট্ট দ্বীপ বলে মনে হয়।

মন্দির পরিদর্শনের পর আমরা লঙ্গরখানার দিকে এগিয়ে গেলাম। লঙ্গরখানা এবং এর ব্যবস্থাপনা এত সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত, যা ভাবলে অবাক লাগে। শত শত স্বেচ্ছাকর্মী সেখানে কাজ করেন। প্রতিদিন ৬০-৭০ হাজার মানুষ ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে এই লঙ্গরখানায় খাবার গ্রহণ করেন। এখানে কেউ প্রশ্নও করে না কে কোন ধর্মের মানুষ। এই মন্দিরের লঙ্গরখানায় সব ধর্মের মানুষের প্রবেশ করার অধিকার আছে। সবার জন্যই আছে পর্যাপ্ত খাবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে এখানে প্রায় প্রতিদিন দুবেলায় প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ খাবার গ্রহণ করে। এখানকার রান্না-বান্না এবং এর আয়োজন সব কিছু হয় স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে। কেউ কোনো পারিশ্রমিক নেয় না। লঙ্গরখানার প্রবেশপথে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে স্বেচ্ছাকর্মীরা আমাদের হাতে এক ধরনের স্টেইনলেস স্টিলের থালা, একটি বাটি ও একটি চামচ ধরিয়ে দিলেন। আমার সঙ্গে থাকা মন্দিরের কর্মকর্তাগণ আমাকে এবং আমার সফরসঙ্গীদের একটি দেয়ালের পাশে মাটিতে বসতে বলেন। আমরা সবাই মাটিতে থালা হাতে বসে পড়লাম। স্বেচ্ছাকর্মীরা প্রথমে চাপাতি (রুটি), ডাল, সবজি, সামান্য ভাত ও থালার পাশের একটি অংশে পায়েশ দিয়ে গেলেন। আরেকটি তিন চাকার সাইকেলের মতো যন্ত্রচালিত যান দিয়ে বাটিতে পানি দিয়ে গেলেন পান করার জন্য। আমরা তৃপ্তি সহকারে খেলাম। খাবারের পরিমাণ নির্ধারিত নয়। যার যতটুকু প্রয়োজন সে ততটুকুই খেতে পারবে। আমরা খাবারের পর্ব শেষ করে থালা-বাটি ও চামচ নিয়ে স্বেচ্ছাকর্মীদের কাছে ফেরত দিলাম। গাইডের নিকট জানতে চেয়েছিলাম এখানে সবাই মাটিতে বসেই খান কি না? তারা বলেছিলেন ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত রাষ্ট্রনায়করা যারা যখন এই মন্দিরের লঙ্গরে এসে লঙ্গর গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তাঁরা সবাই মাটিতে বসেই আহার সেরেছেন। আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, এখানে কোনো ভিআইপি কালচার নেই, সবাই সমান ও সবাই একসঙ্গে মেঝেতে বসেই আহার করেন। আমি অবাক হয়ে চিন্তা করলাম প্রতিদিন প্রায় লাখ খানেক মানুষ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে এখানে খেয়ে যাচ্ছে। কোনো দিন এ খাবারের ব্যবস্থা বন্ধও হয়নি, এ খাবার থেকে কাউকে বঞ্চিতও করা হয় না। জানতে পারলাম এই অমৃতসর শহরে এমনো দরিদ্র পরিবার আছে যারা দিনের দুটি আহারই গ্রহণ করেন এই লঙ্গরখানায়। মাসের পর মাস বছরের পর বছর ধরে। কেউ তাতে বাধাও দেয় না, কোনো প্রশ্নও করে না। এক ভিন্ন অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে মন্দির থেকে ফেরার পথে মহান সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট এই বিশ¡ ব্রহ্মান্ডের বিস্ময়কর বৈচিত্র্যের কথাই শুধু ভাবছিলাম। আরও ভাবছিলাম ধর্ম-বর্ণ নিয়ে কেন এত বাড়াবাড়ি? কেন আমরা যার যার ধর্ম বিশ্বাসে স্থির থেকে অন্যের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও অসাম্প্রদায়িক হই না? শুরু হয় মন্দির থেকে প্রস্থান পর্ব। আসার পথে মন্দিরের অফিস কক্ষে আবারও গেলাম। কর্তাব্যক্তিরা আমার সঙ্গে ছবি তুললেন এবং কিছু বই ও স্বর্ণমন্দিরের একটি ছবি আমাকে উপহার দিলেন। তারা আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন আমি কখনো ঢাকা বিশ¡বিদ্যালয়ের পাশে অবস্থিত গুরুদুয়ারা ভ্রমণ করেছি কি না? আমি সত্য কথাই বললাম, ‘না আমার ভ্রমণ করার সুযোগ কখনো হয়নি’। কেন যেন নিজেকে একটু ছোট মনে হলো। মনে মনে ভাবছিলাম ঢাকার গুরুদুয়ারা দেখিনি অথচ তাদের মূল ধর্মীয় স্থান অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির দেখতে এসেছি! ‘বাড়ির পাশে আরশি নগর ... এক দিনও না দেখিলাম তারে’। মনস্থির করলাম ঢাকায় ফিরে ঢাকা বিশ¡বিদ্যালয়ের পাশে অবস্থিত গুরুদুয়ারাটি দেখতে যাব।

দেশে ফিরে গত ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩ আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে গুরুদুয়ারাটি দেখতে যাই এবং তাদের কাছে স্বর্ণমন্দির দেখে আসার গল্প বলি। তারা শুনে খুবই আপ্লুত হন এবং বাংলাদেশে তাদের অবস্থান ও তাদের বিভিন্ন কর্মকান্ড ও সুখ-দুঃখের কথা আমাকে জ্ঞাত করেন। তারা আমাকে চা পানে আপ্যায়িত করেন আর আমাকে কিছু উপহার সামগ্রী প্রদান করেন। যার মধ্যে একটি হলো ‘কিরপান’, তাদের ভাষায় সাধারণত খুব সম্মানী ব্যক্তিদের এটি (কিরপান) উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। আমি অভিভূত হলাম এবং তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নিজ বাসায় ফেরত আসি।

এবারের দিল্লি ভ্রমণ ছিল বিচার-সংক্রান্ত এক কর্মশালায় অংশগ্রহণের জন্য। বিচার সংশ্লিষ্ট কথা বলেছি, শুনেছি। একই সঙ্গে অমৃতসর ভ্রমণে জেনেছি ইতিহাস ও অনেক অজানা তথ্য। নিজের ভাবনা হয়েছে সমৃদ্ধ। শ্রেণিকক্ষে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অর্জিত শিক্ষাই কেবল শিক্ষা নয়। ভ্রমণ ও এর মধ্য দিয়ে জানতে পারা ইতিহাস, সমাজ ও বিবর্তিত মানব ভাবনা অনেক সত্যের আলো দেখাতে পারে। সেটিই কোনো ভ্রমণের অর্জন। এবারের ভারত ভ্রমণে এটিই উপলব্ধি করেছি।

এবারের ভারত ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্যের অতিরিক্ত অমৃতসর ভ্রমণ করেছি জালিয়ানওয়ালাবাগে শাহাদাতবরণকারী মানুষগুলোর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার জন্য। আর সেই সঙ্গে স্বর্ণমন্দির পরিদর্শনের মধ্য দিয়ে অনুভব করলাম শিখ ধর্মাবলম্বীগণ মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহনশীলতার বাণী বিশে¡ ছড়িয়ে দিতেই তাদের মন্দির সবার জন্য উন্মুক্ত রেখেছেন। এটি মানবতা ও অসাম্প্রদায়িকতার স্বচ্ছ প্রতিফলন। এবারের ভারত ভ্রমণে উপলব্ধি করেছি জীবনের শুভ ভাবনাকে বিকশিত করতে হলে অজানার পানে ছুটতে হবে। আর সেটিই হবে অনেক কিছুু জানার শুভ সংকলন। এবারের ভ্রমণের মাধ্যমে অর্জিত ভাবনাগুলো আমার মনোজগতে সঞ্চিত রইবে। অপেক্ষায় রইলাম পরবর্তী কোনো ভাবোদ্দীপক ভ্রমণের জন্য।

                 লেখক : বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি

সর্বশেষ খবর