শুক্রবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

আন্দালিব রাশদী

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

► পর্ব-১১

পূর্ব প্রকাশের পর

সাধারণত ফ্ল্যামিঙ্গো কথার মধ্যে নাক গলায়, এবার গলায় ডাহুক। বলল, এই ডাল খেলে পেটে অসুখ হবে। ভালো করে দেখো ডালের ওপর কালো কালো অনেক বিচি ভাসছে। এগুলোই ড্যাঞ্জারাস।

 

শেহেরজাদ এগিয়ে ডালের দিকে তাকিয়ে বলে- আরে ওটা তো কালিজিরা, পাঁচফোড়ন।

ডাহুক বলল, তুমি বললেই হলো, আমি কি তেলাপোকাদের হাগু চিনি না। এগুলো জমিয়ে ডালে দিয়েছে যাতে এসব খেয়ে আমাদের পেটে অসুখ হয়।

ফ্ল্যামিঙ্গো বলল, আমি ডালের মধ্যে অনেক মরা পিঁপড়াও দেখতে পেয়েছি। পিঁপড়া খাওয়া যায় কিন্তু তেলাপোকার ওসব খাওয়া হচ্ছে, ওয়াক থু। আমি ডালের বদলে মুরগির ডানা চাই।

শেষ পর্যন্ত মন্টু ভাই ছাড়া আর কেউ সুস্বাদু ডাল খেলো না। কিছু পরিমাণ ভাত আর বাটির চার ভাগের তিন ভাগ ডালই রয়ে গেল।

প্লেট টিফিন ক্যারিয়ার গুটিয়ে ওপরে যাওয়ার সময় শেহেরজাদ বলল, আমাকে দুই ঘণ্টা সময় দিতে হবে। এক ঘণ্টা ফিজিক্স আর এক ঘণ্টা কেমিস্ট্রি পড়ে কালকের ক্লাসের জন্য তৈরি হয়ে নিই। নতুবা ক্লাসে বকা খেতে হবে।

ফ্ল্যামিঙ্গো জিজ্ঞেস করল, ছেলে টিচার না মেয়ে টিচার।

মেয়ে টিচার।

মোটা না চিকন।

মোটা।

তাহলে তাকে কিছু বলার দরকার নেই। তোমাকে তখন মারতে পারে। যাও পড়াশোনা করে তাড়াতাড়ি চলে এসো, আমাকে আজ তিনটি গল্প শোনাতে হবে।

টিয়া একটা কাগজে লিখে দিল, নামার সময় একটা চিরুনি এনো। আমরা সম্ভবত আনিনি। আর যদি টুথপিক থাকে নিয়ে এসো।

ওপরে যাওয়ার পর অবশিষ্ট ভাত আর ডাল দেখে মা বলল, কিছুই তো খায়নি।

শেহেরজাদ বলল, সবই খেয়েছে, আমিও ওদের সঙ্গে খেয়েছি। শুধু ডালটা মন্টু ভাই ছাড়া কারও খাওয়া হয়নি।

ডাল কী দোষ করল?

ডালের কোনো দোষ নেই মা। তুমি যে ডাল বাগার দেওয়ার সময় কালিজিরা আর কী সব দিয়েছো এগুলো তো ডালের ওপর ভাসছিল, এটা দেখে বড় মেয়েটা বলল, এগুলো ড্যাঞ্জারাস জিনিস, তেলাপোকার হাগু। যদিও তার কথা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই তবু ভাবলাম ওজন বাড়ানোর জন্য দোকানদার যদি মসলার সঙ্গে ওসব মিশিয়ে থাকে এ কথা মনে করে আমিও খাইনি। ওকে মা, এখন নো টক। আমি দুই ঘণ্টা পড়াশোনা করব, তারপর নিচে নামব। একটা চিরুনি আর টুথপিকের কৌটা টেবিলের ওপর রেখে দিও। নিয়ে যাব।

মা বলল, টুথপিকের একটা খালি কৌটা থাকতে পারে, কিন্তু গত তিন বছরে কোনো টুথপিক কেনা হয়নি। হঠাৎ মা-র কাঁদতে ইচ্ছে করল। স্বাভাবিক স্বর বদলে কাঁদো কাঁদো নাকি স্বরে বলল, আমার মন্টুটার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। বাড়েল্লার পীর সাহেবের কাছে নিয়ে যেতে পারলে হতো।

আমি বললাম, মন্টু ভাইয়ের মাথা ঠিকই আছে।

কয়দিন আর ঠিক থাকবে? যেসব বিচ্ছু মেয়ে বউয়ের সঙ্গে ফাও নিয়েছে তারাই ছেলেটার মাথা খারাপ করে দেবে। একেকটা বিচ্ছুর কথা কী ছিরি। ছোটটার তো এখনো মুখই ফোটেনি।

শেহেরজাদ বলল, তোমার উচিত একবার নিচে গিয়ে ভাইয়াকে দেখে আসা।

মা ধমক দেয়, উচিত-অনুচিত আমাকে শেখাবি? মন্টুর কি উচিত না আমাকে এসে দেখে যাওয়া?

শেহেরজাদ বলল, কেমন করে আসবে, বাবা না নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে গঞ্জিকাসেবী আর নাটুকে নচ্ছারটার দোতলায় ওঠা নিষেধ। তখন তো তুমিও সায় দিয়েছো। থাকগে, এসব প্যাঁচালের মধ্যে আমি নেই।

ঠিক দশটায় যখন নামতে যাচ্ছে দেখে একটা ফ্লাস্ক হাতে মা দাঁড়িয়ে, দুটো মেলামাইনের কাপও আছে। বলল, ঘুমের আগে আমি মন্টু মঞ্জুকে গরুর দুধ খাওয়াতাম। এটাও ভালো, পাউডার দুধ। চার কাপ হবে, মন্টুকেও এক কাপ খেতে বলিস। লাগলে চিনির কৌটাও নিতে পারিস।

মন্টু ভাই সত্যিই এক কাপ খেলো। ডাহুক ও ফ্ল্যামিঙ্গো দুধে না বলল না। আরও এক কাপ ছিল। মন্টু ভাই বলল, মঞ্জুর টেবিলে রেখে আয়।

মঞ্জু ভাই রুমে কখনো তালা দেয় না ভিতর থেকে দরজার ছিটকিনিও লাগায় না তবে দরজায় ভারী পর্দা আছে। অন্তত এক বছর ধোয়া হয়নি, ময়লা জমে জমে আরও ভারী হয়ে গেছে। মঞ্জু ভাই দরজা খোলা রাখার একটি যুক্তি দিয়ে থাকে ভূমিকম্পের সময় দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরোতে চাইলে দরজা বন্ধ রাখা যাবে না। আমার জীবনে একবারই তিন মিনিটের ব্যবধানে দুবার মৃদু ভূমিকম্প হয়েছে। বাড়ির সবাই টের পেলেও মঞ্জু ভাই এই রুমেই গঞ্জিকা সেবন করে অঘোরে ঘুমাচ্ছিল। খোলা দরজার ব্যবহারের সুফল মঞ্জু ভাই কখনো লাভ করেনি।

সাত.

আমাদের চার তলার ভাড়াটে নইমুদ্দিন খানের বড় মেয়ে ইসমত আরা ফয়জুন্নেসা আপা দুই বছর আগে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন, মানুষটা কি পাগল নাকি?

শেহেরজাদ তখন ক্লাস এইটে, পাগল কথাটা তার পছন্দ হয়নি। তখন জোর দিয়েই বলেছে মোটেও সে রকম কিছু নয়। বাবার কথা নকল করে বলেছে মঞ্জু ভাই একজন বিশিষ্ট গঞ্জিকাসেবী। পৃথিবীর অনেক দেশে এখন গঞ্জিকা বৈধ। মঞ্জু ভাই বলেছে ইনশা আল্লাহ বাংলাদেশেও বৈধ হয়ে যাবে। তখন গঞ্জিকার স্টিগমাটা কাটবে।

ইসমত আরা বললেন, আসলে না করে, না দেখে, না খেয়ে আমরা অনেক কিছুর সমালোচনা করে থাকি। একবারের জন্য হলেও গাঁজা খেয়ে দেখতে হবে জিনিসটা আসলে কেমন। মাঝরাতে মাঝে মাঝে গন্ধটা পাই, আমার তো ভালোই লাগে। কিন্তু বাবা বলে এটা বাড়িওয়ালার হারামজাদা ছেলেটার কাজ। এটা বাড়াবাড়ি, আমি বাবাকে বলেছি, এটা পারসোনাল চয়েস। তুমি শুনলে খুব অবাক হবে বাবার বস হীরালাল বাবু প্রতিদিন সকালে মেপে মেপে নিজের ১৫০ এমএল মূত্র পান করে থাকেন। ইন্ডিয়ান প্রাইম মিনিস্টার মোরারজি দেশাইও পান করতেন ২৫০ এমএল। নিজেরটা কম পড়লে ওয়াইফের কাছ থেকে ৫০-৬০ এমএল ধার নিতেন।

শেহেরজাদ মঞ্জু ভাইয়ের পক্ষেই বলে, গন্ধটা আমার কাছে মনে হয় পোড়া চামড়ার কিন্তু আমাদের কেয়ারটেকার আবুল বাশার মিরধা বলে একেবারে অ্যারাবিয়ান দুম্বার খাঁটি মূত্রের মতো। তা হতে পারে। আমি তো আর সৌদি আরব যাইনি, দুম্বাও দেখিনি।

আমাদের তিন তলার একটা ফ্ল্যাট হলেও তাতে থাকে দুটো পরিবার। দুই বন্ধু ও তাদের দুই স্ত্রী। কারওই সন্তান হয়নি। আমাদের ব্যাপারে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। চারজনই চাকরি করে সম্ভবত একই অফিসে। সাড়ে ৯টার দিকে বেরোয়, একসঙ্গে রাত ৯টার দিকে ফেরে। মাসের প্রথম দিন বাবার হাতে ভাড়া তুলে দেয়, বাবা তাতেই খুশি।

চার তলার নইমুদ্দিন খানের দ্বিতীয় মেয়ে ইফফাত আরা কামরুন্নেসা বড় বোনকে ডিঙিয়ে তার কলেজের একজন বড় ভাই, মাস্তানও হতে পারে সালামত নাম, তার সঙ্গে সংসার শুরু করেছে, কেউ কেউ বলছে বিয়ে না করেই। তাতে অবশ্য আমাদের কিছু এসে যায় না।

শেহেরজাদ বাচ্চা দুটোকো নিয়ে পাশের রুমে ঘুমোতে এলো। ফ্ল্যামিঙ্গো বলল, শেহেরজাদকে ছোট ঘোড়া হতে হবে, সে তার পিঠে চেপে বসবে। কিছু ঘোড়া চালিয়ে তারপর ঘুমোবে।

ডাহুক বলল, মানুষকে যে ঘোড়া বানায়, মরে যাওয়ার পর আল্লাহ তাকে ছাগল বানিয়ে দেয়। এটাই আল্লাহর বিচার। কাজেই ফ্ল্যামিঙ্গো যে আর আশি বছর পর ছাগলে পরিণত হবে এ সম্পর্কে সে শতভাগ নিশ্চিত।

ডাহুক তাকে বলল, অ্যাটিচিউড পরীক্ষায় তুমি ছাড়া এ বাড়ির সবাই ফেল করেছে। আমি নতুন লোকটাকে বলতে শুনেছি, তিন দিনের রেজাল্ট দুই দিনেই পেয়ে গেলে এক দিন লাভ।

দুজনই একটি করে পা শেহেরজাদের ওপর দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে একটি গল্পও তাদের শোনাতে হয়নি। তার মনে হচ্ছিল টিয়া পাখি আসবে, সেজন্য তখনো দরজার ছিটকিনি লাগায়নি।

টিয়া সত্যিই এলো, আস্তে করে মেয়েদের পা টেনে শেহেরজাদের শরীর থেকে নামাল। একটি প্যাকেট এবং দুটি পাতা তার হাতে।

টিয়া প্যাকেট দিয়ে তিন আঙুল দেখিয়ে বলল এটা থ্রি পিস। স্যুটকেসেই ছিল এখন তার এসব পরতে ইচ্ছে করে না। শেহেরজাদ এটা নিজের জন্য বানালে খুশি হবে।

শেহেরজাদও যে এটা নিয়ে খুশি হয়েছে বোঝানোর জন্য তাকে আলিঙ্গন করল এবং বলল টেইলারের খরচ কে দেবে?

টিয়া বলল, সে দেবে। তার টাকা আছে।

দুটি হাতে লেখা পাতা শেহেরজাদকে দিয়ে টিয়া রুমে ফিরে যায়।

বাথরুমের কাজ সেরে এসে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে শেহেরজাদ পড়তে বসে :

গতকাল মধ্যরাতের একটা ঘটনা তোমাকে জানাতেই হবে। আমরা ঘুমিয়েই পড়েছিলাম।  রাত দেড়টার দিকে দরজায় বারবার টোকা পড়লে আমি মন্টু সাহেবকে ঘুম থেকে তুলি। দরজা তিনিই খোলেন। দরজা খুলতেই অদ্ভুত ধরনের একটা লোক ঘরে ঢোকে।                 [চলবে]

সর্বশেষ খবর