ইরানের এক খ্যাতিমান কবির নাম মোহাম্মদ তকি বাহার। তিনি শুধু একজন কবিই ছিলেন না; ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও ইতিহাসবিদ। বিংশ শতাব্দীর ইরানে তিনি ‘মালেক-ওশ-শোয়ারা’ অর্থাৎ কবিদের বাদশাহ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। তকি বাহার ১৮৮৬ সালে খোরাসান প্রদেশের রাজধানী মাশাদে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোহাম্মদ কাজেম সাবোরিও একজন বিখ্যাত কবি ছিলেন। তকি বাহার আট বছর বয়সে তাঁর প্রথম কবিতা রচনা করেন। চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি আরবি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে তিনি ফারসি ভাষা আয়ত্ত করেন। সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করার উদ্দেশ্যে ১৯০৬ সাল থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত ইরানের সাংবিধানিক বিপ্লবের সময়ে তিনি এই আন্দোলনে যোগ দেন। তিনি খোরাসান নামে এক সংবাদপত্র সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। সাংবিধানিক আন্দোলনে বিজয় লাভের পর তিনি কয়েকটি নির্বাচনে ইরানের পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন।
রেজা শাহ পাহলবীর শাসনামলে ১৯৩৪ সালে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মোহাম্মদ তকি বাহার সাহিত্য অনুষদের পারসিয়ান লিটারেচার বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৫ সালে তিনি সংক্ষিপ্ত মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী আহমদ কাভাম সরকারের মন্ত্রিসভায় সংস্কৃতি ও শিক্ষাবিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। জীবনের শেষ বছরগুলোতে তিনি যক্ষ্মা ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডের এক স্যানাটোরিয়ামে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। দেশে ফেরার পর তাঁর স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটে। ১৯৫১ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
১
হে পুত্র, তুমি তোমার মায়ের মনে আঘাত দিয়ো না,
তাঁর চেয়ে আর কেউ তোমাকে বেশি ভালোবাসে না,
তুমি কি জানো, তোমার জন্যে কি আছে তার হৃদয়ে?
তোমার জন্যে তার ভালোবাসা কতদূর বিস্তৃত?
মা তার বুকের মাঝে যে ভালোবাসা ধারণ করেন,
কোনো অশুভ ছায়া তা কেড়ে নিতে পারে না।
সকল ভালোবাসার ভিত্তি মায়ের ভালোবাসা,
শোক বা সুখের সময়েও তা হ্রাস পায় না।
তুমি অন্ধ, খোঁড়া, অসুস্থ বা দারিদ্র্যে থাকলে
অথবা তুমি বৃদ্ধ, ছিন্ন বস্ত্রধারী ভিক্ষুক হলেও
তোমার জন্যে মায়ের ভালোবাসার হেরফের হয় না,
এ ভালোবাসা ঈশ্বরের নয়, এটি মায়ের ভালোবাসা।
পৃথিবীতে যদি তোমার মায়ের হৃদয় না থাকতো,
দৃষ্টির আড়ালে রয়ে যেত তোমার সকল মানবতা।
তার মুখ এক পরিপূর্ণ স্বর্গীয় উদ্যান,
তার আশীর্বাদধন্য স্তন থেকে প্রবাহিত হয়
বেহেশতের কাওসার ঝরনার ধারা।
ওঠো, তার আশীর্বাদের পায়ে নত হও।
ধিক তোমাকে, যদি তোমার মাকে কাঁদাও;
তাঁর হৃদয় জ্ঞান ও বিচক্ষণতার চাবিকাঠি,
কারণ তার হৃদয় সকল সুখের আধার।
২
কাল গভীর রাতে রাস্তায় এক বৃদ্ধের সাথে সাক্ষাৎ হলো,
দুর্বলতার কারণে তিনি মাটির দিকে ঝুঁকে হাঁটছিলেন,
তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘আপনি কি পথে কিছু হারিয়েছেন’?
বৃদ্ধ উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমার যৌবন, আমার যৌবন, আমার যৌবন!’
৩
কেউ আর এখন আমার প্রেমের কথা জানে না,
কারণ আমার সব কথা প্রেমের মধুতে মধুময়,
চোখের প্রতি পাতায় আমি ধারণ করি সহস্র পর্বতের শক্তি
প্রেমের বাদশাহর পথে আমি কাটি তরবারির দাগ।
৪
আমার হৃদয়ে সেই চাঁদের দুঃখ ছাড়া আর কিছু নেই,
আমার পরিতৃপ্তি, কারণ আমার আর কোনো দুঃখ নেই।
আমার হৃদয়ের গভীর ক্ষত সবসময় তাজা থাকে,
আমার কাছে এর চেয়ে নতুন আর কিছু নেই।
৫
আহা! জীবনের ভোরে কি এক প্রেম ছিল,
শত্রুর শরাঘাতে মৃত্যু ঘটে এক আহত হরিণের,
আশার ঔজ্জ্বল্য থেকে সেখানে একটি রশ্মি ছিল,
সেই ঔজ্জ্বল্য ম্লান হয়ে অবশেষে হারিয়ে গেল
নতুন কোনো কবি অথবা তার কবিতা সৃষ্টি হয়নি,
নতুন কবির অন্তর্ধানে মৃত্যু হলো নতুন কবিতার।
৬
প্রিয়তমা যদি তপ্ত ছুরি দিয়ে শত্রুর রক্ত ঝরায়,
তবুও আমি প্রতিশোধ নেব না, কারণ সত্য তাদের পক্ষে,
আমি যদি শত্রুর হাত থেকে ১০০টি আঘাতও পাই
প্রিয়তমার প্রতি নিবেদনে আমার একটি ভুলই যথেষ্ট।